সুখের আশায় চেয়ে থাকি পর্ব-১২

0
1

#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (১২)

সমুদ্রতীরের রাতের বেলার রূপটা অন‍্যরকম সুন্দর হয়। সূর্যের আলো নিভে গেলেই জ্বলে ওঠে নানান রকম কৃত্রিম আলো। চারপাশ হলুদ, সাদা আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে। সেই আলোতেই নাজনীনের চোখ পড়ে জোড়া ভ্রুদ্বয়ের যুবকের মুখখানা। শ‍্যামলা, শান্ত, ভদ্রতার খোলসে মোড়ানো এক তরুণ যুবক। অল্প দূরত্বে তারা পাশাপাশি দাড়ানো।

রুকাইয়া ভাইয়ের এক হাত দখল করে কাছাকাছি দাড়িয়ে আছে। আরেক হাত নাড়িয়ে কথা বলছে মেয়েটি। ভাই যে ছোট রুকাইয়ার ভিষন পছন্দের তা অল্প আলাপেই নাজনীন বুঝতে পেরেছে। সেই সঙ্গে বুঝেছে, মেয়েটির শারীর যতটা বেড়েছে, মানসিকতা ততটা বেড়ে উঠতে পারেনি। বয়সের তুলনায় একটু বেশিই শিশুসুলভ আচরণ মেয়েটির মধ্যে বিদ‍্যমান।

রুকাইয়া ভাইকে প্রশ্ন করে, “ভাইয়া, সমুদ্রের শেষ কোথায়?”

“জানিনা বোনু। হয়তো সমুদ্রের কোন শেষ থাকে না।”

“শেষ থাকে না কেন?”

“আল্লাহ ভালো জানেন। আমি জানাশোনার পরিধি খুবই সিমিত।”

“সিমিত ই তো থাকবে। ছোটবেলায় পড়নি। ফাঁকিবাজি করেছো। যার জন্য আমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারছো না। পড়লে ঠিকই পারতে।”

বোনের মুখফুলানো অনুযোগে ভাইয়ের সাথে নাজনীনও হেসে ওঠে।

বেশ ধৈর্যের সাথে বোনের বাচ্চামো প্রশ্নের জবাব দেয় ছেলেটি। নাজনীন অবাক হয় কিছুটা। রুকাইয়া দিন দুনিয়ার আজব সব প্রশ্ন তোলে ভাইয়ের সামনে। বোনের শিশুসুলভ আচরণ হয়তো ভাইয়ের আদর আহ্লাদের কাছেই প্রতিপালিত হচ্ছে দিন কে দিন।

রাতের অন্ধকার গাঢ় হতেই দুই পরিবারের সবাই আবারও একত্রে মিলিত হয়। রাতের ডিনার তারা এক ছাদের নিচেই করবেন।

ইতিমধ্যে দুই পরিবারের মধ্যে বেশ ভালো চেনা জানা হয়ে গিয়েছে। ভাব ভালোবাসাটাও ভেতরে ভেতরে বেড়েছে। মাইমুনা বেগম ও আজমল শেখ এ নতুন আত্মীয়তায় একটু বেশিই বিনয়ী। অপরদিকে ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা ও তেমনই আন্তরিক। মনে মনে তাদের চিন্তাভাবনা ভিন্ন। অন‍্য ফন্দি আটছেন মনে। কিন্তু সদ‍্য পরিচয়ে বলার সাহস করে উঠছেন না।

আর একটি দিন তারা কক্সবাজারে আছে। শেষ দিনে নাহিদ বোন এবং স্ত্রীকে নিয়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘুরলো। কেনাকাটা করলো। নাজনীন নিজে রুকাইয়াকে একটি উপহার দিলো। দিন পেরিয়ে সন্ধা হতেই লাগেজ গোছানো শুরু হলো। ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। বিদায় পর্বে রুকাইয়া আবেগী হয়ে বললো, “তুমি খুব ভালো আপু। ভালো হতো যদি আমাদের আবার দেখা হতো।”

রুকাইয়ার বাচ্চামো নাজনীনের ও মন ছুয়েছিল অল্প হলেও। পরিচয় হবার পর থেকে যখনই দেখা হয়েছে মেয়েটি পিছু পিছু ঘুরেছে। নাজনীন ভাবে, ছোট একটি বোন থাকলে, হয়তো এই মেয়েটির মতোই হতো।

নাজনীন হেসে জবাব দেয়, “আল্লাহ চাইলে নিশ্চয় দেখা হবে। মন দিয়ে পড়িও। পড়লে, একদিন নিজের প্রশ্নের উত্তরগুলো নিজেই দিতে পারবে। কেমন?”

রুকাইয়ার মন খারাপ। মন খারাপ নিয়েই প্রতিত্তোরে বললো, “আচ্ছা।”

এক এক করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে আজমল শেখ পরিবার নিয়ে নিজ গন্তব্যের দিকে বেড়িয়ে পড়লেন। যাবার আগে নাজনীন ও সবাইকে বলে এসেছে। শুধু দূরে দাড়ানো মানুষটিকে কিছু বলা হয়নি। সে হয়তো বলার বা শোনার অপেক্ষায় নেই।

গতকাল তারা কিছুক্ষণ আশেপাশে থাকলেও নিজ থেকে কেউ কাউকে কিছু বলেনি। হয়নি কোনরকম আলাপচারিতা। এ যুগে নারী লোভী নব্বইটা পুরুষের মধ্যে দশটি পুরুষ উত্তম চরিত্রের ও হয়। যেখানে সেখানে নারীলোক দেখলেই কথা বলার জন্য তাদের জিভ লকলক করে না। তাকে নিয়ে অবশ‍্য নাজনীনের মনে কোন ভাবনা চিন্তা নেই। হওয়ার কথাও নয়। জীবনে না চাইতেও যে প্রতারণার শিকার হয়েছে, তাতে দ্বিতীয়বার কাউকে নিয়ে মনের কোনে ভাবনা চিন্তা আশাটা নিতান্তই বোকামি। হয়তো ছ‍্যাছড়ামো।

নাজনীনের রাতে বাসে কখনও জার্নি করা হয়নি। এবারই প্রথম রাতে বাস জার্নির অভিজ্ঞতা অর্জন করা হবে। নাহিদ ফাহমিদা কে নিয়ে আলাদা বসেছে। ওদের থেকে দুটো সিট পরেই। কাপল হিসাবে তাদের রাতের বাস জার্নি হবে অন‍্যরকম সুন্দর।

নাজনীনের পাশের সিটে মাইমুনা বেগম বসলেন। আজমল শেখ সামনের সিটে। রাতের জার্নিতে নিজের সঙ্গী হিসাবে নাজনীন বেছে নিল হুমায়ুন আহমদের “আমার আছে জল” বইটি।

বাসের সামনের দু পাশের বড় বড় চোখের মত সাদা আলোর লাইট দুইটা রাতের অন্ধকার রাস্তাকে খনিকের জন্য আলোকিত করে তুলছে। নাজনীন বইয়ের পাতা থেকে চোখ উঠিয়ে রাতের রাস্তাঘাট দেখে। রাতের প্রকৃতির মধ্যে আলাদা সৌন্দর্য আছে। আধারে ঢাকা স্থানগুলোতে হঠাৎ হঠাৎ আলো পড়লে কেমন যেন রহস্যময় লাগে।

মাইমুনা বেগম অল্প সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন। নাজনীন এখন পুরোই একাকিত্বের অভ‍্যন্তরে।
______________________________________

একরাত জার্নি শেষে দিনের সদ‍্য ফোটা আলোয় তারা বাড়িতে ফিরে আসে। রাতে যেহেতু মাইমুনা বেগম বেশ খানিকটা সময় ঘুমিয়েছেন তাই দীর্ঘ জার্নি শেষে তিনি কিছুটা ক্লান্তহীন।

নাজনীনের সারারাত ঘুম হয়নি। জেগে কাটিয়েছে। সে খুব ক্লান্ত। ঘুমে ঢুলছে। ঢুলতে ঢুলতে নিজের ব‍্যাগপ‍্যাক নিয়ে রুমে দিকে যেতে নিলে মাইমুনা বেগম বলে ওঠেন, “হাতমুখ ধুয়ে আয়। আমি ঝটপট নাস্তা বানাচ্ছি। খেয়ে তারপর ঘুমাবি।”

“খেতে গেলে ঘুম চলে যাবে মা।”

“যাবে না। খেয়ে ঘুমালে আরাম করে দুপুর পর্যন্ত ঘুমাতে পারবি। এখন যা বলছি কর।”

নাজনীন বারবার হামি তুলছে। ঢুলুঢুলু পায়ে রুমের দিকে যেতে যেতে বললো, “আচ্ছা।”

বাড়ির বউদের কেন যেন বিশ্রাম হয় না। হলেও তাদের সবদিক সামলিয়ে তারপর বিশ্রামের সুযোগ মিলে।

ফাহমিদার বাস জার্নি ছিল প্রেমময় সুন্দর। প্রিয় মানুষটার হাতে হাত রেখে সুখের আলাপ করা, বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ঘুমানো। সবই ছিল রোমান্সে ভরপুর। অর্ধঘুম অর্ধ জাগরণে কেটেছে তাদের রাত। সেও ক্লান্ত। কিন্তু তবুও, শাশুড়ি মায়ের সাথে নাস্তা বানানোর কাজে সাহায্য করতে এলো।

মাইমুনা বেগম খুব জাদরেল শাশুড়ি মা নন। আবার খুব মমতময়ী ও নন। খুব সহজ সরল একজন মানুষ। পুত্র বধুর কোন কিছুতে খবরদারি করতে না। করতে পছন্দও করেন না। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। বিয়ে দিয়েছেন। তাদেরও সংসার হয়েছে। এসবের মধ্যে দিয়েও তিনি বিয়ের শুরুর দিনগুলোর মতোই স্বামী সংসারের প্রতি যত্নশীল, কর্তব‍্য পরায়ন।

ফাহমঞ সাহায্য করতে এলে তিনি নিষেধ করলেন না। না এলেও কিছু বলতেন না। নিজের দায়িত্ব নিজেই পালন করতেন।

বাড়িতে প্রতিদিন রুটি খাওয়া হয়। এজন্য পুরো সপ্তাহের রুটি হালকা সেকে একেবারে ফ্রোজেন করা হয়। এতে গৃহিনীদের সময় বাঁচে।

ফাহমিদা চুলায় চায়ের জন্য পানি বসিয়ে দিলো। অন‍্যদিকে মাইমুনা বেগম ফ্রোজেন রুটিগুলো সেকে ফেলছেন।

চা আর রুটি হয়ে গেলে মাইমুনা বেগম ফাহমিদা কে বললো, “এগুলো নিয়ে টেবিলে রাখ। আমি ডিম পোস করে নিয়ে আসছি।”

ফাহমিদা শাশুড়ি মায়ের কথামতো সেটাই করলো। একে একে সবাই খেতে এলো।

সকালের ঝটপট নাস্তায় রুটি, ডিম পোস আর লাল চা। সবাই খেয়ে যার যার মতো ঘুমিয়ে পড়লো।

কয়েকটি দিন বাইরের ভাড়ি খাবার খেয়ে শরীর মন এবার একটু ঘরোয়া হালকা খাবার চায়। তাই মাইমুনা বেগম দুপুরে খাবারের জন্য আয়োজন করলেন, শিং মাছ দিয়ে আলো পটলের ঝোল আর হাসের ডিম ভুনা।

বেলা তেতে উঠলে এক এক করে সবার ঘুম ভাঙে। ফাহমিদা ঘুম থেকে উঠে টেবিলে সাজানো খাবার দেখে অবাক হয়। মনে মনে ভয় ও পায় কিছুটা। পাছে শাশুড়ি মা কিছু মনে করেন?

ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে, “আমাকে একটা ডাক দিতেন আম্মা। আপনি একা একা কষ্ট করে রান্না করতে গেলেন। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। কত বেলা হতো কিছুই টের পাইনি। আমার ঘুমটা আজ গাঢ় হয়েছে।”

“সমস‍্যা নাই। এ বয়সের ঘুম গাঢ়ই হয়। আমি তোমার শশুরকে ডাকছি। তুমি ওদের ভাইবোনকে ডেকে খেতে
বলো।”

শেষ বিকেলের নরম আলো গায়ে মাখামাখি হয়ে মাইমুনা বেগম বেগুনের চারা গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিলেন। গলায় ছোট একটি ঝোলানো ব‍্যাগ ওনার বাটন ক‍্যামেরা যুক্ত ফোনটা রাখেন। হঠাৎ করেই আওয়াজ তুলে ফোনটি বেজে ওঠে। গাছে পানি দেওেয়া থামিয়ে তিনি ফোনটি ব‍্যাগ থেকে বের করেন। দেখতে পান অপরিচিত নম্বর থেকে কল এসেছে। সাধারণত অচেনা নাম্বারের কল তিনি রিসিভ করেন না। কিন্তু আজ কি মনে করে যেন কলটা রিসিভ করলেন।

ফোনের ওপাশ থেকে পরিচিত কন্ঠস্বরের সালাম দেওেয়া শুনেই মাইমুনা বেগম চিনে ফেললেন। ঠোঁট হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। নতুন বান্ধবী ফোন করেছেন।

দুই বান্ধবী দীর্ঘ আলাপচারিতার এক পর্যায়ে মাইমুনা বেগম তাদের নিজ বাড়িতে দাওয়াত করলেন। এবং খুব জোর দিয়ে বললেন, “আপা, আপনাদের কিন্তু অবশ্যই আসতে হবে।”

ওপাশ থেকে জানালেন, “আসব আপা। কিন্তু আপনাকে একটা কথা জানানোর ছিল। আপনি কি মনে করবেন ভেবে আর বলা হয়ে ওঠেনি। এখন মনে হচ্ছে বলা উচিত।”

মাইমুনা বেগমের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। বললেন, ”কি কথা আপা?”

“আপনার মেয়েটিকে তো আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে।”

মাইমুনা বেগমের বুক ধ্বক করে উঠলো। তিনি মনে মনে এটাই আন্দাজ করেছিলেন। পরিচয় হবার পর থেকে ভদ্রমহিলা বারবার নাজনীন সম্পর্কে এটা সেটা খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞাসা করছিলেন। ঘুরেফিরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল নাজনীন ই। হয়তো এ কথা শুনে নিতে খুশি হতে পারতেন। ভালো পরিবার, ভদ্র নম্র ছেলে। এমন পরিবারই মেয়েকে বিয়ে জন্য দেখা হয় সাধারণত। কিন্তু ঐই যে মেয়ের খুত!

তিনি ভনিতা না রেখেই বললেন, “আমার মেয়ের আগে বিয়ে ছিল আপা।”

ওপাশ থেকে হয়তো এ কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিছুক্ষণ ওপাশ নিরব রইলো। মাইমুনা বেগমও কিছু বলছেন না। মনের মধ্যে খচখচ করে। এখন আপাতদৃষ্টিতে কাউকে ভালো দেখলেও মন মানতে চায় না। মেয়েটিকে ভালো ছেলে দেখেই তো বিয়েটা নিজেদের আগ্রহে দিয়েছিলেন। অথচ, কপাল তো ঠিকই পুড়লো।

“আপনার মেয়েটিকে আমাদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এ কথা তো আমার জানা ছিল না। মেয়েকে তো সারাজীবন এভাবে রাখবেন না। কিছু ভেবেছেন?”

“এত তাড়াতাড়ি কিছু ভাবিনি। তবে এ মুহূর্তে ওকে কিছু বলার সাহস করছি না। সবে একটা ধকল সামলে উঠেছে।”

“তা ঠিক। আমি তাহলে পরিবারের সবার সাথে আলাপ করে আপনাকে জানাব আপা। ঘরে পুত্রবধূ যদি আনতেই তবে আপনার মেয়েকেই আনতে চাই। এখন আপনি কি বলেন?”

“আপা, এত তাড়াতাড়ি কিছু ভাবছি না। আগেরবার নিজেদের জোরজবরদস্তিতে বিয়েটা দেওেয়া। এবার কিছু হলে ওর সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দেওয়ার ইচ্ছে।”

“ছেলেমেয়েদের দেখাটা হলে ওদের মধ‍্যেও বোঝাপড়াটা ভালো হতো। আপনি যদি রাজি হন তাহলে নাজনীন মা কে আমরা দেখতে আসতাম।”

“মেয়ে তো আমার একার না। ওর বাবার কাছে বিষয়টি বলি। আমার ছেলে আছে। সর্বোপরি মেয়ে কি বলে। সব শুনে জানাবো।”

“আচ্ছা। উত্তর কিন্তু হ‍্যাঁ হওয়া চাই।”

মাইমুনা বেগম চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়ের শুকনা মুখ তার ভালো লাগে না। ওদের সবাইকে ওনার পছন্দ হয়েছে। ছোটখাট শিক্ষিত ভদ্র পরিবার। ছেলের ভালো পোস্টের চাকরি। সবমিলিয়ে এমন সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক নয়। কিন্তু মেয়েকে তিনি এ বিষয়ে বলবেন কিভাবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না।

মাথায় পাহাড়সম চিন্তা নিয়ে ফাহমিদার স্বরনাপন্ন হন।

ইন শা আল্লাহ চলবে…..

লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি