সুপ্ত প্রেমের অনুরাগে পর্ব-০৪

0
1

#সুপ্ত_প্রেমের_অনুরাগে🕊️
#পর্ব:চার
#তামান্না_ইসলাম_কথা

সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। আকাশে পাখিরা ডানা ঝাপটে উড়ে চলেছে নিজের বাসভবনে। সে-ই সাথে মেঘেরাও ছুটাছুটি করে চলেছে। সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে বিশাল আকাশ জুড়ে গোধূলি আলোয় রক্তিম করে রেখেছে। আকাশ যেন এক কৃষ্ণচূড়ার মেলা বসেছে। ব্যস্ত নগরীর মানুষ ছুটে চলেছে নিজ গৃহে। সে-ই সাথে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলেছে গাড়ি গুলো। গাড়ির সাথে সাথে যেন শহরের দালান গুলো ছুটে চলেছে।
বেশ অনেক সময় ধরে গাড়ি জ্যামে আটকে আছে। আমাদের আগে বাকি সবাই চলে গিয়েছে আমাদের রেখেই। এতে অবশ্য আমাদের কারো আপত্তি খুব একটা ছিল না। গাড়ি জ্যামে আটকে পড়ায় যতটা না বিরক্ত আদভিন হচ্ছে তার থাকেও বেশি রাগ হচ্ছে আমার। রাগ হওয়ার একটাই কারণ, যত দেরি হবে ততই মায়ের সাথে দেখা করতে দেরি হবে।‌ অপরদিকে আদভিন একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছে।‌ যেটা আমাকে লজ্জা এবং অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে প্রতিটি মেয়ের এই অস্বস্তিতে পড়তে হয়।

“ভাই একটা ফুল নেন। একটা ফুল আপার চুলে দেন। নেন না একটা ফুল।”

একটা ছোট্ট মেয়ে কিছু লাল গোলাপ এবং বেলি ফুলের মালা নিয়ে এসে একটা গোলাপের তোড়া আদভিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে কথা গুলো বললো।‌

“আমার পাশেই তো আস্ত একটা গোলাপ বসে আছে রে পিচ্চি। যে আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে।”

আমার দিকে তাকিয়ে বুকের বা পাশে হাত রেখে কথাটা বললো আদভিন। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটা হয়তো আদভিনের কথা বুঝতে পারেনি যার জন্য আবারো ফুল নিতে বললো।
আদভিন একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবারো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে গোলাপের তোড়া এবং একটা বেলি ফুলের মালা নিয়ে নিলো।
মেয়েটার থেকে ফুল নিয়ে তাকে টাকা দিতেই মেয়েটি আমাদের গাড়ির আগের গাড়ির কাছে চলে গেল।

” আমার গোলাপ ফুটেছে আমার বুকে। যেই গোলাপের ঘুমন্ত মুখ আমাকে আফিমের মতো করে কাছে টেনেছে। আর এই প্রেম বাষ্প গোলাপ আমার সে-ই গোলাপের জন্য। এই গোলাপের সুবাস আমায় যতটা না আকৃষ্ট করে তার থেকে বেশি আকৃষ্ট করে আমার ব্যক্তিগত গোলাপের সুবাস।”

কথা গুলো বলে গোলাপ ফুল গুলো আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আর একটা ফুল চুলে গুঁজে দিয়ে বেলি ফুলের মালা সুন্দর করে হাতে বেঁধে দিলো। হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। লোকটা আর যায় হোক না কেন, মানুষকে খুশি করতে পারে ভালো। আদভিনের কথার উত্তর না দিয়ে সামনে তাকিয়ে রইলাম। সামনে অনেক গাড়ি, রাস্তায় লাগানো গাছে বিভিন্ন ফুল ফুটে আছে কিন্তু আমি শুধু সে-ই ফুল বিক্রেতা মেয়েটাকে দেখে যাচ্ছি।

” জীবন কি অদ্ভুত তাই না? দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার জন্য মানুষ কত কিছুই না করে।‌ যে বয়সে লেখাপড়া করার কথা, পাখির মতো উড়ার কথা সেই বয়সে এসে কি-না জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ফুল বিক্রি করছে।”

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে উক্ত কথা গুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এক মূহুর্তের জন্য মেয়েটির স্থানে নিজেকে অনুভব করলাম। এই তো বাবা মারা গেল যখন আমার বয়স মাত্র নয় বছর হওয়ার কিছু দিন আগে। বাবা মারা যাওয়ার পর হুট করেই চাচা সম্পূর্ণ পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে। বছর খানেক চাচা চাচী ভালো ব্যবহার করলেও দিন দিন তাদের ব্যবহার পরিবর্তন হতে শুরু করলো। এক চাচার রোজগারে তাদের সহ আমরা মা মেয়ে বিনা পয়সায় খাচ্ছি পড়ছি। যার দরুন মাকে বাড়ির সব কাজ করতে হতো টাকা দেওয়ার পরিবর্তে। তখন যদি মা না থাকতো তাহলে হয়তো আমাকে এভাবেই রাস্তায় থাকতে হতো দুমুঠো খাবারের তাগিদে।
আদভিন আর কিছু বললো না হয়তো বলার মতো কিছু নেই তার কাছে। জ্যাম ছুটে গিয়েছে সেই সাথে প্রতিটি গাড়ি ছুটে চলেছে তার গন্তব্যে।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

নিজ বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গেল। ততক্ষণে চারদিকে অন্ধকার নেমে গেছে। আর বাড়িতে আসার পর থেকে চাচি কেন জানি আদভিনকে নিয়ে বসেছে। শুধু বসেছে না বরং সুন্দর করে আপ্যায়ন করছে বটে। পরে তুলির থেকে জানতে পারলাম এসব মা করেছে। মায়ের কানের দুল বিক্রি করে বাজার করে নিয়ে এসেছিল। কথাটা শুনে নিজের ভাগ্যের উপর বড্ডো আফসোস হতে লাগলো। নিজের মা’কে একটু সুখ দিতে পারলাম না। একজন মেয়ে হিসেবে কি ব্যর্থ হলাম! আদভিন বর্তমানে আমাদের এক তালা বাড়ির ড্রয়িংরুমে তুলি আর তুহিনের সাথে গল্প করছে। এই বাড়ি এসে অবশ্য ই সবার আগে শাশুড়ি মা’কে ফোন করে আদ্র এবং রোদ্রর খোঁজ নেওয়া হয়ে গিয়েছে। আদ্র এবং রোদ্রকে শাশুড়ি মা আমাদের সাথে দেননি।

“কি রে মা এখানে বসে আছিস কেন? ওখানে যা জামাই, তুলি সবাই গল্প করছে।”

মায়ের রুমের জানালার পাশে বসে বসে বাইরের অন্ধকার দেখছিলাম এমন সময় মা আমার পাশে এসে বসে কথাটা বললো। মায়ের দিকে তাকিয়ে মা’কে একটু ভালো করে দেখে নিলাম।‌ মায়ের মুখে হাসি আজ যেন একটু বেশি সুন্দর লাগছে আমার কাছে। কিন্তু আমার ভিতরে বয়ে যাওয়া ঝড় দু’চোখ অশ্রু হয়ে বের হয়ে আসতে শুরু করলো। মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম।

“কি হয়েছে তরু? এভাবে কান্না করছিস কেন? ও বাড়ির মানুষ জন কিছু বলেছে? বল আমায়।”

মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করলো মা। মায়ের সোহাগ পেয়ে কান্না গুলো যেন আমার আরো বেড়ে গেল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলাম।

“মা তোমরা আমার সাথে এমন কেন করলে? একজন বিবাহিত লোকের সাথে আমার বিয়ে দিলে? শুধু কি বিবাহিত? মা দুজন সন্তান আছে তার। আমি সতীন নিয়ে ঘর করব মা? কেন করলে তোমরা আমার সাথে?”

মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে কোন রকম কথাটা বললাম। কান্নার জন্য ঠিক করে কথা বলতে পারছিলাম না। মায়ের কি হলো জানিনা তবে আমার মাথা তুলে সোজা করে কপাল কুঁচকে তাকালো।

“এসব কি বলছিস তুই তরু? তোকে এসব কথা কে বলেছে? সতীন আসবে কি করে? আর সন্তান তো,,,”

“তরু!”

মায়ের কথা শেষ করার আগেই দরজার সামনে আদভিন এসে আমাকে ডেকে উঠল। যার জন্য মা তার কথা শেষ করতে পারলো না। কিন্তু মা কি বলতে চাচ্ছিল?

“বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন বাবা? ভিতরে আসো।”

“না আসলে! তরু! মানে!”

আদভিন কিছু বলতে চেয়েও সংকোচবোধ করছিল বারবার। এদিকে আদভিনকে দেখে নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। যেন কিছুই হয়নি।

“আচ্ছা তুমি রুমে যাও আমি তরুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এই তরু যা রুমে গিয়ে দেখ জামাইয়ের কি দরকার।”

প্রথম কথা গুলো আদভিনকে বলে পরের কথা গুলো আমাকে বলে তাড়া দিতে শুরু করলো মা। মায়ের কথা শুনে আদভিন তখন চলে যায়।

“তুমি কি যেন বলছিলে মা? আমি পরে এসে তোমার কথা শুনবো মা।”

মাকে কথাটা বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। আদভিনের উপর রাগ হচ্ছে। অসভ্য লোকটা আসার আর সময় পেলো? যখন মা আমাকে জরুরি কিছু কথা বলছিল তখন আসতে হলো?

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

“মিসেস তরু আপনি কি জানেন আপনাকে একদম গোলাপ জামুনের মতো লাগছে? ইচ্ছে করছে তোমাকে খেয়ে ফেলি। তোমার থেকে নিজেকে কাবু করে রাখা যে দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে।‌ তরু আই নিড ইউ। আই রেইলি! রেইলি নিউ ইউ। আর ইউ রেডী ফর ফার্স্ট নাইট মিসেস তরু?”

আমি রুমে আসার সাথে সাথে রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথাটা বললো আদভিন। আদভিনের চোখে একটা নেশা কাজ করছে। তীব্র ভাবে কাউকে নিজের করে পাওয়ার এক নেশা। এক কামুক নেশা। আদভিনের চোখ দেখে শুকনো ঢুক গিলে নিলাম।
আদভিনের কথা উপেক্ষা করার অধিকার কি আমার আছে? বিয়েটা যেমন হোক আদভিন আমার স্বামী তাকে কি করে ফিরিয়ে দিবো? আমাকে কিছু বলতে না দেখে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।

“কি! কি করছেন আপা,,,”তোমার

আদভিনকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে পিছিয়ে যেতে যেতে কথা বলছিলাম। কিন্তু কথা শেষ করার আগেই পা কিছুর সাথে লেগে ধপাস করে বিছানায় পড়ে গেলাম।

“আমি এখনো কিছু করিনি তরু। আমাকে কি যেন বলেছিলে? অসভ্য? এবার তাহলে অসভ্যতামি করে অসভ্য হচ্ছি। আর ইউ রেডি টু বি মাইন তরু?”

নিজের কথা শেষ করেই ঘাড়ে মুখ ডুবালো আদভিন। আমার ডান হাতে আদভিনের হাতে মুঠিবদ্ধ হয়ে গেল মূহুর্তের মাঝেই। আদভিনকে নিজের এতোটা কাছে দেখে তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে নিলাম।

” এখনো তো কিছুই করি তরু! এর আগেই লজ্জা পাচ্ছো? যখন আমি তোমার আরো কাছে যাব তখন কি করবে?”

কথাটা বলে আদভিন কপালে থাকা চুল গুলো কানের কাছে গুজে দিল। আদভিনের কথা শুনে লজ্জায় মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলাম।
রাত অনেকটা নেমে এসেছে। বাতাসে হালকা ঠান্ডা, জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো বিছানায় পড়ে একরকম সোনালি রুপোলি ছায়া তৈরি করেছে। ঘরের বাতিটাও নিভিয়ে দিয়েছে ওরা—কেবল আলোর উৎস, একে অপরের চোখ।

“তুমি জানো, আমি তোমায় কতখানি চাই?”

আদভিনের কন্ঠ নরম কিন্তু তার কন্ঠ কাঁপছে, যেন নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না।

“আপনি কি জানেন আপনি একটা অসভ্য বুড়ো ব্যাটা? আপনি আমাকে আপনার প্রতি দুর্বল করে দিচ্ছেন? আপনি,,,”

আমার কথা শেষ করার আগেই আদভিন নিজের রুক্ষ ঠোঁট ধারা আমার কথা বন্ধ করে দিল। আবার লজ্জায় চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম। আদভিন ঠোঁট ধীরে ধীরে ছুঁয়ে গেল আমার কপাল, চোখ, গাল। আদভিনের ঠোঁটের প্রতিটি ছোঁয়া যেন একেকটা প্রতিজ্ঞা। তারপর আদভিন নিচু হয়ে আবার আমার ঠোঁটে ডুবিয়ে দিলো। যার ঠোঁটের ছোঁয়ায় ছিল লম্বা, গভীর, মৃদু কামনায় ভরা। আমার সমস্ত দেহ শিউরে উঠল। এবার চোখ বন্ধ করে আদভিনের বুকে মাথা রাখলাম, যেন সেই স্পর্শে নিজেকে গলিয়ে দিতে পারি।

আলতোভাবে তার শাড়ির আঁচল পড়ে যায় কাঁধ থেকে। আদভিনের আঙুল ধীরে ধীরে আমার পিঠ বেয়ে নামে, প্রতিটি ছোঁয়ায় জাগিয়ে তোলে অজানা শিহরণ। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। আমি আর নিজের ভিতর আটকে রাখতে না পারে নিজের সমস্ত ভার আদভিনের উপর ছেড়ে দিলাম।
বিছান ধীরে ধীরে একে অন্যের মাঝে হারিয়ে যেতে লাগলাম। চাদর যেন আমাদের গোপন রহস্যের সাক্ষী হচ্ছে যেখানে ভালোবাসা কেবল দেহে নয়, আত্মায়ও মিলন খুঁজে পায়।

রাতটা যেন থেমে রয়েছে আমাদের জন্য। বাইরের পৃথিবী মুছে যায়। কেবল শরীরের প্রতিটি দোলায়, প্রতিটি কাঁপনে, ওদের প্রেম আর কামনার গান বেজে চলে নিঃশব্দে, গভীরে, আন্তরিকতায়।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

“আমার আবার প্রেম প্রেম পাচ্ছে মিসেস তরু!”

#চলবে