#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ১২
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
জ্যোতির ডেলিভারির ডেট একদম কাছিয়ে এসেছে। যেকোনো সময় তার প্রসব যন্ত্রণা উঠতে পারে। রত্না যত্নের কমতি করছেন না মেয়ের। দিনরাত সবসময় খেয়াল রাখছেন। মাহিরা এখন শাহরিয়ারদের বাসাতেই আছে। তাই মাঝেমধ্যেই এসে জ্যোতিকে দেখে যায়। মুক্তাও এসেছেন গতকাল বোন এবং ভাগ্নীকে সাহায্য করার জন্য। বলাই বাহুল্য নওশাদও এসেছে সাথে।
রত্না ব্যাপারটায় একটু খুশিই হয়েছেন। হামজা সাহেব সারাদিন বাসায় থাকেন না। শাহরিয়ার দূর থেকে যতটা সম্ভব খেয়াল রাখে, কিন্তু তারপরও ঘরে একজন পুরুষ মানুষ থাকা লাগে, কখন না কখন কোন দরকার হয়।
এতোসবের ভিড়ে জ্যোতির অস্থিরতা অনেক বেড়েছে। শরীর ও মনের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমও হয়না তার। কত শত চিন্তা যে মস্তিষ্কে ঘুরাফেরা করে!
________________
নিশুতিরাত। চারদিকে শুনশান নীরবতা। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় কয়েকটা কুকুর টহল দিচ্ছে পাহারাদারের ভঙ্গিতে। সময় ঘড়ির কাঁটায় বারোটার কিছু বেশি।
জ্যোতির নিদ্রাহীন চোখ সবে লেগে এসেছে। পাশেই সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত রত্না ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ আচমকাই জ্যোতি তন্দ্রা বিচ্ছিন্ন হলো। কী যেন একটা বেঠিক লাগলো তার কাছে, কিছু একটা ঠিক নেই! চমকে লক্ষ্য করলো তার অপরিসীম যন্ত্রণা হচ্ছে। কোমরের নিচের অংশও ভিজে ভিজে লাগছে। চমকের ধাক্কা কাটতেই ব্যথার তরঙ্গ খেলে গেলো মস্তিষ্কে, যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হলো জ্যোতির সর্বাঙ্গ। বিষয়টা ধরতে জ্যোতির কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠে উচ্চ শব্দে ডাকলো,
“আম্মুহ!”
রত্না যেন নিদ্রা এবং জাগরণ উভয় জগতের মাঝামাঝিতেই দোদুল্যমান ছিলেন। কন্যার তীব্র কন্ঠ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তিনি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন।
জ্যোতি চোখ মুখ যন্ত্রণায় কুঁচকে আর্তনাদ করে উঠলো,
“আম্মুহ! সময় হয়ে গেছে মনে হচ্ছে!”
দিশেহারা রত্না দৌড়ে রুম হতে বেড়িয়ে গেলেন বাকিদের জাগাতে………..
___________________
ডেলিভারি রুমের সামনে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে। শাহরিয়ার অস্থির হয়ে পায়চারি করছে আর ক্ষণে ক্ষণে দরজার দিকে তাকাচ্ছে আতংক নিয়ে। চুলগুলো এখনো উসকোখুসকো। অবচেতন মনে অনভ্যস্ত হাতে কয়েকবার আঙুল চালালো সেগুলোকে বাধ্য করার দায়ে, কিন্তু লাভ হলো না খুব একটা।
রুমের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে রত্না, মুক্তা এবং হামজা বসে আছেন। তাদের বরাবর দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নওশাদ, ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মুখের সামনে ধরে হাতুড়ির মতো করে ঠোঁটে থেমে থেমে মৃদু আঘাত করছে উদ্বিগ্ন হয়ে। তার পাশে থাকা বেঞ্চে মাহিরা বসে আছে, থেমে থেমে পা নাড়াচ্ছে। সকলের চোখে মুখেই নিদারুণ দুশ্চিন্তার ছাপ।
রত্না ঘরের সবাইকে ডেকে তড়িঘড়ি করে শাহরিয়ারকে ফোন করেছিলো তখন। এতো রাতে বাইরে গাড়িও পাওয়া যাবে না। শাহরিয়ারও বলে দিয়েছে যত রাতই হোক তাকে যেন খবর দিতে এক মিনিটও দেরি না করা হয়।
শাহরিয়ারকে ফোন দিতেই কিছু সময়ের মধ্যে শাহরিয়ার গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছে উদ্ভ্রান্তের মতো।
তারপর সবাই মিলে ধরাধরি করে জ্যোতিকে উঠিয়ে রওনা হয়েছে সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
জ্যোতিকে হাসপাতালে আনা হয়েছে প্রায় ছয় ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে। আসার পর তাকে লেবার রুমে শিফট করা হয়েছে। এইতো কিছুক্ষণ আগেই ওকে ডেলিভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রতিটি মিনিট যাচ্ছে আর প্রত্যেকের স্নায়ুর চাপ যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সবাই বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে দুশ্চিন্তা নিয়ে।
আরো কিছুক্ষণের মধ্যেই সোহাইল, ফারিয়া, অরোরা হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হলেন হাসপাতালে। মোদ্দা কথা কেবিনের সামনে আর কারো উপস্থিত হওয়া বাকি রইলো না।
শাহরিয়ার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সবাই ঘুমে ছিলো, সেও কাউকে জাগানোর পিছনে সময় নষ্ট না করে হন্তদন্ত হয়ে চলে এসেছে। হাসপাতালে পৌঁছে দৌড়াদৌড়িতে অনেকক্ষণ মনেই ছিলো না বাসায় খবর দেওয়ার কথা। শেষে হামজা সাহেব জিজ্ঞেস করাতে মনে পড়েছে। তৎক্ষনাৎ বাসায় ফোন করে জানিয়েছে এদিকের অবস্থা। ফোন পেয়ে সবাই তখনই আসার জন্য উতলা হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু শাহরিয়ার বাঁধা দিয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে ফার্স্ট বেবি, তাই সময় লাগবে। আপাতত কারো আসা লাগবে না, এদিকটা সে ম্যানেজ করে নিচ্ছে। জ্যোতিকে ডেলিভারি রুমে শিফট করলে তখন সে ফোন করে তাদেরকে আসতে বলবে।
কিন্তু মাহিরা ভাইয়ের এতো জ্ঞানের তোয়াক্কা বেশিক্ষণ করতে না পেরে দুই ঘন্টা পরেই হাজির হয়ে গেছে। বাকিরা শাহরিয়ারের ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলো।
ঘন্টাখানেক পর কেবিনের দরজা খুলে একজন নার্স বেরিয়ে এলো। হাসিমুখে জানালো,
“ছেলে হয়েছে। মা এবং বাচ্চা দুজনেই ঠিক আছে।”
সকলের জানে যেন এতক্ষণে পানি এলো। খুশিতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাতে লাগলো সবাই।
শাহরিয়ারের শরীর যেন এতক্ষণে একদম ছেড়ে দিয়েছে। এতক্ষণ টানটান হয়ে থাকা স্নায়ুগুলোও যেন শিথিল হলো মূহুর্তেই। নিজেকে একেবারে ভারশূণ্য বোধ হলো তার। জ্যোতির যন্ত্রণাকাতর মুখটা এতোটা সময় ধরে বারবার বুকে ছুরির ফলার মতো গেঁথে যাচ্ছিলো, কানে বাজছিল ওর কাতর চিৎকার। এতোটা সময় যেন নিজের মধ্যেই ছিলো না সে। অতঃপর এই সংবাদ যেন মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতো শীতলা ছড়িয়ে দিলো তার সর্বত্র।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকজন নার্স তোয়ালে প্যাঁচানো কিছু একটা শাহরিয়ারের কোলে ধরিয়ে দিলো মিটিমিটি হেসে। শাহরিয়ার বিস্ময় নিয়ে দেখলো একটা পুতুল চোখ মুখ কুঁচকে নড়াচড়া করছে সেখানে। হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক যেন একেবারে মোমের পুতুল! হতবাক হয়ে শাহরিয়ার চেয়ে রইলো পুতুলটার দিকে। তার কাছে এখনও সবকিছু স্বপ্নের মতোই লাগছে!
খুব ভয়ে ভয়ে শাহরিয়ার পুতুলটার একটা তুলতুলে হাতে নিজের আঙুল ছোঁয়ালো, যেন ছোঁয়া লাগলেই সেটি গলে যাবে!
এই পুতুলটা তার সন্তান?
শাহরিয়ারের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো মূহুর্তেই। হুট করেই করে কেঁদে উঠে চুমু খেলো ছোট্ট পুতুলটার চোখে, কপালে, গালে।
ততক্ষণে সবাই ঘিরে ধরেছে বড় শাহরিয়ার এবং ছোট শাহরিয়ারকে। বিস্ময়, আনন্দের এক মিশ্র অনুভূতির উচ্ছ্বাস নিয়ে দেখছে ছোট্ট নাজুক প্রাণটাকে।
নার্স সাবধান করে দিলো বাচ্চাকে অপরিষ্কার হাতে না ছুঁতে। হাতে জীবাণু থাকলে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।
কিছুক্ষণ পর শাহরিয়ার ভ্রম কাটলো, ধাতস্থ হয়ে দ্রুত আজান দিলো বাচ্চার কানে। তারপর বাড়িয়ে দিলো সামনে জ্বলজ্বলে মুখে দাঁড়িয়ে থাকা হামজা সাহেবের দিকে।
__________________°_________________
শাহরিয়ার কেবিনে ঢুকে দেখলো জ্যোতি নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে বেডে। পাণ্ডুর চেহারাটা দেখে শাহরিয়ারের পৃথিবী যেন এক পলকের দুলে উঠলো! মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে একদম সাদা দেখাচ্ছে। খুব ক্ষীণ ভাবে ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা।
চোখ হালকা খুলে শাহরিয়ারকে দেখে ফ্যাকাসে এক হাসি দিলো জ্যোতি। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো শাহরিয়ারের কোলে থাকা তোয়ালে জড়ানো তীব্র আকাঙ্খিত সদস্যের দিকে।
শাহরিয়ার এগিয়ে একদম নিকটে এসে দাঁড়ালো মেয়েটার, একটা হাসি দিয়ে তাকালো স্ত্রীর দিকে, অথচ চোখে তার ব্যথা। স্ত্রীর কষ্ট কল্পনা করেই তার ভিতর খুশিতে ভাটা পড়ছে। বারবার মনে হচ্ছে সে যদি পারতো এই কষ্টের ভাগ নিতে! যদি পারতো!
জ্যোতি ইশারায় বাচ্চাটাকে নিজের কাছে চাইতেই শাহরিয়ার আলতোভাবে ভীষণ সাবধানে শিশুটিকে জ্যোতির বাহুতে দিলো। জ্যোতি কেমন মায়াভরা চাহুনি মেলে দেখতে লাগলো শিশুটিকে। এই ছোট্ট পুতুলটার জন্যই তো জ্যোতির এতোদিনের কষ্ট! অথচ এই মুখটা দেখে সেসব কষ্টের ক্ষণগুলো যেন মূহুর্তেই কর্পূরের মতো উবে গেলো! এতো সুখী নিজেকে ইতোপূর্বে আর কখনো মনে হয়নি তার। মাতৃত্ব বুঝি এতো স্নিগ্ধ হয়?
“কী তুলতুলে, তাই না?”
জ্যোতি বাচ্চার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে প্রশ্ন করে।
“হুম, ঠিক যেন হাওয়াই মিঠাই, ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলি!”
জ্যোতি উচ্চ শব্দে হেসে ফেলে শাহরিয়ারের কথা শুনে। লোকটার মাথা গেছে খুশিতে! কী বলতে কী বলছে!
“কী নাম রাখা যায় ওর?”
“তুমি ঠিক করেছো কোনোটা?”
“উহু।”
“জুবায়ের রাখলে কেমন হয়?”
জ্যোতি মুখ তুলে তাকালো শাহরিয়ারের মুখপানে। একটা স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে বললো,
“সুন্দর তো! রাখা যায়, কী বলেন?”
________________°_______________
গতকাল ছেলের আকিকা করা হয়েছে, নাম রাখা হয়েছে জুবায়ের শাহবাজ শাফি, বেশ বড়সড় ভারিক্কি একটা নাম।
নাম নিয়েও ফারিয়ার সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে। উনি চাইছিলেন নাম সাফোয়ান রাখতে, কিন্তু বিরোধ করে বসে স্বয়ং শাহরিয়ার। অবশেষে নামের শেষে শাফি লাগিয়ে মধ্যস্থতা করা হয়। কিন্তু ফারিয়া সেই অসন্তুষ্টই রয়ে গেলেন।
শাহরিয়াররা প্রতিদিনই আসে জুবায়েরের সাথে দেখা করতে। জ্যোতির পরিবারও বাঁধা দেয় না, হাজার হোক তাদের অধিকার আছে। নিজেদের রেষারেষিতে আরেকজনের উপর তো জুলুম করা যায় না।
শাহরিয়ার যতটা সময় ছেলের সংস্পর্শে থাকে ততটা সময় ভীষণ প্রাণবন্ত থাকে। নিজের জীবনের মানে যেন শাহরিয়ার নতুন করেই খুঁজে পেয়েছে, পরিবার জিনিসটাও নতুন ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে।
জ্যোতি শাহরিয়ারের এই উচ্ছ্বাস দেখে আনমনে, ঠোঁটে থাকে মৃদু হাসি। কিন্তু অজানা আশংকাও দানা বাঁধে তার মনে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে…….
যদি তার থেকে কেড়ে নেওয়া হয় তার সন্তানকে? এমনটা সে হতেই দিবে না! কেউ এমনটা ঘটাতে চাইলে জ্যোতি কাউকেই ছাড়বে না!
দেড়মাস পরঃ
~~~~~~~~~~
জ্যোতি চুপচাপ নিজের কোলে ছেলের ঘুমন্ত মুখটা দেখছে। এখন জ্যোতির জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সত্ত্বা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ছেলে।
আপনমনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছেলেকে দেখছে সে।
আগাগোড়া পুরো বাপের মতো হয়েছে। চোখজোড়া পর্যন্ত বাবার পেয়েছে। পাওয়ার মধ্যে হয়তো গায়ের রঙটা পেতে পারে মায়ের, অবশ্য এটাও নিশ্চিত না। বাচ্চার গায়ের রঙ এতো দ্রুত বুঝা যায় না। বড় হতে হতে অনেক পরিবর্তন আসে।
এই জিনিসটাই জ্যোতির ভিতরে ঈর্ষা তৈরি করছে। দশমাস দশদিন গর্ভে রাখলো সে, আর ছেলে বাপের কপি হয়ে বসে আছে! মানা যায় এসব?
জ্যোতি গাঢ় চুম্বন করলো ছেলের কপালে। নিজের সাথে আরো ভালো করে জড়িয়ে ধরলো, যেন বাঁধন আলগা হলেই উধাও হয়ে যাবে।
জ্যোতি ছেলেকে হালকা দোল দিতে দিতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো।
শাহরিয়ারকে খুলার নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছে আজকে সে। আইনি বিষয়গুলো নিয়ে হামজা সাহেবই দৌড়াদৌড়ি করছেন। আইনজীবী ধরা, কাগজপত্রের ঝামেলা সব আব্বুই করছে।
বিষয়টা এতেদূর গড়াতো না, কিন্তু ফারিয়ার হঠকারিতায় এমনটা হয়েছে।
শুরু থেকেই উনি চাপ দিচ্ছিলেন জুবায়েরকে দিয়ে দেওয়ার জন্য। শাহরিয়ার নিজে তাকে বুঝিয়ে থামিয়ে রাখতে চেয়েছে, বারবার বলেছে জল ঘোলা না করার জন্য।
কিন্তু উনি সেটা শুনলেন না, শাহরিয়ারকে না জানিয়ে নিজে ফোন করে হামজা সাহেবকে এটা নিয়ে যা পেরেছেন তাই বলেছেন। সব কথার শেষ কথা হিসেবে উনি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন জ্যোতিকে উনারা নিবেনা না, তাদের শুধু বাচ্চা চাই, ব্যস! জুবায়েরকে যেনো ভালোয় ভালোয় তাদের কাছে হস্তান্তর করে দেওয়া হয়। নয়তো উনি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবেন।
ব্যস! এরপর যা হওয়ার তাই হলো। এমনিতেই হামজা সাহেব বিষয়গুলো নিয়ে আগে থেকেই ক্ষ্যাপা ছিলেন, তাও যা-ওবা উনার ক্ষোভে ভাটা পড়তে শুরু করেছিলো ফারিয়ার হঠকারিতায় যেন সে ক্ষোভের নিভু নিভু আগুন হাওয়া পেয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো।
“ঘুমিয়ে গেছে তো, বিছানায় শুইয়ে দে।”
রত্নার উপস্থিতিতে জ্যোতির ধ্যান ভাঙলো।
“অ্যাঁ? হ্যাঁ, দিচ্ছি।”
রত্না সরিষার দানার তৈরি বালিশ বানিয়েছেন নাতির জন্য। এতে নাকি মাথার গঠন ঠিক থাকে। রত্না শোয়ার জায়গা গুছিয়ে দিলে জ্যোতি আস্তেধীরে জুবায়েরকে শুইয়ে দেয়।
এমন সময় জ্যোতির ফোন কর্কশ শব্দে বেজে উঠে। রত্না হন্তদন্ত হয়ে ফোন এগিয়ে দেয় মেয়ের দিকে, পাছে জুবায়েরের ঘুম ভেঙে যায়।
জ্যোতি স্ক্রিনে নামটা দেখেও রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে উত্তপ্ত গলার স্বর ভেসে এলো,
“তুমি খুলার নোটিশ পাঠিয়েছো?”
জ্যোতি নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, এবার আপনিও কোনো ভণিতা না করে ঠিকঠাক সাইন করে দিন।”
শাহরিয়ার অবাক স্বরে ডেকে ওঠে,
“জ্যোতি!!”
“কিছু বলতে চাইছেন?”
“তুমি শিওর?”
“শিওর না হলে নোটিশ নিশ্চয়ই পাঠাতাম না?”
“তুমি পাগল হয়ে গেছো! বিষয়টা তো অন্য ভাবেও সমাধান করা যায়, তাই না?”
জ্যোতি একঝলক ঘুমন্ত জুবায়েরকে দেখে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে সরে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। কথার শব্দে জেগে ওঠতে পারে ছেলেটা। রত্না কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
“দুনিয়ার সবাই পাগল, আপনি একা সুস্থ মানুষ! ভুল বললাম, আপনার পরিবারের সবাই সুস্থ, খালি আমি, আমার আব্বু-আম্মু, আমার পরিবারই অসুস্থ, পাগল, তাই না?”
শাহরিয়ার গলার স্বর ভীষণ নরম করে বললো,
“আমি এটা কখন বললাম? জ্যোতি, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো৷ ডিভোর্স কোনো ছেলেখেলা নয় যে মন চাইলো, করলাম!”
জ্যোতি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“আপনার কী হয়েছে, সেটা বলুন তো? আপনি নিজে আমাকে বলেননি আমার যা মন চায় আমি যেন তা করি? আপনার কিছুই যায় আসে না, আপনার শুধু বাচ্চাই মেইন? বাচ্চা হওয়ার পর ডিভোর্স আপনিই দিবেন, বলেননি এ কথা?”
শাহরিয়ার ভীষণ হতাশ কন্ঠে বললো,
“জ্যোতি, ডোন্ট বি সিলি প্লিজ! তখনের হিসাব আলাদা ছিলো!”
“হিসাব তো অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেছে। হিসাবের খাতা খুললে আপনি নিস্তার পাবেন তো, শাহরিয়ার শাহবাজ?”
শাহরিয়ার থমকে গেলো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভরাট কন্ঠে বললো,
“আপনি আসছি তোমার বাসায়, যা কথা হবে সামনাসামনিই হবে!”
“একদম না! আমি কোনো কথা বলতে—”
শাহরিয়ার ফোন কেটে দিলো জ্যোতিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই! কয়েকবার ব্যাক করতে চাইলেও শাহরিয়ার কল কেটে দিলো প্রত্যেকবার!
জ্যোতি করুণ চোখে তাকালো মায়ের দিকে। ভীষণ অসহায় লাগছে তার! রত্নাও অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে।
জ্যোতি দ্রুত মেসেজ টাইপ করলো,
“আপনার সাথে আমার আর কোনো কথা বাকি নেই। যতটুকু বলার বলে দিয়েছি। আমাদের দেখা নির্ধারিত দিনে উকিলসমেত পৌরসভাতেই হচ্ছে ইনশাআল্লাহ!”
#চলবে……….
#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ১৩
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
“আমি চাচ্ছি না আমার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে!”
শাহরিয়ার সাফ সাফ জানিয়ে সরাসরি তাকালো জ্যোতির দিকে। জ্যোতি পাশের চেয়ারটাতেই বসে আছে চোয়াল শক্ত করে।
ডেস্কের ওপাশে বসা আইনজীবী মোহাম্মদ সামিউল হক নোটিশের কাগজগুলো নাড়াচাড়া করে জ্যোতির দিকে তাকালেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।
জ্যোতি চোয়াল শক্ত করে বললো,
“কিন্তু আমি চাচ্ছি ডিভোর্সটা হোক!”
জ্যোতির কথা শুনে কক্ষটায় একটা ভারী নীরবতা নেমে এলো। শাহরিয়ারের চোখে বিস্ময়ের ছায়া খেলে গেলো দ্রুত। সে কিছুক্ষণ বিশ্বাসই করতে পারলো না জ্যোতি কথাটা এতটা স্পষ্ট ভাবে বলে দেবে।
শাহরিয়ার কন্ঠে ভারিক্কি ভাব তুলে বললো,
“তুমি কি একবারও ভেবে দেখছো না, আমাদের একটা বাচ্চা আছে? মাত্র দুই মাসের… ওর কী হবে?”
জ্যোতি তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“আমি সব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি শাহরিয়ার। এই সম্পর্কটা আমাকে প্রতিনিয়ত অসহ্য করে তুলছে। বাচ্চাকে আমি একাই মানুষ করতে পারবো।”
সামিউল হক কাশলেন হালকা করে, তারপর বললেন,
“আপনাদের বোঝাপড়ার শেষ চেষ্টাটা কি করা যায় না? সন্তান ছোট, সম্পর্কটা এখনও আইনি বিচ্ছেদের আগে সমঝোতার জায়গায় আছে।”
শাহরিয়ার হতাশ স্বরে বললো,
“আমি বারবার চেষ্টা করছি। কথা বলেছি, বোঝাতে চেয়েছি। কিন্তু ওর কাছে যেন আমি অপরাধী হয়ে গেছি।”
জ্যোতি গলা তুলে কন্ঠ উঁচিয়ে বললো,
“আপনি কি সত্যিই ভাবছেন আমি অহেতুক এসব করছি? কতগুলো রাতে আমি বিষন্ন হয়ে একা কেঁদে ঘুমিয়েছি, আপনি টের পেয়েছেন কোনদিনও? না কোনোদিন বুঝার চেষ্টা করেছেন? আপনি আদোতে আমাকে কখনোই বুঝতে চেষ্টা করেনি, আমাকে সময় দেননি, স্ত্রীর মর্যাদা দেননি। স্ত্রীর সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও আপনি জানেন না! এসব কি আপনার কাছে তুচ্ছ মনে হয়?”
শাহরিয়ার একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি নিজেকে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করছি, জ্যোতি! নিজের ভুলগুলো শুধরে নিতে চাইছি। এটা কি যথেষ্ট নয়?”
সামিউল হক ধীরে কোমল স্বরে বললে,
“দেখুন, শাহরিয়ার সাহেব,আপনি বলছেন আপনি বদলাতে চান। কিন্তু আপনার ওয়াইফ যেই অবস্থায় আছেন, সেটা রাতারাতি আসেনি। দিনের পর দিন ছোট ছোট অভিমান, অভিযোগ জমে জমে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
“স্যার, আত্মোপলব্ধি অনেক বড় একটা বিষয়। একটা মানুষ যখন নিজেই উপলব্ধি করে সে ভুল ছিলো তখন তার ভিতরই নিজেকে শুধরে নেওয়া আকাঙ্খা তৈরি হয়। আর আমি মনে করি এই অবস্থায় সেই মানুষটাকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত! আমিও একটা চান্স ডিজার্ভ করি!”
সামিউল হক এই পর্যায়ে বললেন,
“আপনারা যখন বললেন, আপনাদের দুই মাসের বেবি আছে, তখন বিষয়টা আরও সংবেদনশীল হয়ে যায়। বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আপনাদের খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।”
জ্যোতির কন্ঠে এই পর্যায়ে নমনীয়তা আসে। গলার স্বর নরম হলেও কষ্টে জর্জরিত কন্ঠে বলে,
“আমি জানি, বাচ্চার একটা স্বাভাবিক পরিবার দরকার। কিন্তু একটা ছায়াহীন ঘর আর সম্পর্কহীন সংসারেও কি ও শান্তিতে বড় হবে? যেখানে ওর মাকে প্রতিনিয়ত সেই পরিবারের সদস্যদের দ্বারা লাঞ্ছিত হতে হয়?”
শাহরিয়ার আবেগচাপা কণ্ঠে বললো,
“আমি বাবা, ও আমারও সন্তান, জ্যোতি! আমি আমার ছেলেকে চোখের সামনে বড় হতে দেখতে চাই।”
সামিউল হক দ্বিধায় পড়লেন। এমন কেস তার কাছে নতুন নয়। ডিভোর্সের লইয়্যার হওয়ার সুবাদে এরকম অনেক কেসই তার কাছে হরদম আসে। কিন্তু এতো ছোট একটা বাচ্চার বাবা-মা এই দম্পতি। তাদের বিচ্ছেদ আসলেই অনেক সমস্যার সৃষ্টি করবে। বাচ্চা জ্ঞান হওয়ার আগেই এতো বড় একটা ধাক্কা কীভাবে সামলাবে?
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
“শুনুন, আমি আপনাদের পরামর্শ দিচ্ছি, একটা মাস সময় নিন। সেই সময়ের মধ্যে দুজন আলাদা থাকুন, কিন্তু একজন থেরাপিস্টের সাথে দেখা করুন। যদি তখনও মনে হয় সম্পর্ক ঠিক করা সম্ভব না, তখন ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিন। সময় নিন, ভাবুন। আইন শুধু সম্পর্ক শেষ করার পথ না, মাঝে মাঝে সম্পর্ক বাঁচানোর সময়ও দেয়।”
শাহরিয়ার তাকায় জ্যোতির দিকে। দুজনের চোখাচোখি হলে জ্যোতি চোখ ফিরিয়ে নেয় সংকোচে।
____________________°_________________
জ্যোতি বাবার সাথে বাসায় ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। রত্না শুষ্ক মুখে মেয়ের কাছে সব শুনতে চাইলেন। জ্যোতিও কোনো রাখঢাক না করে সবটাই বললো।
তারপর জ্যোতি ব্যস্ত হয়ে পড়লো জুবায়েরকে সামলাতে।
জুবায়েরকে ঘুম পারিয়ে একটু অবসর মিললো তার। চুপচাপ ছেলের পাশে শুয়ে সারাদিনের কথা ভাবতে লাগলো।
~~~~
উকিলের চেম্বার থেকে বের হয়ে শাহরিয়ার জ্যোতিকে রিকুয়েষ্ট করেছিলো,
“জ্যোতি, আমি তোমার সাথে কিছুক্ষণ একটু একা কথা বলতে চাই। আমাকে এখন একটু সময় দেও।”
জ্যোতি এমনিতেই জুবায়েরের জন্য চিন্তায় ছিলো পুরোটা সময়। বাসায় রত্নার কাছে একা রেখে এসেছে ওকে। তাই দায়সারা ভাবে বললো,
“আমার হাতে এখন সময় নেই। জুবায়েরকে আম্মুর কাছে রেখে এসেছি অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। বাসায় যেতে হবে।”
শাহরিয়ার একটু উত্তপ্ত স্বরে বললো,
“তুমি বিষয়টাকে এতো জটিল করছো কেনো? যেকোনো সমস্যাই একসাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়৷ আমরা একটা মিউচুয়াল সমোঝোতায় আসতে পারি, তাই না?”
হামজা সাহেব হস্তক্ষেপ করে বললেন,
“তুমি কী সমাধান দিবে একটু বলো তো শাহরিয়ার? যেখানে তোমার মা নিজে বলেছেন তারা আর আমার মেয়েকে নিতে চাচ্ছেন না তোমাদের ঘরে– সেখানে আমি কিভাবে, কিসের ভরসায় আমার মেয়েকে পাঠাতে পারি বলো তো? আমার কাছে এখনো কল রেকর্ড আছে, শুনবে?”
“আঙ্কেল, আমি আমার মায়ের হয়ে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু জ্যোতির সংসারটা তো আমার সাথে তাই না? সেক্ষেত্রে আমার কথার থেকে আমার মায়ের কথাকে বেশি প্রায়োরিটি দেওয়া নিশ্চয়ই ঠিক হচ্ছে না?”
হামজা সাহেব লম্বা করে দম নিয়ে জোরে শ্বাস ফেললেন। তারপর খুব শান্ত কন্ঠে বললেন,
“তোমার কথার প্রাধান্য কতটুকু সেটা তো বুঝতেই পারছি! অন্তত তুমি যদি ঠিক থাকতে তাহলে আমার মেয়েকে ফিরে আসতে হতো না শাহরিয়ার! সংসার শুধু তোমার সাথে এই কথাটা তুমি ভুল বললে। সবাইকে নিয়েই একটা সংসার গঠিত হয়। তোমার সংসার শুধু আমার মেয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সেই সংসারে তোমার পরিবারও আছে, থাকবেই-এটাই স্বাভাবিক! আমার কোনো ছেলে থাকলে তাকেও আমার সাথেই থাকতে হতো। কিন্তু একটা সংসারে যদি বেছে বেছে একজনের উপরই সবাই চড়াও হয় তাহলে সেটা কোন যুক্তি ন্যায়সংগত বলো তো? তুমি ঠিক হতে চাচ্ছো মানলাম, কিন্তু তোমার ফ্যামিলি কি ঠিক হতে চাচ্ছে? তুমি নাহয় বাইরের পৃথিবী থেকে আমার মেয়েকে প্রটেক্ট করতে পারবে, কিন্তু তোমার ঘরের ভিতরে আমার মেয়েকে কীভাবে প্রটেক্ট করবে?
মানসিক স্বস্তি একটা মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বের বিষয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তোমার পরিবারে আমার মেয়ে সেটা কোনোভাবেই পাচ্ছে না!”
“আমি তো এক মাস সময় চেয়েছি আঙ্কেল।”
হামজা সাহেব বিদ্রুপের সুরে বললেন,
“এক মাসে তুমি সবাইকে ঠিক করে দিবে, তাই না? পারলে করো! যাইহোক, বাসা থেকে বের হয়েছি অনেকক্ষণ হয়েছে। আমার নাতি ঘরে মা ছাড়া আছে অনেকক্ষণ ধরে। আল্লাহ হাফেজ।”
এরপর হামজা সাহেব জ্যোতিকে নিয়ে চলে আসেন।
~~~~~~~~~
“আপনি সত্যি চাচ্ছেন জ্যোতির তালাক হোক?”
রত্না চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করে স্বামীকে।
হামজা সাহেব একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“হ্যাঁ, আমি চাচ্ছি।”
“আপনি কি বেশি তাড়াহুড়ো করছেন না?”
হামজা সাহেব অবাক হয়ে বললেন,
“৯/১০ মাস তোমার কাছে তাড়াহুড়ো মনে হচ্ছে রত্না?”
“শুনেছি শাহরিয়ার ডিভোর্স দিতে চাচ্ছে না?”
হামজা সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
“ওর চাওয়া না চাওয়া দিয়ে আমি কী করবো? তখন না বড় গলায় বলেছে সে ডিভোর্স দিবে বাচ্চা হলেই? এখন পল্টি খাচ্ছে কেনো? কাপুরুষ কোথাকার! জবানের ঠিক নেই!”
রত্না ধীর গলায় বললেন,
“হয়তো সত্যি সত্যিই পরিবর্তন হয়েছে? জ্যোতির অনুপস্থিতিতে ওর গুরুত্ব বুঝতে পারছে?”
“কীভাবে বুঝলে ওর পরিবর্তন হয়েছে? মুখে বলেছে তাই?”
রত্না শাড়ির আঁচলে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে বললো,
“এই কয়েকটা মাস ধরে ওকে দেখেছি আমি। মানুষের নিজের ভুল উপলব্ধি করার পিছনে কোনো না কোনো প্রেক্ষাপট তো থাকে, তাই না? এখন নিশ্চয়ই আকাশ থেকে কোনো ফেরেস্তা নেমে এসে বলবে না— শুনো আল্লাহর বান্দা, তুমি যা করছো তা ঠিক হচ্ছে না। তুমি ভালো হয়ে যাও!— তাই না?”
“তোমার হয়েছে কী বলো তো? তোমার সামনেই তো শাহরিয়ারের মায়ের সাথে কথা হয়েছে আমার! তুমি শুনোনি উনি কী বলেছেন? তারপরও বলছো আমার মেয়েকে সেখানে পাঠাতে? তাও কার ভরসায়? শাহরিয়ারের? ও যদি ভালোই হতো তবে জ্যোতি ওখান থেকে চলে আসতো না! আমার মেয়ে কি বানে ভাসা কচুরিপানা? আমি, ওর বাবা, এখনো আল্লাহর রহমতে জীবিত আছি!”
রত্না কিছু বলতে উদ্যত হলে হামজা সাহেব থামিয়ে দেন তাকে,
“রত্না,অফ যাও! আমার সামনে আর কারো সাফাই গাইতে চেয়ো না দয়া করে। এমনিতেই অনেক চিন্তায় থাকি৷ নতুন কোনো চিন্তা মাথায় নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই আমি।”
________________°_____________
শাহরিয়ার ঘরে ঢুকতেই দেখলো ফারিয়া ড্রয়িং রুমে তার জন্যই অপেক্ষা করছে। শাহরিয়ারকে দেখতে পেয়ে উৎসুক হয়ে বললেন,
“আপডেট কী? কাজ হয়ে গেছে? জুবায়েরকে আমাদের কাছেই তো দিবে, তাই না?”
শাহরিয়ার কিছুক্ষণ থম মেরে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর চোয়াল শক্ত করে বললো,
“মা, আমি না বলেছি আমি ডিভোর্স চাচ্ছি না? তাহলে এটা কেমন প্রশ্ন?”
ফারিয়া স্পষ্ট গলায় বললেন,
“তুমি এখনো বলছো তুমি ডিভোর্স চাও না? তোমাকে না বলেছি ওই মেয়ে আমাদের ঘরের জন্য নয়? জেদি, রাগী, কারো কথায় ওঠে না।”
শাহরিয়ার ধীরে মাথা নাড়ে,
“আমার আর জ্যোতির মধ্যে যা হয়েছে, সেটা আমাদের সমস্যা, মা। তুমি বারবার বাইরের মতো করে দেখছো, কিন্তু ভেতরে যে ভালোবাসা ছিলো,….আছে,ওটা তুমি দেখতে পারছো না।”
ফারিয়া ঠোঁট চেপে বললেন,
“ভালোবাসা? যদি এত ভালোবাসা থাকতো, তাহলে মেয়েটা ঘর ছেড়ে যেতো না। একটা ভালো মেয়ে নিজের বাচ্চা কোলে নিয়ে স্বামীর সংসার ছাড়ে না, এটা বুঝো।”
শাহরিয়ার গলা নিচু করে বললো,
“তুমি, আমি, আমরা কখনোই জ্যোতিকে বুঝতে চাইনি, মা। ওর অভিযোগগুলোকে ঠুনকো ভেবেছি। অথচ সত্যিটা হলো আমি তাকে যথেষ্ট সময় দিইনি, সম্মান দিইনি, ভালোবাসা দিইনি। সে কষ্ট পেয়েছে, আমি সেটা এখন বুঝি।”
ফারিয়া বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
“তোমার ঘাড়ে এক বাচ্চা, সংসারের দায়িত্ব, এখন যদি তুমি এই মেয়ে নিয়ে পড়ে থাকো, তাহলে তোমার জীবনটাই ভেসে যাবে। ও তোমার জন্য পারফেক্ট নয় শাহরিয়ার!”
এই পর্যায়ে শাহরিয়ারের কন্ঠ চড়ে গেলো,
“জীবন তো এমনিতেই ভেসে যাচ্ছে, মা! একটা সময় তুমি বলেছিলে, সংসার মানে বোঝাপড়া, আজ তুমি নিজেই বলছো ‘চলে যেতে দাও’।”
ফারিয়া কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিজের ছেলেকেই চিনতে তার কষ্ট হচ্ছে!
ফারিয়া একটু থেমে কন্ঠে কোমলতা ঢেলে বললেন,
“তুমি এই সম্পর্ক ধরে রাখলে কষ্ট আরও বাড়বে। তুমি এখন যা ভাবছো, তা মনে হচ্ছে না হবে। ওই মেয়ে তো সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে। নিজেকে ছোট করো না, শাহরিয়ার।”
শাহরিয়ার চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
“আমি ওকে ছোট করতে চাই না। আমাদের সম্পর্কটা এখন শুধু আমার আর ওর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এখন আমরা একটা সন্তানের পিতা-মাতাও! আমি শুধু চাই, জ্যোতি একবার অন্তত আমাদের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ভেবে দেখুক! সেই জন্য আমি অপেক্ষা করতে রাজি আছি।”
ফারিয়া তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললন,
“তোমার দেখছি বড় দরদ উথলে ওঠছে হঠাৎ করে ওর জন্য! কাহিনি কী? নিজেই তো প্রথমে বলেছিলে ডিভোর্স নিবে?”
শাহরিয়ার হঠাৎ হেসে ফেললো। এমন সিরিয়াস সিচুয়েশনে এভাবে হাসতে দেখে ফারিয়া ভড়কে গেলেন।
“কী হয়েছে, হাসছো কেনো এভাবে?”
“তোমার কী হয়েছে সেটা আগে বলো তো? এভাবে উঠেপড়ে লেগেছো কেনো আমাদের ডিভোর্সের জন্য? আমার তো প্রেমের বিয়ে না, এমনকি আমি নিজে পছন্দ করেও তোমাদের বলিনি। জ্যোতিকে তোমরাই পছন্দ করেছো আমার জন্য৷ এখন সেই মেয়েকে তোমরাই সহ্য করতে পারছো না! মেয়ে যদি শুরু থেকেই তোমাদের মনমতো না হয়ে থাকে তাহলে আমাকে ওর সাথে বিয়ে কেনো করিয়েছো?”
ফারিয়া দৃষ্টি সরিয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন,
“আমার পছন্দ ছিলো না। তোমার বাবাই পছন্দ করেছে ওকে। আমি শুরু থেকেই বলেছি ওদের সাথে আমাদের স্ট্যাটাসে গ্যাপ আছে। কিন্তু আমার কথা সে শুনলো না! অন্যের প্রশংসায় গলে গিয়ে নিজের মর্জি চালিয়েছে।”
শাহরিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষাদ কন্ঠে বললো,
“আমার জানা সবচেয়ে তিক্ত সত্যি কথাটা কী, জানো মা? আমরা সবাই মিলিয়েই জ্যোতিকে তাড়িয়েছি! আমাদের সবার আচরণেই ও চলে যেতে বাধ্য হয়েছে!”
ফারিয়া অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি কি ভাবছো তোমার বউয়ের উপর আমরা জুলুম করেছি? তোমাকে আমাদের নামে ওই মেয়ে এটাই বলেছে তো, ঠিক না? আমি জানতাম ওর ভিতরে কুটিলতা ভর্তি! আমি মানুষ চিনতে ভুল করি না, হাহ্!”
শাহরিয়ার ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের এক বিদ্রুপ হাসি খেলে গেলো। উপহাসের সুরে বললো,
“ও কিছু বলেনি– এটাই তো সব চেয়ে বড় সমস্যা মা!”
__________________°________________
নিজের নাম্বারে শাহরিয়ারের কল দেখে রত্না দ্বিধায় পড়লেন। তাকে কল করেছে কেনো? কল কি ধরা উচিত?
কিছুক্ষণ দোনোমোনো করে অবশেষে কল রিসিভ করলেন তিনি।
শাহরিয়ার সালাম দিয়ে সরাসরি বললো,
“আন্টি, আপনার মেয়ে কি এখন আমাকে আমার ছেলেকেও দেখতে না দেওয়ারর পণ করেছে?”
রত্না ভড়কে গেলেন। কী বকছে এই ছেলে?
“কী হয়েছে?”
“ওর ফোনে কতক্ষণ ধরে কল করছি। ধরছে না।”
“ওহ, ও তো নামাজ পড়ছে। ফোনের আওয়াজ তো আমিও পাইনি, হয়তো সাইলেন্ট করে রেখেছে।…. আচ্ছা নামাজ শেষ করে কল দিতে বলবো।”
“জ্বি, আচ্ছা। আসসালামু আলাইকুম।”
বলে শাহরিয়ার ফোন কেটে দিলো।
রত্না জ্যোতির রুমে গিয়ে দেখলেন জ্যোতি সবে সালাম ফিরিয়েছে।
“শাহরিয়ার অনেকক্ষণ ধরে কল দিচ্ছে জুবায়েরকে দেখার জন্য। নামাজ শেষ করে কল দিস।”
জ্যোতি ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কখন কল দিলো?”
“কী জানি, আমাকে মাত্র কল দিয়ে বললো তুই নাকি এখন ওকে ওর ছেলেকেও দেখতে দিচ্ছিস না!”
“ফাউল লোক! সারাদিন আউল ফাউল বকে!”
“ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিস মনে হয়?”
“সাইলেন্ট থাকলেও ভাইব্রেশন তো হওয়ার কথা।”
জ্যোতি জায়নামাজ গুছিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে এগারোটা মিসড ভিডিও কলের নোটিফিকেশন উঠে আছে।
ভ্রু কুঁচকে দেখতে দেখতে আবিষ্কার করলো ওর ফোনে ডু নট ডিসটার্ব মোড অন করা।
জ্যোতি দ্রুত কল ব্যাক করলো। শাহরিয়ার মনে হয় ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলো, একবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো কল।
কল রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে জ্যোতি ব্যাক ক্যামেরা চালু করে ছেলের দিকে তাক করে ধরলো। কিন্তু তাতেও অল্পক্ষণের জন্য সেলফি ক্যামেরাতে তাকে দেখা গেলো।
শাহরিয়ার গজগজ করে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখন বরের সাথেও পর্দা করা শুরু করো! আমি গেলে তো প্যাকেট হয়ে বসেই থাকো, এখন ফোনেও ঘোমটা দিয়ে থাকো, চমৎকার!”
জ্যোতি দাঁতে দাঁত চেপে টিটকারি হজম করলো।
“কতবার ফোন করেছি দেখেছো?”
জ্যোতি কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলো,
“ফোনে ডোন্ট ডিসটার্ব মোড অন করা ছিলো।”
“তোমাকে কে ডিসটার্ব করে যে ডোন্ট ডিসটার্ব অন করে রেখেছো? আমি?”
জ্যোতি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“সীম কোম্পানি কিছুক্ষণ পর পর মেসেজ পাঠায়, মেসেজের বিকট টোনে জুবায়ের ভয় পেয়ে যায়। এজন্য অন করেছিলাম।”
“তাহলে ব্লক করে রাখো, তাহলেই তো হয়!”
“ব্লক তো আরো অনেক কিছুই করতে ইচ্ছা করে! পারি না দেখেই তো…!”
শাহরিয়ার নড়েচড়ে বসে হালকা ধমকে বললো,
“দেখো, তেড়ছা কথা বলবে না, ভালো লাগে না এসব। ….ফোন ভালো করে ধরো, বাবুকে দেখা যাচ্ছে না ঠিকমতো।”
জ্যোতি মনে মনে শাহরিয়ারকে কয়েকটা বকা দিয়ে ফোন ঠিকঠাক করে ধরলো।
#চলবে……..