#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ৪
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
শাহরিয়ার নিজের রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রমের সোফায় বসলো মাহিরার সামনাসামনি।
“আজকে ফ্যাক্টরিতে যাবে না আর?”
মাহিরা তার তিন বছরের ছেলে মহসিনকে খাইয়ে দিতে দিতে ভাইকে প্রশ্ন করলো।
“যাবো, বিকেলের দিকে।”
মাহিরা নিজের ছেলের দিকে মনোযোগ দিলো।
ওদিকে শাহরিয়ার উসখুস করছে। মাহিরা বড় ভাইয়ের দিকে ফিরলো। শাহরিয়ারের তামাটে বর্ণের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পর্যবেক্ষণ করে বললো,
“ভাইয়া, কী হয়েছে? গতকাল থেকে তোমাকে অনেক ডিসটার্বড লাগছে।”
শাহরিয়ার যেন অপেক্ষাতেই ছিলো মাহিরার প্রশ্নের। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি এবং তর্জনী দিয়ে কপাল ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,
“জ্যোতির…. আব্বু এসেছিলো কালকে আমার অফিসে।”
মাহিরা এবার নড়েচড়ে বসলো। সিরিয়াস হয়ে বললো,
“কেনো?”
“এইতো, এসব ঝামেলা নিয়েই কৈফিয়ত চাইতে এসেছিলো। জ্যোতির সাথে আমাদের আচরণ নাকি ভালো ছিলো না। মোট কথা ব্লেইম দিয়ে যাচ্ছিল সমানে।”
“তারপর?”
” এক পর্যায়ে লিমিট ক্রস করলে আমিও রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। শেষে উনিও রাগারাগি করে চলে গিয়েছিলো।”
মাহিরা চোখ উল্টে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো।
“ভাইয়া তুমি আসলে কী বলো তো! তোমার মেজাজে কী অলটাইম কেরোসিন ঢালাই থাকে যে স্পার্ক পেলেই আগুন ধরে যায়? শেষমেশ শশুরের সাথেও রাগারাগি করলে?”
শাহরিয়ার বিরক্ত হয়ে বললো,
“আরে সিচুয়েশনটাই এমন ছিলো। তাছাড়া উনার সাথে রাগারাগি হোক এমনটা আমি চাইনি। বয়সে এবং সম্পর্কে দুটোতেই উনি সম্মানের। এজন্যই গিল্ট ফিল হচ্ছে।”
“সবকিছু ঘেঁটে ঘ’ করে গিল্ট ফিল করে কী লাভ, শুনি?”
শাহরিয়ার বিরক্তিতে চ্চ’ করে উঠলো।
“এখন টিটকারিই মারবি, নাকি সলুশনও দিবি কিছু?”
“তুমি আবার আমার সলুশনের ধার ধারলে কবে থেকে, বলো তো? এককাজ করো, উনার কাছে অ্যাপোলোজাইস করে নেও।”
“পাগল? কালকে যে সীন হয়েছে এরপর উনার সামনে গেলেও আমার শরীর অবশ হয়ে যাবে অস্বস্তিতে!”
“তো আমার কাছে আর কোনো সমাধান নেই! যাও তো তুমি এখান থেকে। ভালো লাগছে না তোমাকে!”
তখনই শাহরিয়ারের ফোনে কল এলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে রাকিব লেখা।
“আচ্ছা, থাক তুই। গেলাম আমি!”
বলেই শাহরিয়ার সেখান থেকে সটকে পড়লো। নিজের রুমে এসে কল রিসিভ করে বললো,
“হ্যাঁ, বলো।”
“স্যার, মেডাম উনার আম্মুরে নিয়া বড় বাজারে আসছে। কীসব জানি কিনতাসে!”
শাহরিয়ারের ভ্রু কুঁচকে গেলো।
“কীসব কিনছে মানে? কী কিনছে?”
“ওইতো, মুদি দোকানের থেকে সদাই-পাতি কিনতাসে।”
শাহরিয়ার রেগে বললো,
“তাহলে সেটাই না বলবে! ইডিয়ট!”
ফোন কেটে দিলো শাহরিয়ার। জ্যোতির নাম্বারে ডায়াল করলো। তিন চারবার কল করার পরেও কেউ ধরলো না। মেজাজটাই খারাপ হচ্ছে তার! এই মেয়ের সাথে আসলেই কেউ বাস করার যোগ্য না!
রাকিবের নাম্বারে আবার ডায়াল করলো সে।
“হ্যাঁ স্যার, বলেন।”
“নজর রাখবে ওদের উপর। কোথায় যায় না যায় ইনফর্ম করবে। আর বাসায় পৌঁছানো অব্দি ফলো করবে। বাসায় গেলে আমাকে কল দিয়ে জানাবে সাথে সাথে।”
“আচ্ছা।”
_____________°___________
ঘরের কিছু টুকিটাকি জিনিসপত্র কেনার জন্য জ্যোতি বেরিয়েছে আম্মুর সাথে। গ্রোসারি সুপারশপে গিয়ে লিস্ট অনুযায়ী জিনিসপত্র কিনে বাইরে আসতেই একটা লোকের উপর চোখ পড়লো তার। জ্যোতির ভ্রু কুঁচকে উঠলো।
এই লোকটাকে বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ও তাদের বাসার একটু দূরের চা দোকানটায় দেখেছিলো সে। এখনও জ্যোতিদের দিকেই তাকিয়েছিলো। জ্যোতির নজর সেদিকে যেতেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
ফলো করছে নাকি? টেনশন ফিল করলো সে। দ্রুত আম্মুকে নিয়ে রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে গেলো৷ মাঝপথে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো লোকটাও তাদের পিছন পিছন সমান তালে আসছে।
ফলো যে করছে এটা নিশ্চিত হয়ে গেলো জ্যোতি।
তড়িঘড়ি করে একটা রিকশায় মাকে নিয়ে উঠে পড়লো সে। দ্রুত বাড়ির ঠিকানা দিয়ে কোনোরকম না থেমে যেতে বললো চালককে।
রত্না মেয়ের এমন আচরণে চোখ সরু করে তাকালেন।
“কী হয়েছে?”
“বাসায় গিয়ে বলছি।”
বাসায় ফিরে জ্যোতি মেইন গেইট আটকে দিলো তড়িঘড়ি করে। এদিকে রত্না মেয়ের আচরণে অবাক হচ্ছেন যারপরনাই।
“আম্মু কেউ একজন ফলো করছিলো আমাদের! আব্বুও ঘরে নেই। ভুলেও অপরিচিত কেউ এলে গেইট খুলবে না।”
মেয়ের ভয়ার্ত অভিব্যক্তি দেখে রত্নাও ভয় পেয়ে গেলেন।
জ্যোতি নিজের রুমে গিয়ে বোরকা খুলে ফ্যানের নিচে শুয়ে পড়লো। বাইরে প্রচুর রোদ, আর ভ্যাপসা গরম। অসহ্য লাগছে।
হঠাৎ ফোনের আওয়াজ পেলো। কিন্তু জ্যোতির একদম উঠতে ইচ্ছে করলো না। পড়ে রইলো একইভাবে। কে কল করেছে সেটাও দেখার চেষ্টা করলো না। অনেকক্ষণ বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যান শব্দ করে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেলো। পরক্ষণেই আবার শুরু হলো।
অসহ্য হয়ে জ্যোতি এবার উঠেই পড়লো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে স্ক্রিনে শাহরিয়ার নামটা দেখে বিরক্তি আরও বাড়লো।
কল রিসিভ করে পুনরায় বিছানায় শুনে ফোনটা কানে ঠেকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
” কী হয়েছে?”
শাহরিয়ারও সমানতালে ঝাঁজের সাথে বললো,
“কতবার কল দিয়েছি তোমায়? কল ধরো না কেনো?”
“বাইরে ছিলাম, ফোন নিয়ে যাইনি।”
“গ্রোসারি শপে গিয়েছিলে?”
জ্যোতির ভ্রু কুঁচকে গেলো।
“আপনি জানলেন কীভাবে?”
পরক্ষণেই বিদ্যুৎ গতিতে জ্যোতির মাথায় কথাটা খেলে গেলো।
“স্পাই লাগিয়েছেন আমার পিছনে?”
শাহরিয়ার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“নতুন জানো? শুরুতেই তো বলে দিয়েছি!”
“আপনি মানুষ? জানেন ওই গুন্ডামার্কা লোকটাকে দেখে আমি কত ভয় পেয়েছিলাম?”
“গুন্ডা? কে গুন্ডা?”
“আপনার স্পাই! লোক রেখেছেন পিছনে ভালো কথা, একটু ভদ্রগোছের কাউকে রাখতে পারলেন না?”
“তুমি দেখে ফেলেছো ওকে?”
“যে পিকুলিয়ার বেশভূষা ছিলো, অন্ধও না দেখে চিনে ফেলবে!”
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো শাহরিয়ারের। রাকিবকে বারবার করে বলে দিয়েছে কোনোক্রমেই যেন জ্যোতির চোখে না পড়ে। গর্দভটা সেটাও ঠিকঠাক ভাবে করতে পারলো না! রাকিবের ক্লাস তো সে পড়ে নিবে। এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তার।
“আসল কথায় আসো। তুমি আর বাইরে যাবে না। যা যা দরকার আমাকে ফোন করে জানাবে। আমি লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিবো।”
“কেনো? কেনো বাইরে যেতে পারবো না আমি?”
“আশ্চর্য! তোমার শরীরের কন্ডিশন জানো না তুমি?”
“শাহরিয়ার আমি প্রেগন্যান্ট, প্যারালাইজড না! আপনি কি মনে করেন দুনিয়ার সব অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা সারাদিন শুয়ে বসে কাটায়?”
“আমি আবার সেটা কখন বললাম! বাইরে ওয়েদার যেইরকম, এই অবস্থায় বের হলে যদি রাস্তায় ঘুরে পড়ে যাও তখন কী হবে? সেজন্যই মানা করেছি!”
জ্যোতির হঠাৎ রাগ ভুলে হাসি পেলো শাহরিয়ারের কথা শুনে। শাহরিয়ার তার জন্য এতোটা উদ্বিগ্ন হয়নি আগে কখনো। ভালোই লাগলো তার। পরক্ষণেই আবার ঝাঁজের সাথে বললো,
“তাহলে আপনাকে কেনো বলবো? আমার আব্বুর সামর্থ্য আছে আমাকে দরকারী জিনিসপত্র এনে দেওয়ার।”
শাহরিয়ার এবার ক্ষেপে বললো,
“জাস্ট শাট আপ! নিজের বউয়ের ভরণপোষণের তার বাপের উপর দিবো? আমাকে কি তোমার বোনলেস মনে হয়?”
“বোনলেস তো আপনি সত্যি সত্যিই। মনে করার কিছু নেই!”
“দেখো জ্যোতি, খোঁচা মেরে কথা বলবে না। এসব আমার সহ্য হয় না। আমাদের মধ্যে যা কিছুই হয়ে যাক না কেনো, উই আর স্টিল হাসবেন্ড ওয়াইফ। পরে কী হবে না হবে সেটা পরে দেখা যাবে। নিজের দায়িত্ব পালন করছি, তোমার উপর দয়া দেখাচ্ছি না কোনো!”
“দায়িত্ব তো আপনার আরও অনেক কিছু ছিলো। সেসবের বেলায় তো নির্বিকার ছিলেন। আর আপনার মধ্যে যে দয়ামায়ার ছিটেফোঁটাও নেই সেটা আবার জানি না আমি?”
শাহরিয়ার পাল্টা শাসিয়ে কিছু বলতে চাইলেও আঁটকে গেলো। মেজাজ খারাপ করা যাবে না। জ্যোতি ইচ্ছে করে তাকে রাগাচ্ছে। নিজেকে শান্ত করে বললো,
“বাবার বাসায় গিয়ে তোমার মুখে খই ফুটেছে। ওয়েল, আমারও সমস্যা নেই। করো বারগেনিং যত মন চায়! তোমার সাথে অন্য কথা বলার আছে।”
জ্যোতি চুপ করে থাকে।
শাহরিয়ার বলে,
“ইয়ে….আঙ্কেল এসেছিলেন গতকাল আমার অফিসে।”
জ্যোতি ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে।
“আব্বু?”
“হুম।”
জ্যোতি উত্তেজিত হয়ে বললো,
“কী কথা হয়েছে আপনাদের? আব্বুকে কী বলেছিলেন আপনি? কালকে সারাদিন এজন্যই আব্বুর মেজাজ এমন ছিলো!”
“তোমাদের বাবা মেয়ের কি আমাকে ব্লেইম করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই?”
“আপনি অনেক ভদ্র মানুষ তো তাই ব্লেইম করা লাগে!”
জ্যোতির কথায় পাত্তা দিলো না শাহরিয়ার।
“ক্যাজুয়াল কথাবার্তা হয়েছে। আসলে….একটু রাগারাগি হয়েছিলো বলতে গেলে। আঙ্কেল রাগ করে চলে গিয়েছিলেন অফিস থেকে!”
“মানে! কী নিয়ে রাগারাগি হয়েছিলো?”
শাহরিয়ার হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো,
“সব নষ্টের গোড়া তুমি! আগে আমার মাথা খেতে, এখন নিজের বাবার মাথাও খাচ্ছো!”
জ্যোতি হতভম্ব হয়ে গেলো৷
“আচ্ছা শুনো, আমি আসলে রাগারাগি করতে চাইনি আঙ্কেলের সাথে। অনিচ্ছাকৃত ভাবে হয়েছে। তুমি আঙ্কেলকে আমার তরফ থেকে স্যরি বলে দিও।”
জ্যোতি মেজাজ তেতে উঠলো মুহুর্তেই। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“কেনো? ভুল করেছেন আপনি, ক্ষমাও আপনি নিজের মুখে চাইবেন। আমাকে via(মাধ্যম) কেনো বানাতে চাইছেন? কী নিয়ে, কোন পর্যায়ে রাগারাগি হয়েছে সেটা কি আমি দেখেছি?”
“তুমি তোমার বাবার বাসায় আছো, এজন্যই বলছি। আঙ্কেল মনে হয় না আমার ফোন ধরবে!”
জ্যোতি রেগেমেগে বললো,
“শাহরিয়ার, ডু ইউ নো ইউ আর আ মেন্টালি সিক পার্সন?”
শাহরিয়ার হতভম্ব হয়ে বললো,
“তুমি আমাকে পাগল বলছো?”
কথার মাঝখানেই জ্যোতি ফোন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে।
শাহরিয়ার অবাক হয়ে ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
“বেয়াদব! গুরুজনদের কথা শোনে না! গুণে গুণে আট বছরের বড় হই আমি এই মেয়ের!”
#চলবে………….