#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ১৬
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
“আব্বু, আসবো?”
হামজা সাহেব মাত্রই ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ছেিলেন, এমন সময় জ্যোতি নক করলো।
“হ্যাঁ, আসো।”
জ্যোতি ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলো। ওড়নার খুট আঙুলে প্যাঁচাতে লাগলো সংকোচে।
হামজা সাহেব মুখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে।
“আব্বু, তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
হামজা সাহেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়ের দ্বিধাগ্রস্ত চেহারা পর্যবেক্ষণ করলেন কিছুক্ষণ, অতঃপর বললেন,
“বলো, শুনছি আমি।”
জ্যোতি যেন অথৈজলে পড়েছে। কোথা থেকে কথা আরম্ভ করবে তার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। ভিতরে কত কথা হুটোপুটি খাচ্ছে, অথচ জিভের আগায় একটাও আসছে না। কী মুসিবত!”
হামজা সাহেব নরম কন্ঠে শুধালেন,
“কী হয়েছে, মা? কী বলতে চাচ্ছো?”
আব্বুর স্নেহময় কন্ঠে জ্যোতির সকল দ্বিধা যেন এক লহমায় উবে গেলো। ভীষণ ধীর কন্ঠে বললো,
“আব্বু, আপনি কেসটা উঠিয়ে নিন। আমি ডিভোর্সটা চাচ্ছি না।”
হামজা ঠিকমতো শুনতে পেলেন না, তাই পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“কী? একটু জোরে বলো মা।”
“আব্বু! আপনি কেসটা উঠিয়ে নিন!”
জ্যোতি কন্ঠ হালকা উঁচু করে আবার বললো।
হামজা সাহেব স্তব্ধ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চেহারায় স্পষ্টত বিস্ময়ভাব।
“তুমি ঠিক বলছো?”
জ্যোতি মাথা নেড়ে সায় জানায়। তারপর রুদ্ধ কন্ঠে বলে,
“আব্বু, উনি আরেকবার সুযোগ চাচ্ছেন। আমার মনে হচ্ছে একবার সুযোগ দেওয়া উচিত, জুবায়েরের খাতিরে হলেও। তাছাড়া উকিল সাহেবও বারবার বলছিলেন এই কথা। এজন্যই এক মাস সময় নিতে বলেছিলেন আমাদের।”
হামজা সাহেব চুপ করে রইলেন। একটা কথাও না বলে কাঁধ দুটো ঝুলিয়ে রকিং চেয়ারে বসে পড়লেন পরাজিত ভঙ্গিতে।
জ্যোতি আতংক নিয়ে আব্বুর দিকে তাকালো। আব্বুর নীরবতা তার স্নায়ুতে চাপ সৃষ্টি করছে ভীষণভাবে।
আব্বুর পায়ের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে আব্বুর মলিন মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে আকুল গলায় বললো,
“আব্বু, তুমি আমার উপর রাগ করেছো, তাই না? আমার কারণে তোমার এতো ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।”
হামজা সাহেব হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন,
“আমি রাগ করছি না জ্যোতি, আমি তোমাকে নিয়ে চিন্তিত। আমার একটামাত্র সন্তান তুমি। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না আমি কতটা অপরাধবোধ নিয়ে প্রতিটারাত চোখের পাতা এক করি! তোমার চিন্তায় আমার ঘুম হয় না। আমার নাতির চেহারা দেখলে আমার নিজের করা ভুলগুলো যেন আরও জ্বলজ্বল করে ওঠে৷ আমি কী করবো বলো? আমি নিজে নিরুপায়!”
“আব্বু, আব্বু, ও আব্বু,”
জ্যোতি হামজা সাহেবের দাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বললো,
“তুমি কেনো বারবার একই কথা বলো? যা হয়েছে সেটাতে তোমার কোনো দোষ ছিলো না। বিশ্বাস করো, তুমি বিষয়টা এভাবে নিজের উপর নিবে জানলে আমি কখনো এসব তোমাদের বলতামও না, না এখানে সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে আসতাম! পড়ে রইতাম ওখানে। তুমি আমার অনেক প্রিয়, আব্বু! আমি এভাবে তোমাকে দুশ্চিন্তায় দেখতে পারছি না।আমার খারাপ লাগে ভীষণ!”
হামজা সাহেব চুপ করে রইলেন একই ভঙ্গিতে। মস্তিষ্কে কত চিন্তার ঝড় বইছে! দীর্ঘক্ষণ একই ভাবে থেকে অবশেষে সোজা হয়ে বসলেন, কন্ঠে কঠোরতা ফুটিয়ে বললেন,
“আচ্ছা, ঠিক আছে! যেহেতু তুমি সুযোগ দিতে চাইছো, তোমার সংসার, সেহেতু আমি হস্তক্ষেপ করবো না।… কিন্তু শুধু এই একবারই! শাহরিয়ার যদি এরপরও কাপুরুষের মতো তোমায় নিজের ঘরে প্রটেক্ট ব্যর্থ হয় তাহলে আমি তোমাকে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো, তোমার কথাও শুনবো না তখন!”
_______________________
দুই সপ্তাহ পরঃ
~~~~~~~~~~~
শাহরিয়ার জ্যোতির জিনিসপত্র গাড়িতে উঠাচ্ছে, মাহিরা হেল্প করছে জিনিসগুলো ভিতর থেকে আনতে। মাহিরা বাবুর খেলনাগুলো বের করে আনলে শাহরিয়ার বলে,
“আমি অনেক খেলনা কিনে রেখেছি, এগুলো এখানেই রাখ। জ্যোতি বেড়াতে আসলে তখন জুবায়ের খেলতে পারবে।”
সদরদরজার সামনে সিমেন্ট দিয়ে বসার মতো দুটো বেঞ্চ বাঁধানো আছে। সেখানে হামজা সাহেব বসা, তার পাশের দরজায় হালকা ঠেস দিয়ে রত্না দাঁড়িয়ে আছেন, কোলে জুবায়ের।
জ্যোতি তখনও ভিতরে, সবকিছু গোছগাছ করছে নেওয়ার জন্য।
শাহরিয়ারের কথায় রত্না-হামজা দুজনেই মুখ তুলে তাকালেন শাহরিয়ারের দিকে। কথাটা যেন ভিতরটায় আঘাত করেছে। মেয়ে এবং নাতির একসাথে প্রস্থান তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। রত্না জুবায়েরকে চুমু খেলেন কয়েকটা। হামজা সাহেব আরো গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।
আরও কিছুক্ষণ পর সবকিছু গাড়িতে তোলা হলে জ্যোতি বেরিয়ে আসে ভিতর থেকে। কালো বোরকা নিকাবে আপাদমস্তক ঢাকা তার।
“আচ্ছা, তাহলে যাওয়া যাক।”
শাহরিয়ার জ্যোতিকে আসতে দেখে বলে।
সকলেই নড়েচড়ে বসলো। জ্যোতি আব্বু আম্মুর কাছে এগিয়ে গেলো ধীর পায়ে।
“আব্বু, আম্মু।”
আলতো করে ডাকলো সে, কন্ঠে মৃদু কম্পন হচ্ছে।
হামজা সাহেব উঠে দাঁড়ালেন,
জ্যোতির কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে বললেন,
“যেতো চাচ্ছো, তাই যেতে দিচ্ছি। নিজের খেয়াল রাখবে, জুবায়েরের খেয়াল রাখবে। আর কোনো সমস্যা হলে কোনো সংকোচ ছাড়াই আমাকে বলবে।”
শেষ কথাটা বলে হামজা সাহেব শীতল চোখে তাকালেন জামাতার দিকে। শাহরিয়ার একটু অপ্রস্তুত হলো এতে।
জ্যোতির ভিতরে কান্না দলা পেকে উঠলো, রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
“আব্বু, অনেক ভুল করেছি জীবনে। কিন্তু তুমি বরাবরই আমার সব ভুলগুলোকে ফুল ভেবে আমাকে বারংবার আগলে নিয়েছো, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো। আমাকে এবারও ক্ষমা করে দিও প্লিজ। আমার উপর রাগ করে থেকো না।”
হামজা সাহেব পুনরায় জ্যোতির মাথায় আরেক চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“ধুর পাগলি! তুমি কোনো ভুল করলে-না ক্ষমার প্রশ্ন আসবে! একমাত্র সম্মানে আঘাত লাগা ছাড়া কোনো বাবা তার মেয়ের উপর রাগ করে থাকতে পারে না। সবসময় মনে রাখবে, তোমার আব্বু আম্মু তোমার পাশে আছেন সবসময় ইনশাআল্লাহ।”
জ্যোতি আব্বুর কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়। হামজা সাহেব রত্নার কোল থেকে জুবায়েরকে নিজের কোলে নিয়ে আদর করতে থাকেন। জ্যোতি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে। মা-মেয়ে দুজনেই দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। দীর্ঘ আলিঙ্গন শেষে রত্না মেয়েকে আদর করে ছলছল চোখে কিছু উপদেশ দেয়। জ্যোতির চোখেও পানি।
বিদায়ের পালা শেষ হলে জ্যোতি গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। পিছন পিছন রত্না আর হামজা সাহেবও এগিয়ে আসেন।
শাহরিয়ার বিদায় নেয় শ্বশুর শ্বাশুড়ির কাছ থেকে।
“আঙ্কেল, আন্টি, আসি তাহলে। দোয়া করবেন।”
রত্না ভারাক্রান্ত কন্ঠে বললেন,
“আমার মেয়ের খেয়াল রেখো। উপরে এক আল্লাহ আর জমিনে তোমার উপর ভরসা করে ওকে আবার পাঠাচ্ছি। যদি নিজের কথা না রাখো তাহলে হাশরের দিনে তোমায় আমি ছাড়বো না!”
হামজা সাহেব শাহরিয়ারকে বললেন,
“তোমার বাবা মা কেউ আসেনি?”
শাহরিয়ার বললো,
“বাবা আসতে চেয়েছে। কিন্তু আমিই বারণ করেছি। আসলে উনার শরীর ভালো যাচ্ছে না কিছুদিন ধরে। এজন্য বাসাতেই রেস্ট নিতে বলেছি।”
হামজা সাহেব গম্ভীর হয়ে রইলেন, প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না৷ বিশ্বাস করলেন কিনা বোঝা গেলো না।
মাহিরা জুবায়েরকে কোলে করে গাড়ির পিছনের সীটে বসলো।
জ্যোতি ঘুরে আব্বু আম্মুর কাছ থেকে পুনরায় বিদায় নিয়ে মাহিরার পাশের সীটে বসলো।
সবাই উঠে গেলে শাহরিয়ারও ড্রাইভিং সীটে বসে হামজা আর রত্নার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে আবার বিদায় জানায়।
মাহিরা আর জ্যোতিও একই ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বিদায় জানায় আরেকবার।
গাড়ি স্টার্ট হয়, চলতে শুরু করে ধুলিমাখা পথ দিয়ে। রত্না-হামজা শূন্য বুকে তাদের যাওয়া দেখে। ভিতরটা ভীষণ খালি খালি লাগছে তাদের।
____________________
গাড়ি এসে থামে শাহবাজ মহলের সামনে। গেটের দারোয়ান তাদের দেখে সালাম ঠুকে তড়িঘড়ি করে মেইন গেইট খুলে সরে দাঁড়ায়।
শাহরিয়ার গাড়ি নিয়ে ভিতরে চলে যায়। জ্যোতির ভীষণ নার্ভাস লাগছিলো। তাই পুরোটা রাস্তা মাহিরা জ্যোতির হাত ধরে বসে মৃদু সাহস জুগিয়ে গেছে।
গাড়ি থামলে শাহরিয়ার গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজা খুলে জ্যোতিকে বের হতে সাহায্য করে।
জ্যোতি সাবধানে জুবায়েরকে কোলে করে নামে গাড়ি থেকে। সংকোচে চারদিকে নজর বুলাতে থাকে। অনেক দিন পর এসেছে। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ার মতন বদল হয়নি।
মাহিরা দরজা খুলে দেওয়ার অপেক্ষা না করে নিজেই নেমে পড়েছে। জ্যোতির পাশে এসে বাহু দিয়ে জ্যোতির কাঁধ জড়িয়ে ধরে আলতো চাপ দিয়ে ভরসা দেয়।
“আসো।”
শাহরিয়ার গাড়ির জিনিসপত্র গুলো নামাতে নামাতে হাঁক ছাড়ে,
“লতিফ? লতিফ? জিনিসগুলো উপরে আমাদের রুমে পৌঁছে দেও।”
শাহরিয়ারের হাঁকডাকে প্রায় ত্রিশের কাছাকাছি বয়সের একজন ছুটে আসে। মূলত সে-ই লতিফ।
জ্যোতিকে দেখে একটু হকচকিয়ে যায় লোকটা। বহুদিন পর দেখেছে কিনা।
দ্রুত সালাম দেয়,
“আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম। অনেক দিন পরে আসছেন, আপনাকে দেখে খুশি হইছি।”
জ্যোতি হালকা হেসে অভিবাদন গ্রহণ করে।
শাহরিয়ার বলে,
“তোমরা যাও, আমি আসছি পিছন পিছন।”
মাহিরা জ্যোতিকে নিয়ে এগিয়ে গেলো সামনে।
বাড়িতে ঢুকে বিশাল ড্রয়িং রুমে কাউকেই দেখতে পেলো না তারা। মাহিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জ্যোতি ভীষণ নার্ভাস চোখে তাকালো তার দিকে। মাহিরা একটু হেসে তাকে অভয় দিলো যেন।
ততক্ষণে পিছন পিছন শাহরিয়ার এসে দাঁড়িয়েছে। শাহরিয়ার কাউকে না দেখে বাবা মার কামরার দিকে যেতেই যাবে এমন সময় সোহাইল সাহেব বেরিয়ে এলেন হাসিমুখে। আপাদমস্তক ব্যক্তিত্ববান ঋজু এক ভদ্রলোক। বয়স ছাপ্পান্নের বেশি হলেও শরীরে এখনো শক্তি আর দৃঢ়তা ভরা। উঁচু লম্বা গড়ন, চওড়া কাঁধ, সোজা পিঠ, দেখলেই বোঝা যায় একসময় শরীরচর্চা করতেন। গায়ের রঙ হালকা তামাটে, মুখে হালকা পাকা দাড়ি, কপালে বয়সের রেখা থাকলেও তা তাকে আরও গম্ভীর আর মর্যাদাবান করে তুলেছে। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কথা কম বলেন, কিন্তু উপস্থিতি এমন যে সবাই আপনাআপনি সম্মান দেখায়, আপনাআপনি সমীহ আসে তাঁর প্রতি অজান্তেই। হাঁটার ভঙ্গিতে আত্মবিশ্বাস, আর মুখে সবসময় এক ধরনের নীরব দৃঢ়তা সবসময় বিরাজমান তার মাঝে।
শাহরিয়ারের দৈহিক গঠন আগাগোড়ার বাপের মতো হয়েছে। বাপ ছেলের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তাদের সম্পর্ক বলে দেওয়া যায়।
সোহাইল সাহেবের পরনে অফ হোয়াইট রঙের মসলিনের একটা পাঞ্জাবি আর ঢিলেঢালা পাজামা, পায়ে চামড়ার একটা চপ্পল। ঘরে সবসময়ই তাকে এমন বেশভূষায় দেখে এসেছে জ্যোতি।
ভদ্রলোকের উপস্থিতি ভিতরে অদ্ভুত এক কাঁপন ধরায় তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের কারণে। জ্যোতির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। শ্বশুরকে দেখে ভিতরে হৃদপিণ্ড দপাতে লাগলো।
কিন্তু সোহাইল সাহেব মৃদু সহাস্যে বললেন,
“এসে পড়েছো তোমরা? আমি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম ড্রয়িং রুমে তোমাদের জন্য। একটু আগেই গিয়েছি নিজের রুমে।”
জ্যোতি মিনমিন করে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম বাবা, কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। এইতো আলহামদুলিল্লাহ। বসো সোফায় তোমরা। আমি মিতুকে ঠান্ডা শরবত দিতে বলে আসি।”
শাহরিয়ার দ্রুত বললো,
“বাবা, থাক। এখানে বসার দরকার নেই। ফ্রেশ হয়ে রুমেই বসুক। ….মা কোথায়?”
সোহাইল সাহেব একটু থমকালেন। মৃদু স্বরে বললেন,
“আছে, রুমেই আছে। ….বিশ্রাম নিচ্ছে সম্ভবত।”
“শরীর খারাপ নাকি?”
সোহাইল সাহেব শ্রাগ করলেন। যার অর্থ তিনি জানেননা।
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমি ফ্রেশ হয়ে গিয়ে দেখা করে আসছি।”
শাহরিয়ার জ্যোতিকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে নিজের কামরার দিকে এগিয়ে গেলো।
মাহিরা বাবার দিকে অর্থবোধক দৃষ্টিতে তাকালে সোহাইল সাহেব হতাশ ভঙ্গিতে দুইপাশে মাথা নাড়েন। তা দেখে মাহিরাও হতাশ হয়। সকালে জ্যোতিকে আনতে যাওয়ার কথা বলার পর থেকে ঘরে থম মেরে নিজের রুমে বসে আছেন ফারিয়া। কারো সাথে কথা বলছেন না। বাকিরাও অবশ্য তোয়াক্কা করলো না।
__________________________
হাতল ঘুরিয়ে নিজেদের কক্ষে প্রবেশ করলো জ্যোতি। দীর্ঘ দশ মাস পর এলো এই কক্ষে সে। এই কক্ষে তার পাঁচ মাসের সংসার আছে, আছে পাঁচ মাসের যাতনার গল্প! কত শত মূহুর্তের সিন্দুক এই কক্ষ!
জ্যোতি ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলো চারদিকে। বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে রুমে। কয়েকটা ফার্নিচার চেঞ্জ করা হয়েছে, কিছু এক্সট্রা আনা হয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো সে। আগেরটা বদলে এটা আনা হয়েছে। সাইজেও প্রায় আগেরটার দ্বিগুণ। সামনে মখমলের কাপড়ে মোড়া একটা ছোট টুলও দেখা যাচ্ছে বসে সাজগোছ করার জন্য। ড্রেসিং টেবিলের সাথের সেট বুঝাই গেলো।
কবে এনেছে এটা?
বেডের পাশে বাচ্চাদের দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্য একটা দোলনা রাখা। দোলনার পাশে কিছু বাচ্চাদের খেলনাও আছে।
আরও খুটিনাটি বেশ কিছু পরিবর্তন চোখে পড়লো জ্যোতির।
শাহরিয়ার কিছুক্ষণ পর এসে দরজার সামনে রাখা সব লাগেজ ভিতরে টেনে এনে একপাশে সরিয়ে রেখে জোরে একটা দম নিলো।
তারপর জ্যোতির দিকে এগিয়ে এসে জুবায়েরকে নিজের কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে বললো,
“দেখি, দেও ওকে আমার কাছে। তুমি বোরখা খুলে ফ্রেশ হয়ে আসো। ততক্ষণ আমি ওকে রাখছি।
জ্যোতি সায় জানিয়ে জুবায়েরকে তার বাবার কোলে দিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো।
কিছুক্ষণ পর শাওয়ার নিয়ে চুলে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বের হয়ে দেখলো শাহরিয়ার খেলছে জুবায়েরের সাথে বিছানায়।
জ্যোতি চুপচাপ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে লাগলো।
“অরোরাকে দেখছি না যে? ও জানে আমি আসবো?”
“জানবে না কেনো? জানে। কোন বান্ধবীর সাথে দেখা করতে গিয়েছে যেন বললো।”
এমন সময় দরজায় নক হলো। জ্যোতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শাহরিয়ারের দিকে তাকালে শাহরিয়ার বলে,
“দাঁড়াও, আমি দেখছি।”
শাহরিয়ার বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে উঁকি দিলো। দরজা ওপাশ দেখে দরজা পুরো খুলে সরে দাঁড়ায় শাহরিয়ার।
হ্যাংলা পাতলা সেলোয়ার-কামিজ পরা একটা মেয়ে ট্রে হাতে ভিতরে ঢুকে। ঠান্ডা শরবতের জগ আর দুটো গ্লাস রাখা ট্রেতে, সাথে কয়েকটা ছোট পিরিচে কয়েকটা ফল কেটে রাখা।
চুপচাপ ট্রে রেখে আবার নীরবে চলে গেলো মেয়েটা।
জ্যোতি আগে কখনো দেখেনি মেয়েটাকে বাড়িতে। তাই শাহরিয়ার দিকে তাকালো প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে।
শাহরিয়ার সাথে সাথে সাফাই গাওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
“মিতু, সপ্তাহখানেক হলো রেখেছি। তুমি আসবে, জুবায়েরকে সামলানোর জন্য আরও একজন থাকা জরুরি, তাই নিয়োগ দিয়েছি।”
জ্যোতি সরল অভিব্যক্তি দিয়ে বললো,
“কেনো, আপনি আছেন না?”
শাহরিয়ার স্থির হয়ে জ্যোতির দিকে তাকালো। কথাটা কেমন যেন ঝংকার তুললো কানের পাশে, মনে কেমন ভালো লাগার ঢেউ তুললো। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে শাহরিয়ার কোমল স্বরে বললো,
“আমি তো অবশ্যই আছি মিসেস, কিন্তু আমি যখন অফিসে থাকবো তখন তো একজন হ্যাল্পিং হ্যান্ডের প্রয়োজন হবে আপনার, তাই না?”
জ্যোতি মাথা নেড়ে সায় দিলো। শাহরিয়ার বলার ভঙ্গিতে লজ্জা পেলো কেনো যেন, গাল আবছা লাল হয়ে উঠলো অজান্তেই।
#চলবে……..
#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ১৭
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
“তুমি এসব ছেলেমানুষি কখন ছাড়বে বলো তো?”
সোহাইল সাহেবের গমগমে কন্ঠস্বর ভেসে এলো ঘরের মধ্যখান থেকে। ফারিয়া বিছানায় চুপচাপ শুয়ে ছিলেন। অকস্মাৎ কথার আওয়াজে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন। স্বামীকে দেখে একবার জলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,
“আমার কোন কাজ তোমার ছেলেমানুষি মনে হচ্ছে, শুনি?”
সোহাইল সাহেব মহা বিরক্ত হলেন। তিরস্কারের স্বরে বললেন,
“তুমি এখন কী করছো? এসব কি ছেলেমানুষি নয়? ছেলের বউ এসেছে, নাতি এসেছে অথচ একবার দেখতে বের হওনি। এসব ছোটলোকি আচরণ তোমায় শোভা পায়?”
ফারিয়া তেতে উঠে বললেন,
“এই, ছোটলোক কাকে বললে? আমি ছোটলোকি আচরণ করছি? ছেলের বউকে তো তোমরাই এনেছো, তোমরাই দেখো। আমার দেখা না দেখা নিয়ে কার কী আসে যায়?”
সোহাইল সাহেব দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
“দিন দিন বয়স হচ্ছে, আর আক্কেল হাঁটুতে নামছে! ছেলেমেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে নাতিনাতনিও হয়ে গেছে। আর কবে আক্কেল হবে তোমার, শুনি?”
ফারিয়া ক্রুদ্ধ হয়ে বললো,
“তুমি আমার সাথে কোন টোনে কথা বলছো সোহাইল?”
“তোমাকে বোঝানোর আর কোনো পন্থা আমার কাছে নেই। তাই এই টোনেই এখন থেকে তোমায় অভ্যস্ত হতে হবে যা দেখছি!”
ফারিয়া জলন্ত দৃষ্টিতে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর পানে। রাগে ভিতরে উথাল-পাতাল ঢেউ উঠছে।
সোহাইল সাহেব চোয়াল শক্ত করে পুনরায় বললেন,
“নিজের বিহেভিয়ার চেঞ্জ করো, বুঝলে? অন্তত ছেলের সামনে তার বউয়ের সাথে। বেশি লাগাম টানতে চেয়ে পরে না আবার লাগাম ছাড়া হয়ে যায় তোমার! ছেলে যখন নাগালের বাইরে চলে যাবে তখন কেঁদো চোখে লবণ মরিচ ডলে ডলে!”
সোহাইল আর এক মূহুর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চলে গেলেন হনহন করে। স্ত্রীর আচরণে তিনি বেজায় ক্ষিপ্ত!
ফারিয়া বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে রইলেন স্বামীর যাওয়ার পথে।
_________________________
“মা, আসবো?”
শাহরিয়ার দরজায় টোকা নেড়ে ফারিয়ার মনোযোগ আকৃষ্ট করলো।
ফারিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেকে দেখে নড়েচড়ে বসলেন।
শাহরিয়ার একটা সার্ভিং ট্রলিতে করে ঢেকে রাখা খাবার নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে ট্রলিটা একপাশে রাখলো।
একটা চেয়ার টেনে মায়ের বরাবর সামনে বসলো চুপ করে।
কিছুক্ষণ নীরবে মাকে পরখ করে বললো,
“তুমি লাঞ্চ করোনি কেনো?”
ফারিয়া থমথমে মুখে উত্তর দিলেন,
“খিদে ছিলো না।”
“খিদে ছিলো না কী ছিলো সেটা আমি ভালো করেই জানি।”
শাহরিয়ার বিড়বিড় করলো।
ছেলের মৃদুস্বরে বলা কথাটা শুনে ফারিয়া কিছুটা অভিমানী স্বরে বললেন,
“তুমি আসার পর একবারও আমার সাথে দেখা করেছো? সেই বউ নিয়ে রুমে ঢুকেছো, একবারও মায়ের সাথে দেখা করার কথা মনে ছিলো না?”
শাহরিয়ার হেসে ফেললো।
“মা, এতোদিন পর ওদের এনেছি, জিনিসপত্র গুছাতে একটু সময় লেগেছে। তাছাড়া আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম, বাবা বললো তুমি ঘুমাচ্ছো। তাই আর ঘরে ঢুকিনি।”
ফারিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি গুছিয়েছো সব?”
শাহরিয়ার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
“তো কে গুছাবে? জ্যোতি জুবায়েরকে সামলাচ্ছিলো, তারপরও যা পেরেছে হেল্প করেছে।”
ফারিয়া চোখ বড়বড় করে তাকালেন।
শাহরিয়ার তার অভিব্যক্তি দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
“কী হয়েছে? এভাবে দেখার কী আছে?”
“দেখছি তুমি কীভাবে বউয়ের আঁচলে বাঁধা পড়েছ!”
কথাটা মনে মনে থাকলেও মুখে বললেন,
“কিছু না।”
শাহরিয়ার কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো,
“খাবার এনেছি, খেয়ে নেও।”
“পরে খাবো।”
শাহরিয়ার স্থির ভাবে দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করে কতক্ষণ বসে রইলো, তারপর মায়ের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
“মা, তুমি আগের সবকিছু ভুলে এখন সবটা স্বাভাবিক নেওয়ার চেষ্টা করো প্লিজ। তুমি জুবায়েরকে পর্যন্ত একবার দেখতে যাওনি ওদের নিয়ে আসার পর থেকে। তোমার কাছে তোমার জেদ জুবায়ের আর আমার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?”
ফারিয়া একটু নড়েচড়ে বসলেন,
“তুমিও তো আমার কথা শুনছো না এখন আর।”
শাহরিয়ার মায়ের হাতদুটো নিজের মুঠিতে নিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“মা, আমি তোমার ছেলে, তোমার কথা শুনবো না তো কার কথা শুনবো? কিন্তু তাই বলে তোমার অযৌক্তিক জেদ তো আমি পূরণ করতে পারবো না,তাই না? ঘরে আমরা মানুষ কয়জন বলো তো? হাতেগোনা এই কয়জনই তো তাই না? তাহলে এরকম রেষারেষি কি মানানসই? যৌথ ফ্যামিলি হলে নাহয় এসব কাবজাব মেনে নেওয়া যেতো। কিন্তু থাকিই অল্প কয়জন, এখন সবাই যদি এভাবে মনমালিন্য করে একে অপরের ছায়া না মারাই তাহলে কীরকম বিশ্রী দেখায় বিষয়টা বলো তো?”
শাহরিয়ার থেমে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, অতঃপর আবার একটা দম নিয়ে বলা শুরু করে,
“মা, আমি আশা করবো আমার স্ত্রীকে তুমি আগের সব রেষারেষি ভুলে স্বাভাবিক ভাবে নিবে। এখন সে শুধু আমার স্ত্রী নয়, আমার সন্তানের মা-ও। জ্যোতির সাথে একটু মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করো প্লিজ। ও ভুল করলে সেটা স্নেহের সাথে বুঝিয়ে দেও। তুমি ওর গুরুজন, মায়ের মতো। ও আর অরোরা তো প্রায় একই বয়েসী তাই না?”
ফারিয়া তারপরও নিশ্চুপ রইলেন। ভিতরে কী চলছে বোঝা মুশকিল।
শাহরিয়ার ফারিয়ার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললো,
“আমার কথাগুলো ভেবে দেখো প্লিজ। ঘরে আর কোনো ঝামেলা চাই না, বাবাও অপছন্দ করছে বিষয়গুলো।
…আচ্ছা, যাইহোক, তুমি খেয়ে নেও খাবারগুলো।”
ফারিয়া চোখ সরিয়ে খাবারের ট্রলির দিকে তাকালেন বিষাদ মুখে। খেতে চাওয়ার কোনো ইচ্ছে পরিলক্ষিত হলো না তার মাঝে।
শাহরিয়ার সেটা লক্ষ্য করে কিছুটা সংকোচ নিয়ে বললো,
“….আমি খাইয়ে দিবো?”
ফারিয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। শাহরিয়ার তার প্রতি বরাবরই ভীষণ যত্নশীল। তাই মাথা নেড়ে সায় জানালেন।
শাহরিয়ার সায় পেয়ে ট্রলিটা নিজের সামনে এনে ধীরে ধীরে খাবারের ঢাকনা সরাতে লাগলো।
_____________________
জ্যোতি এসেছে সপ্তাহখানেক পার হয়ে গিয়েছে। জ্যোতি কিছুটা আগের ছন্দে ফিরে এলেও এখনও কিছুটা সংকোচ বিরাজমান তার মধ্যে।
অরোরা একপ্রকার উপেক্ষা করে চলে তাকে। ফারিয়া চুপচাপ জুবায়েরকে নিয়ে থাকে, জ্যোতির সাথে ঠেকায় না পড়লে পারতপক্ষে কথা বলেন না। মাঝে মধ্যে শীতল চোখে অপলক ভাবে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝিয়ে দেন জ্যোতিকে তিনি পছন্দ করছেন না। বাকি সবাই, সবকিছু ঠিকঠাক, স্বাভাবিক।
জ্যোতিও সময় দিচ্ছে, আপ্রাণ চেষ্টা করছে সবকিছু নরমাল করার জন্য।
নিজেই আগ বাড়িয়ে ফারিয়ার সাথে টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করছে, কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করছে। ফারিয়া হয় উত্তর দেন, নয়তো হু- হা করেন।
জ্যোতিও দমে গিয়ে আর কথা বাড়ায় না।
শাহরিয়ার প্রথম দিনই জ্যোতিকে বলেছে সবকিছু ইজি নিতে। তার উপর কোনো চাপ নেই। সে যেন শুধু চেষ্টা করে একটু এডজাস্ট হওয়ার, এর বেশি কিছু নয়। আর সমস্যা হলে শাহরিয়ার তো আছেই, তাকে যেন জানায়।
ব্যস, এই একটা অভয়বাণীতেই জ্যোতি চলছে।
জ্যোতি হাঁপিয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। দমবন্ধ লাগে তার এভাবে ঘরে একলা থাকতে। শাহরিয়ার দিনের অধিকাংশ সময় বাড়িতে থাকে না, জুবায়েরকে সামলাতে মিতুই বেশি সাহায্য করে। এজন্য এখন নিজেই ঘোরাফেরা করে বাড়িতে।
মাত্রই নিজে চা বানিয়ে শ্বশুরের কক্ষে দিয়ে এসেছে। তার হাতের চা দারুণ হয়। সোহাইল সাহেব ভীষণ পছন্দ করেন। ফেরার পথে ফারিয়ার সাথে দেখা হয়ে যায় তার।
জ্যোতি ভীষণ বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করে,
“আন্টি, কিছু খাবেন? বানিয়ে দিবো?”
ফারিয়া চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ স্থির ভাবে চেয়ে থেকে বললেন,
“লাগবে না। কিছু লাগলে আমি সুমিকেই বলে নিতে পারবো৷ তোমায় কিছু বললে তো আবার আমার ছেলের কান ভরাবে তোমায় দিয়ে কাজ করাই। ইদানীং তো তোমার কথাই শুনছে শুধু!”
জ্যোতি ভীষণ অপ্রস্তুত হলো ফারিয়ার সরাসরি এমন তীর্যক কথায়।
তাই কোনো প্রতিত্তোর না করে দ্রুত শ্বাশুড়িকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো।
কিন্তু আচমকা ফারিয়া শক্ত করে জ্যোতির হাত আঁকড়ে ধরে বললেন,
“আমার ছেলেকে বশ করেছো তাই না?”
জ্যোতি আর ধৈর্য ধরতে পারলো না। হাত ঝট করে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা ব্যঙ্গ করে বললো,
“ছেলে মায়ের পরোয়া করে তো ঠিকঠাক, বউয়ের পরোয়া করলেই বশীকরণের কামাল, তাই না আন্টি? যদি এমনটাই হয় তাহলে আমিও তো বলতে পারি আপনিও আঙ্কেলকে বশ করেছেন?”
ফারিয়া আচমকাই সজোরে জ্যোতিকে চড় মেরে বসলেন। জ্যোতির হতভম্ব হওয়ার কথা থাকলেও হলো না। চোখ জোড়া বন্ধ করে হজম করে নেওয়ার চেষ্টা চালালো পরনের কাপড় খামচে ধরে।
“মা! এটা কী করেছ তুমি?”
হঠাৎ-ই শাহরিয়ারের ক্রুদ্ধ কন্ঠ ভেসে এলো পাশ থেকে। দুজনই চমকে পাশে তাকিয়ে শাহরিয়ারকে দেখতে পেলো ক্ষুদ্ধ অবয়বে। ফারিয়া হতভম্ব হয়ে গেলেন। শাহরিয়ার কি দেখে ফেললো সবটা?
শাহরিয়ার বিদ্যুৎ গতিতে তাদের নিকটে এসে চক্ষু গরম করে বললো,
“তুমি কাজটা একদম ঠিক করোনি মা! ক্ষমা চেয়ে নেও ওর কাছ থেকে।”
ফারিয়া ভয় পেয়ে এলোমেলো ভাবে বললেন,
“বাবা তুমি পরের কাহিনি দেখেছো। ও তোমার বাবাকে নিয়ে খুব বাজে কথা বলেছে আমাকে।”
“মা, আমি পুরো ঘটনাই দেখেছি। ও ওই কথাটা কোন প্রসঙ্গে বলেছে সেটাও আমি শুনেছি!”
ফারিয়া উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। শাহরিয়ারের মাথায়, মুখে এলোমেলো হয়ে হাত বুলাতে বুলাতে অধীর হয়ে বললে,
“তোর কী হয়েছে বাবা? ও তোকে কী করেছে? তোকে কী খাইয়েছে বল?”
শাহরিয়ার চোখ বন্ধ করে স্পর্শটুকু হজম করে নিলো। তারপর উত্তপ্ত স্বরে বললো,
“আগে মেরুদণ্ড ছিলো না, এখন মেরুদণ্ড গজিয়েছে মা! চোখ ছিলো না,এখন চোখ হয়েছে।”
জ্যোতি একপাশে সরে দাঁড়িয়ে দর্শক আয়নের মতো মা-ছেলের বাকবিতন্ডা দেখছে। সে বিস্ময় নিয়ে ভাবছে এটাই কি সেই শাহরিয়ার? এই শাহরিয়ারকে তার ভীষণ অচেনা, ভীষণ আপন ঠেকছে তার নিকট!
“তুই তো ওকে সহ্যই করতে পারতি না। এখন কী হয়েছে? তোর বাচ্চার মা হয়েছে বলে এমন করছিস?”
“মা! ও আমার স্ত্রী আগে, আমার বাচ্চার মা পরে! তুমি লিমিট ক্রস করবে না, প্লিজ! ক্ষমা চেয়ে নেও। নয়তো এরপর যা হবে তার জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে তুমি!”
জ্যোতি বিস্ময় নিয়ে ডাগরডাগর চোখ জোড়া নিয়ে তাকালো স্বামীর পানে। ‘ও আমার স্ত্রী আগে’ কথাটা ঝংকার তুললো জ্যোতির কানে। তার ভিতরে যেন অজস্র প্রজাপতির উড়াউড়ি শুরু হয়ে গেলো মূহুর্তেই। হুট করেই জ্যোতির মনে এলো এক জীবনে তার আর কোনো বিশেষ চাওয়া পাওয়া নেই।
ফারিয়া রেগে গেলেন। দিশা হারিয়ে বললেন,
“এভাবে বউয়ের আঁচলে বাঁধা পড়বি কোনোদিন ভাবিনি! এক কালনাগিনী এনেছি ঘরে! আমি কোনো ভুল করিনি! চাইবো না আমি ক্ষমা! যা করার, কর তুই!”
বলেই হনহন করে চলে গেলেন তিনি।
শাহরিয়ার গরম চোখে মায়ের প্রস্থান দেখলো। জ্যোতি এই পর্যায়ে হুশ ফিরে পেলো। শাহরিয়ারের হাত ধরে টানতে টানতে তাদের কামরায় নিয়ে এলো। তারপর শাহরিয়ারকে বেডে বসিয়ে দিয়ে তার সামনে বসলো হাঁটু গেঁড়ে। আলতো করে শাহরিয়ারের হাতদুটো নিজের হাতে বন্দী করে বললো,
“শান্ত হোন। এতো উত্তেজিত হচ্ছেন কেনো?”
শাহরিয়ার চোয়াল শক্ত করে বললো,
“আমার বউয়ের গালে বেহুদা চড় মারবে আর আমি বোনলেস হয়ে তা দেখবো?”
জ্যোতির ভিতরে অনুভূতির তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হলো। আমার বউ!
কথাটা এতো মিষ্টি কেনো?
মুখ তুলে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“এটা তো নতুন নয় শাহরিয়ার। এর আগেও একবার উনি আমার গায়ে হাত তুলেছেন। এরপর পরই তো আমি চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি মাথা ঠান্ডা করুন, ইজি হোন। এতো রিয়েক্ট করার কিছু নেই।”
শাহরিয়ার রাগত দৃষ্টিতে তাকালো জ্যোতির পানে।
“আগে নাহয় মেরুদণ্ডহীন ছিলাম, তাই তোমাকে তোমার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারিনি। এখন যাও মগজ ঠিকানায় এসেছে, এখনও যদি আগের মতো কাপুরুষ থাকি তাহলে কীভাবে হবে? আর তুমি কোন বুঝে বলছো রিয়েক্ট না করতে? চড় খাওয়া কি তিনবেলা ভাত খাওয়ার মতো যে ইজি হবো?”
জ্যোতি স্থির হয়ে চেয়ে রইলো মানুষটার দিকে। হুট করে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।
“এখন কি আমি ঝগড়া করবো আন্টির সাথে? আমি না চাইতেই বউ-শাশুড়ীর যুদ্ধ চলছে, আমি ময়দানে নামলে তো কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে!”
শাহরিয়ার হাসলো না জ্যোতির রসিকতায়। কেমন বিষন্ন দৃষ্টিতে নিজের স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইলো। হুট করে কী হলো কে জানে, শাহরিয়ার জ্যোতিকে ঝাপটে নিজের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো, একেবারে মিশিয়ে ফেললো নিজের সাথে। জ্যোতি অপ্রস্তুত হলেও পড়ে রইলো শাহরিয়ারের বুকে। অনেকক্ষণ একইভাবে মৌন থাকলো দুজনে, শুধু দুজন দুজনার সান্নিধ্য, নিঃশ্বাসের শব্দ অনুভব করলো নীরবে, নিভৃতে। হঠাৎ শাহরিয়ার ভগ্নকণ্ঠে বললো,
“আমাকে মাফ করে দেও বউ। আমি তোমার সাথে কিছুই ঠিক করিনি। মাফ করে দেও প্লিজ।”
জ্যোতি শাহরিয়ারকে ঠেলে উঠতে চাইলে শাহরিয়ার আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো জ্যোতিকে, ছাড়তে চাইছে না সে কোনোমতেই সহধর্মিণীকে।
জ্যোতি হাল ছেড়ে দিলো নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করা থেকে। একটু নীরব থেকে বললো,
“ঘাঁ শুকিয়ে যায়, কিন্তু দাগ ঠিকই থেকে যায়। না চাইতেও স্মৃতির দংশন ঠিকই রয়ে যায় শাহরিয়ার।”
“ভুলে যাও না সেসব স্মৃতি?”
জ্যোতি সামান্য হাসে। হেসেই বলে,
“স্মৃতির মরণ কে না চায়, বলুন?”
শাহরিয়ারের শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হলো। জ্যোতিকে সামান্য আলগা করে এলোমেলো চুমুতে ভরিয়ে দিলো জ্যোতির মুখ, গলা সব। জ্যোতি শিউরে উঠলো এলোমেলো গভীর স্পর্শে।
“তাহলে ভুলো না সেইসব স্মৃতি! আমারও তো প্রায়শ্চিত্ত করা দরকার, তাই না?”
জ্যোতি এবার আরও নিকটে যায় শাহরিয়ারের, এলোমেলো ভাবে শাহরিয়ারের মুখে দু হাত দিয়ে স্পর্শ করে অবিরাম, যেন বুঝতে চায় সত্যিই শাহরিয়ার কিনা। ভীষণ আকুলতা নিয়ে চেয়ে থাকে মানুষটার দিকে। মানুষটার পরিবর্তন, আত্ম-অনুশোচনা তাকে তীব্রভাবে স্পর্শ করছে।
কেমন আকুল হয়ে গভীর কন্ঠে বলে,
“আমি ক্ষমা করে দিলাম শাহরিয়ার, ক্ষমা করে দিলাম আপনাকে…..”
“করো না, একদম ক্ষমা করো না! এতো সহজেই ছেড়ে দিও না। প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দেও, তোমাকে জয় করে নেওয়ার সুযোগ দেও। মাথার তাজ করে রাখার কথা ছিলো তোমায়, অথচ…… স্বামী হয়ে এমন কষ্ট দিয়েছি তোমায় যা দেওয়ার অধিকার আমার ছিলো না…..”
জ্যোতি হাত রাখে শাহরিয়ারের মুখে, বাঁধা দেয় আর কিছু বলতে।
“ভুলে যান সেসব। আমিও ভুলে যাবো। প্রেম ও দ্রোহের মধ্যে আমি নাহয় প্রেমটাই গ্রহণ করে নিলাম!”
#চলবে………