সুপ্ত প্রেমের অনুরাগে পর্ব-১২

0
11

#সুপ্ত_প্রেমের_অনুরাগে🕊️
#পর্ব:বারো
#তামান্না_ইসলাম_কথা

শহুরে ম্যারাত মানে এক ধরণের নিঃসঙ্গতা, যা জনাকীর্ণ রাস্তাঘাট, উঁচু দালান আর কোলাহলের মধ্যেও নিঃশব্দে মানুষের মনকে গ্রাস করে। এখানে প্রতিটি মানুষ যেন ব্যস্ত, ছুটে চলছে নিজস্ব লক্ষ্যপানে, অথচ সম্পর্কগুলো হয়ে উঠছে যান্ত্রিক, অনুভূতিশূন্য। শহরের ঝলমলে আলোয় আড়াল হয়ে যায় মানুষে মানুষে ব্যবধান, যেখানে বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় স্বার্থ, আর ভালোবাসার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে প্রয়োজন। প্রতিদিনই হাজারো মুখ দেখা হয়, অথচ সত্যিকারের সংযোগ খুবই কম। রাত বাড়লে শহরের ম্যারাত আরও গভীর হয় উঁচু বিল্ডিংয়ের কাচের জানালায় প্রতিফলিত হয় একাকীত্ব, ক্লান্তি আর অভ্যন্তরীণ শূন্যতা। শহুরে জীবন যেমন গতি নিয়ে আসে, তেমনি কেড়ে নেয় আত্মিক প্রশান্তি। এই ম্যারাত এক গভীর বেদনার নাম, যা মানুষের হৃদয়ে নিরবে জমে থাকে, অদৃশ্য কিন্তু অনুভবযোগ্য।
গুটিসুটি হয়ে আমার কোলে মাথা রেখে ফ্লোরেই শুয়ে আছে আদভিন। আমার হাত তার চুলে বিচরণ করছে।

“প্রত্যেক মানুষের জীবনে একজন মানুষ থাকা দরকার যার সাথে হাসি, কান্না সব কিছু করা যায়। এমন একটা কাঁধের প্রয়োজন যেখানে মাথা রেখে নীল আকাশ এবং মধ্য রাতে মেঘে ঢাকা চাঁদ দেখা যায়।”

কোলে মাথা রেখেই কথা গুলো বললো আদভিন। আদভিনের চুলে হাত চালিয়ে দিতে দিতে হাওয়ায় উড়তে থাকা পর্দা দেখতে থাকলাম।

“মানুষ কখনো একা একা কান্না করতে চায় না আদি। মানুষের একটা বিশ্বস্ত কাঁধের প্রয়োজন হয়। আমার সে-ই কাঁধটা আপনি।”

কথা গুলো বলে আদভিনের কপালে চুমু দিয়ে আবারো অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। শুধু ভাবতে লাগলাম ইয়ানশিরার কথা। মেয়েটা এমন একটা ছেলেকে ভালোবেসে ছিল যে, কখনো তাকে না বরং তার শরীরকে ভালোবেসে ছিল। ভুল মানুষের জন্য নিজের জীবন দিতে হয়েছে। আর এখন তার শেষ সম্বল, তার সন্তান! না আর্দ্র রোদ্র আমার আর আদভিনের সন্তান। আমি কিছুতেই ওদের নিয়ে যেতে দিব না। ওদের ছাড়া যে আমরা সম্পূর্ণ একা।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

সকাল সকাল আমার শশুর বাড়ি এসে হাজির হয়েছে আমার চাচা চাচি। তাদের জন্য রান্না করতে করতে হাঁপিয়ে যাচ্ছি। শুধু যে আমি করছি তা না! মা আসার পর মা নিজেও আমাকে সাহায্য করছে। কিন্তু মেয়ের শশুর বাড়ি এসে এভাবে কাজ করা কজন ভালো চোখে দেখে? যাই হোক, শুধু চাচা চাচি না বরং ইয়ানশিরার মৃত্যু বার্ষিকীর জন্য খাবার গুলো একটা আশ্রমে পাঠানো হবে। যার জন্য সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই রান্নার কাজে লেগে যেতে হয়েছে। চাচা চাচির সামনে বসে আছে আমার শাশুড়ি। সকাল সকাল আমার চাচি এখানে আসার কারণ আর কেউ বুঝতে না পারলেও আমি জানি এখানে কেন এসেছে। কিন্তু আমি যে তাদের কাজে কখনো সফল হতে দিবো না।

“চাচা নতুন ফ্ল্যাটে উঠছেন কবে?”

মাত্রই চায়ে চুমুক দিচ্ছিল চাচা হঠাৎ করে আদভিনের কথা শুনে কেশে উঠলেন তিনি। অপরদিকে চাচাকে কথাটা বলে আরাম করে চায়ে চুমুক দিতে লাগল।

” হ্যাঁ তাইতো তরু মা তো বলেছিল আপনারা ফ্ল্যাটে উঠবেন।”

আদভিনের পাশাপাশি শশুর বাবাও চাচাকে কথাটা বললো। শশুর বাবার কথা শুনে চাচি মুখটা ফ্যাকাসে করে ফেললো। মুখের ভাবভঙ্গি এমন যেন তেতু কিছু গিলতে বলা হয়েছে।

“আর বলবেন না বেয়াই সব আমাদের কপাল। আমাদের এতো কষ্ট করে তিলে তিলে জমানো টাকা নিয়ে লোকটা পালিয়ে গেছে।”

শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরে কান্না করার অভিনয় করে কথাটা বললো চাচি। চাচির এমন ভাব দেখে আদভিন সবার চোখের আড়ালে হাসলো।

“কি বলেন এসব বেয়াই? আপনি থানায় মামলা করেন নাই?”

“থানায় গেছিল কিন্তু কোন কাজ হয় নাই। আসলে বেয়াই তুলির বাবা যে ফ্ল্যাট দেখেছিল সেটা ছিলো অন্য জনের। সে ছিল সেই বাসার কেয়ারটেকার। কিন্তু তুলির বাবা তো এতো কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। সে বলছিল ঐ ফ্ল্যাট না কি তার নিজের। বিশ্বাস করে টাকা গুলো দিছিল। এখন আমরা রাস্তায় নেমে গেছি।”

কথাটা বলতে বলতে চোখের পানি কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুছে নিল চাচি।

” এই কি হয়েছে রে? তোর চাচি এমন করে কান্না করছে কেন? কি হয়েছে ড্রয়িংরুমে?”

মায়ের কথা শুনে একবার তার দিকে তাকিয়ে আবারো রান্না করতে শুরু করলাম। আমার মা যে কিছু জানে না তা না! জানে তবে শুধু এইটুকু জানে জানে যে, চাচার টাকা নিয়ে এক লোক পালিয়ে গি

” আচ্ছা মা তুমি কি জানো চাচা চাচি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে? আচ্ছা মা, চাচা শুধু আমাদের ভরণপোষণ দেয় বলে কি তুমি সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে নিবে? হ্যাঁ মুখ বুজে তখন সহ্য করা যেতো যদি সব কিছু ফ্রিতে দিতো। সে তো আমাদের কোন কিছুই ফ্রিতে দেয় না। আমার বিয়ের আগে বাড়ির সমস্ত কাজ আমাদের দুজনের উপর চাপিয়ে দিতো। তুমি আমাকে কিছু করতে দিতে না সব একা একা করতে। একজন মানুষ যে পরিমাণে কাজ করে সেটা তোমাকে দিলে আমাদের সব কিছু ভালো মতো হয়ে যেতো। এমন তো না যে আমরা তাদের বাড়িতে পরে থাকতাম। তারাই তো আমাদের বাড়িতে থাকে তবুও তাদের এতো কিসের অহংকার মা?”

“বাড়িতে একজন পুরুষ মানুষ থাকা দরকার। তোর বাবা মারা যাওয়ার পর তো সব কিছু তোর চাচা দেখাশোনা করেছে।”

মায়ের এবারের কথা শুনে আমার কেন জানি রাগ হলো। এই দুনিয়ায় কি কেউ এমনি এমনি করে?

“মা তোমার কি মনে হয় এসব এমনি এমনি করেছে? তোমার কি একবারও মনে হয়নি চাচা ফ্ল্যাট কেনার জন্য এতো গুলো টাকা কোথায় পেলো? মা বাবার নামের যে সম্পত্তি ছিল সেটা বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে গিয়েছিল। তোমার অগোচরে আলমারি থেকে কাগজ নিয়ে এসব করেছে। এই যে এখানে এসেছে কেন জানো? আমার থেকে টাকা নিতে। আমি যেন তাদের টাকা দিই। আর জানো মা! এই মানুষ গুলো আমাকে মিথ্যা কথা বলেছিল।”

আমার কথা শুনে মা কেমন নিস্তেজ চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকালো। মুখটা শান্ত। মায়ের এমন ভাব দেখে কিছু বুঝতে পারলাম না।

“তোর কি মনে হয় আমি কিছুই জানিনা? আমি সব কিছু জানি। তোর চাচি যে, আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে আলমারি থেকে জমির কাগজপত্র বের করে নিয়েছে আমি তা সব দেখেছি। দেখেও কিছু বলিনি। বলে কি হবে বলতো? একবার ছাড়া বারবার একই কাজ করবে। আমরা কি,,”

“তরু একটু রুমে আসো না!”

মায়ের কথা শেষ করার আগেই দরজার সামনে আদভিন এসে আমাকে ডেকে চলে গেল। অপরদিকে মায়ের কথা যেন আমার মাথা এলোমেলো করে দিল। মা আগে থেকেই সব কিছু জানতো! কখনো আমাকে একটু বললো না? মায়ের উপর অভিমান নিয়ে হাত মুছতে মুছতে চলে গেলাম আদভিনের কাছে।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

এক সপ্তাহ আগে অন্তুকে আটক করেছে পুলিশ। এর মূল কারণ হচ্ছে, একটা মেয়েকে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করার জন্য। মেয়েটি থানায় মামলা করতেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। নিজের ভাইকে ছাড়াতে উকিল নিয়ে থানায় এসেছে সামিন। নিজের ভাইকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখবে না সে।

“অফিসার আমার মক্কেলকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এই যে এইটা তার প্রমাণ পত্র। আর এইটা তার বেলের কাগজ।”

কথাটা বলেই পুলিশ অফিসারের দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিল এডভোকেট রাফিন সিকদার। পুলিশ অফিসার কাগজ দেখে একবার সামিনের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো।

“কনস্টেবল অন্তুকে ছেড়ে দাও।”

খুব অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যেন পুলিশ অফিসারকে কাজটি করতে হলো যা তার গলার স্বর শুনে বুঝতে পারলো সবাই।

“এরপর আপনাকে দেখে নেওয়ার পালা অফিসার।”

#চলবে