#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (১০)
সংসার ত্যাগের তিন মাসের মাথায় নাজনীনের কাছে ডিবোর্স পেপারটি এসে পৌছালো। ডাকঘর থেকে যখন নিজের নামে চিঠির কথা শুনেছিল, নাজনীন তখনই আন্দাজ করতে পেরেছিল। কাঙ্খীত বস্তুটি হয়তো এসেই গেলো। সে নিজ থেকে কিছু না করলেও, ওদিক থেকে যে বসে থাকবে না তার ওর জানা ছিল। ওকে তাড়াবার প্লান প্রোগ্রাম তো কম করা হয়নি। নাজনীন কাগজে সই করতে বেশি সময় নিলো। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে খসখসে কাগজে কাঙ্খীত স্থানে কলমের আচরে নিজের নামটি বসিয়ে চিরতরে নিজেকে মুক্ত করলো একটি টক্সিক সম্পর্ক থেকে।
না চাইতেও মনে পড়ে যায় বহু কথা। আজ থেকে দুই বছর আগেও একটি কাগজের পাতায় তার সই নেওয়া হয়েছিল। যে কাগজে নিজের নাম বসিয়ে ট্যাগ লেগেছিল বিবাহিতর। ঠিক দুই বছরের ব্যবধানে আরেকটি কাগজে নিজের নাম বসিয়ে ট্যাগ লাগলো তালাকপ্রাপ্তা রমনী। এ জীবন আমাদের না চাইতেও এমন অনেক কিছু দেয়, যা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে দুঃখ কষ্টের হলেও আদতে তা ভালোর লক্ষণই বহন করে।
সম্পর্কে পিছুটান থাকলে সে সম্পর্ক ছেড়ে এলেও সারাজীবন কষ্টে কাটাতে হয়। আজ যদি তাদের কোন সন্তান থাকতো, অবশ্যই সে হত সম্পর্কের পিছুটান। স্বামী নামক শীশ্নধারী নপুংসকটার প্রতারণার দহন স্ত্রী ও সন্তান উভয়কেই বইতে হতো। নারী আমৃত্যু সঙ্গীহীন থাকতে পারলেও, পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত সন্তানকে বাবার আদরটা দিতে পারে না। শূন্যস্থান থেকেই যায়। তখন দুঃখটাও বেশি ভারি হয়। তার থেকে ভালো পিছুটান হওয়ার আগেই মানুষটার আসল রূপ প্রকাশ পেয়েছে।
মাইমুনা বেগম মেয়ের আড়ালে মুখে আচল চেপে কাঁদেন। অন্য মায়েদের মত তিনিও আজীবন স্বামী সংসারে সুখী দেখতে মেয়েকে আশা নিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন। মনে করেছিলেন, নারী জীবনের প্রকৃত সুখ স্বামী এবং সংসারে। যেমন তিনি করছেন। কিন্তু সব ভবনা তো আর সত্য হয় না। সব মেয়ের কপালে সুখ নামক অদৃশ্য অস্পর্শ সত্তাটি লিখা ও হয় না। হয়তো নাজনীন ও তেমনই একজন।
আজ একেবারে কাটছাঁট হয়ে গেল একসময়ের রাজন নাজনীন দম্পতির বিবাহ সম্পর্ক। বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ির পরিবেশ থমথমে। কিন্তু নাজনীন যে এদিনটাই একটু বেশিই স্বাভাবিক, শান্ত। দুপুরে সময় নিয়ে গোসল করলো। বহুদিন পরে গায়ে ঘষে ঘষে সাবান মাখলো। চুলে শ্যাম্পু মেখে ভালো করে চুলগুলো ধুলো। প্যাচানো চুলে একটু স্মুদনেস আনতে কন্ডিশনার ও নিলো। গোসল শেষে সুন্দর একটি জামা পড়লো। মুখে ক্রিম লাগালো। তারপর পরিপাটি হয়ে দুপুরের খাবারের জন্য ডাইনিংয়ে গিয়ে বসলো।
ফাহমিদাকে দেখে নাজনীন চমৎকার একটি হাসি উপহার দিলো। বেচারী ননদের হাসিমুখখানা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলো। এতদিন পাগলবেশে বেড়ানো ননদের হাসি তার জায়গায় অন্য কেউ হলেও নিতে পারতো না। নাজনীন বুঝি একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছে। এ শঙ্কায় ফাহমিদার মুখ রক্তশূন্য হয়ে এলো। হাতে রাখা ডালের বাটিটা দ্রুত হাতে টেবিলে রেখে দৌড়ে গেলো কিচেনে। মাইমুনা বেগম সেখানে রান্না করছিলেন। এটুকুই আসতেই ফাহমিদা হাপিয়ে উঠলো। হাপাতে হাপাতে বললো, “আম্মা, নাজনীনের মাথাটা বোধহয় এবার একেবারে গেছে।”
খুন্তি দিয়ে তরকারি নাড়ছিলেন মাইমুনা বেগম। পুত্রবউয়ের কথায় তার দিকে তাকিয়ে থাকেন গোলগোল চোখে। এ কথা তার বোধগম্য হয়নি। ফাহমিদা পুনরায় বললো, “এতদিন যা চেয়েছি আজ সেটাই হলো। আপনি, আমি কতকরে বুঝিয়েছি ওকে। ওকে এতগুলো দিনে ঠিকমতো খায়নি, নিজের যত্ন নেয়নি। কেবল মনমরা হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে। সেই মেয়ে দেখেন, আজ সুন্দর জামা পড়েছে। কত সুন্দর পরিপাটি হয়ে খেতে বসেছে।”
মাইমুনা বেগম সব শুনে আর দাড়ালেন না। রান্না শেষ। গ্যাসের ফ্লেইম অফ করে তড়িঘড়ি করে মেয়ের কাছে যান। নাজনীন টেবিলে দস্তারখানা বিছিয়ে রাখছিল।
মা কে দেখেও নাজনীন চমৎকার একটি হাসি উপহার দিলো। বললো, “অনেকদিন পরে শান্তি লাগছে মা। মনে হচ্ছে মাথা থেকে ভারি বোঝা নেমেছে। রান্না হয়ে গেলে, খেতে দাও। ক্ষুদা লেগেছে অনেক।”
মাইমুনা বেগম মেয়ের মাঝে খুজে পেলেন ঠিক ছোটবেলার নাজনীনকে। আনন্দে কখন যেন তার চোখদুটো পানিতে ভরে উঠলো তিনি টেরই পেলেন না। শাড়ির আচলের কোনা দিয়ে দ্রুত মুছে ফেললেন। এভাবে যখন তখন মেয়ের সামনে কান্নাকাটি করা ঠিক না। মনে মনে ঠিক করলেন, আজীবন তার সুন্দর কোমল মেয়েটিকে হাসিখুশি রাখতে যা করণীয় তার সব করবেন তিনি। তবুও মেয়েকে এক ফোটা কষ্ট পেতে দিবেন না।
সেদিন সন্ধ্যায় নাহিদ, বোনের পছন্দের চিকেন চাপ আর বাটার নান নিয়ে এলো। নাজনীন নিজ গরজে সেদিন দুধ চা করলো। তারপর সবাইকে চায়ের সাথে নান, চাপ বেড়ে খাওয়ালো। সবাই যখন বসে সন্ধার নাস্তা করছে। ঠিক তখন নাহিদ একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করলো।
“যদি সবাই মিলে কক্সবাজার ঘুরে আসি, তাহলে কেমন হয়?”
বিয়ের পরে একবার স্বামী সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছিল ফাহমিদা। এরপর আর লং ট্রিপে যাওয়া হয়নি। স্বামীর মুখে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাবে তার গুলুমুলু মুখখানা খুশিতে ডগমগ করতে লাগলো। তা নজর এড়ায় না নাজনীনের।
আজমল শেখ ধীরে ধীরে চায়ের চুমুক দিয়ে চা পান করছেন। তিনি বললেন, “তোমরা যাও। সবাই গেলে দোকান দেখবে কে? তাছাড়া বাড়িঘর ফেলে একসঙ্গে যাওয়া যায় না।”
নাহিদ নির্ভর দিয়ে বললো, “দুই তিনটা দিন কর্মচারী সামলাবে। তাছাড়া দোকানে সিসি ক্যামেরা আছে। ওখানে বসে সব তদারকি করতে পারব। এ নিয়ে তুমি ভেব না। বহুর জীবনে বড় ধকল গিয়েছে। তাছাড়া আমরাও নিয়মতান্ত্রিক জীবনে হাপিয়ে উঠেছি। জীবনে রিফ্রেশমেন্টের দরকার আছে। তাই সবাই মিলে চলো ঘুরে আসি।”
এরপর আর হয়তো কোন যুক্তি খাটে না। আজমল শেখ কিছু বললেন না। মেয়ের কথা ভেবে চিরকাল সংসার সংসার করে হেদিয়ে ম””রা মাইমুনা বেগমও নিরবে সম্মতি জানালেন। বাকি নাজনীন। নাহিদ ভ্রু উচিয়ে বোনকে শুধায়, “কীরে?”
ফেলে আসা জীবন নিয়ে নাজনীন আর ভাবতে চায় না। তবুও কী অতীত এত সহজে পিছু ছাড়ে? রাজনের সাথে যাওয়ার কথা ছিল সমুদ্র দেখতে। অথচ সময়ের ব্যবধানে দুজন মানুষের মাঝে আজ আর কোন সম্পর্ক নেই। চূড়ান্ত বিচ্ছেদ রচিত হয়েছে। কি ভেবেছিল, আর হচ্ছে কী!
নাজনীন প্রতিত্তোরে শুধু বললো, “আচ্ছা।”
_________________________________
আজও সকালে নাস্তা না বানিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে পিয়ালি। রাজন চিৎকার চেচামেচি করছে নাস্তা না পেয়ে। পুরোদমে চাকরি ছেড়ে আলস্য বিলাস করছে পিয়ালি। বেশিরভাগ সময়ে অনলাইন অথবা হোটেল থেকে কিনে খেতে হয় রোজ। রাজন এসবে ত্যাক্ত বিরক্ত।
ঘুমন্ত পিয়ালির দিকে জোরে হাক ছাড়ে রাজন, “বলি জমিদার কন্যার ঘুম কি হলো? আমার অফিস যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। নাস্তা কোথায়?”
আচমকা ঘুম ভাঙায় পিয়ালিও বিরক্ত হয়। চোখ কচলে বলে,”ষাড়ের মত না চেচিয়ে নিজেরটা নিজে করতে পারো না?”
“না, পারি না। তোমাকে রেখেছি কিজন্য? শোপিসের মত সোকেসে সাজিয়ে রাখতে?”
“এত সকালে আমার ঘুম ভাঙে না।”
“নবাবের বেটি। আগে তো ঠিকই আটটার আগে অফিসে চলে যেতে সেজেগুজে। এখন এত নাটক শিখেছো কোথা থেকে? বস্তি থেকে মহলে ঠাই দিলে পিপিলিকার ও ডানা গজায় দেখছি।”
“পারব না। কি করবি?”
পাল্টা প্রশ্নে রাজন থতমত খেয়ে যায়। সে ভুলে যায় এ পিয়ালি। নাজনীন নয়। যাই হয়ে যাক স্বামীর যত্নে ত্রুটি না রাখা মেয়েটি এ নয়।
রাজন বলে, “বাসা থেকে বেড়িয়ে যাবি সোজা।”
পিয়ালি এবার আর তর্কে জড়ায় না। কিচেনে গিয়ে ফ্রাই প্যান টা রাজনের দিকে ছুড়ে ফেলে বলে, “এত সস্তা আমাকে তাড়ানো? বললেই হলো। করব না কিছু। কি করবি তুই?”
ননস্টিকের ভারি ফ্রাই প্যানের লম্বা হাতল গিয়ে লাগে রাজনের পায়ে। মুহুর্তেই ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো। ছোট একটি গর্ত হয়ে গেলে ক্ষত স্থানে।
রাজন আর্তনাদ করে উঠলো। পিয়ালির হুস ফিরলো। রাগের মাথায় এ কি করলো সে? আজ বাদে কাল তাদের হানিমুন ডেইট। আজ কিনা জখম করে দিলো। এ জীবনে লং ট্রিপে যাওয়া হয়নি তার। রাজনকে আঘাত করে এ সুযোগ হাত ছাড়া করার মেয়ে সে নয়। দ্রুত হাতে রাজনকে বিছানায় বসিয়ে প্রাথমিকভাবে রক্ত বন্ধ করলো। মুখে পানির ছিটে দিয়ে কিচেনে গেলো। এক কাপ চা, ফ্রোজেন করা পরোটা ভেজে আর একটি ডিমের অমলেট করে আনলো রাজনের জন্য।
রাজনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পিয়ালিকে খাইয়ে দিতে লাগলো তাকে। উদ্দেশ্য, শিকারী হাতছাড়া করা যাবে না কিছুতেই।
রাজনের মন গলে। হাসিমুখে নাস্তা করে। সে খাবারটুকু মুখে নিতেই দক্ষিণের হাওয়ার তারে ডাস্টবিনের ময়লার দূর্গন্ধ নাকে এসে লাগে। মুহুর্তেই চোখমুখ কুচকে যায় তীব্র গন্ধে। অশান্তি যখন আসে তখন সব দিক দিয়েই আসে। পায়ের ব্যাথায় টনটন করছে। দূর্গন্ধে বমি চলে আসার উপক্রম। তার মধ্যে পিয়ালি হাসিমুখে খাবার হাতে দাড়িয়ে। এই মুহূর্তে কোনটাকে প্রাধান্য দিবে রাজন বুঝে উঠতে পারে না।
_________________________
যে মানুষটার মুখ দর্শন করবে না বিধায় কোনরকম আইনি ঝামেলায় গেল না নাজনীন। ঠিক সেই মানুষটা তার কয়েক হাত দূরে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বুঝি একেই বলে?
ইন শা আল্লাহ চলবে….
লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি
[রিচেক দেওেয়া হয়নি।]