রেড হার্ট পর্ব-০৭

0
2

#রেড_হার্ট❤️
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
#পর্ব_সাত

পুরুষালি ধাক্কা কোনো নারীর’ই সহ্য করা কাম্য নয়। বকুলের ও তেমনটি’ই হলো। ভ্রমের এক ধাক্কায় সিড়ি বেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে শামলে নেয় যথাসাধ্য। তবুও মনে হচ্ছে পা আর হাত দুটোতেই বেশ লেগেছদ। হাড্ডি না ভাংলেই হয়!

তাদের মধ্যকার ঘসে বাহিরে জানাতে চায়না। তাই তখন পড়ে গিয়েও যন্ত্রনা নিয়ে ওপাশের একটা কোণায় জায়গা করে বসে আছে। একটু আগেই ভ্রম কে তড়িঘড়ি করে যেতে লাগলো। বেশ খানিকক্ষণ হয়েছে তো। লোকটা মনে হয় চলে গিয়েছে। এবার সে নিজে নিজে পড়ে যাওয়ার গল্প তো অন্তত বলতে পারবে।

ছোট বাচ্চাদের মতো কেবল হাতে ভর দিয়ে শরীর টাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আস্তে করে কয়েক সিড়ি গিয়ে সেভাবেই পড়ে থাকে যেভাবে সে প্রথমে পড়েছিল। তবে বিপত্তি ঘটে আরেক জায়গায়। পা ফসকে আবারো সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে নিচে। ব্যাথার জায়গায় পুনরায় ব্যাথ্যা পাওয়ায় জোরে চিল্লিয়ে উঠে সে। পড়ে যায় ফ্লোরে। সাথে সাথে মাথাটা ভনভন করলো। চোখের সামনে নেমে আসলো ঘন কালো আঁধার।


হসপিটালের জানালার সাদা পর্দার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে ভ্রম। বেডে ঘুমন্ত আমরিন। একবার প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আরেকবার মেয়েটার দিকে তাকালো। মেয়েটার মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। সুন্দর মুখটায় মনে হচ্ছে রক্ত নেই। অবশ্য থাকার কথাও না। যে পরিমাণ ব্লিডিং হয়েছে! একটা মেয়ে কদিন পরে ডাক্তার হবে আর তার নিজের সম্পর্কে কোনো হেলদোল ই নেই।

ভাবতেই বুকের ভেতর থেকে তপ্ত শ্বাস বেড়িয়ে আসলো তার। তখনই কেবিনে প্রবেশ করে ইয়াদ। হাতে ফলের প্যাকেট। ফলগুলো টেবিলে রেখে বন্ধু কে দেখে এগিয়ে আসে।

-“কিরে কখন এলি?”

-“এই বিশ মিনিট হবে।”

-“আমায় জানাতে পারতিস ব্রো?”

-“বাদ দে। এর কাহিনি কি সেটা বল।”

ভ্রমের কথায় ইয়াদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বুলি আওড়িয়ে বললো,

-“এর কাহিনী আন্টি আংকেল বলবেন।”

-“কি বলছিস? কিন্তু কেন?”

-“আমিও জানি না সেটা। বললো তুই আসলে যেনো তোকে ওখানে নিয়ে যাই।”

-“আচ্ছা, বুঝলাম সবই। কিন্তু এইটা বল, ওর জ্ঞান আসবে কখন?”

-“ডাক্তার বলেছিলেন যেকোনো সময়। তাই…”

-“তাহলে চল ওর মা-বাবার কাছে যাই।”

-“হুম, যাওয়া যায়! চল তাহলে।”

-”হ্যাঁ চল!”

কথা শেষ করে নিজের মতোন করে হাঁটা ধরে ইয়াদ। কিছুটা ভাবুক হয়ে সে ইয়াদের পা অনুসরণ করছে। আপাতত তার দৃষ্টি মেলে পথ চিনতে মস্তিষ্ক কে বলতে ইচ্ছে করছেনা।

-“কীভাবে পড়ে গেলে মা?”

-“শান্ত হোন আন্টি। আ’ম ফাইন। এভ্রিথিং ইজ ওকে। আমার হাতেই তো শুধু অল্প আঘাত লেগেছে আর পা তিনদিন রেস্টে থাকতে ব্যস এতটুকুই তো?”

বউয়ের এমন কথায় ভ্রমের মা কিছুটা আবেগী হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ব্যাপারটা নিশ্চিত করতেই সে নিজ উদ্যোগে বলতে শুরু করে,

-“আমি শাড়ি পড়তে অভ্যস্ত নই। শামলাতেও তো পারিনা। যার কারনে সিড়ি দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।”

-“তাইলে মাথার আঘাত টা?”

কাচুমাচু করে আয়না উপরোক্ত প্রশ্ন টা করলো।
বকুল মুচকি হাসলো। উত্তরের বললো,

-“ন্যাড়্যা বেলতলায় একবার যায়, শুনেছো তো প্রবাদবাক্য টা? কিন্তু আমি বেলতলায় বারবার যাই। ফলস্বরূপ মাথায় দ্বিতীয়বারের মতো আঘাত পেলাম।

অতঃপর টুকটাক কথা বিনিময় হলো ভ্রমের মা-বাবা এবং ফুপুর সাথে। সবার সাথে কথা হলেও কথা কিংবা দেখা হলো না ভ্রমের সাথে। ভ্রমের কথা মাথায় আসতেই হাস্বোজ্জল মুখখানা চুপসে যায়। মানুষ টা তাকে দেখতে অবধি এলো না? সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা কেটে যেতে লাগলো। একবারের জন্যেও কি আসবে না?
সে চাইলেও ভ্রমের কথা বলতে পারতো। বলেনি কারন সে চায়না ভ্রম সবার কাছে ছোট হোক। তবে এখানে চুপ থাকলেও ঘরে অবশ্যই সে ব্যাট্যাকে ধরবে। ধরবেই ধরবে। সামান্য ফোন ধরবে বলে এইরকম ব্যবহার? এরম ঘেউঘেউ তো পাড়ার কুকুরেরাও করেনা!

ঠোঁট উল্টিয়ে নিলো সে। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিলো। অতঃপর মলিন মুখ নিয়ে আয়না কে ডাকলো।

-“আয়না..? এদিকে এসো একবার।”

-“হ আপা, কন।”

-“তোমার ভাই…?”

আয়নাকে এতটুকু বলতেই সে উত্তরে বলে,

-“আরে আপা কইয়েন না। ভাইজান সকালে যে গেছিলো পরে আর আসেনাই বাসায়। কল করতাছে খালুজান কিন্তু রিসিভ করতাছেনা।”

-“ওহ!”

বকুলের ছোট্ট উত্তর। আয়না ফের বললো,

-“এইটুকুই আপা?”

-“হ্যাঁ!”

-“আমি তাইলে যাই।”

বকুল কথা বাড়ালো না। অনুমতি স্বরুপ মাথা নাড়ালো কেবল। মস্তিষ্ক একটা কথাই বললো, ‘তোর জন্য কি তাহলে সে রাগ করেছ? নাহ বকুল, যে ভুল করেছিস তা শুধরে নে।’

তখনই কেবিনে প্রবেশ করে ভ্রমের বাবা খালেকুজ্জামান। তিনি কানে ফোন নিয়ে এদিকেই এসেছেন। বকুল পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মনযোগ দিলো হাতে থাকা আপেল টা খাওয়ায়। কিন্তু যখনই ভ্রমের বাবার কথোপকথন তার কর্ণকুহর হলো তখনই খাওয়া থামিয়ে দিল। ভ্রমের বাবা আর ভ্রমের কথোপকথন;

-“কিরে ভ্রম সকাল থেকে তুই লাপাত্তা, ফোনটাও বন্ধ। চিন্তায় ছিলাম না? কোথায় আছিস তুই?

ফোনটা লাউডে থাকায় বকুল’ও ভ্রমের আওয়াজ শুনতে পেলো। ভ্রমের কাঠকাঠ গলায় উত্তর,

-“আছি কোথাও একটা। কি দরকারে খুঁজছিলে বল।”

ভ্রমের গলায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। বাবার সাথে এহেন ব্যবহারে বকুল’ও খানিকটা বিরক্ত হলো। কই সে তো তার বাবার সাথে কত মিষ্টি করে কথা বলতো। আর সেখানে ভ্রম একটা বেয়াদবের মতো আচরণ সবসময়ই করে। ভ্রমের উপর চরম বিরক্তি তে বকুলের মুখ থেকে ‘চ’ সূচক শব্দ বের হয়।
ফের মনযোগ দেয় বাপ-ছেলের কথোপকথনে,

-“কোথায় তুমি?”

-“ঢাকায়।”

ছেলের কথায় চমকে গিয়ে বাবা বললেন,

-“কিহ? ঢাকায় কেন?”

-“আমার বেস্টফ্রেন্ড আমরিন গতকাল মাঝরাতে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলো। ডিএমসি তে আনা হয়েছে। সকালে খবর টা পেয়েই চলে এসেছি।”

এই কথা শুনে বাবার প্রচণ্ড রাগ উঠে যায়। হুংকার দিয়ে ছেলেকে শোধান,

-“বাহ! আমার কেয়ারিং ছেলে। বউ এদিকে হাত-পা ভেঙে হসপিটালে এডমিট হয়ে কেবিনে পড়ে আছে আর সে বেস্টফ্রেন্ড কে দেখতে গিয়েছে। বাহ!”

বাবার কথায় সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে প্রসঙ্গ উলটে বাবাকে শোধায়,

-“শোনো বাবা। ও আমার জাস্ট বিয়ে করা বউ, কোনো দায়িত্ব কর্তব্য নয়।”

-“তাহলে তোর বেস্টফ্রেন্ড?”

-“ও আমার অনেক কিছুই হয়।”

শেষের কথাটা শুনে বকুলের বুকের ধুকপুকানি আওয়াজ টা বেড়ে গেল। তাহলে সকালে মেয়েটা আমরিনের জন্যই….। অজান্তেই চোখের কোণে জল চিকচিক করতে লাগলো। সায় জানালো না সে তাতে। দ্রুত নিজেকে শামলে নিলো। অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে হাতের পাশে থাকা ফোনটায় নজর দিলো।

বাবা’ও ছেলের এহেন আচরণে বউমার কাছে লজ্জিত। এখানে এসে ভ্রমের সাথে কথা বলাটাই ওনার ভুল হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বেরিয়ে গেলেন কেবিন থেকে। তিনি আর চান না মেয়েটা কষ্ট পাক। তখনও ভ্রম কথা বলছে,

-“আজই ব্যাক করছি বাসায়। আরেকটা কথা, আমার টিমকে এমএমসি তে ট্রান্সফার করা হয়েছে। তাই আমার ফ্রেন্ডদের জন্য একটা ব্যাচেলার বাসা জোগাড় করে দাও।”

ভ্রমের কথা বলা শেষ। খালেকুজ্জামান সাহেব প্রতিত্তুরে কিছু বললেন না৷ বিরক্তিমাখা চাহনি নিয়ে কলটা কেটে দিলেন। ফোন লাগালেন খালি বাসার জন্য।


নিজের বাবার সাথে কথা বলেই ইয়াদকে সাথে নিয়ে পা বাড়ালো অফিসরুমে। সেখানটায় তার জন্য আমরিনের মা-বাবা অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ আগের সব কথাবার্তা’ই ইয়াদ শুনেছে। কিছু বলেনি ভ্রম কে।

অফিসে প্রবেশ করেই আমরিনের মা-বাবার মুখোমুখি হলো ভ্রম। কুশল বিনিময় সেরে সোজা প্রশ্ন করলো,

-“জি আংকেল-আন্টি বলুন কি জন্য ডেকেছেন।”

ভ্রমের কথায় আমরিনের মা-বাবা জোড়পূর্বক হাসলো। আমরিনের মা কথাটা তুললেন,

-“একটা অন্যায় আবদার করলে রাখবে বাবা?”

ভ্রম কনফিউজড হয়ে যায়। অন্যায় আবদার করবে আর তাকে রাখতেও বলছে? এ কেমন কথাবার্তা। মনে মনে এগুলো আওড়ালেও আমরিনের মা-বাবাকে বললো,

-“আসলে আন্টি, রাখার হলে রাখবো। আপনারা অবশ্যই জানেন আমি কেমন মাইন্ডের ছেলে। তাই বলে ফেলুন। সাধ্য হলে রাখবো ইনশা’আল্লাহ।”

মুখ খুলে আমরিনের বাবা।

-“চার বছর ধরেই তো তুমি ডিএমসি তে আছো। আমরিনের সাথে তো তোমার তিন বছরের পরিচয়। ও পড়তো আরএমসি তে। যখন তোমাকে সোশ্যাল প্লার্টফর্মে দেখলো তখন এসে ওর মামনিকে বলছে যে,“মাম্মা আমাকে ডিএমসি তে ট্রান্সফার করিয়ে দাও, আমি এই ছেলেটার সাথে পড়বো ।”
আমার স্ত্রী’ও মেয়ের কথা ফেলতে পারেনি। পরে ওকে ডিএমসি তে ট্রান্সফার করে দেয়। আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব হয় তোমাদের। আমাদের মেয়ে সে কি খুশি। তারপর একদিন ও বুঝতে পারে যে ও তোমায় ভালোবাসে। দুদিন পর নাকি তোমার বার্থডে, সেদিন তোমাকে বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার আগেই তুমি বিয়ে করে ফেললে। এখন…”

আমরিনের বাবা চুপ করে গেলেন। ভ্রম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের কথা থেমে যাওয়ায় সে নিজ থেকেই বুলি ফুটিয়ে বললো,

-“তারপর?”

আমরিনের মা এবার পুরো কথাটা শেষ করার জন্য মুখ খুললেন,

-“সারাদিন ও ফ্রেন্ডের সাথে ট্যুরে ছিলো ফিরেছে মাঝরাতে। আর এসেই ইন্টারনেটে তোমার বিয়ের নিউজ টা পেয়ে….”

-“এখন কি বলতে চাচ্ছেন আপনারা?”

ভ্রমের স্পষ্ট ভাষায় সোজা প্রশ্ন। ঘাবড়ালেন আমরিনের মা-বাবা উভয়েই। দুজনেই শুকনো ঢোক গিলে নিলেন। অতঃপর বুকে এক কদম সাহস নিয়ে আমরিনের বাবা প্রস্তাব দিলেন ভ্রমের কাছে,

-“আমি আমাদের মেয়েকে হারাতে চাইনা। তাই প্লিজ তুমি ওকে বিয়ে করো! প্লিজ বাবা!”

আমরিনের বাবার কথায় মা’ও তাল মেলালেন,

-“হ্যাঁ বাবা। একজন মা-বাবা হয়ে মেয়ের জীবন ভিক্ষা চাচ্ছি। প্লিজ বাবা!”

#চলবে?