#পর্ব:এক
#সুপ্ত_প্রেমের_অনুরাগে🕊️
#লেখনীতে: তামান্না ইসলাম কথা
কবুল বলার ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে জানতে পারলাম আমার স্বামীর আমি প্রথম স্ত্রী না। উনি আগেও বিয়ে করেছিলেন। তার শুধু প্রথম স্ত্রী না বরং আমার স্বামীর সাত মাসের দুজন যমজ সন্তান রয়েছে। কথাটা শোনার পর কিছুটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আমার সব কিছু ঘুরতে শুরু করেছে। আশেপাশের সবাই এবং কাজীর বলা কোন কথা আমার কর্ণপাত হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমি কানে শুনতে পাচ্ছি না। চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে।
” বলো মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
কাজীর কথা শুনে একবার টলমল চোখে আশেপাশে আমার মা’কে খোঁজার চেষ্টা করলাম। দেখলাম আমার মা দরজার সামনে একটা সবুজ রঙের সুতির কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুখ চেপে কান্না করছে। অসহায়ের মতো মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজকে আমার বিয়ে অথচ আমার মায়ের গড়নে একটা পুরনো সুতির শাড়ি। চোখের ভাষায় মাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম আমি এই বিয়ে করতে পারব না মা। কিন্তু আমার অসহায় দৃষ্টি এবং মায়ের অসহায়ত্ব যেন আমাকে বারবার বলে দিচ্ছে, “আমার কিছু করার নেই।”
নিজের অসহায়ত্বের উপর নিজের করুণা হচ্ছে। এ কেমন ভাগ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছিলাম যার জন্য এমন এক পরিস্থিতিতে পড়তে হলো?
” মা তরু তাড়াতাড়ি এভাবে কান্না করতে নেয়। মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে একদিন সবাইকে নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যের বাড়িতে যেতে হয়। সবাই অপেক্ষা করছে মা, তুই এবার কবুল বলে দে।”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার মা’কে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে রুমের ভিতরে চাচি প্রবেশ করে আমার পাশে বসতে বসতে কথাটা বললো আমার চাচি আমেনা বেগম।
চাচির কথা এবং কাজে আমার মনটা ভিতর থেকে বিষিয়ে উঠলো। আজ সব কিছু চাচা চাচির জন্য হচ্ছে। বাবার কথা আজ বড্ড মনে পড়ছে। আজ বাবা বেঁচে থাকলে আমাকে এই বিয়ে করতে হতো না। আর না তো আমার চাচা চাচি আমাদের সাথে এমন করতে পারতো।
“চুপচাপ কবুল বলে দে তরু নয়তো এর ফল তোর মা’কে ভোগ করতে হবে। তাড়াতাড়ি করে বলে দে মা। রাত গড়িয়ে যাচ্ছে। আবার তো তোকে নিয়ে সে বাড়িতে যেতে হবে।”
প্রথম কথা গুলো কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেও পরের কথা গুলো লোক দেখানোর জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কথাটা বললো। চাচির কথা শুনে ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকালাম। একটা মানুষ কতটা জঘন্য হলে এভাবে হুমকি দেয়? আমি জানি আমি যদি এখন বিয়ে না করি তাহলে এর ফলস্বরূপ আমার মায়ের উপর অমানবিক অত্যাচার শুরু হবে। চাচির কথা শুনে শেষ বারের মতো দরজার সামনে তাকিয়ে দেখি সেখানে মা নেই। আবারো চাচি, কাজীসহ সবাই তাড়া দিতে শুরু করলো কবুল বলার জন্য। ঝাপসা দু’চোখ নিয়ে কোন রকম কবুল বলে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম। সারাদিনের না খাওয়া আর ধকলে শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এরপর কি হলো বা আমার মায়ের সাথে কি হলো আমার আর কিছুই জানা নেই।
🍁🍁🍁🍁🍁🍁🍁
ঠান্ডা হিম ধরা শীতল বাতাস এবং চাঁদের এক টুকরো আলো থাইগ্ৰাস গড়িয়ে রুমের ভিতরে এসে হাত ছানি দিচ্ছে। আকাশে মেঘেরা যেন দৌড়ে ছুটে চলেছে কোন এক অজানা গন্তব্যে। মেঘের ছুটাছুটির কারণে কখনো সখনো আকাশের পূর্ণাঙ্গ চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে আবার মেঘের দল গুলো হারিয়ে যেতেই সেকেন্ড কাটা পাড় হতে না হতেই চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আচ্ছা এখন রাত কয়টা বাজে? মানুষ কি ঘুমানয় না? যদি ঘুম আসে তাহলে এতো রাতে এই গাড়ি গুলো কোন গন্তব্যে ছুটে চলে?
হঠাৎ করে নিজের সমস্ত মুখের উপর কারো গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়তেই হাঁসফাঁস লাগতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার ঠিক মুখের উপর ঝুঁকে আছে। যার জন্য এভাবে নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে। বিরক্ত এবং ভয় নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই সব কিছু কেমন জানি অন্ধকার লাগছে। ঘরের কোথায় তেমন আলোর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। চোখ মেলতেই যেন নিঃশ্বাস আরো বেশি করে আছড়ে পড়তে শুরু করলো। এমন অন্ধকার ঘরে ভয়ে উঠে বসতে গিয়েও উঠতে পারলাম না। কিছুর সাথে কপালে আঘাত লেগে আবারো আগের মতো পড়ে রইলাম।
“এতো ছটফট করছো কেন মেয়ে? একটু চুপ করে থাকতে পারো না?”
হঠাৎ করে পুরুষালী কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম। সে-ই সাথে ভয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরলাম। পরক্ষনেই মনে হলো সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি কয়েক ঘণ্টা আগে আমি যাকে কবুল বলে স্বীকার করেছি সে ব্যক্তি। এমন এক ব্যক্তির সাথে নিজের সারাজীবন বেঁধে নিলাম যাকে আমি কখনো মানতে পারব না। রাগে দুঃখে ইচ্ছে করছে চিৎকার করি। কিন্তু চিৎকার না করা সম্ভব না। চিৎকার না করতে পারলেও নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে ঠিক পারলাম।
“এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার? এভাবে কান্না করছো কেন?”
লোকটা রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে ধমক এবং বিরক্তের সাথে আমাকে কথাটা বললো। লোকটার ধমক খেয়ে ধরফর করে উঠে বসে সামনে তাকাতেই হেঁচকি উঠে গেলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি পড়নে শুধু একটা ট্রাউজার। চুল থেকে হালকা টুপ টুপ করে পানি পড়ছে যে লোকটার নাকে গিয়ে ঠেকছে। লুমহীন ফর্সা বুক। লোকটা দেখতেও সুন্দর যে কারো পছন্দ হয়ে যাবে। কোন পুরুষকে প্রথম বারের মতো এমন অবস্থায় দেখে লজ্জায় পড়ে গেলাম।
“এভাবে হাঁ করে তাকিয়ে না থেকে পানি খাও। তোমার নিজের বর অন্য কারো বর না যে এভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে গিলে খাবে।”
পানির গ্লাস আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে কথা গুলো বললো লোকটা। লোকটার কথা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম। কি মুখ কাটা মানুষ ভাবা যায়?
” আমার ড্রেস? আমার ড্রেস এইটা কেন? কে,,,”
“এতো কথা বলো কেন? চুপচাপ পানিটা শেষ করতে পারছো না?”
আমার কথা শেষ করার আগেই আবারো ধমক দিয়ে কথা গুলো বললো। এবারের ধমকে চোখ দুটো আবার ছলছল করে উঠলো।
মাত্র এক চুমুক পানি মুখে দিয়েছিলাম। পানি মুখে থাকা অবস্থায় নিজের তাকাতেই বিয়ের পোশাক পরিবর্তে অন্য পোশাক দেখে প্রশ্ন করতেই ধমক দিয়ে উঠলেন।
“এবার বলুন আমার পোশাক পরিবর্তন করেছে কে? আর আপনি এখানে কি করছেন?”
পানিটা শেষ করেই প্রশ্ন করলাম। কিন্তু আমার এই প্রশ্ন করাটা যেনো নিজের বোকামির বড়ো পরিচয় দিলো। সে-ই সাথে লোকটার চোখে মুখে বিরক্তের আভা কাটিয়ে শয়তানি হাসি ফুটে উঠলো।
“এই রুমে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছো? নাকি এখানে তুমি আমি ব্যতীত তৃতীয় কোন মানুষ আছে যে তোমার পোশাক পরিবর্তন করে দিবে? আর রইলো বাকি তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের কথা! সেটা তো।”
লোকটার কথা শুনে চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল। তার মানে এই অসভ্য লোকটা আমার পোশাক পরিবর্তন করেছে?
“হ্যাঁ উত্তর দিন। আপনি এই রুমে কি করছেন? আর আপনি আমার পোশাক পরিবর্তন করেছেন মানে কি? একটা মেয়ের অনুমতি আপনি এই কাজ করেছেন?”
কিছুটা রেগে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করলাম। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং ধীরে পায়ে একদম আমার কাছ ঘেঁষে কিছুটা ঝুঁকে পরলো আমার দিকে।
“এইটা আমার রুম আর এখানে আমার আধিপত্য চলে মিসেস তরু। আর বাকি রইলো ড্রেস চেঞ্জ করার কথা! ওয়েল আই এম ইউর হাসবেন্ড। তোমার পোশাক পরিবর্তন করার জন্য আমার কোন অনুমতির প্রয়োজন হবে না। এই আদভিন চৌধুরী একাই যথেষ্ট তোমার জন্য। এন্ড ইউ নো পিচ্চি! আজ আমাদের বাসর রাত। এখনো বাসর করা বাকি।”
কথাটা শেষ করেই আদভিন তার ডান হাত দিয়ে আমার কানের পাশে থাকা চুল গুলো খুব আলগোছে গুঁজে দিল। আদভিনের ছোঁয়াতে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। এই গরমের মাঝেও শীত অনুভব হতে লাগলো। আদভিন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে চাইলেই তার হাতের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে বিছানার অপর দিকে চলে গেলাম।
আদভিন কিছু না বলে শুধু এক নজর আমার দিকে তাকিয়ে বিছানায় থাকা লাল গোলাপের পাপড়ি গুলো ঝেড়ে ফেলে দিলো। তার দৃষ্টিতে বিরক্ত মিশে আছে। সে-ই সাথে কিছু অজানা রাগ।
🍁🍁🍁🍁🍁
“বউ রাতে চুমু খাওয়া হয়নি।”
#চলবে