#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ১৮
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
চৈত্রের তীব্র দহনে ধরনী যেন পুড়ে ছারখার হওয়ার উপক্রম। এতো তীব্র গরম এর আগে কখনো পড়েছে বলে মনে পড়ছে না জ্যোতির। সূর্যের আগুনের হলকা যেন ঘরের ভিতরেও ঢুকে পড়ছে। এসির নীচ থেকে নড়ার মতো একটা মূহুর্তও খুঁজে পায় সে।
শাহরিয়ার ফ্যাক্টরি থেকে এসেছে কিছুক্ষণ হলো। এসেই ফিট হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। শাহরিয়ারকে আসতে দেখেই জ্যোতি জুবায়েরকে মিতুর কোলে দিয়ে ছুট লাগিয়েছে ঠান্ডা কিছু আনার জন্য।
তড়িঘড়ি করে ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত বানিয়ে এনে শাহরিয়ারের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে বললো,
“ঠান্ডা শরবত এনেছি, খেয়ে নিন, ভালো লাগবে।”
শাহরিয়ার ক্লান্ত দেহে জ্যোতির দিকে শুয়ে থেকেই দৃষ্টিপাত করার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে হাল ছেড়ে দিলো। অবসন্ন কন্ঠে বললো,
“টি টেবিলটায় রেখে দেও প্লিজ। আমি শরীর টেনে উঠাতে পারছি না!”
জ্যোতির ভীষণ মায়া হলো। মানুষটা আসলেই ভীষণ খাটে প্রতিদিন। সারাদিন এসির মধ্যে থেকে তার স্বামীর এই অবস্থা, আর যারা মাথার উপর ফোসফাস করতে থাকা সূর্যের নিচে থেকে কাজ করে, দিনমজুরি করে, তাদের কথা ভাবতেই জ্যোতির ভীষণ দুঃখ হলো।
জ্যোতি গ্লাসটা টি টেবিলের উপর রাখলো না। কন্ঠে মাধুর্য ঢেলে বললো,
“একটু কষ্ট করে উঠুন। এটা পান করলে কিছুটা স্বস্তি বোধ হবে।”
শাহরিয়ার দুই হাত উঁচিয়ে মেলে ধরে অসহায় কন্ঠে বললো,
“একটু হেল্প করো টেনে উঠাতে।”
জ্যোতি ফিক করে হেসে ফেললো। গ্লাসটা টেবিলে রেখে দুই হাতে শাহরিয়ারের দুই হাত ধরে গায়ের জোরে টানতে লাগলো, কিন্তু একচুল পরিমাণ নড়চড় হলো না শাহরিয়ারের বিশাল দেহে।
টানতে টানতে কাহিল হয়ে জ্যোতি থেমে হাঁপাতে লাগলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“আল্লাহ! কী ভারী আপনার শরীর! এক চিমটি নাড়াতে পারিনি!”
শাহরিয়ার হো হো করে উচ্চ শব্দে হেসে ফেললো জ্যোতিকে এভাবে হাঁপাতে দেখে। একটু আগের অবসন্ন ভাব উবে গিয়ে ভীষণ কৌতুক বোধ করলো। চট করে ডান হাতের কনুইতে ভর দিয়ে নিজেকে হালকা উঠালো। চোখে মুখে দুষ্টুমির ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো,
“তুমি তো দেখছি একটা ফার্মের মুরগী!”
জ্যোতি কটমট করে তাকালো অসভ্য লোকটার দিকে। চোখ দিয়ে যেন ভস্ম করে দিতে পারলে খুশি হতো।
জ্যোতির রাগী মুখ দেখে শাহরিয়ারের মাথায় শয়তানী বুদ্ধি হুটোপুটি খেতে লাগলো।
জ্যোতি শাহরিয়ারের মুখ দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে ফেললো মূহুর্তেই।
শাহরিয়ার কিছু একটা বলার উপক্রম হতে জ্যোতি হড়বড় করে বললো,
“এই, চুপ! একদম চুপ! যখনই মুখ খুলে আজেবাজে কথা বলে! অসভ্য লোক!”
শাহরিয়ার আবার ফিক করে হেসে ফেললো। সোজা হয়ে বসে বললো,
“আচ্ছা কিছু বলবো না। দেও, শরবতটাই খাই।”
জ্যোতি শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে আড়চোখে তাকালো শাহরিয়ারের পানে।
শাহরিয়ার এক নিশ্বাসে পুরো গ্লাস সাবার করে ঠক করে গ্লাসটা রাখলো বেডের পাশের টেবিলে।
জ্যোতি বিড়বিড় করলো,
“পানি খাওয়ার আদবও ঠিকঠাক পালন করে না! আল্লাহ ধৈর্য দেও!”
শাহরিয়ার শুনতে পেয়ে সরু চোখে তাকালো তার দিকে। কতক্ষণ একই ভঙ্গিতে চেয়ে থেকে বললো,
“বিছানায় উঠে বসো।”
জ্যোতি ভ্রুকুটি করে বললো,
“কেনো?”
“বসো আগে।”
জ্যোতি চুপচাপ আদেশ পালন করলো।
শাহরিয়ার দুম করে জ্যোতির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।
জ্যোতি বাঁধা দিতে গিয়েও দিলো না মানুষটার ক্লান্তির কথা চিন্তা করে।
“তুমি এতো বেরসিক কেনো বলো তো? বর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, কই তুমি একটু চুলে বিলি কেটে দিবে তা না ভ্যাবলাকান্তের মতো কাঠ কাঠ হয়ে সিনা টান করে বসে আছো! এমন আনরোমান্টিক হলে চলে?”
শাহরিয়ার টিটকারি করে বললো চোখ বুজে রেখেই। চোখ বুজে আছে দেখেই দেখলো না জ্যোতির অভিব্যক্তি। আসলে জ্যোতির সুড়সুড়ি হচ্ছে ভীষণ। মুখ ফুটে বলতেও পারছে না মেয়েটা।
শাহরিয়ার ব্যাঙ্গাত্মক কথা শুনে জ্যোতি রোবটের মতো চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো।
শাহরিয়ারের কপালে ভাঁজ পড়লো।
“এভাবে চুল টানছো কেনো? বিলি কেটে দিতে বলেছি, তুমি তো দেখছি আমার চুলের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছো!”
কথা শেষ করে চোখ খুলে তাকালো বরাবর সামনে থাকা জ্যোতির কাঠ কাঠ মুখের দিকে। আশ্চর্য হয়ে বললো,
“আল্লাহ! মুখ এমন শক্ত করে আছো কেনো? আমি আবার কী ভুল করে ফেললাম!”
জ্যোতি করুণ মুখে বললো,
“আমার… আমার সুড়সুড়ি লাগছে!”
শাহরিয়ারের কয়েক সেকেন্ড লাগলো বিষয়টা ধরতে। বিষয়টা বুঝে আসতেই আবার হাসা আরম্ভ করলো। হাসতে হাসতেই হতাশ হয়ে বললো,
“তুমি আসলেই মারাত্মক আনরোমান্টিক!”
বলেই একটা বালিশ জ্যোতির কোলে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লো তার কোলে একই ভঙ্গিতে।
“এবার ঠিক আছে?”
জ্যোতি লজ্জা পেয়ে বলে,
“হু।”
শাহরিয়ার ক্ষণে ক্ষণে হাসি পাচ্ছে। থামছে না কোনোমতেই। এদিকে জ্যোতি রেগে কটমট করে তাকাচ্ছে লোকটার দিকে বারবার। আশ্চর্য! এতো হাসছে কেনো লোকটা? এতো হাসির কী ঘটেছে?
_________________°______________
“আমি মাহমুদকে বিয়ে করতে পারবো না আব্বু!”
অরোরা যেমন ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকেছে ঠিক তেমনই ঝড়ের বেগে কথাটা বলে দম নিলো সে।
সোহাইল এবং ফিরোজা দুজনেই অবাক চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। এভাবে হঠাৎ উড়ে এসে বিস্ফোরকের মতো এই কথাটা বলার হেতু দুজনেই খুঁজে পাচ্ছেন না।
ফিরোজা চোখ গরম করে কিছু একটা বলতে নিলে সোহাইল হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয় তাকে। তারপর খুব শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“তাহলে কাকে করবে?”
অরোরা দ্বিধান্বিত হয়ে পিতামাতার মুখে চোখ বুলায়।
তারপর বড় করে দম নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,
“আমার পছন্দ আছে। একজনকে পছন্দ করি!”
ফারিয়া বিস্মিত হয়ে মেয়েকে ধমক দিতে নিলে সোহাইল শীতল চোখে তাকায় স্ত্রীর দিকে। চাহুনিতে চুপ থাকার আদেশ দেয়। ইতোমধ্যে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে। ফারিয়া তাই চুপ করে যান। সোহাইল সাহেব গমগমে কন্ঠস্বরে নিরুত্তাপ ভাব বজায় রেখে প্রশ্ন করেন,
“সে-ও করে?”
“হুম।”
সোহাইল সাহেব কতক্ষণ স্থির ভাবে এক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন। বাবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে অরোরার অনূভুত হতে লাগলো সে যেন পুড়ে যাচ্ছে। আড়ষ্ট হয়ে দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ করলো সে।
“বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারবে তোমার বাড়ি অবধি?”
অরোরা সরাসরি চোখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। কন্ঠে পূর্বের আত্নবিশ্বাসী ভাব বজায় রেখে বলে,
“হ্যাঁ! ও ফ্যামেলি নিয়ে আরও আগে থেকেই আসতে চাচ্ছে। আমিই দমিয়ে রেখেছিলাম।”
সোহাইল সাহেব একটু থম মেরে বসে রইলেন। কিছু সময় অতিবাহিত হলে পুনরায় প্রশ্ন করেন,
“ছেলে কী করে?”
অরোরা তার পছন্দের মানুষের বৃত্তান্ত দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তৎক্ষনাৎ।
___________________°_________________
“নির্লজ্জ দেখেছি তবে তোর মতো এতো নির্লজ্জ আগে চোখে পড়েনি! পছন্দ আছে সেটা আমাকে আগে না জানিয়ে সিধা বাপের কাছে চলে গেলি? শাহরিয়ার ঠিকই বলে, তুই দিনদিন চূড়ান্ত রকমের বেয়ারা এবং বেয়াদব হচ্ছিস! কী নাটকটাই না করলি আজকে!”
ফারিয়া ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে মেয়েকে বললেন কথাগুলো।
অরোরা বিরক্ত হলো। চোখেমুখে বিরক্তিভাব ফুটিয়ে তুলে ঝাঁজের সাথে বললো,
“ঘরে কত নাটক হয় সেগুলোতে কারো সমস্যা হয় না, আর আমি কোনো নাটক মঞ্চায়ন করলেই সবার গায়ে ফোস্কা পড়ে যায়, বুঝলাম না কাহিনি!”
ফারিয়া কটমট করে তাকালেন এমন বেয়ারা মন্তব্যে। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
“তোর এতো তাড়া কিসের ছিলো যে একেবারে বলা-কওয়া ছাড়া আমাদের ঘরে গিয়ে এমন বোম ফাটালি?”
অরোরা সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“এছাড়া আমার আর কী করার ছিলো? দুজনে মিলে তো আমার ঘাড়ে তোমার বোনের ছেলেকে চাপিয়ে দিতে চাইছিলে, যেমন হুট করে ভাইয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছো! অথচ ভুলে গিয়েছো আমি কিন্তু ভাইয়া নই!”
ফারিয়ার মুখে কোনো কথা সরলো না। ভিতরে তীব্র ক্ষোভে টগবগ করে ফুটছেন তিনি।
“আসলে তোমাদের কথা বলতে শুনে ফেলেছিলাম আমি। আমার সাথে মাহমুদের বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা বলছিলে। সেই থেকে তিনদিন ধরে অপেক্ষা করছি কখন আমার কাছে সিদ্ধান্ত জানতে আসবে। ওমা! দুজনের একজনও আসলে আমার মত জানার জন্য! বুঝতে পারছো আমি কতটা ট্রেসের মধ্যে ছিলাম? আমি শিওর হয়ে গিয়েছিলাম তোমরা নিজেরা নিজেদের পছন্দ আমার উপর চাপিয়ে দিবে। এজন্যই আজকে নিজেই আগ বাড়িয়ে জানিয়ে দিয়েছি। ভালো করেছি না?”
ফারিয়া রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“আমি আজকেই তোর সাথে কথা বলতে যাচ্ছিলাম! এর আগেই তুই এমন অসভ্যতামি করে বসলি!”
অরোরা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
“হ্যাঁ এখন আমি বলে ফেলেছি তাই তোমার মনে পড়ে গিয়েছে আজকে আমার সাথে কথা বলতে আসার কথা তোমার, তাই না? তিনদিন ধরে যে আমি অপেক্ষা করলাম সেটা?”
ফারিয়া রেগেমেগে কিছু বলতে গেলে অরোরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে বললো,
“আমার সাথে মেজাজ দেখাবে না প্লিজ! তোমার মেজাজ ভাইয়ার উপর গিয়ে দেখাও। ভাইয়া ছাড়া তোমার মেজাজ হ্যান্ডেল করার ধৈর্য কারো নেই!”
বলেই রেগেমেগে প্রায় উড়ে চলে গেলো অরোরা সেখান থেকে।
ফারিয়া বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। এটা সত্যি তার চড়া মেজাজ নিয়ে ভীষণ কুখ্যাতি আছে। হুটহাট মেজাজ হারিয়ে ফেলার দুর্নাম নিজের বাপের বাড়িতেও আছে তার। এজন্যই লোকজন একপ্রকার তাকে এড়িয়ে চলে।
শাহরিয়ারটাও বোধ জেনেটিক্যালি এই বৈশিষ্ট্য পেয়েছে।
____________________°__________________
জ্যোতি শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখে শাহরিয়ার ছেলের সাথে খেলছে। ছেলেও খুশিতে কুটি কুটি হয়ে মাড়ি বের করে হাসছে।
জ্যোতির পরনে নেভী ব্লু রঙের ঢোলা কামিজ। এরকম বেশ কয়েকটা মাহিরা কাস্টমাইজ করে জ্যোতির জন্য বানিয়ে এনেছে ট্রেইলারের কাছ থেকে। একে তো গরম, তার উপর বাচ্চার মা। কাপড়টাও ভীষণ আরামদায়ক। পরে স্বস্তি আছে।
জ্যোতি ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে উল্টেপাল্টে আলতো করে মুছতে লাগলো মনোযোগ দিয়ে। গোসলশেষের সতেজতা তখনও তার চোখেমুখে লেপ্টে আছে, চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানির স্বচ্ছ ফোঁটা। কিছু গাল ছুঁয়ে, কিছু ঘাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে। হঠাৎ কিছু জলকণা ছিটকে এসে পড়লো শাহরিয়ারের মুখে। পানির ছিটায় চমকে উঠে শাহরিয়ার তাকালো উৎসের দিকে। ব্যস! ওই তাকানো পর্যন্তই! চোখ আর ফেরানো হলো না তার।
গাঢ় রঙের পোশাকটা জ্যোতির ত্বকের ওপর যেন ঝিলিক দিয়ে উঠছে বারেবারে, মুখজুড়ে ভেজা পানির দীপ্তিতে তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজ। ভেজা চুল মোছার চেষ্টারত জ্যোতিকে এতো বেশি স্নিগ্ধ কমল ঠেকছে তার নিকট আজ! চোখের পলক পড়ে যাওয়া ভুলে গিয়ে শাহরিয়ার অপলক চেয়ে রইলো জ্যোতির দিকে।
চুল মুছতে মুছতে হঠাৎ আয়নার প্রতিফলকে শাহরিয়ারের এমন অভিভূত দৃষ্টি ধরা পড়তেই জ্যোতি থমকে গেলো। হাত থেমে গেলো মূহুর্তেই, আড়ষ্ট বোধ করলো প্রচন্ডভাবে। পই করে ঘুরে অপ্রস্তুত অভিব্যক্তি নিয়ে শুধালো,
“আজব তো! এভাবে কী দেখছেন ভ্যাবলাকান্তের মতো? চোখ ফিরান বলছি!”
শাহরিয়ার সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নির্লজ্জের মতোন বললো,
“নিজের বউকে দেখছি! তোমার কী সমস্যা?”
প্রথমে হতভম্ব হলেও কথাটা ঠাওর করতে পেরে জ্যোতির কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুতে লাগলো। লজ্জা চেপে কপট রাগের ভান ধরে বললো,
“মানে? আপনি কি জানেন, আপনি দিনদিন অসভ্য হচ্ছেন?”
শাহরিয়ার মুখে দুষ্টু ভাব ফুটিয়ে সরল কন্ঠে বললো,
“বউয়ের সামনে অসভ্য হবো না তো কার সামনে হবো শুনি? দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র বউ আমার! সেটাও আবার সুন্দরী! অসভ্য না হয়ে উপায় আছে আমার?”
জ্যোতি কথার খেই হারিয়ে ফেললো। কথা বোধগম্য হতেই রেগেমেগে কাছে থাকা একটা বালিশ শাহরিয়ারের দিকে ছুঁড়ে মেরে ফোঁসফোঁস করতে করতে বললো,
“মনে হচ্ছে দশটা বউ না থাকায় অনেক আফসোস হচ্ছে? দশটা বউ রাখার অনেক শখ তাই না?”
অকস্মাৎ আক্রমণে শাহরিয়ার প্রতিহত করার সময়টুকু পেলো না। বালিশের আঘাত খেয়ে বোকার মতো তাকালো বউয়ের দিকে। বিড়বিড় করে বললো,
“প্রশংসাটুকু চোখে পড়লো না, কিন্তু দশটা বউ শব্দটা যে উচ্চারণ করেছি সেটা ঠিকই ছাপ্পা মারার মতন চোখে পড়ে গেছে! হায়রে মেয়ে মানুষ!!”
#চলবে………
#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ১৯
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
বসার ঘরে অতিথিদের পুরোদস্তুর আপ্যায়ন চলছে। অরোরাকে দেখতে এসেছে আজ। সঠিক ভাবে বলতে গেলে অরোরার আমন্ত্রণেই তারা এসেছে দেখাদেখির পর্ব সারতে। জ্যোতি নিজের ঘরেই ছিলো। শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করেছিলো জ্যোতি সেখানে সবার সাথে বসবে কিনা। জ্যোতি সাফ মানা করে দিয়েছে। শুধু মহিলা থাকলে সমস্যা ছিলো না, কিন্তু সেখানে অপরিচিত পুরুষও আছে।
নিজের ঘরে ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘরময় পায়চারি করতে করতে একা একাই কথা বলছিলো ছেলের সাথে। এমন সময় মিতু এসে জানান দিলো,
“আপু, স্যার বলেছে বাবুকে উনার কাছে দিতে।”
জ্যোতি কিছুক্ষণ দ্বিধা করে জুবায়েরকে মিতুর কোলে দিয়ে দিলে মিতু জুবায়েরকে নিয়ে চলে যায়।
জ্যোতি বেশ কিছুক্ষণ ঘরে চুপচাপ এটা সেটা করতে থাকে। জুবায়ের দেওয়ার পর থেকে অস্থির লাগছে তার। শেষমেশ অস্থিরতা সহ্য করতে না পেরে দোতালার করিডরে এসে দাঁড়ায়। একপাশে সরে গিয়ে রেলিঙে ঝুঁকে নিচে দেখতে থাকে। এখান থেকে ড্রয়িং রুম মোটামুটি ভালো করেই দেখা যায়।
শাহরিয়ার জুবায়েরকে নিজের কোলে বসিয়ে রেখে হেসে হেসে কথা বলছে ছেলের বড় ভাইয়ের সাথে। বাকিরাও কথা বলছে একে অপরের সাথে। অরোরা একপাশের মাঝখানে লাজুক মুখে বসে আছে। তার ঠিক বরাবরই এক যুবক বসে আছে। থেকে থেকে মুচকি হেসে অরোরার মুখে তাকাচ্ছে। অরোরাও একই কাজ করছে। দুজনের চোখাচোখি হলে দুজনেই লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিচ্ছে।
জ্যোতি উপর থেকে সবকিছুই দেখছে। কিন্তু… কিন্তু কিছু একটা খুব খচখচ করছে তার মনে। কিছু একটা বেঠিক লাগছে তার। ছেলেটাকে জ্যোতি কি আগে কোথাও একটা দেখেছে? চেনা চেনা ঠেকছে কেনো? মুখটা দেখে কী যেন মনে করি করি করে মনে আসছে না। কে ছেলেটা?
____________________°_________________
ছেলের নাম রবিন। রবিনের ফ্যামিলির থেকে তার বাবা মা, বিবাহিত বড় ভাই ও তার স্ত্রী-সন্তান, ছোট বোন এসেছে অরোরাকে দেখতে।
শাহরিয়ার মুখে একটা হাসি লটকে রেখেছে সেই কখন থেকে। কোলে জুবায়ের নড়াচড়া করছে। ছেলেটাকে একদণ্ড বসিয়ে রাখা যায় না। সবসময় কোলে করে হেঁটে বেড়ানো লাগে। আচ্ছা পাজি হয়েছে! শাহরিয়ার পা হালকা দুলিয়ে দুলিয়ে ছেলেকে সন্তুষ্ট করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
কথা বলার একপর্যায়ে রবিনের বড় ভাই রুহান প্রশ্ন করে,
“আপনার ওয়াইফকে দেখছি না যে?”
শাহরিয়ার মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই মাপা মাপা স্বরে বললো,
“আমার স্ত্রী রিলিজিয়াস মাইন্ডের। অপরিচিত কোনো পুরুষের সামনে আসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।”
শাহরিয়ার সোজাসাপটা উত্তরে রুহান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। যেন শাহরিয়ার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সে অনধিকার চর্চা করেছে। তাই আর কোনো প্রশ্ন করলো না এই বিষয়ে।
“বাবুর বয়স কত?”
রুহানের স্ত্রী রীতি প্রশ্ন করলো শাহরিয়ারের দিকে চেয়ে থেকে।
“চার মাস।”
___________________°__________________
জ্যোতি চুল আচঁড়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শাহরিয়ার বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কী যেন করছে, পাশেই জুবায়ের ঘুমাচ্ছে। সেদিকে চেয়ে জ্যোতি একটা হতাশার শ্বাস ফেললো। এখন কত নিষ্পাপ শিশুর মতো ঘুমুচ্ছে। অথচ রাত যত বাড়বে এই খুদের অত্যাচার তত বাড়বে।নিজে তো জেগে থাকবে থাকবেই, সাথে বাবা মার ঘুমও হারাম করে দিবে। জ্যোতি চোখ সরিয়ে নিবদ্ধ করে ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কাজরত শাহরিয়ারের দিকে। সারাদিনের মনে খচখচ করা কিছু প্রশ্ন আবার যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। জিজ্ঞেস করবে?
“উহুম,”
জ্যোতি হালকা কেশে বললো,
“তারপর, কেমন দেখলেন ছেলের ফ্যামেলিকে?”
“উঁ? হ্যাঁ, ভালোই। স্ট্যানডার্ড ফ্যামেলি। কথাবার্তা বলে ভালোই মনে হলো। ছেলেও সবার বেশ পছন্দ হয়েছে।”
জ্যোতি চুপ করে গেলো।
“ছেলের নাম কী?”
“রবিন।”
“ডেট ফাইনাল করেছেন বিয়ের?”
“না, এখনও ফাইনাল করা হয় নি। এনগেজমেন্টের ডেট ফিক্স করা হয়েছে আপাতত। নেক্সট উইকে রাখা হয়েছে এনগেজমেন্ট।”
জ্যোতি আর কিছু বললো না। কিন্তু মনে কিছু একটার খচখচানি ঠিকই রয়ে গেলো।
_________________°______________
বেলকনিতে থাকা ঝুলাটায় কিছুক্ষণ বসে আনমনে চিন্তা করতে লাগলো জ্যোতি। কিছু একটা নিয়ে তার কপালে ভাঁজ পড়ে আছে সেই কখন থেকে।
দুদিন ধরে মনের খচখচানি কমার বদলে পারদের তরতর করে বেড়ে চলছে। বারবার মনে হচ্ছে সে কিছু একটা মিস করে গেছে, কিছু একটা ভুলে বসে আছে। মোদ্দা কথা অরোরা যেই ছেলেটাকে পছন্দ করেছে জ্যোতির তার প্রতি কেমন যেন একটা দ্বিধা ভাব কাজ করছে। নিজের চিন্তায় নিজেই বিরক্ত সে।
একটু পরপরই জুবায়েরের কান্না শুরু হলে জ্যোতির ধ্যান ভাঙে। দ্রুত বেলকনি থেকে উঠে রুমে চলে এলো।
মিতু তাকে দেখে বললো,
“আপু, খিদে পেয়েছে সম্ভবত।”
জ্যোতি মাথা নেড়ে জুবায়েরকে কোলে নিয়ে নেয়।
_________________°_______________
“আমার ছেলেটাকে কেনো যেন ভালো ঠেকছে না, বুঝলেন?”
জ্যোতি বিছানায় একপাশ হয়ে শুয়ে জুবায়েরের পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বললো।
শাহরিয়ার তোয়ালে দিয়ে ভেজা মুখ মুছা বাদ দিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
“কেনো?”
জ্যোতি অনিশ্চিত ভাবে বললো,
“জানি না। আমার সিক্স সেন্স কেনো যেন ছেলেটাকে ভালো ভাবে নিচ্ছে না।”
শাহরিয়ার মুখ মুছে তোয়ালেটা একপাশে সরিয়ে রেখে জ্যোতির পাশে বসলো।
“এতো দুশ্চিন্তা করো না। তাছাড়া এসব থেকে দূরে থাকলেই ভালো হবে আমাদের। বাকিরা তো দেখছেই। সবচেয়ে বড় কথা ছেলেটা অরোরার পছন্দের। আমাদের মতামত খুব একটা প্রাধান্য পাবে না সেখানে। এখানে কিছু বলতে গেলেই ঝামেলা হবে।”
জ্যোতি মেনে নিলো কথাটা। আসলেই, শুধু শুধু ঝামেলা করার কোনো মানে হয় না।
__________________°________________
“ওখানে সবকিছু ঠিক আছে?”
মায়ের প্রশ্নে জ্যোতি নিজের কন্ঠে প্রয়োজনের বেশি উচ্ছ্বাস ঢেলে বললো,
“হ্যাঁ, সবকিছু ঠিকঠাক আছে। শুধু তোমার নাতি অনেক জালাতন করে। রাতে ঘুমাতেই দেয় না!”
ফোনের ওপাশে রত্নার চাপা হাসির ধ্বনি শোনা গেলো।
“মা হয়েছিস, এসব ভোগ করা লাগবেই।”
জ্যোতির মুখ মলিন হয়ে এলো।
“জানো, মাঝে মধ্যে এতো কান্না পায়! বুঝতেই পারি না কী করবো। তাও তো মিতু আছে দেখে কিছুটা ছাড় পাই। নয়তো আমি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যেতাম!”
রত্নার ভীষণ মায়া হলো মেয়ের জন্য। কন্ঠে আদর ঢেলে বললেন,
“বাসায় আয়, কিছুদিন ঘুরে যা। ভালো লাগবে।”
জ্যোতি অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দেয়,
“দেখি।”
রত্না সচকিত হয়ে বললেন,
“তোর শ্বাশুড়ির কী অবস্থা? তোর সাথে স্বাভাবিক তো?”
জ্যোতি এইবার কিছুটা থমকে গেলো। মুহুর্তেই মানস্পটে হানা দিলো কিছু স্থিরচিত্র। তবুও কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে জবাব দিলো,
“হুম। সবকিছু ঠিক আছে। তুমি দুশ্চিন্তা করো না। আমি দেখি, সুযোগ পেলে একপাক ঘুরে আসবো তোমাদের ওখান থেকে।”
“তোর ছোট ননদের এনগেজমেন্ট কালকে না?”
“হুম। তোমাদের তো ইনভাইট করা হয়েছে, তাই না? আসবে না?”
রত্না কন্ঠে অনিশ্চিত ভাব ফুটিয়ে তুলে বললেন,
“নিশ্চিত না।”
আরও কিছুক্ষণ মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলে জ্যোতি ফোন রেখে দিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো।
আসলে সে মাকে মিথ্যে বলেছে। সবকিছু স্বাভাবিকের আড়ালে আসলে অস্বাভাবিক রয়েছে। সেদিন ফারিয়ার সাথে ওই ঘটনার পর থেকে কিছুটা অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছে বাড়িতে।
শাহরিয়ার মায়ের প্রতি যত্নে খামতি না রাখলেও কেমন যেন সূক্ষ্ম একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে মায়ের সাথে তার। এতই সূক্ষ্ম যে চোখে ধরা পড়ে না, কিন্তু যার সাথে দূরত্ব সে ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছে বেশ।
_______________°____________
“শাহরিয়ার, তোমার সাথে আমার কথা আছে, আমার কামরায় আসো।”
ড্রয়িং রুমে বসে ফোন স্ক্রোল করছিলো শাহরিয়ার, হুট করে সেখানে ফারিয়া এসে কথাটা বললেন।
শাহরিয়ার মুখে নির্লিপ্ত ভাব বজায় রেখে বললো,
“এখানেই বলতে পারো। আমার কোনো সমস্যা নেই।”
ফারিয়া তপ্ত শ্বাস ফেলে কন্ঠে ভারিক্কি ভাব বজায় রেখে বললেন,
“কিন্তু আমার সমস্যা আছে! এখানে বলতে পারবো না, তুমি আমার রুমে আসো।”
শাহরিয়ার সশব্দে নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
“চলো।”
নিজের রুমে এসে ফারিয়া কোনোরকম প্রারম্ভিকতার ধার না ধরে সোজা প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন,
“কী সমস্যা তোমার? এরকম আচরণ করছো কেনো?”
শাহরিয়ার যেন বুঝতে পারেনি এমন ভঙ্গিতে শ্রাগ করে বললো,
“কিরকম আচরণ করছি?”
ফারিয়া কোনো কথা খুঁজে পেলেন না উত্তরে। আসলেই তো? কেমন আচরণ করছে? খালিচোখে তো স্বাভাবিকই আছে। তারপরও ভিতরে বারবার অনুভূত হচ্ছে সব স্বাভাবিক নেই। কিছু একটা পূর্বের মতোন নেই। ফারিয়া আড়ষ্ট বোধ করলেন উত্তর খুঁজে না পেয়ে। দায়সারা ভাবে বললেন,
“এইযে, কেমন যেন আচরণ করছো। আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না। কিন্তু আমি জানি তুমি ঠিক বুঝতে পারছো আমি কিসের কথা বলছি। সেদিনের ঘটনার পর থেকেই তোমার ভিতর এই পরিবর্তন এসেছে। যেন তুমি আমার ছেলে তাই দায়বদ্ধতার খাতিরে আমার খোঁজ খবর রাখছো, আগের সেই আন্তরিকতাটা দেখছি না আমি তোমার মধ্যে।”
শাহরিয়ার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু চিন্তা করতে করতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,
“তোমার কথা বুঝতে পারছি না। বুঝিয়ে বললে ভালো হতো। কোন দিনের কথা বলছো যেন?”
ফারিয়া ভীষণ অসহায় বোধ করলেন। শাহরিয়ার যে ইচ্ছাকৃত ভাবে না বুঝার ভান ধরেছে এটা তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। এজন্য আরও বেশি বিব্রত বোধ করছেন তিনি। শাহরিয়ার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও উত্তর না পেয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলো,
“বলো? কোন দিনের কথা?”
ফারিয়া তবুও চুপ করে রইলো।
“আমি বলছি কেমন। যেদিন ছেলের সামনে ছেলের বউকে চড় মেরেছো, সেদিনের কথা তাই না?”
ফারিয়া কী বলবেন ভেবে পেলেন না। কেমন এক জিঘাংসাময় চোখে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। মানসিক দহন তার সহ্য হচ্ছে না আর!
শাহরিয়ার যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে সোফায় গা ছেড়ে বসলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আহহা, দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তুমিও বসে পড়ো। দাঁড়িয়ে কতক্ষণ কথা বলবে?”
ফারিয়া ধীরে ধীরে বিছানা বসে পড়লেন।
শাহরিয়ার নিজেও কিছু বলছে না। ফারিয়াও কথা খুঁজে পাচ্ছে না। অদ্ভুত পীড়াদায়ক এক নীরবতা!
শেষমেশ ফারিয়া মুখ খুললেন,
“তুমি সবকিছু স্বাভাবিক করো। আমার এসব ভালো লাগছে না, শাহরিয়ার!”
ফারিয়ার গলা শুনে মনে হলো তার গলায় ব্যাঙ ঢুকেছে, কেমন ফ্যাসফ্যাসে শোনা গেলো কথাটা।
শাহরিয়ার শ্রাগ করে বললো,
“সব তো স্বাভাবিকই আছে! আর কত স্বাভাবিক চাও তুমি?”
ফারিয়া সরাসরি তাকালেন ছেলের চোখের দিকে। চোয়াল শক্ত করে বললেন,
“কালকে তোমার বোনের এনগেজমেন্ট। আমি চাচ্ছিনা আমাদের মধ্যে আর কোনো ভুল বুঝাবুঝি থাকুক। তাই আজকেই সবটা ক্লিয়ার করা উচিত।”
শাহরিয়ার এবার একটু ঝুঁকে বসলো, যেন এতক্ষণে আসল কথা পেড়েছেন ফারিয়া।
“এক্সেক্টলি! আমি তো এটাই চাইছিলাম যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না থাকে। কিন্তু তুমিই তো সেটা চাইলে না! ইচ্ছাকৃত ভাবে জল ঘোলা করলে। আমার কী দোষ?”
ফারিয়া কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে, যেন কোনো কথাই তার বোধগম্য হচ্ছে না।
শাহরিয়ার বুঝিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
“তুমি ভুল করেছিলে মা! ভুল করলে নিজে থেকে স্যরি বলতে হয়, এটাই নিয়ম। সেখানে আমি তোমায় বারবার বললাম স্যরি বলতে। অথচ তুমি নিজের ভুলটুকুকে ভুল বলে জ্ঞানই করলে না! ভুল অস্বীকার করলে কি সেটা আর ভুল থাকে না? সঠিক হয়ে যায়, মা?”
ফারিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন,
“তো এখন কী করতে বলো আমাকে? মাফ চাইবো ওর পায়ে ধরে?”
শাহরিয়ার হতাশ হলো। ভীষণ হতাশ। কন্ঠে সেটা একটুও রাখঢাক করার প্রচেষ্টা না করেই হতাশার সুরে বললো,
“মা, আমি তোমাকে কীভাবে বুঝালে তুমি বুঝবে বলো তো? পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন আসছে কেনো? আমি বা জ্যোতি দুজনের একজনও তোমাকে সেটা করতে বলেছি? জ্যোতিকে নিয়ে আসার পরেও আমি তোমাকে রিকুয়েষ্ট করে বারবার বলেছিলাম, ‘যা হয়ে গেছে সেটা অতীত, ওটাকে বর্তমানে টেনেহিঁচড়ে আনার কোনো প্রয়োজন নেই। জ্যোতিকে একটু স্বাভাবিক ভাবে নেওয়ার চেষ্টা করো।’ তুমিও তো এতে রাজি হয়েছিলে। তাহলে এখনও কেনো এমন অবুঝপানা করছো? দোয়া করে আমাকে ডিভাইডেড হতে দিও না। আমি ডিভাইড হতে চাই না। আমাদের পরিবারটা খুব বেশি বড় না। এটাকে আরও টুকরোতে বিভক্ত করার জন্য তোমার এতো তোড়জোড় কেনো আমাকে একটু বলো প্লিজ? অন্তত একটা যৌক্তিক কারণ দেখাও? এই জায়গায় আমার বউয়ের ভুল হলে আমি তাকেও শাসন করতাম। কিন্তু আমি যতটুকু দেখছি ভুল তো ওর মধ্যে তেমন নেই। তাহলে?”
ফারিয়া চুপ করে রইলেন।
শাহরিয়ার আবার বলতে শুরু করে,
“তুমি ওকে বহিরাগতদের মতো ট্রিট করো, অরোরা আমার সামনে ওর সাথে বেয়াদবি করে। মানে এগুলো কী বলো তো? এই সমস্ত আচরণ তোমাদের সাজে? যায় তোমাদের সাথে? জ্যোতি আমাকে ভরসা করে, আমার হাত ধরে আবার এসেছে এই বাড়িতে। সেখানে আমার সাথে ওর সম্পর্কের কারণে ওকে যদি বারবার অপমান অপদস্ত হতে হয় তাহলে স্বামী হিসেবে আমার কি এসব মেনে উচিত? এটা যুক্তিযুক্ত? আমি কার কথা বলছি! বেশি দূরে যাওয়ার তো দরকার নেই, ছোট মামার কথাই ধরো? এসমস্ত আচরণের কারণে উনিও তো মামানীকে নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন, ভুলে গিয়েছো?”
ততক্ষণে ফারিয়ার মুখ থমথমে হয়ে উঠেছে। আঁধার ঘনিয়ে এসেছে তার সুশ্রী মুখে। শাহরিয়ার থামলে শান্ত শীতল কণ্ঠে বললেন,
“ঠিক আছে। জ্যোতিকে বলে দিও আমি তাকে স্যরি বলেছি। এবার সবকিছু থামাও।”
শাহরিয়ার হকচকিয়ে গেলো একটু। হয়তো আশা করেনি কথাটা। কথাটা বোধগম্য হতেই বলতে চাইলো,
“ভুল তো তুমি করেছো। তোমার হয়ে স্যরি আমি কেনো বলবো? তোমার নিজে বলা উচিত না?”
কিন্তু বলতে পারলো না মায়ের চেহারা দেখে। বিনিময়ে প্রশ্ন করলো,
“নিজের ভুল স্বীকার করছো তাহলে?”
ফারিয়া কিছুক্ষণ মৌন থেকে উত্তর দিলেন,
“হ্যাঁ!”
#চলবে……