#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (০২)
কলিং বেলের শব্দে নাজনীনের ঘুম ভাঙে। অনবরত কলিং বেল বাজিয়ে চলেছে কেউ। বিরক্তিতে নাজনীনের কপালে দুটো ভাজের সৃষ্টি হয়। গায়ে ওড়না চাপিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে।
স্বভাব অনুযায়ী নাজনীন দরজা খোলার আগে আই হোলে চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। রাজন এসেছে।
দরজা খুলতেই রাজন ভেতরে প্রবেশ করে। গোটা একটি রাত ঘরে স্ত্রী রেখে বাড়ির বাইরে কাটিয়ে এসেও রাজনের মধ্যে কোন অস্বস্তি, জড়তা দেখতে পেল না নাজনীন।
ফজরের নামাজ শেষে নাজনীনের প্রতিদিনকার রুটিন ছিল সকালে রাজনের জন্য নাস্তা তৈরি করা। আজও ব্যাতিক্রম হয়নি। নাজনীন নাস্তা তৈরি করছে। পরোটা, ডিমের অমলেট আর মিক্সড সবজি ভাজি।
বিয়ের পর যবে থেকে রাজনের সঙ্গে একত্রে থাকা শুরু করেছিল । তখন থেকেই তার হাতের নাস্তা খেয়ে রাজন অফিস যেতো রোজ। অথচ, আজকের চিত্রপট ভিন্ন। রাজন সময় নিয়ে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নাস্তা না খেয়েই বেড়িয়ে পড়লো। শুধু যাওয়ার আগে বলে গেল, “আজ নাস্তা করব না।”
অনেকগুলো দিন ধরে তারা সকাল আর রাতের খাবারটা মুখোমুখি চেয়ারে বসে খায়। আজ সে রুটিন বদলে গেল। রাজনের জন্য নাজনীন আজও নাস্তা বেড়ে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছিল। কিন্তু, রাজন না খেয়েই অফিসে চলে গেল। নাজনীন কোনরকম উচ্চবাচ্য করলো না। অশ্রুসিক্ত অশ্রুসিক্ত চোখে নিজের খাবারটা শেষ করলো। রাজনের জন্য বাড়া খাবার একটি বক্সে ভরে বাসার সামনে আশ্রয় নেওয়া সদ্য মা হওয়া কুকুরটাকে দিয়ে এলো।
রাজনের জন্য আজ টিফিন বক্স ভর্তি করে নানান পদের খাবার এসেছে। নাজনীনের সন্দেহ ই সঠিক। তবে মেয়েটি নিচের শ্রেণিতে কাজ করে। রেস্টুরেন্টের এক কর্ণারে বসে আয়েশ করে রাজন খাবার খায়।
“আরেকটু দেই?” বলে আরেকটি লুচি আর খাসির গোসত তুলে দেয় রাজনের প্লেটে।
মেয়েটি খাওয়ার মাঝেই শুধায়, “ওদিকে সব ঠিকঠাক তো?”
“কিছুটা।”
রাজনের ছোট্ট উত্তর মেয়েটির বোধহয় পছন্দ হলো না। মনে মনে সে বেজায় বিরক্ত। কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো, “কিছুটা মানে কী? মেয়েটি কি রাজি হয়নি? তুমি আমাকে বলেছিলে, এ মাসের মধ্যেই বিয়ে করবে।”
রাজন খাওয়া রেখে মেয়েটির দিকে তাকায়। বলে, “মেয়েটি কাকে বলছো পিয়ালি? সে আমার স্ত্রী। এবং সেই সঙ্গে খুব ভালো একজন মানুষ। তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে।”
রেগে যায় পিয়ালি। কন্ঠে রাগ মিশিয়ে চাপা স্বরে বলে ওঠে, “এতই যখন ভালো। তাহলে আমার কাছে কি করতে এসেছিলে? এখন এসব কথায় বা কেন বলছো?”
“তুমি জানোনা কেন তোমার কাছে এসেছি? কে আগে এসেছে? তুমি না আমি?”
পিয়ালি থতমত খেয়ে যায়।রাজন মুখ খুলতে শুরু করলে পানি অনেকদূর গড়িয়ে যাবে। পিয়ালি অত্যন্ত চতুর শ্রেণির মেয়ে। সে রাজনকে সামল দিতে প্রতিত্তোরে বলে, “পুরোনো কথা টানছো কেন জান? তোমাকে হারানোর ভয়ে আমি কুকড়ে থাকি সারাক্ষণ। আমি তো একা নই বলো?”
“এতবার ঘ্যান ঘ্যান করবে না আমার সামনে। এত অশান্তি নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। আর হুটহাট দেখাও করতে চাইবে না। যখন বলেছি বিয়ে করব, করবই। তুমি যাও এখন। অফিসে হুটহাট আমার ডেস্কে চলে আসবে না। চোখে লাগে।”
“আচ্ছা জান।”
রাজন কপাল কুচকে ফেলে। এই মেয়েটির ন্যাকামো সে একদম পছন্দ করে না। কিন্তু, ফ্রিতে ফয়দা লুটতে গিয়ে এমন ফাঁদে পড়েছে, চাইলেও বেড়নোর উপায় নেই। অগ্যতা সারাজীবন সহ্য করতে হবে। রাজন হাত ঘড়িতে সময় দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ায়।
রাজন চলে যেতেই পিয়ালি মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে ওঠে, “এমন রেডিমেড মা””””ল পেতে হলে এটুকু কথা সহ্য করাই যায়। উহু বেশিক্ষণ নয়। রাস্তা কিভাবে ক্লিয়ার করতে হয় তা আমার ভালোই জানা আছে।”
_________________________
তখন তপ্ত দ্বিপ্রহর। নাজনীন সবে গোসল করে রুমে এসেছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাড়িয়ে মাথায় কুন্ডলি পাকিয়ে চুলে পেচিয়ে রাখা টাওয়েল খুলছিল নাজনীন। এরমধ্যেই শব্দ করে ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে।
রাজন কল করেছে। নাজনীন ভিষন অবাক হয়। সে বিস্ময় নিয়ে কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে রাজনের কন্ঠস্বর। জিজ্ঞাসা করে, “কি করছো নাজনীন?”
“গোসল করলাম মাত্রই।”
“খেয়েছো?”
“না।”
“খেয়ে নাও। অনেক বেলা হয়েছে।”
“হ্যাঁ।”
“বিকালে কি খাবে বলো? অফিস থেকে আজ তাড়াতাড়ি চলে আসব। তোমার জন্য কি আনবো?”
নাজনীনের আজ যেন অবাক হওয়ার দিন। রাজনের হুটহাট করা কর্মকাণ্ড তাকে যেমন দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তেমনি প্রশ্ন জাগছে তার প্রতিটি কাজে। নাজনীনের হঠাৎ মনে হয়, সব বুঝি ঠিক হয়ে আসছে। রাজন ভুল, ভ্রম থেকে বেড়িয়ে আসছে। গত রাত, সকাল মিলিয়ে রাজনের একের পর এক কর্মকাণ্ডে নাজনীন যেমন দুঃখের সাগরে ভাসছিল। দুপুরে স্বামীর তরফ থেকে আসা একটি কল আর কিছু কথায় সে সব যেন ভুলতে বসেছে। তার নারী মন, প্রত্যাশা রাখছে অনেক কিছু। চোখ ভরে ওঠা পানি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে বললো,
“কিছু না। আপনি আসলেই হবে।”
রাজন কল রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে বিশ্বাস করে, নাজনীনের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার, একটু যত্ন নিলে মেয়েটি সহজেই তার প্রস্তাব মেনে নিবে। ফলে সে স্বাভাবিকভাবে দুটো স্ত্রী নিয়ে সংসার করতে পারবে। জটিলতা আছে অনেক। কিন্তু সহজ হয়ে যাবে।
রাজনের স্বার্থপর ভাবনা চিন্তায় বিঘ্ন ঘটলো নাজনীনের বাবা এবং ভাইয়ের ফোন কলে। শশুরের তরফ থেকে ভালো করে বুঝবাক্য আসলেও। নাজনীনের ভাইয়ে কঠিন স্বরে তার সঙ্গে কথা বলেছে। এমনকি হুমকিও দিয়েছে, বোনকে কষ্ট দিলে জেলে পঁচিয়ে মা””রবে।
নাজনীনের পরিবার ঢাকায় স্থানীয়। একটু গ্রামের দিকে তাদের একতলার ছোট বাড়িটা। শহরে দুটো দোকান। মুদি দোকানে বসেন বাবা। আর রড, সিমেন্টের দোকানে ওর ভাই। অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশ সচ্ছল তারা। যেহেতু স্থানীয়, তাই প্রশাসনিক ক্ষমতা মন্দ হবে না। সে গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেঝ ছেলে। বাবা মৃত। আর মা অন্য ভাইদের সঙ্গে থাকেন। কালেভদ্রে তার কাছে এসে কিছুদিন থেকে যান। গ্রামের চাষাভূসা ভাইয়েরা এসে তার ঝামেলা মাথায় নিতে চাইবে কেন? ভাবতেই রক্ত শূন্য হয়ে এলো রাজনের মুখশ্রী। একটি সমস্যা থেকে রেহাই পেতে গিয়ে আরও অনেকগুলো ঝামেলা সম্মুখীন হলো সে।
নাজনীনের জন্য তার বাবা ভাই থাকলেও তার জন্য কেউ নেই। পানি অনেকদূর গড়ালে সেই পানিতে তাকেই ডুবে ম”””রতে হবে। অগ্যতা রাজন বুদ্ধি নিতে পিয়ালির স্বরণাপণ্য হলো। অন্যদিকে সব শুনে পিয়ালিও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তার অবসানে সে এক পৈশাচিক দুষ্টূ বুদ্ধি এটে ফেললো মাথায়। রাজনের উদ্দেশ্য বললো, “ডার্লিং কোন চিন্তা করো না। এতদূর যখন আসতে পেরেছো। আরেকটু পথ হয়ে যাবে। এ নিয়ে তো এত ভেব না। আমি আছি তো। পথের কাঁটা নিজ থেকে সরানোর ব্যবস্থা করছি।”
রাজনের পিয়ালির কথা বোধগম্য হয় না।
“বুঝলাম না। হেয়ালি না করে সরাসরি বলতে পারো না?”
পিয়ালি হাসে। মনের কথা মুখে আনলে এই নারী লোভী পুরুষটা নিজের স্বার্থ নিয়ে সরে পড়বে। যা করার তার একাই করতে হবে। রাজনকে আশ্বস্ত করলো, “সেরকম কিছু না। আমাদের ভালো হোক এমন কিছুই করব।”
অন্যদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধা হয় নাজনীনের অপেক্ষার অবসান হয় না।
নাজনীন খুব সুন্দর একটি শাড়ি পড়েছে। ফর্সা গায়ে পার্পেল রঙের শাড়িতে তাকে বেশ মানিয়েছে। কোমর সমান লম্বা চুলগুলো খোপা করেছে আর্টিফেশিয়ার বেলি ফুলের গাজরা দিয়ে। হাতে পড়েছে দুটো সোনার বালা। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। তাতেই যেন রূপ ঠিকরে পড়ছে রুমের আনাচকানাচে। দেয়ালের যদি জবান থাকতো তাহলে অবশ্যই বলতো, “নাজনীন তুমি অপরূপা!”
ইন শা আল্লাহ চলবে…….
লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি