বকুলের বাস্তবতা পর্ব-০১

0
1

#বকুলের_বাস্তবতা
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি

১.
বকুলের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে তার ঘর থেকে বের করে এনে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে লাঠি দিয়ে অমানুষের মতো পেটাতে লাগল তার সৎ মা। বকুল প্রথমদিকে কিছুটা হাহাকার করলেও একসময় চুপ হয়ে গেল। কষ্টগুলো যেন তার গায়ে সয়ে গেলো। দীর্ঘ ১৭ বছর থেকে তো কম কষ্ট সহ্য করছে না। আরেকটু নাহয় করল।

দীর্ঘ সময় ধরে বকুলের উপর এই অমানবিক অত্যাচার চালিয়ে অবশেষে ক্ষান্ত হলেন আতিফা বেগম। হাত থেকে লাঠিটা ফেলে দিয়ে শুরুতেই কিছু বিশ্রী গালি দিয়ে বললেন,
“একদম মায়ের মতোই দুশ্চরিত্রা হয়েছিস। ছেলে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না তাই না? আমার ভাইপোকে নিজের রূপ দেখিয়ে পাগল করতে চাস? যেভাবে তোর মা আমার স্বামীর মাথা খেয়েছিল?”

বকুলের যায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের‍ যুক্তি দিত। কিন্তু বকুল সেটা করে না। কারণ সে জানে, এই বাড়িতে তার কোন যুক্তিই চলে না। তার মুখ থেকে বের হওয়া সবথেকে বড় সত্যিটাও এখানে মিথ্যা। তাই আর অযথা কোন পরিশ্রম করল না সে। আতিফা বেগম আর কিছু বলতে যাবেন এমন সময় সেখানে চলে আসল আতিফা বেগমের ১৫ বছর বয়সী মেয়ে আনহা। আনহা এসেই ফ্লোরে পরে থাকা বকুলকে টেনে তুলল। নিজের মায়ের দিকে রক্তির চোখে তাকিয়ে বলল,
“তুমি আবারো আপুর গায়ে হাত তুলেছ আম্মু! তোমায় না কতবার বলেছি, আমার আপুর গায়ে যেন একটা ফুলের টোকাও না লাগে।”

নিজের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন আতিফা বেগম। বলে উঠলেন,
“এই যে এসে গেছেন একজন! আমার পেটের মেয়ে হয়ে আমার বিরোধিতা কর‍তে তোর লজ্জা করে না? কিসের এত আপু আপু করছিস? নিজের মায়ের থেকে সৎ বোনকে বেশি আপন মনে হচ্ছে? আমি কি সাধে ওকে মারছি? অন্যায় করেছে জন্যই…”

“আমার বকুল আপু কোন অন্যায় করতে পারে না। আমি কখনোই সেটা বিশ্বাস করব না।”

“তাহলে কি তোর আশরাফ ভাই মিথ্যা বলছে? আশরাফ নিজে আমায় বলেছে যে..”

“আম্মু থেমে যাও। তোমার ঐ দুশ্চরিত্র, লম্পট ভাইপোর ব্যাপারে কোন কথাই আমি শুনতে চাই না। ওর কথায় তুমি বকুল আপুর উপর এত অত্যাচার করছ ভাবতেও তো আমার কেমন জানি লাগছে! মানে তোমার শুধু অজুহাত দরকার তাই না? যেকোন একটা অজুহাত পেলেই আমার আপুর উপর এমন অমানবিক অত্যাচার করবে।”

“আনহা! খুব আপু আপু করছিস! সৎবোনের প্রতি এত মায়া। একদিন দেখবি এই বকুলই তোর কাছ থেকে তোর সবকিছু কেড়ে নেবে যেভাবে এর মা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছিল..”

নিজের মায়ের ব্যাপারে এসব কথা আর সহ্য করতে পারে না বকুল। তাই তো কান্নারত স্বরে বলে,
“আমার আম্মু আপনার থেকে কিছু কেড়ে নেয় নি। আমার আম্মু এমন ছিলেন না।”

আতিফা বেগম এগিয়ে এসে বকুলের মুখ চেপে ধরে বলল,
“তোর মা কেমন ছিল সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। আমার সাথে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিল আমার স্বামীর। কিন্তু বিয়ের প্রথম ৫ বছর আমি কোন সন্তানের মা হতে পারি নি। আর এই সুযোগ ব্যবহার করে তোর মহান মা আমার স্বামীর সাথে পরকীয়া করে তোর মতো জারজ বাচ্চার জন্ম দেয়! কিন্তু কথায় আছে না, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এই পাপের ফল হিসেবেই তোর মা ক্যান্সার নামক মারণরোগে আক্রান্ত হয়। তবে মরতে মরতেও আমায় শান্তি দিল না। তোর মতো আপদকে আমার ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়ে গেল। শুধুমাত্র আমার স্বামীর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে তোকে আমি এই বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি নাহলে…”

বকুল দমে যায়। ছোটবেলা থেকে এসব কথা শুনে বড় হয়েছে সে। কিন্তু জন্মের পর ৭ বছর তো সে তার মায়ের কাছেই ছিল৷ সে তো দেখেছে তার মাকে জীবনের শেষ দিন অব্দি লড়াই করে যেতে। তার মা কতোটা আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন। নিজের মৃত্যুর আগে অব্দি তিনি বকুলের জৈবিক পিতা “আফজাল শেখ” এর সাথে যোগাযোগ করেন নি। আতিফা বেগমের সংসার ভাঙতে চান নি। কিন্তু শেষ জীবনে যে তার আর কিছুই করার ছিল না। শুধুমাত্র নিজের মেয়ের জন্য তিনি বাধ্য হয়েছিলেন বকুলের কাছে হাত পাততে। মৃত্যুর আগে বকুলের দায়িত্ব দিয়ে যান আফজাল শেখকে। আফজাল শেখও দায়িত্ববোধ এড়াতে পান নি। কোথাও না কোথাও তার মনে অনুশোচনাও ছিল। সে কারণে বকুলের দায়িত্ব নিতে তিনি কার্পণ্য করেন নি। নিজের জীবনে ঝামেলা তৈরি হবে জেনেও বকুলকে নিজের সংসারে নিয়ে এসেছেন। যতোটা পেরেছেন আগলে রেখেছেন। এখনো আফজাল শেখের উপস্থিতিতে বকুলের গায়ে ফুলের টোকাও দিতে পারেন না আতিফা বেগম।

আতিফা বেগম কোন কথা না বলে স্থান ত্যাগ করেন। তিনি চলে যেতেই আনহা বকুলকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুমি চিন্তা করো না আপু। আমি তোমার পাশে আছি। সবসময় তোমার পাশে থাকব এভাবেই।”

বকুল সামান্য স্বস্তি পায় আনহার কথায়। আনহা এবার বকুলকে আলিঙ্গন মুক্ত করে জিজ্ঞেস করে বলে,
“আপু তুমি সত্যি করে বলো তো কি হয়েছিল আজ?”

আনহার কথাটা শুনেই বকুলের মনে পড়ে যায় কিছু সময় আগের স্মৃতি। সে কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলে,
“আমি রান্নাঘরে সকলের জন্য চা বানাচ্ছিলাম। এমন সময় আশরাফ ভাই রান্নাঘরে এসে আমার হাত ধরে টান নেয়। আমি ভয়ে ওনার দিকে গরম চা ছুড়ে মারি। এরপর ওনার চিৎকার শুনে তোমার মা ছুটে আসে আর…উনি আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দেন। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছা করে ওনার দিকে চা ছুড়ে মারিনি।”

বলতে বলতেই বকুলের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে বলে। আনহা বলে,
“হুশ,আপু এভাবে কেঁদো না। তুমি কোন ভুল কাজ করো নি। আমি ওখানে উপস্থিত থাকলে তো ঐ আশরাফকে জানে মেরে দিতাম। ওকে নিজের কাজিন ভাবতেও আমার ঘৃণা লাগে। পাক্কা লম্পট একটা। এসব জানোয়ারদের এভাবেই শায়েস্তা করা উচিৎ। কিন্তু আম্মু তো কখনো তার প্রিয় ভাইপোর দোষ দেখবে না। আমি দেখছি কি করা যায়।”

বলেই আনহা সামনের দিকে পা বাড়াতে নেবে এমন সময় বকুল তাকে থামিয়ে বলে,
“এমনিতেই অনেক অশান্তি হয়েছে তুমি আর নতুন করে কিছু বলো না।”

“কি বলছ তুমি আপু? এভাবে ছেড়ে দিলে ঐ আশরাফ আরো মাথায় উঠবে। এবার ওকে আমি একটা শিক্ষা দেবোই। তুমি এত ভয় পাও কেন ওকে? ও কিছু করতে পারবে না। একটু সাহসী হওয়ার চেষ্টা করো। কাল থেকে তুমি আমার সাথে ক্যারাটে শিখতে যাবে। মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্য এসব শেখা প্রয়োজন।”

বকুল মলিন হেসে বলে,
“যতোই ক্যারাটে শিখি না কেন, মেয়ে হয়ে কখনো কি পুরুষদের সাথে গায়ের জোরে পেরে উঠব?”

“আপু তুমি বুঝছ না ব্যাপারটা। ক্যারাটে শিখলে তোমার মনেও সাহস এবং আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। তখন তুমি আর এখনকার মতো নিজেকে দূর্বল ভাববে না। আমি জানি, ছোট থেকে মায়ের অত্যাচার, অপমানে তুমি যেভাবে একটা ট্রাজিক শৈশভ কাটিয়েছ তাতে তোমার পক্ষে নিজের হয়ে আওয়াজ তোলা কঠিন। বাট, ডোন্ট ওয়ারি আমি আছি তোমার হয়ে আওয়াজ তোলার জন্য। ঐ আশরাফকে এবার আমি এমন শিক্ষা দেব যে আর জীবনেও কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।”

বলেই আনহা চরম রাগে সামনের দিকে ছুটতে থাকে। আর বকুল হতাশার চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“না জানি ও আবার কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পরে। আমার জন্যই সবটা হয়েছে। আনহার মা ঠিকই বলে আমিই হয়তো এই পরিবারের সব সমস্যার জন্য দায়ী। তুমি আমায় কেন একা রেখে চলে গেলে আম্মু?”

বলেই বকুল নিজের চোখের জল মুছে আনহার পিছনে ছুট লাগায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨