#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃঅন্তিমপর্ব
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
কেটে গেছে চার চারটি দীর্ঘ বসন্ত। সময় যেমন আপন গতিতে বয়ে চলে ঠিক তেমনই জীবনও আপন গতিতে বয়ে চলে, থেমে থাকে না কারোর জন্য।
এই চারটি বছরে প্রত্যেকের জীবনে এসেছে পরিবর্তন, এসেছে নতুনত্ব, খুঁজে পেয়েছে নিজ নিজ অবলম্বন।
অরোরার বিয়ে হয়েছে মাহমুদের সঙ্গে বছর দুই আগে। অরোরা এই সম্পর্কে রাজি ছিলো না কোনোমতেই , মাহমুদের মতো একটা ছেলেকে নিজের এমন জীবনের সাথে জুড়ে নিতে তার মন সায় দিচ্ছিলো না, বারবার মনে হচ্ছিলো ছেলেটাকে ঠকানো হবে। তারউপর তার জীবনের ওই দুর্ঘটনার পর নতুন কোনো সম্পর্ক তৈরি করা নিয়ে তার ভিতর ভীতি কাজ করছিলো। বিয়ে, প্রেম, ভালোবাসা এগুলো নিয়ে একপ্রকার ফোবিয়া তৈরি হয়ে গিয়েছিলো তার অভ্যন্তরে। কিন্তু মাহমুদ আর অরোরার খালামনি সব জানার পরও অরোরাকে মাহমুদের বউ করতে চেয়েছিলো, অরোরাকে তার নিজ পরিবারের পাশাপাশি মানসিক সাপোর্ট দিয়েছিলো। মাহমুদ দুটো বছর তার পিছনে পরে ছিলো জোঁকের মতো। শেষমেশ অরোরা হার মেনেছে মাহমুদের প্রচেষ্টার কাছে। খুব অনাড়ম্বর ভাবে তাদের বিয়েটা হয় অরোরার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে। বিয়ের বছর ঘুরতেই তাদের এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়। এখন অরোরা,স্বামী সন্তান নিয়ে হ্যাপিলি ম্যারিড।
মাহিরা আর রাজিবের আরো একটি সন্তান হয়েছে, এইবার কন্যা সন্তান। শ্বশুর বাড়িতে মাহিরার আদর আরও বেড়েছে। স্বামী বটবৃক্ষের মতো হলে স্ত্রীদের মাথা কখনো নত হয় না। পুরুষের শুধু প্রয়োজন সব সম্পর্কের ভারসাম্য ঠিক রাখা।
জ্যোতি আর শাহরিয়ার? ওদেরও কোল আলো করে একটা কন্যা সন্তান হয়েছে, নাম রাখা হয়েছে জয়িতা। নতুন সদস্যের আগমনে বাড়ির প্রত্যেকের খুশি দেখে কে!
জ্যোতির প্রতি প্রত্যেকের দৃষ্টি ভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। ফারিয়াও তার প্রতি যথেষ্ট যত্নবান হয়েছেন এখন। পুত্রবধূকে নিয়ে অযথা ঈর্ষাপরায়ন হোন না এখন আর তিনি আগের মতন। আগের মতো খিটখিটে স্বভাবও তার মধ্যে আর বিদ্যমান নেই। জীবন তাকে বেশ ভালো শিক্ষাই দিয়েছে।
শ্বশুর বাড়িতে এখন জ্যোতির ভিত বেশ শক্তপোক্তই হয়েছে। পাক্কা গিন্নি হয়েছে সে।
ছোট্ট জুবায়েরের বয়স গুটি গুটি করে বাড়তে বাড়তে সাড়ে চার বছরে এসে ঠেকেছে। ছোট বোনকে পেয়ে সেও খুশি। তবে মাঝে মধ্যে শিশুসুলভ ঈর্ষা যে হয়না, এমন না। এই বছর তাকে স্কুলে ভর্তি করানো হবে। কিন্তু সে একদমই ইচ্ছুক না এতে!
রবিনের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। ওর বিপক্ষে প্রায় তিনটা বছর মামলা চলেছিলো। গতবছর রায় হয়েছে। কথায় আছে পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না, তার ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই হয়েছে।
আর জান্নাত?
মেয়েটা তার জীবন যেখানে থেমেছে, ঠিক সেখান থেকেই আবার নতুন করে শুরু করেছে। পরিবার তাকে অনেক বুঝিয়েছে পুনরায় বিয়ে করতে, কিন্তু সে রাজি হয়। নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মতো ধৈর্য, সাহস বা শক্তি তার মধ্যে এখন আর নেই। প্রথম সম্পর্কে যে বিভীষিকাময় স্মৃতি তার মানস্পটে ভাসে এরপর জীবনকে দ্বিতীয়বার যাচাই করে দেখার হিম্মত তার হয় না। অদূর ভবিষ্যতে হলে তখন দেখা যাবে। আরো একটা ভয় কাজ করে তার অভ্যন্তরে। যদি নতুন সংসারে আর মেয়েটা অবহেলিত হয়? তখন মা হয়ে সে সহ্য করবে কীভাবে? তাই নিজেই নিজের অবলম্বন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তার আফরা আছে, আর কী চাই? সেই থেকে সে আজ পর্যন্ত সিঙ্গেল মাদার রয়ে গেছে।
টুকটাক হাতের কাজ জানতো সে, তার উপর রান্নার হাত দারুণ, কেক বেকিং এর কাজও শিখেছিলো শখের বশে। সেই শখই এখন তার রুজিরোজগারের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুরুটা অনলাইনে মাধ্যমে করেছিলো, আস্তে ধীরে সেটা বড় হতে হতে এখন ছোটখাটো নিজস্ব একটা বেকারি শপ আছে তার। নিজের এবং মেয়ের ভরণপোষণ তো করছেই পাশাপাশি বাবা মায়েরও করছে।
নওশাদও বিয়ে করেছে গত বছর মায়ের জোরাজুরিতে। সেও সুখে আছে।
____________________°____________________
শাহবাজ ম্যানশনে ডাইনিং টেবিলে সবাই সকালের নাস্তা করতে বসেছে।
আজকে জুবায়েরকে স্কুলে ভর্তি করানো হবে। যদিও ফেব্রুয়ারী মাস শেষ হয়ে গিয়েছে, তবুও তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে পরের বছরের চিন্তা বাদ দিয়ে এই বছরই ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই থেকে তার কান্নাকাটি, গাল ফুলানো চলছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। তার বাবা-মা ঠিকই নিজ সিদ্ধান্ত অনড়।
শাহরিয়ার পাউরুটিতে জ্যাম মেখে ছেলের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে গম্ভীর স্বরে বলো,
“চুপচাপ খেয়ে সুবোধ বালকের মতো মাম্মার কাছে রেডি হবে। কোনো ভণিতা করলে চলবে না, বুঝলে?”
জুবায়ের কাঁদো কাঁদো মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু লাভ হবে না বুঝতে পেরে অসহায় চোখে তাকালো দাদা-দাদুর দিকে৷ কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাহায্যের আভাস এলো না। সোহাইল সাহেব একটু কেশে তাৎক্ষণিকভাবে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেললেন, ফারিয়া ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কাঁদো কাঁদো চেহারায় সবই দেখলো জুবায়ের।
এতো বড় ধোঁকা! শেষমেশ দাদা-দাদুও তার সাথে বেইমানি করলো! সব বেইমান ঘুরেফিরে তার আশেপাশেই কেনো থাকে!
জিদে নাক টানতে টানতে বললো,
“আমি যাবো না ইসকুলে! আমি বড় হইচি একনো?”
জ্যোতি “উহুম উহুম” করে কেশে উঠলো। জুবায়ের তার দিকে তাকালে কড়া চোখের চাহুনি ছুড়ে মারলো ছেলের দিকে।
জুবায়ের মায়ের নিষেধাজ্ঞা থোড়াই পরোয়া করলো। এবার আরো ক্ষেপে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমাকে নিলে জইকেও নিতে হবে! ওকেও ইস্কুলে ভর্তি করাতে হবে! না’লে আমি যাবোনা!”
এবার সকলেই কেশে উঠলো একযোগে। বলে কী এই ছেলে! জয়িতাকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে! সবে দেড় বছর বয়স জয়িতার!
শাহরিয়ার ক্ষেপে বললো,
“ফাজলামো করা হচ্ছে আমার সাথে? তোমার বোনের বয়স হয়েছে স্কুলে যাওয়ার? নিজে গুণে গুণে বোনের থেকে তিন বছরের বড় হয়েও স্কুলে না যাওয়ার জন্য হাত পা ছুড়ে কাঁদছে, আর উনি বলে কিনা বোনকেও নিতে হবে! মগের মুল্লুক সব!”
“আহ্হা! বকা দিচ্ছিস কেনো?”
সোহাইল সাহেব ছেলেকে কপট ধমক দিলেন। জুবায়ের লুফে নিলো সেটা।
“বকবেই তো! বাবা সব ভালো খালি জইকে বাসে! আমাকে এত্তুও বাচে না! এজন্যই ইস্কুলে ভর্তি করাচ্চে! যাতে জইকে নিয়ে একা একা ঘুরতে বেরাতে পারে! আমি বুঝি না কিছু? সব বুঝি!”
বাকিরা এ কথা শুনে হেসে উঠলো সাথে সাথে। কী বুদ্ধি রে বাবা! এই তার বুঝার নমুনা!
জ্যোতি ঠোঁট টিপে হেসে বিড়বিড় করে বললো,
“পড়াশোনায় তার মন নেই, কিন্তু নাটক করে ভালো!”
কেবল শাহরিয়ার শীতল চোখে তাকিয়ে রইলো ছেলের দিকে। বাবার চাহুনি দেখে জুবায়ের এবার একটু ভয় পেলো। বেশি বলে ফেলেছে নাকি?
শাহরিয়ার ছেলের মতামতকে রীতিমতো বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যেন তার ধারণাকেই সত্যি প্রমাণ করতে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওর খাওয়া শেষ হলে রেডি করিয়ে দিও। ওকে নিয়ে বেরুবো আমরা। আর রেডি হতে না চাইলে হাত পা বেঁধে রেডি করাবে। বেশি লম্ফঝম্প করলে এক্কেবারে হোস্টেলে দিয়ে দিবো!”
_____________________°___________________
অনেক কসরতের পর জুবায়েরকে ভর্তি করানো হয়েছে। কিন্তু ক্লাসে পাঠানোর কিছু সময়ের মধ্যেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে কেটে আব্বু আম্মুর কাছে ছুটে এসেছে। তার ইসকুল একদম পছন্দ হয়নি। তার ভাষ্যমতে ক্লাসে সে বাদে সবগুলো ছেলে দুষ্টু! কী মহাজ্ঞানী! কয়েক মিনিটেই বুঝে গেছে সে বাদে বাকি সব বাচ্চা দুষ্টু! সে অতিশয় ভদ্র ব্যক্তি!
শেষে শাহরিয়ার আর জ্যোতি অপ্রস্তুত হয়ে টিচারদেরকে বলে জুবায়েরকে নিয়ে সেদিনের মতো স্কুল থেকে বেরিয়ে এসেছে।
জুবায়েরের ফর্সা মুখটা কান্নাকাটির কারণে ফুলোফুলো হয়ে গেছে। কান্না থামানোর জন্য তাকে আইসক্রিম কিনে দেওয়া হয়েছে। এখন ঠোঁট উল্টে গাল ফুলিয়ে সেটা খাচ্ছে গাড়িতে বসে।
গাড়িটা এক জায়গায় থামিয়ে রেখে শাহরিয়ার কতক্ষণ তাকিয়ে দেখতে লাগলো সেই দৃশ্যটা।
তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে স্বরে বললো,
“বাবা, লেখাপড়া করতে হবে না তোমাকে? এমন করলে চলবে?”
জুবায়ের ঠোঁট উল্টে বললো,
“আমার ইসকুল ভালো লাগেনা।”
“না গেলে ভালো লাগবে কীভাবে? ভালো লাগার জন্য তো যেতে হবে, তাই না? কদিন গেলে এমনিতেই ভালো লাগবে। তখন প্রতিদিন যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকবে।”
জুবায়েরের কোনো ভাবান্তর হলো না এই কথায়, একমনে আইসক্রিম খেতে থাকলো সে।
শাহরিয়ার আবার বললো,
“আর এমন করো না কেমন? তুমি যদি ঠিকঠাক পড়াশোনা করো তাহলে ভ্যাকেশনে তোমাকে তোমার পছন্দের দেশে ঘুরতে নিয়ে যাবো, ঠিক আছে?”
জুবায়ের লাফিয়ে উঠলো, উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
“থাইল্যান্ডে, বাবা?”
শাহরিয়ার হালকা হেসে বললো,
“হুম।”
“আমরা ডলফিন দেখবো, বাবা?”
“হুম, বাবা, দেখবো।”
জ্যোতি পিছনের সিটে বসে বাবা ছেলের কথপোকথন শুনছিলো। এই কথা শোনার পর বিড়বিড় করে বললো,
“হু, আমাদের নিয়ে যেন ঘুরাঘুরি করার সময় আছে তার! কী সুন্দর ভাঁওতা দিচ্ছে ছেলেকে! ভাঁওতাবাজ একটা!”
শাহরিয়ার শুনতে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বউয়ের দিকে তাকালো,
“তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“আমার বয়েই গেছে বিশ্বাস করতে! হুহ!”
শাহরিয়ার ছেলেকে নিজের দলে টানার জন্য বললো,
“দেখলে, তোমার মাম্মা বিশ্বাস করলো না! বাবা কি মিথ্যে বলছি, বলো তো?”
জুবায়ের মাথা এদিক ওদিক নাড়িয়ে না বললো, অর্থ বাবা মিথ্যে বলছে না। সে বিশ্বাস করেছে বাবাকে।
তারপর হঠাৎ চিন্তিত হয়ে বললো,
“বাবা, জই’ও যাবে আমাদের সাথে?”
শাহরিয়ার ভ্রু কুটি করে বললো,
“তো কি ওকে রেখে যাবো? তুমি তো আচ্ছা পাঁজি হয়েছো! বোনকে সাথে রাখতেই চাও না!”
“এহ! আমি তো জইয়ের ভালোর জন্যই বলেচি। ও ডলফিন দেখলে ভয় পাবে না?”
“তুমি না পেলে ও কেনো পাবে?”
“আমি তো বড় হয়ে গেচি, ও তো একনো ছোট।”
শাহরিয়ার এক ভ্রু উঁচু করে তীর্যক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সকালে না বললে তুমি এখনো ছোট? তাহলে এখন এক লাফে বড় হয়ে গেলে কী করে?”
ব্যস! জুবায়ের সেই যে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছে আর কোনো কথা বলেনি পুরো রাস্তায়। নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেছে বেচারা।
______________________°___________________
রাতে শাহরিয়ার আর জ্যোতি টেরেসে বসে আকাশ দেখছিলো। আকাশে প্রায় পূর্ণ চাঁদ উঠেছে, দুই দিন পরেই সম্ভবত পূর্ণিমা। নীলাভ আকাশ জুড়ে ছোট ছোট তারার মেলা বসেছে। কিন্তু হালকা কুয়াশার কারণে খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
বছরের শুরুর দিক বলে চারদিকে হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। শাহরিয়ার জ্যোতির হাত নিজের সামনে নিয়ে বসে আছে, একটু পর পর চুমু খাচ্ছে সে হাতে। জ্যোতি মুচকি হেসে মূহুর্তটা উপভোগ করছে।
এমন সময় জুবায়ের ছুটতে ছুটতে সেখানে এলো, এসেই বিস্ফোরকের মতো বলে বসলো,
“মাম্মা-বাবা, তোমরা কি প্রেম করছো?”
যেন টেরেসে বিস্ফোরণ হয়েছে, এমনভাবে চমকে জ্যোতি আর শাহরিয়ার পিছনে তাকালো। শাহরিয়ার অপ্রস্তুত হয়ে সাথে সাথে বউয়ের হাত ছেড়ে দিলো। জ্যোতির লজ্জায় মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখলো।
ছেলেটা এত্তো পাঁজি! সবসময় তাদের রোমান্টিক মূহুর্তে বাগড়া দেয়!
শাহরিয়ার চোখ মুখ গরম করে বললো,
“তোমাকে এই কথা কে শিখিয়েছে?”
“রিলসে দেখেছি বাবা, ছেলে-মেয়ে নাকি একসাথে প্রেম করে!”
শাহরিয়ার তাজ্জব হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। বলে কী এই ছেলে! হতাশ হয়ে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আরো দেও হাতে মোবাইল!”
জ্যোতি সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বললো,
“এই খবরদার! ওর হাতে ট্যাব আপনি দিয়েছেন! আমার কোনো দোষ নেই!”
তারপরের ঘড়ি ধরে কয়েক মিনিট শাহরিয়ার ছেলেকে বোঝালো এসব পঁচা কথা বলতে নেই। এগুলো বললো আল্লাহ পাপ দিবে। মাম্মা বাবা শুধু একটু টাইম স্পেন্ড করছিলো, ব্যস!
ছেলেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিচে পাঠিয়ে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সে।
“ওর মুখ এতো ডাইরেক্ট হলো কীভাবে? তোমার থেকে পেয়েছে নিশ্চিত!”
জ্যোতি ক্ষেপে বললো,
“হ্যাঁ যত খারাপ সব আমার থেকে পেয়েছে তাই না? আর আপনি দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা?”
বউ ক্ষেপে যাচ্ছে বুঝতে পেরে শাহরিয়ার জ্যোতিকে টেনে নিজের কাছে এনে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, কাঁধে থুতনি রেখে আদুরে গলায় বলে,
“আমি তো মজা করছিলাম বউ, আমার বউটা মজাও বোঝে না। এখন তো আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছে,
বোঝে না সে~ বোঝে না~”
জ্যোতি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বলে,
“ছাড়ুন! ঢঙ দেখানো হচ্ছে এখন! আপনার সিআইডি কখন না আবার পিছন থেকে এসে আবার কোন বোম ফাটায়…. ছাড়ুন!”
শাহরিয়ার চাপা হাসি হাসে, তারপর জ্যোতির কাঁধে মুখ ডুবিয়ে বলে,
“আসবেনা, সিআইডিকে নিচে পাঠিয়ে দিয়েছি। বউয়ের সাথে ঢঙ করবো না তো কার সাথে করবো? দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র বউ আমার!”
“আরো বউ আনার সখ আছে মনে হচ্ছে? ঘটক ধরবো আপনার জন্য?”
শাহরিয়ার মজা করে বললো,
“তুমি একাই তো একশো। তোমাকে সামলাতে সামলাতেই তো তোমার স্বামী বুড়ো হয়ে যাচ্ছে!”
হঠাৎ জ্যোতি কেমন চুপ হয়ে যায়। শাহরিয়ারের খটকা লাগে একটু।
“বউ? কী হয়েছে?”
জ্যোতি কেমন মন খারাপ করা সুরে বলে,
“আমরা আস্তে আস্তে বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, তাই না? স্বাভাবিক হায়াত পেলে একটা সময় আমাদের চামড়াও কুঁচকে যাবে, আমরাও বুড়ো হবো। সময় এতো দ্রুত চলে যায় কেনো, বলুন তো?”
শাহরিয়ার জ্যোতির সামনাসামনি এসে তার কোমড়ে দুই হাত বেঁধে বললো,
“সব কিছুরই শেষ থাকে বউ। কোনো কিছু তৈরি হয়েছে মানেই একটা সময় সেটা নিঃশেষ হবে। কিন্তু তাই বলে মন খারাপ করে মাঝের সময়টুকু নষ্ট করলে হবে? এই সময়টুকু আমাদের স্মৃতিময় করে রাখা উচিত যাতে আফসোস না হয়।”
জ্যোতির ভিতরে হাসফাস লাগতে আরম্ভ করলো। শাহরিয়ার জ্যোতির মন ভালো করার জন্য আশেপাশে কেউ নেই দেখে নিয়ে ডাক দিলো,
“বউ?”
“হুম?”
শাহরিয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আদুরে চোখে তাকিয়ে কিছু ইশারায় বললো। জ্যোতি লজ্জা পেলো ভীষণ। শাহরিয়ারও হাসলো।
অতঃপর দুজনে খোলা আকাশের নীচে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু সুন্দর মূহুর্ত কাটালো নিশুতি রজনীকে সাক্ষী রেখে।
কিছু সময় পর জ্যোতি একপাশে সরে গেলো, মুখে তার লাজমাখা হাসি, গালদুটো রক্তিম। চুপচাপ দূর আকাশের দিকে চেয়ে রইলো সে।
শাহরিয়ার জ্যোতির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে জ্যোতির এক হাত ধরে।
একটু পর সে জ্যোতির হাতে চুমু খেয়ে তার দিকে ঘুরে বললো,
“আমার না এমন আবহাওয়ায় ভিতরে কেমন কবি কবি ভাব আসছে বউ!”
জ্যোতি এক ভ্রু উঁচু করে টিটকারি মেরে বললো,
“তাই নাকি? তা কবি মশাই, আমাকে একটা কবিতা শোনান তো!”
শাহরিয়ার হাসলো, বউ তার সাথে মজা করছে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু পাত্তা দিলো না, একমনে কিছুক্ষণ কিছু একটা ভেবে জ্যোতির দুইহাত নিজের দু’হাতের মধ্যে আবদ্ধ করে জ্বলজ্বলে চোখে তাকালো সহধর্মিণীর দিকে। ভীষণ বিমুগ্ধ প্রেমময় দৃষ্টিতে জ্যোতিকে দেখতে দেখতে আবেগ নিয়ে আবৃত্তি করলো একটু আগেই নিজে তৈরি করা পঙক্তিগুলো,
“~অনন্ত হোক তোমার আমার সন্ধিক্ষণ,
স্তব্ধ হোক ঐন্দ্রজালিক এই প্রহর,
কেটে যাক শতাব্দী, অজস্র অগণিত ক্ষণ,
দীপ্ত হোক ঔজ্জ্বল্যের এই আলোক প্রহর!~”
জ্যোতি অবাক হয়ে চেয়ে রইলো প্রিয় পুরুষটির দিকে। কী অপূর্ব , কী গভীর পঙক্তিগুলো! তার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপতে আরম্ভ করলো আবেগের দরুন। তারপর হঠাৎ সে আছড়ে পড়লো শাহরিয়ারের বুকে, জাপ্টে জড়িয়ে ধরলো তার শখের পুরুষটাকে শক্ত হাতে।
এক ক্ষীণ মুচকি হাসি ফুটিয়ে শাহরিয়ার নিজেও বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো তার হৃদয়ের রাজপ্রাসাদে বসানো প্রিয়তমাকে।
তাদের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে হিমেল হাওয়ার মৃদু স্পর্শ, মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতি নিজে এক অদৃশ্য ভালোবাসার আবরণে তাদের জড়িয়ে ধরেছে চারিপাশ থেকে। দূরের আকাশ কুয়াশার নরম চাদরে মোড়া। তারই মাঝে মেঘেরা খেলছিলো চাঁদের সঙ্গে লুকোচুরি, আর সেই চাঁদ যেন নীরব সাক্ষী হয়ে রইলো তাদের সেই প্রেমময় ঔজ্জ্বল্যের আলোক প্রহরের, আনমনে হেসে উঠলো শুভ্র আলোর ছায়ায়…….
{~সমাপ্ত~}