চলার শেষ প্রান্তে পর্ব-১৪

0
16

#চলার_শেষ_প্রান্তে(১৪)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সাগরিকা চৌধুরী থমকে গেলেন। ছেলের মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে বললেন—
—”তুই জানিস? কবে জানলি?”

তাহসান একটু নিচু স্বরে উত্তর দিল
–” বাসা নেওয়ার কিছুদিন পর এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে শুনেছিলাম কিছুটা। পরে নিজে যাচাই করে জেনেছি। কিন্তু মা, ওর সততা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। ও কখনো বে-পর্দা চলাফেরা করে না, এমন মেয়ে সহজে দেখা যায় না।

সাগরিকার মুখে মৃদু এক প্রশান্তির ছায়া ফুটে উঠল।
–” তাহলে তুই কি এখনো ওকে বিয়ে করতে চাইস?

তাহসান একটু হাসল।
–” আমি চাই মা। কিন্তু জোর করে নয়। ও যদি রাজি না হয়, আমি ওর সিদ্ধান্ত মেনে নেব।

সাগরিকা ধীরে মাথা নাড়লেন।
–” তাহলে আমি আবার একদিন ওদের বাসায় যাবো। এবার তোকে নিয়ে যাবো। ওর সাথে শান্তভাবে কথা বলিস। তবে মনে রাখিস কারো ওপর চাপ না দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।

তাহসান বলল,
–“না মা, আমি শুধু চাই ও জানুক, ওর অতীত আমার কাছে কোনো বাধা নয়। আমি চাই সে নিজের ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিক।

সাগরিকা মৃদু হাসলেন।
–” আল্লাহ তোর জন্য সহজ করে দিক বাবা। এমন বুঝদার ছেলে পেয়ে আমি গর্বিত।
.
.
বিকেলের নরম আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে ঘরে এসে পড়েছে। সাহানা বেগম চায়ের ট্রেতে দু’কাপ চা আর কিছু বিস্কুট সাজাচ্ছিলেন। এমন সময় দরজায় কড়া নড়ল।

ফারিয়ার ছোট ভাই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
দরজার ওপাশে সাগরিকা চৌধুরী আর তাহসান দাঁড়িয়ে।

সাহানা বেগম একটু অবাক হলেও খুশি হলেন।
–” আরে ভাবি! আপনি! তাহসানকে নিয়ে এসে খুব ভালো করেছেন।

সাগরিকা হেসে বললেন,
–” হ্যাঁ ভাবি এবার মা ছেলে মিলে চলে এসেছি।

তাহসান মাথা নিচু করে সালাম দিল।
সাহানা বেগম স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন,
–” আসো বাবা, বসো।

তারা ড্রইংরুমে ঢুকলে ফারিয়া তখনো পড়ার ঘরে ছিল। সাহানা বেগম তাদের চা বিস্কুট আর বানিয়ে রাখা শুকনো পিঠা দিলেন। সাগরিকা চৌধুরী আর অপেক্ষা না করে ফারিয়াকে ডাকতে বললেন।

সাহানা বেগম তাকে ডাক দিলেন।
–” ফারিয়া মা, একটু আসবি?

মুহূর্তখানেক পর ফারিয়া এসে যখন তাহসানকে দেখে, তার মুখে একরাশ বিস্ময় খেলে যায়!

ফারিয়া এসে ড্রইংরুমে দাঁড়াতেই তাহসানের চোখ পড়ল তার মুখে। ফারিয়ার মুখটা একটু কুণ্ঠিত, কিন্তু ভেতরে সে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করছিল।

সাগরিকা চৌধুরী ইশারায় তাহসানকে উৎসাহ দিলেন।
তাহসান নরম গলায় বলল,
–” আপনি একটু কথা বলতে পারেন আমার সাথে?

ফারিয়া সাহানা বেগমের মুখের দিকে তাকাল। তিনি মাথা নাড়লেন, যেন বলছেন,যা, কথা বলে দেখ।

তাহসান আর ফারিয়া বারান্দার একপাশে এসে দাঁড়াল। চারদিকে নীরবতা। শুধু পাখিরা মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে।

তাহসান হালকা গলায় বলল,
–” আপনার কথা মা আমাকে বলেছে। আপনার সৎ সাহস আর স্পষ্টভাষা আমার মনে দাগ কেটেছে, ফারিয়া।

ফারিয়া নিচু চোখে বলল,
—” আমি শুধু সত্যটা জানিয়েছি। আমি চাই না কাউকে কিছু না জেনে বন্ধনে জড়িয়ে ফেলি। আমার একটা অতীত আছে, যেটা হয়তো কেউ সহজে মেনে নিতে পারে না। আর আমি এখনো পড়াশোনার মাঝখানে আছি।

এই প্রথমবার তাহসান ফারিয়াকে কাছ থেকে স্পষ্টভাবে দেখতে পেল। এতো দিন ঝাপসা দেখেছে। তাই এক নজর তাকিয়ে থেকে বলল,
–” আমি আপনার অতীত জানি, কিন্তু সেটা আমাকে থামাতে পারেনি। আমি চাই আপনি নিজের ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিন, কোনো চাপ নয়। আমি শুধু এটুকু জানাতে চেয়েছি, আপনার অতীত আমার ভবিষ্যৎ বাছাইয়ের পথে কোনো বাধা না।

ফারিয়া একটু চমকে তাকাল তাহসানের দিকে। চোখে মৃদু পানি চিকচিক করছে।
সে আস্তে বলল,
–” আপনি ভেবে বলছেন তো?

তাহসান হাসল।
–” আমরা সবাই ভুল করি, ফারিয়া। কিন্তু ভুল থেকে ফিরে আসাটাই বড়। আর আপনি যে সাহসিকতার সঙ্গে সেটা স্বীকার করেছেন, সেটাই আপনাকে আমার চোখে আরও সম্মানিত করেছে।

একটু থেমে সে আবার বলল,
–” আমি অপেক্ষা করব। আপনি সময় নিয়ে ভেবে নিবেন।

ফারিয়া কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে হালকা একবার মাথা নাড়ল।

তাহসান আর তার মা চলে গেলে ফারিয়া ধীরে ধীরে নিজের ঘরে ঢুকল। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। সন্ধ্যার আবছা আলো ঘরে ঢুকছে। এক অজানা ভাবনার জাল তাকে ঘিরে ধরেছে।

মিনিটখানেক পর সাহানা বেগম এসে পাশে দাঁড়ালেন। মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।
–” কি ভাবছিস মা?

ফারিয়া একটুখানি হাসল।
–” নিজেকে নিয়ে ভাবছি, আম্মু। আমি কি সত্যিই নতুন করে শুরু করতে পারবো?

সাহানা বেগম ধীরে বললেন,
–” আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব হয়, মা। তুই নিজে জানিস, তোর কোনো দোষ ছিল না। একটা ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছিলি। কিন্তু তুই সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছিস, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছিস।

ফারিয়া বলল,
–” উনি আজ যা বললেন, তাতে বুঝলাম, তিনি সত্যিই বোঝেন। কিন্তু তবু ভয় হয়, আম্মু। যদি ভবিষ্যতে কিছু মনে করিয়ে দেয়? যদি আমার অতীত একদিন আমাকে তাড়া করে?

সাহানা বেগম মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
–” যতদূর মনে হচ্ছে তাহসান ছেলে খারাপ না। ওর চোখে তোকে দেখেছি, সৎ মনোভাব দেখেছি। সব সম্পর্কেই ভরসা আর মাফের জায়গা থাকতে হয়। তুই দোয়া কর, নামাজ পড়, আল্লাহর কাছে বল, তারপর সিদ্ধান্ত নিস। আমরা তোর পাশে আছি সবসময়।

ফারিয়ার চোখে পানি চলে এল। সে মায়ের কোলে মাথা রাখল।
–” আমি একটু সময় নেব, আম্মু। মনকে বোঝাতে হবে, সাহস জোগাতে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।

সাহানা বেগম আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ঘর জুড়ে তখন নীরব এক প্রশান্তি।
.
.

ফারিয়া আবার তার নিয়মিত ছন্দে ফিরে আসে। সামনে তার ফাইনাল পরীক্ষা, তাই মনোযোগটা এখন পুরোপুরি পড়াশোনায়। ক্লাস শেষে লাইব্রেরিতে সময় কাটে বেশি। সহপাঠীদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি, নোট শেয়ারিং সবকিছুই যেন এক নতুন উদ্যমে করে সে।

প্রতিদিন ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করে, এরপর পড়ার টেবিলে বসে যায়। সারাদিনের ব্যস্ততায়ও যেন কোনো ক্লান্তি নেই তার মধ্যে। যেন নিজের লক্ষ্যটাকেই শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছে সে।

ক্যাম্পাসে বান্ধবীরা কেউ জানে না, তার ভেতরে কত কিছু লুকানো আছে। ক্লাসের ফাঁকে ছোট ছোট হাসি, ক্যানটিনে চা খাওয়া, লাইব্রেরির নিরব কোণে একাগ্র পড়াশোনা সবই যেন জীবনের এক নীরব সংগ্রামের চিহ্ন হয়ে থাকে।

সাহানা বেগমও বুঝতে পারেন, তার মেয়েটা এখন অনেক পরিণত। তিনি শুধু দোয়া করেন, যেন আল্লাহ তার মেয়ের সব মেহনত কবুল করেন এবং সে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।

পরীক্ষা যতই ঘনিয়ে আসে, ফারিয়ার ব্যস্ততা ততই বাড়ে। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই তার দিন শুরু হয়। নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, তারপর নাশতা করে পড়ার টেবিলে বসা এই ছিল তার রুটিন। সে জানে, জীবনের একটা অধ্যায় শেষ করতে হলে পুরোদমে চেষ্টা করতেই হবে।

ক্যাম্পাসেও সে ছিল ভীষণ ব্যস্ত। ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, লাইব্রেরিতে নোট নেয়া সব মিলিয়ে দিনগুলো যেন পাখার মত উড়ে যাচ্ছিল। সহপাঠীরা ফারিয়ার পড়াশোনার প্রতি নিষ্ঠা দেখে প্রেরণা পেত। কেউ কেউ বলত,
–” তুই একদিন অনেক বড় কিছু করবি, ফারিয়া।

ফারিয়া শুধু মৃদু হেসে বলত,
–” ইনশা আল্লাহ। চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এইদিকে তাহসান, সে দূর থেকেই ফারিয়াকে লক্ষ্য রাখত। সরাসরি কিছু বলত না, কেবল মাঝে মাঝে মায়ের কাছ থেকে ফারিয়ার খোঁজ নিত। সাগরিকা যখন বলতেন,
–” মেয়েটা খুব পড়াশোনায় মনোযোগী, বুদ্ধিমতী মেয়ে রে।
তাহসান তখন চুপচাপ থাকত, কিন্তু মনে মনে দোয়া করত,
–” আল্লাহ ওকে সফলতা দাও।

ফারিয়া জানত না, কেউ একান্তভাবে তার জন্য অপেক্ষা করে, তার মেহনতের জন্য দোয়া করে। সে শুধু জানত, আল্লাহর উপর ভরসা করে এগিয়ে যেতে হয়। আর সেই পথেই সে চলছিল নিরবে, আত্মবিশ্বাসে।

এদিকে সাগরিকা চৌধুরীর যেন ধৈর্যই ধরা পড়ে না। কবে যে ছেলেটা বিয়ে করবে, আর কবে তিনি বউ এনে নিজের সংসারে এক নতুন সম্পর্কের সূচনা করবেন এই ভাবনাতেই মন ভরে থাকে তার।

ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার। নিজের মতো করে সাজানো সংসারে এক শান্তশিষ্ট, ভদ্র, শিক্ষিতা বউকে বরণ করে নিয়ে, ধীরে ধীরে একটা গভীর মায়ার বন্ধন তৈরি করার ইচ্ছে লুকিয়ে রাখেন মনে।
তার আশা নতুন বউটা যেন তার মনের মতো হয়, যার সাথে তিনি শুধু শাশুড়ি-বউ না, বরং মা-মেয়ের মতো একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন।

আবার কখনো কখনো রাতে বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে দোয়াও করেন,
–” হে আল্লাহ, আমার ছেলের জন্য একটা ভালো মেয়ে দান করো, যাকে আমি মেয়ের মতো ভালোবাসতে পারবো।

তাছাড়া সাগরিকা চৌধুরী সাহানা বেগমের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। দুই পরিবারের মাঝে যেন সৌহার্দ্য বজায় থাকে, সে দিকটায় তিনি সবসময় সচেতন।

মাঝে মাঝে ফোন করে ফারিয়ার খোঁজ-খবরও নেন তিনি।
–” পড়াশোনার কী খবর মা? শরীর ঠিক আছে তো?
তার কণ্ঠে যেন মায়ার ছোঁয়া লেগে থাকে।

ফারিয়াও ভদ্রভাবে উত্তর দেয়, সম্মান দেখাতে ভুল করে না কখনো।
তাদের ছোটখাটো এসব কথাবার্তায় যেন এক নীরব বন্ধনের আভাস জেগে ওঠে যা হয়তো একদিন একটি দৃঢ় সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে দেবে….

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

(রি-চেক করা হয়নি।)