ঔজ্জ্বল্যের আলোক প্রহর পর্ব-০৬

0
1

#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর

#পর্বঃ৬

#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম

জ্যোতির পেটে একগাদা চিপচিপে ধরনের নীলচে ঠান্ডা জেল দিয়ে ট্রান্সডুসার নাড়াচাড়া করছে একজন মহিলা সনোগ্রাফার, সামনের মনিটরে মানব-ভ্রূণের সাদাকালো হালকা অবয়ব দৃশ্যমান হচ্ছে।

সাথেই রত্না বসে আছে।
হঠাৎ-ই কেবিনে হুড়মুড় করে কেউ একজন ঢুকলো।

“এই, এই এখানে হচ্ছে কী!”

সবাই বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে দেখলো শাহরিয়ারকে।
রাগে মুখের অবয়ব অদ্ভুত হয়ে আছে তার।
পিছন পিছন দরজায় থাকা মেয়েটাও ঢুকে কাচুমাচু হয়ে বলে,

“ম্যাম, আটকাতে চেয়েছি, কিন্তু সবাইকে একপ্রকার ধাক্কিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছে।”

শাহরিয়ার ক্রুদ্ধ হয়ে বললো,

“এবর্শন করানোর জন্য এসেছো তাই না? এই আপনি, (আল্ট্রা করা মহিলার দিকে তাকিয়ে) আপনি কীভাবে সায় দিচ্ছেন এটায়, হ্যাঁ? মামলা করবো আমি! আপনাদের সবার নামে মামলা করবো! এই হাসপাতাল একেবারে বন্ধ করে দিবো!”

একদমে উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগলো শাহরিয়ার।

মহিলার নাম রেবেকা। তিনি হতভম্ব হয়ে একবার জ্যোতিদের, একবার শাহরিয়ারকে দেখছেন।

জ্যোতি অপ্রস্তুত হয়ে শুষ্ক কন্ঠে মিনমিন করে বললো,

“বাচ্চার বাবা!”

রেবেকার রাগার কথা থাকলেও তার ভীষণ হাসি পেলো পাগলাটে ধরনের এই পুরুষটির আচরণে।

“আপনি প্লিজ শান্ত হোন মিস্টার…. ”

“শাহবাজ! শাহরিয়ার শাহবাজ।”

“মিস্টার শাহবাজ, আপনি শান্ত হোন। এখানে কে এবর্শন করাচ্ছে? এখানে তো আল্ট্রা করানো হচ্ছে বাচ্চার কন্ডিশন দেখার জন্য। ঐযে মনিটরে তাকান, আপনাদের বাচ্চাকে দেখা যাচ্ছে। হার্টবিট শুনবেন বাচ্চার?”

শাহরিয়ার মনিটরে তাকালো৷ মুহুর্তেই যেন সে একেবারে শীতল হয়ে গেলো। নিজেকে ভার শূন্য লাগছে তার। ঐযে, মনিটরে আবছা ছোট কিছু একটা দেখা যাচ্ছে, ওটা তার সন্তান? সত্যি?

ভীষণ বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে গেলো শাহরিয়ার মনিটরের দিকে। স্ক্রিনে আলতো করে হাত রাখলো, যেনো অনুভব করতে চাইছে তার সন্তানকে।

রেবেকা আবার বললেন,

“হার্টবিট শুনবেন বাবুর?”

শাহবাজ মাথা ঝাকিয়ে সায় জানায় দ্রুত শিশুদের মতো। রেবেকা লোকটার অভিব্যক্তি দেখে ঠোঁট চেপে হাসি আটকায়। তারপর ফিটাল ডপলার এগিয়ে দেয় শাহরিয়ারের দিকে। শাহরিয়ার সেটা নিয়ে কানের কাছে ধরে। ভিতর থেকে একটু ছন্দ ভেসে আসছে। শাহরিয়ার যেন অন্য জগতে চলে যায় শুনতে শুনতে। যতই শোনে, মন ভরে না কিছুতেই।

“শুনতে পেরেছেন?”

শাহরিয়ারের সম্বিৎ ফিরে আসে।

“জ্ব-জ্বি!”
পরক্ষণেই উত্তেজিত হয়ে হড়বড় করে বলে,

“ডাক্তার, ওকে বিশ্বাস করবেন না। ও তো বাচ্চাটা রাখতেই চাচ্ছে না। ও এবর্শন করতে বললে যদি……”

“রিল্যাক্স মিস্টার শাহবাজ, রিল্যাক্স!”
রেবেকা মাঝ পথে থামিয়ে দেয় শাহরিয়ারকে।
“আপনার ওয়াইফ প্রায় চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই সময় এবর্শন করায়ও না কেউ সিরিয়াস কন্ডিশন ছাড়া, পুরোপুরি রিস্কি। সবচেয়ে বড় কথা, আপনার ওয়াইফের এই রকম কোনো ইন্টেনশন নেই। আপনি রিল্যাক্স হোন।”

শাহরিয়ার যেন একটু শান্ত হলো। পরক্ষণেই জলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো জ্যোতির দিকে। জ্যোতিও পুরোটা সময় ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ষণ কয়েক পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইলো তারা পরস্পরের দিকে। প্রথমে শাহরিয়ারই চোখ ফিরিয়ে নিলো, সাময়িক অবসান ঘটলো তাদের নীরব স্নায়ু যুদ্ধের।

________________°_______________

“হাসবেন্ড তোমার অনেক কেয়ার করে, তাই না?”

টিস্যু দিয়ে উদরে থাকা থকথকে পদার্থগুলো মুছতে মুছতে প্রশ্ন করলো রেবেকা।

“বাচ্চার।”

ছোট্ট করে উত্তর দিলো জ্যোতি।

রেবেকা ভ্রু কুঁচকে বললো,

“তোমার করে না? না করলে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে আসতো?”

জ্যোতি চোয়াল শক্ত করে বললো,

“তাদের পরোয়া শুধু বাচ্চাকে নিয়েই, বাকি সব যাক উচ্ছন্নে, তাদের কিচ্ছু যায় আসে না।”

রেবেকা আর প্রশ্ন করলেন না। জ্যোতির মনস্তাপ কিছুটা অনুভব করতে পারছেন তিনি।

_____________

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে দেখলো শাহরিয়ার গাড়ির নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে আছে। জ্যোতি সেটা দেখেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রত্মাকে নিয়ে দাঁড়ালো রাস্তার পাশে সিএনজির জন্য।
শাহরিয়ার মেজাজ খারাপ করে হর্ণ বাজাতে লাগলো লাগাতার। আশেপাশের মানুষ তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।

জ্যোতি দাঁত কিড়মিড় করে বললো,

“আম্মু, তাকে গিয়ে বলো নাটক না করে চলে যেতে, যাও! কুইক!”

রত্মা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন গাড়ির কাছে৷ গাড়ির জানালায় উঁকি দিয়ে বললো,

“এরকম করছো কেনো? এটা হাসপাতাল না? এখানে রোগীরা আসে। তাদের সমস্যা হবে।”

“আপনার মেয়েকে বলেন কোনো নাটক না করে চুপচাপ আপনিসহ গাড়িতে উঠতে। বাসা অবধি আমি নামিয়ে দিবো।”

রত্মা পড়লেন ফ্যাসাদে। বিভ্রান্ত হয়ে বললেন,

“ও তো উল্টো তোমাকে বলেছে নাটক না করে ফেরত যেতে। এখন কী করবো আমি?”

শাহরিয়ার মেজাজ খারাপ করে বললো,

“আন্টি, ওকে বলুন চুপচাপ গাড়িতে উঠতে। আমি এখানে কোনো তামাশা করতে চাইছি না। কিন্তু ও যদি চায় তাহলে বড় রকমের তামাশা করতেও আমার গায়ে বাঁধবে না!”

রত্না ফোস করে নিশ্বাস ছাড়লেন। এ দুটোর নাটক শেষ হবে কবে? কেউ কারো চেয়ে কম না!

দ্রুত মেয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

“চুপচাপ গাড়িতে উঠ। নয়তো বড় রকমের তামাশা হবে। তোর তামাশা মজা লাগলেও আমার লাগবে না।”

বলেই জ্যোতির হাত টেনে হরহর করে গাড়ির কাছে নিয়ে এলেন। জ্যোতি ফোঁসফোঁস করে বললো,

“সীন ক্রিয়েট ছাড়া জীবনে পারে কী!”

রত্না চোখ গরম করে তাকালেন মেয়ের দিকে। জ্যোতি চুপ করে গেলো।
রত্না গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে মেয়েকে ধরে গাড়িতে বসাতে গেলেন এমন সময় শাহরিয়ার বললো,

“ওকে সামনের সীটে বসতে বলুন।”

জ্যোতি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,

“আমি বসবো না ওখানে!”

“তোমার কি আমাকে ড্রাইভার মনে হচ্ছে?”

“নিজেই তো শখ ড্রাইভ করে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, ড্রাইভার মনে হবে না তো কী মনে হবে?”

“আমাকে রাগাবে না বলে দিচ্ছি! ভালোয় ভালোয় আমার পাশের সীটে বসো।”

“আপনার তো চাঁদীতে সবসময় রাগ উঠেই থাকে, নতুন করে রাগানোর কী আছে?”

“আচ্ছা অসভ্য হয়েছো তো তুমি!”

“আপনি–”

এই পর্যায়ে রত্না ধমকে উঠলেন,

“জ্যোতি! চুপচাপ সামনের সীটে গিয়ে বস!”

মায়ের ধমক খেয়ে থমকে জ্যোতি তাকালো রত্মার দিকে। মা-ও দিন দিন তার সাথে বেইমানি করছে! মানা যায় এসব!

রেগে তাকালো শাহরিয়ারের দিকে। শাহরিয়ার ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলো, ঠোঁটে তার বিজয়ের আভাস। রাগে পিত্তি জ্বলে গেলো জ্যোতির। গজগজ করতে গাড়ির দরজা খুলে ভিতর বসে ঠাস করে আটকে দিলো।

“আস্তে! দরজার কিছু হলে তোমাকে দিয়ে ঠিক করাবো!”

জ্যোতি জলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো শাহরিয়ারের কথা শুনে। অভদ্রলোকটা দরজার চিন্তা করছে!

রত্না পিছনে বসে গজগজ করতে লাগলেন,

“রাস্তাঘাটেও নিস্তার নেই! যেখানে সেখানে যখন-তখন শুধু ঝগড়া আর ঝগড়া! মাঝে মধ্যে মন চায় দুটোর মাথা ঠুকে দিই, এতে যদি মগজ জায়গা মতো আসে!”

এক মনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে শাহরিয়ার। জ্যোতিও নিরবে বাইরে তাকিয়ে আছে। শাহরিয়ার এক ফাঁকে রিয়ারভিউ মিররটা একটু নেড়েচেড়ে দিলো। জ্যোতিকে দেখা যাচ্ছে এখন মিররে ঠিকঠাক।
শাহরিয়ার আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে মিররের দিকে। এক সময় নিস্তব্ধতা ভেঙে বললো,

“আমাকে ফোন করে জানিয়ে দিলেই তো হতো। এরকম কাহিনিও হতো না।”

জ্যোতি যেন অপেক্ষাতেই ছিলো এমন কিছুর। রাগে হিসহিসিয়ে বললো,

“আপনার ফোন করে জেনে নেওয়ার ইচ্ছে হলো না একবারও?”

“আমাকে না বললে আমি কীভাবে জানবো তুমি হুট করে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছো?”

“ঠিকই তো, জানবেন কীভাবে! মেয়েরা এই অবস্থায় ডাক্তার দেখায় হাসবেন্ডকে নিয়ে। আমার তো সেটা হচ্ছে না। আপনার না জানারই কথা!”

শাহরিয়ার গম্ভীর হয়ে গেলো। চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে লাগলো।

___________________°________________

বাসার কাছাকাছি এসে শাহরিয়ারের গাড়ি থামলো। জ্যোতি ভীষণ হন্তদন্ত হয়ে নামলো গাড়ি থেকে। তীর্যক দৃষ্টিতে সেটা দেখে শাহরিয়ার ধমকে বললো,

“আস্তেধীরে নামো। এতো তাড়াহুড়ো করছো কেনো?”

জ্যোতি পাত্তাই দিলো না। রত্না বের হওয়ার আগেই গেইটে জোরে জোরে নক করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গেইট খুলে দেওয়া হলো। নওশাদ খুলেছে গেইট।
গেইটটা একটু উঁচু। ভিতরে প্রবেশ করতে উঁচু বাঁধের মতো অংশটুকু প্রবেশ একটু সাবধানে করা লাগে। জ্যোতি ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলে সেইসময় আচমকাই নওশাদ জ্যোতির হাত ধরে, একটু টেনে জ্যোতিকে ভিতরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। ঘটনার আকস্মিকতায় জ্যোতি নিজেও হতভম্ব হয়েছে। দ্রুত নওশাদের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে ভিতরে চলে গেলো।

শাহরিয়ার গাড়িতে বসে পুরো দৃশ্যটাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলো।
কে এই ছেলেটা? জ্যোতিদের বাড়িতে কী করছে? ছেলেটার এতো অতি উৎসাহী হয়ে জ্যোতির হাত ধরাটা ভালো লাগলো না তার।

____________________°_________________

“এইতো আছে সবাই ভালো। তোদের ওখানের কী অবস্থা? সবাই ভালো আছে?”

“——-”

অরোরা মায়ের রুমের দোরগোড়ায় আসতেই দেখতে পায় ফারিয়া কারো সাথে কথা বলছেন। ছোট খালার সাথে কথা বলছেন বুঝতে পেরে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ নিজের নাম শুনতে পেয়ে থমকে যায়। দ্রুত দরজার থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ে কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করে কথাগুলো।

“অরুর বিয়ের কথা তো আমিও ভাবছি। কিন্তু শাহরিয়ারের ঝামেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বিষয়টা ধরতে ইচ্ছে করছে না।”

“——–”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, ডিভোর্স-ই হবে, এটা ফাইনাল। শাহরিয়ারের ঝামেলা শেষ হোক, তারপর দেখবো অরুর বিষয়টা।”

“——-”

“মাহমুদ?”

ফারিয়ার মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো অকস্মাৎ। একটু চিন্তা করে বললেন,

“শাহরিয়ারের বাবা তো এখনো লন্ডনে। আসুক, তখন কথা পেরে দেখবোক্ষণ।”

অরোরার কপালে চিন্তার রেখা পড়লো। উদ্বিগ্নতার আভাস স্পষ্ট চেহারায় ফুটে উঠেছে। অরোরা একছুটে সেখান থেকে চলে গেলো। তার দুশ্চিন্তা তরতর করে বাড়ছে।

#চলবে……….