সুখের আশায় চেয়ে থাকি পর্ব-১৩+১৪

0
1

#সুখের_আশায়_চেয়ে_থাকি (১৩+১৪)

“ফাহমিদা!”

“জি আম্মা!”

বউমাকে ডেকেও বলার মত কথা সাজিয়ে উঠতে পারেন না মাইমুনা বেগম। ইতস্তত বোধ করেন।

ফাহমিদা শাশুড়ি মায়ের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

জড়তা কাটিয়ে মাইমুনা বেগম বলেন, “কি দিয়ে শুরু করব বুঝতে পারছিনা। আসলে, নাজনীনের জন্য ভালো একটি বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। ওর সামনে একথা কিভাবে তুলব বুঝতে পারছিনা। ও যদি বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে না নেয়।”

“বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে না নেওয়াটা কি অযৌক্তিক হবে ওর জন্য? বলুন?”

মাইমুনা বেগম জবাবে কিছুই বলতে পারেন না।

শাশুড়ি মায়ের নিরবতার পিঠে ফাহমিদা বলে, “আপনি এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? কিছুদিন হলো একটি ঝামেলা থেকে বেরিয়ে মেয়েটি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। পড়াশোনায় মন দিয়েছে। এর মধ্যে এসব কথা তোলার কি খুব দরকার আছে? শুনেছি, আগের বিয়েটি আপনারা নিজের মনমতো দিয়েছেন। এবারেও একই কাজ কেন করতে চাইছেন? আমার মনে হয়, ওকে ওর মত থাকতেন দিন। পড়াশোনা করুক। নিজের পায়ে দাড়াক। এরপর ও যা ভালো বুঝবে করবে। এত তাড়াহুড়োর কিছু আছে বলে মনে হয় না।”

“কিন্তু, বউমা ওরা খুব আগ্রহ করছিল।”

“এখানে অনাগ্রহের তো কিছু নেই আম্মা। আমাদের নাজনীন মা শা আল্লাহ দেখতে যেমন সুন্দর, তেমন তার নম্র ভদ্র আচরণ। পছন্দ হওয়ার মতোই মেয়ে। আপনাকে পূনরায় কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, মেয়ে পড়ছে। পড়াশোনা শেষ না হলে কথা আগাতে পারছিনা। বুঝতে পেরেছেন?”

বউমার কথার প্রতিত্তোরে মাইমুনা বেগম সুবোধ বালিকাটির ন‍্যায় মাথা কাত করে সম্মতি জানায়।

মা এবং ভাবির কথোপকথন কান এড়ায় না নাজনীনের। সে সবই শুনেছে। উঠানের এক কোনায় দাড়িয়ে তারা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব‍্যাস্ত, তখনই নাজনীন ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠানে আসতে নিচ্ছিল। সব কথায় তার কান ভেদ করে মস্তিষ্কে পৌছায়। ভাবির বুদ্ধিমত্তার সাথে দেওেয়া উত্তরগুলো ওর খুবই পছন্দ হয়। মনে মনে তাকে না ধন্যবাদ জানাতে ভুল করে না। কারো চোখ পড়ার আগেই দরজার কাছে থেকে সরে যায় নাজনীন। পা চালিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসে।

এরপর মাইমুনা বেগম আর সে বিষয়ে নিজের ভাবনা চিন্তা বন্ধ রাখেন। ফাহমিদা তো ঠিকই বলেছে। সে তাড়াহুড়ো ই করছিল বটে।

দিন দুয়েক পরে মাইমুনা বেগমের কাছে আবার কল আসে। বান্ধবী ফোন করেছে। কুশল বিনিময় শেষে জিজ্ঞাসা করে, “সে বিষয়ে কথা বলেছেন বাড়িতে?”

মাইমুনা বেগম প্রথমে কি বলবেন বুঝতে না পারলেও, পরক্ষণেই নিজেকে বোঝালেন। কথা ঝুলিয়ে রেখে লাভ নেই। ভনিতা না রেখে প্রতিত্তোরে বললেন, “আপা, আমি এত তাড়াতাড়ি কিছু করতে চাইছি না। মেয়ে আমার সবে একটি ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়েছে। পড়াশোনায় মন দিয়েছে। আপাতত ওর পড়াশোনা শেষ না হওয়া অব্দি কিছু ভাবতে পারছিনা।”

ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাসের স্পষ্ট শব্দ নাজনীনের কানে লাগে। মায়ের থেকে একটু দূরে বসেই অপেক্ষা করছিল ভালো কিছুর জবাব আসার। কিন্তু সে তো জানে না, দূর্লভ বস্তু যেমন খুব সহজে পাওয়া যায় না। তেমনিই খুব করে চাওয়া মানুষটিকে খুব সহজে জীবনে পাওয়া যায় না। সৃষ্টিকর্তার এখানে বান্দার পাথে অপেক্ষা নামক খেলা খেলতে মন চায়। মহামহিম রব দেখতে চান উমুক বান্দার জন্য ওই বান্দাটি আদৌ উপযুক্ত কিনা! দীর্ঘ অপেক্ষার অঙ্গারে বান্দাকে পুড়িয়ে খাটি সোনা কিনা খতিয়ে দেখেন।
এখন দেখা যাক, অপেক্ষার দীর্ঘ সময়টুকু ধৈর্যের সাথে পাড় করতে পারে কিনা! না, অকালেই ঝরে অন‍্যতে মন দেয়।
______________________________

রাজনের দিনকাল ভয়াবহ রকমের খারাপ যাচ্ছে। পিয়ালির ছুড়ে মারা ফ্রাই প‍্যানের আঘাতে হওয়া পায়ের ক্ষত রাজনের আজও শুকায়নি। অল্প একটু স্থানে যন্ত্রনা দায়ক ক্ষত হয়ে দাড়িয়েছে। চিকিৎসা নিয়েও জ্বালাপোড়া নিরাময় হচ্ছে না। অন‍্যদিকে হাওয়া ছাড়লেই তীব্র দূর্গন্ধে বাসায় টেকাও শুধু মুশকিল ই নয় মহা মুশকিল। বাসা বদলানো প্রয়োজন। পায়ের যন্ত্রনায় নিয়মিত অফিস করাও কষ্টকর হয়ে দাড়িয়েছে তার জন্য। বর্তমানে ছুটিতে বাসায় দিন কাটাচ্ছে সে।

বেশ কিছুদিন যাবত বাসায় থাকার কারণে পিয়ালির দিকে নজর পড়ছে রাজনের। কৈ পেট তো ফোলা ফোলা লাগে না? এতদিনে প্রেগনেন্সির সেকেন্ড ট্রাইমেস্টারে থাকার কত। শারীরিক, মানসিক উভয় দিকেই পরিবর্তন হওয়ার কথা। অথচ পিয়ালি দিব‍্যি হেটে চলে বেড়াচ্ছে। কোন পরিবর্তন নেই।

এক দুপুরে খেতে বসে রাজন প্রশ্নটা করেই ফেললো, “পিয়ালি, তোমার এখন কয় মাস চলে?”

“কি?”

“বুঝতে পারছোনা?”

“না।”

পিয়ালির এই ‘না’ শব্দটি রাজনকে অনেকগুলো রহস‍্যের মুখোমুখি এনে দাড় করায়। মুহূর্তেই কপালে শিরা ফুলে ওঠে। মুখের স্পষ্ট রাগের চিহ্ন ফুটে ওঠে। খাওয়া থামিয়ে সটান দাড়িয়ে পড়ে। বিপরীত পাশে বসা পিয়ালির চুলের গোছা ধরে টেনে নিয়ে আসে ড্রয়িং রুমে। চুলের গোছা থেকে হাত সরিয়ে মুখ চেপে ধরে। রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে, “আমার সাথে এই নাটকটি কেন করলি? আমাকে কেন বলেছিলি? তুই তিন মাসে গর্ভবতী।”

হঠাৎ আক্রমনের কারণ বুঝে উঠতে পারছিল না পিয়ালি। রাজনের প্রশ্নে উত্তর খুজে পায় না। থতমত খেয়ে যায়। অপরদিকে রাজনের হাতের চাপে মুখের চোয়াল ভেঙে আসার জোগাড় মেয়েটির। যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে। ইশারায় ছাড়তে বলে। না মুখ না ছাড়লে কথা বলবে কি করে?

রাজনের শক্ত হাতের বন্ধন থেকে ছাড়া পেতেই পিয়ালি হাফ ছেড়ে বাঁচে। বড় বড় করে ঘন শ্বাস নেয়। কিন্তু রাজন প্রশ্ন থেকে এক চুলও নড়ে না। ফের জিজ্ঞাসা করে, “কেন এমন করলি বল? কেন মিথ‍্যাচার করলি আমার সাথে?”

পিয়ালির নতমুখে জবাব দেয়, “তাহলে কি বিয়ে করতে আমায়?”

“সেটা পরের প্রশ্ন। মিথ্যা বলে এত নাটক কেন করলি? কি ক্ষতি করেছি আমি তোর? কেন আমার সাজানো সংসার নষ্ট করলি?”

“নষ্ট আমি করিনি। করেছো তুমি।”

“কিহ! আমি করেছি?”

রাজন যেন নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এ কথা আদৌ সত্য? সে নিজের সংসার নষ্ট করেছে? অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পিয়ালির দিকে তাকায়।

পিয়ালি হাসে। এ হাসির পিছনের গল্প অনেক। বলে, “কিছু হলেই আমার উপর হাত উঠাও। তোমার প্রাক্তন স্ত্রী তো পারলে আমাকে মে””রেই ফেলে। সব দোষ কি শুধুই আমার? তোমার এক চুল দোষ ও কি নেই?”

রাজন প্রতিত্তোরে কিছুই বলে না। বলবেই বা কি? নিজেকে এ প্রশ্নের কাঠগড়ায় আগে কখনও যে দাড় করায়নি। রাজন তবুও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে প্রতিত্তোরে বলে, “দোষ? আমি করেছি?”

“নিজেকে প্রশ্ন করে দেখ। দোষ তোমার কি একটুও নেই?”

রাজন এবার কিছুই বলে না। নিরব নিথর হয়ে দাড়িয়ে রই।

থামে থাকে না পিয়ালি। সে বলতে শুরু করে, “আমি নিতান্তই দারিদ্র্যঘেষা পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়ে। অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে আমি তৃতীয় জন। আমার চাষাভূষা বাবা এতগুলো ছেলেমেয়ে প্রতি পালনে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন। কোনরকম এসএসসির পরে গার্মেন্টসে ঢুকলাম। প্রতিবেশি এক চাচার মাধ্যমে। বছর খানিক চাকরির বয়স পেড়লো। শহরে অভস্থ হতে লাগলাম। এক পর্যায়ে তোমার সাথে দেখা। আমি ওয়ার্কার হিসাবে চাইব, উপর মহলকে হাতে রাখতে। যেন আমি সুযোগ সুবিধা অন‍্যদের থেকে বেশি পাই। এবং স‍্যার, ম‍্যামদের নেক নজরে থাকি। প্রায়শই বিভিন্ন রকমের খাবার বানিয়ে আনতাম। তার মধ্যে তুমিই বেশি খুশি হতে। খাবারের প্রশংসা করতে। তোমার সাথে আমার সখ‍্যতা বাড়তে লাগলো। আমার তোমাকে মনে ধরলো। ধরবে না ই বা কেন? তুমি শিক্ষিত, দেখতে ভালো। আমার থেকে উচু পজিশনে। আর কি চাই? কিন্তু তোমাকে এ কথা জানাব কি করে? উচু নিচুর একটা তফাত আছে না। সাজগোজ বাড়ালাম। প্রথম নজরে পড়লাম। তুমিও এগিয়ে আসলে। প্রেম হলো। একসময় ঘনিষ্ঠতা বাড়লো। একদিন জানতে পারলাম তুমি বিবাহিত। অথচ, এ কথা তুমি আমাকে আগে বলোনি। আমার সুন্দর, উন্নত জীবন চাই। দারিদ্র্যের জীবন আর চাই না। হাপিয়ে উঠেছি। এজন্য তোমাকে চাই। তাতে তোমার জীবনে যে থাকে থাকুক। তুমি কিন্তু আমার থেকে সুখ খুজতে ভুলতে না। ঘরে যে তখন তোমার অত সুন্দর স্ত্রী, তাও তোমার মধ্যে আমি অন‍্যরকম মাদকতা টের পেতাম আমার ছোয়ায়। অথচ, সৌন্দর্যের বিচার করলে, আমি তার ধারেকাছেও নেই। অস্তিত্ব সংকটে তোমার আরও আষ্টেপৃষ্ঠে আকড়ে ধরলাম। সত্যি আমি কন্সিভ করেছিলাম। তোমাকে দেখানো রিপোর্ট মিথ্যা ছিল না। কিন্তু তোমাকে পুরোপুরি ভরসা করে উঠতে পারছিলাম না। তাই কিছুদিনের মধ্যে এ‍্যাবোর্শন করা হয়েছিল। তবে ততদিনে তুমি আমার ওপর পুরোপুরি ঝুকে গেলে। স্ত্রী ছাড়তে দ্বিধা করলে না। তোমার স্ত্রী যেদিন তোমার ছেড়ে গেল, সেদিন ও ফ্লাটে আমি গিয়েছিলাম। সে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার মন বলে উঠলো, কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে দেখ তো। কেমন লাগে ওর! প্রেগনেন্সির রিপোর্ট দেখালাম। আরও ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা বললাম। তোমার স্ত্রী প্রথমে শান্ত থাকলেও পরে রূপ নিলো সাক্ষাৎ বাঘিনী। সেদিনও সে আমায় মে””রেছিল জানো? তারপর তো গেলোই। আমাদের বিয়ে হলো। সত্যি বলতে, সুখ আর হলো না। কেমন অশান্তি অসুখ লেগেই থাকে। বিলাস বহুল জীবন কাটাতে তোমাকে বেছে নেওয়া। যেই তুমি এক সময় আমাকে পেলে সব ভুলে যেতে, আমার ছোয়ায় উন্মাদ হয়ে যেতে। সেই তুমি গায়ে হাত তোলো আমার! আমি অবাক হয় জানো? আগের তুমি আর এখনের তুমির মধ্যে বিরাট ব‍্যবধান। অনেক কথা তো বললাম। এখন বলো? এখানে কি তোমার একটুও দোষ নেই? তোমার স্ত্রীকে ছাড়তে না চাইলে আমি জোর করে ছাড়াতে পারতাম? যত ভিডিও ফুটেজ থাকুক না কেন। তার চেয়েও বড় কথা তাকে প্রকৃত অর্থে চাইলে তুমি আমার শরীরে ডুবে যেতে পারতে? তুমি বিবাহিত এ কথায় বা কেন বলোনি? প্রথমে তো অজান্তে তোমার জীবনে এসেছি। শুরুতে সব জানানোর পর যদি সম্পর্ক আগাতাম বা শুরু করতাম তাহলে তুমি বলতে পারতে সব দোষ আমার। আমি জেনে বুঝে এসেছি। আসলেই কি তাই? দোষ যদি করে থাকি তবে তুমি আমি দুজনেই করেছি। এ কথা যত তাড়াতাড়ি স্বীকার করবে তোমার জন্য ভালো।”

পিয়ালি দীর্ঘ ব‍ক্তব‍্য শেষে টি টেবিলের ওপর রাখা পানি ভর্তি জগ মুখে ধরেই ঢকঢক করে পানি খেল। হাপিয়ে গিয়েছে সে।

অন‍্যদিকে রাজন, বিকারগ্রস্ত রোগীর ন‍্যায় দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি ঝাপসা, এলোমেলো। এভাবে কখনও ভাবেনি সে। পিয়ালি সে কিছুই বললো না। আর না পিয়ালি তাকে কিছু বললো।

রাজন পায়ের ক্ষতর জন্য সোজাসুজি হাটতে পারে না। খুড়িয়ে খুড়িয়ে রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। মস্তিষ্ক জট পাকিয়ে আছে। এ মুহূর্তে কিছুই ভাবতে পারছেনা। হিসাবে গড়মিল লেগেছে। মনের মধ্যে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। মনে হয় সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে তবে নিভবে।
___________________________

নাজনীন নিজেকে নিয়ে বড় বেশি ব‍্যাস্ত। পরিক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। নাহিদ গিয়ে কেন্দ্রে দিয়ে আসে। পরিক্ষা শেষে আবার নিয়ে আসে। চারিদিকে বিপদ ফাঁদ পেতে থাকে। পরিবেশ অনিরাপদ। এরমধ্যে বোনকে একা পাঠাতে তার মন সায় দেয় না।

যোগাযোগ চলে দুই পরিবারের মধ্যে। এখনো মুখোমুখি দেখা হয়নি তাদের। মাইমুনা বেগমের সাথে ছেলের মায়ের কথা হয়। কথার ফাঁকফোকরে নাজনীনের খবর নেওয়া হয়। ওপাশ থেকে একজন আগ্রহ নিয়ে সে গল্প শোনে।

একদিন বিকেল বেলায়, ফাহমিদা বিকেলের চা নাস্তার আয়োজন করছিল। বারান্দার এক কোনে বেতের তিনটি মোড়া পেতে রাখা। একটি গোল টি টেবিল। খালি জায়গায় কয়েকটা ইনডোর প্লান্ট। সেখানে প্রায়শই আড্ডা জমে বাড়ির তিন মানবির। এ সময়টা বাড়িতে পুরুষ লোক থাকে না। তারা থাকে কর্মস্থলে।

আসরের পরের সময়টা বেলা হু হু করে পড়তে শুরু করে। এই দেখা যায় বারান্দার এক কোনায় এক ফালি চকচকে হলদে রোদ। পরক্ষণেই দেখা যায় চারিপাশ আচ্ছন্ন হয়ে আসছে আধারিতে। সেদিনের চিত্রপট ভিন্ন ছিল। জৈষ্ঠ্যের ভ‍্যাপসা গরম দিনে দুপুর পরে শুরু হলো কালবৈশাখির তান্ডব। আকাশ ঘন কালো হয়ে এলো। মুহুর্তে শান্ত প্রকৃত রূপ নিল ভয়াবহতায়। সেদিন তার নাহিদ এবং আজমল শেখের দোকানে ফেরা হয় না। খাবার পরে ঝুম বৃষ্টির শীতলতায় গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়েন।

বৃষ্টি শুরুর সাথে সাথে মাইমুনা বেগম ব‍্যাস্ত হয়ে পড়েন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে। বৃষ্টির পানিতে রান্না হয় খুব সুন্দর ও স্বাদু। বড় বড় ড্রামে পানি জমিয়ে রাখেন।

বসার ঘরে হাওয়ার তালে পর্দা দুলে উঠছে। মাইমুনা বেগম সব পানি সেকে, আসরের নামাজ পড়ে সোফায় বসেন। আসেন আজমল শেখ ও। নাজনীন আসরের নামাজ শেষে সোজা কিচেনে চলে যায়। ভাবিকে নাস্তা বানানোর কাজে সাহায্য করে।

বিকালের নাস্তায় তৈরী করা হয়, আলু পুড়ি, চিকেন পাকোড়া আর ঘন দুধ চা।

ফাহমিদা পুরি ভাজতে ভাজতে বললো, “তুমি পাকোড়া গুলো ভেজে ফেল না বোন। আমার চিকেনে গন্ধ লাগছে। কেমন গা গুলিয়ে আসছে।”

নাজনীন ফাহমিদার দিকে সর্তক দৃষ্টিতে তাকায়। মনের মধ্যে অন‍্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়। আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করে না। থাক না। সত্যি হলে, সেই বলবে।

বিকালের নাস্তার সাথে দারুণ আড্ডা জমে উঠেছে। আকাশ কালো করে বাইরে পড়ছে মুশুলধারে বৃষ্টি। ঘরের মধ‍্যখানে পরিবারের কয়েকটি প্রাণি মিলে নিজেদের আলাপ আলোচনায় মশগুল। পারিবারিক আড্ডা পৃথিবীর অন‍্যতম সুন্দর দৃশ‍্যের একটি। বড় বড় চুমুকে আজমল শেখ চা শেষ করেন। মেয়ের উদ্দেশ্য বলেন, “তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে মা? পরিক্ষা শুরু হয়েছে শুনলাম। কেমন হচ্ছে?”

নিজের গম্ভীর, দাপটের সাথে চলা বাবার মুখ থেকে মা নামক আদুরে সম্বোধনে নাজনীনের মন খুশিতে নেচে ওঠে। জীবনের চরম বাস্তবতায় ঘেরা সময়ে সে পরিবারের প্রত‍্যেকটি সদস্যকে পেয়েছে বন্ধু রূপে। পাছে সে কষ্ট না পায় সেদিকে দৃষ্টি তাদের সদা জাগ্রত। ভালোলাগায় মন ছেয়ে থাকে। বাবার প্রশ্নের প্রতিত্তোরে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলে, হঠাৎ করেই নাকমুখ চেপে ফাহমিদা তড়িঘড়ি করে স্থান ত‍্যাগ করে। ব‍্যাসিনে গিয়ে এ অব্দি পেটে পড়া খাবারের বিসর্জন ঘটে। নাজনীনের আর কিছুই বলা হয়ে ওঠে না।

সদ‍্য ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেতে বসেছিল নাহিদ। স্ত্রীর অদ্ভুত কান্ডে বড় বড় চোখ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। সে ঘটনা বুঝতে অপারগ।

ফাহমিদা খাদ‍্যের বিসর্জন দিয়ে, চোখমুখ ধুয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ডায়নিংয়ের একটি চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে। এমন সময় নাজনীন এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে হাজির হয়। ফাহমিদা বিনা বাক‍্যে ঢকঢক করে গিলে নেয়।

নাজনীন শুধায়, “টেস্ট করিয়েছেন?”

বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় ফাহমিদা। দুদিকে মাথা ঝাকায়।

নাজনীন আবারও বলে, “আগামীকাল টেস্ট করাবেন। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন?”

“না।”

“আসলেই?”

“হুম।”

নাজনীন হেসে ফেলে। বলে, “এইযে খাবারে গন্ধ লাগা, হটাৎ করে ব”””মি হওয়া। এসব কিসের লক্ষণ জানেন না?”

ফাহমিদার ফোলা গালদুটো হালকা গোলাপি আকার ধারণ করে। নাজনীনের কথায় বেচারি ভারি লজ্জা পায়।

“ভাইয়া জানেন?” নাজনীন প্রশ্ন করে।

“না।”

“তাহলে সবাইকে গিয়ে বলি?”

ফাহমিদা নাজনীনের হাত টেনে ধরে। লাজ রাঙা মুখের লাজুক কন্ঠে বলে, “এখন না। আগে শিওর হই।”

“আচ্ছা।”
_______________________________

নাজনীনের ডিগ্রীর আর একটি বছর আছে। তৃতীয় বর্ষে উঠেছে। টুকটাক পড়াশোনা, মাঝেমধ্যে ক্লাসে গেলে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেওেয়া, ফুচকা খাওয়া, আইসক্রিম খাওয়া। এসবের মধ‍্যেই দিন কাটছিল। তারমধ‍্যে ফাহমিদা গর্ভবতী। ভাবির একটু আধটু যত্ন, দেখভাল। আসন্ন নবজাতকের জন্য ছোট ছোট খাতা সেলাই।

হঠাৎ করেই একদিন নাজনীনের নামে পার্সেল আসে। কুরিয়ার থেকে কল করে তাকে জানানো হয়, অনুগ্রহ করে পার্সেলটি রিসিভ করতে।

একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে কুরিয়ার অফিস ফিরে। বেশ ভারি একটি পার্সেল। চোখমুখে কৌতুহল উপচে পড়ছে।

বাড়ি ফিরে সর্বপ্রথম পার্সেলটি আনবক্স করে। আবিষ্কার করে কালজয়ী লেখকদের লেখা কিছু বই। এবং সাদা কাগজে নীল কলমের আচরে ফুটিয়ে তোলা একটা চিঠি। অথবা চিরকুট ও বলা যেতে পারে।

এ বয়সে আবেগ থাকে। মনের কোনে নানা অনুভূতি জন্ম নেয়। অজ্ঞাত পরিচয়হীন মানুষের থেকে উপহার পেয়ে নাজনীনের ও তেমনটিই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা তাকে চিনিয়েছে কঠোরতা।

নাজনীন চিরকুটটা হাতে নিল। তাতে লেখা ছিল,

◆◆◆◆
নিস্তব্ধতা,
আপনাকে দেখেছিলাম সমুদ্রে পাড়ে। নিরব, সরল, কোমল একটি মুখশ্রী। যে মুখে লেপ্টে ছিল স্নিগ্ধতার আবেশ। জানেন, আমি মোহিত হয়ে পড়েছিলাম। আপনার নিরবতাকে ভিষন পছন্দ হয়েছিল। আপনার নম্রতা, সভ‍্যতায় আমি অভিভূত হলাম। এরপর জানতে পারলাম আপনার পরিবারের সাথে আমার বাবা মায়ের সখ‍্যতা তৈরি হয়েছে। আমার বোনটিও আপনার আশপাশ ঘুরঘুর করে। আমার তখন মনে হয়েছিল এরচেয়ে খুশির যেন আর কিছুই হয় না। ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয় আমি কে? আমি জানি, আপনার যে মন মানসিকতা তাতে আমার হাবিজাবি লেখা পড়ার ধৈর্য্য এবং সময়টা আপনার নাও হতে পারবে। তবুও আমার অবচেতন মন চাইছে, আপনি পড়বেন। আমার বাবা মায়েরও আপনাকে পছন্দ হলো। এদিকে আপনাতে মন দিয়ে আমি ভেতরে ভেতরে কুপোকাত। ওনারা বিষয়টিকে জোর দিলেন। এ অব্দি আমি চুপ ছিলাম। আপনার পরিবারের কাছে প্রস্তাব রাখতেই জানতে পারলার অপ্রত্যাশিত কিছু কথা। আপনার জিবনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এ কথা আমি জানামাত্রই আমার শুধু মনে হয়েছে, এই মানুষটিকে কি করে ঠকানো যায়? এই মানুষটি যে জীবনে একবার পেয়েছে তার তো মাথায় করে রাখা উচিত। ঠকানো, কষ্ট দেওেয়া এসব তো বহু দূরের কথা। আমি আপনাতে হারিয়েছি। এ কথা দুনিয়ার সব সত‍্যর মধ্যে একটি। আমার ছোট্ট জীবনে আপনাকে চিরসঙ্গী হিসাবে চাই এটিও তেমনই সত্যি। আমি জানিনা আমার রব কপালে কি লিখে রেখেছেন। আপনার মা জানিয়েছেন আপনার পড়াশোনা শেষে ভেবে দেখবেন। আমি জানিনা আদৌ কি হবে না হবে। আপনার অব্দি কথা পৌছেছে কিনা তাও জানিনা। আমি আপনার প্রহর গুনছি। বিগত মাসগুলোতে আপনার প্রতি শুধু আমার অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। আমি রাশভারী মানুষ। অথচ আমার সারাক্ষণ মনে হয় আপনাকে পেলে আমি অনেক গল্প করব। মনের মধ্যে কত কথা জমিয়ে রেখেছি। অথচ, লিখতে গিয়ে শব্দ খুজে পাচ্ছিনা। জানিনা কেমন আছেন। আপনার মত শান্ত শীতল মানুষকে দেওয়ার মত বই ছাড়া অন‍্য কোন কিছুকে বেস্ট মনে হয়নি। আমি আপনার হ‍্যাঁ উত্তরের আশায় পথ চেয়ে আছি। প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তা দরবারের দোয়া করছি, ওই মন ভাঙা মানুষটাকে তুমি আমার করে দাও। আমি আজীবন তাকে যত্নে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখব। জীবনে কখনও যদি কাউকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে ইচ্ছা হয়, তবে সেই সুযোগটি আমাকে দিলে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। আমার ফোন নাম্বারটি দিয়ে রাখলাম। অনুগ্রহ করে কখনও যদি আপনার কন্ঠস্বর শোনান।

ইতি
রোমান
◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆

একবার নয়। কয়েকবার চিঠিটি পড়লো নাজনীন। তার মন ভাঙাচোরা মানুষকে নিয়ে কেউ অনুভূতি সাজাতে পারে এ ও কি বিশ্বাসযোগ্য? নিজের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। এ জীবনে তার জন্য কেউ এতটা আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এ ও কি বিশ্বাস করতে হবে তাকে?

কারো থেকে উপহার পেলে তাকেও কিছু দিতে হয়। এটাই নিয়ম। নাজনীন দুটো বইয়ের সঙ্গে চিরকটুট লিখে দিলে। খুব সংক্ষেপে তাতে লিখলো,

◆◆কদম ফোটা ঘন বরষায় ছাতা হীন ঝুম বৃষ্টিতে ভেজার বড় ইচ্ছে। এ জীবনে এক পশলা রহমতের বৃষ্টির ন‍্যায় সচ্ছ, নিরেট, খাদহীন ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই।”

ইন শা আল্লাহ চলবে……

লেখনীতে~সুমাইয়া ইসলাম জান্নাতি