#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী
একটা প্রবাদ শুনেছেন নিশ্চয়,”বাসর রাতে বিড়াল মারতে হয়।” আমার জীবনে তাই ঘটলো। ঐ যে আমার শাশুড়ী মা অজ্ঞান হয়ে পড়লেন এরপর রাজন আর কোনোদিন ওর মায়ের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারেনি। ওর এক কথা “মায়ের অমতে তোমাকে বিয়ে করেছি একটু কষ্ট করে সবকিছু সহ্য করে নাও। আমি মায়ের খুব আদরের সন্তান।তোমার পক্ষ নিয়ে কথা বললে মা সইতে পারবেন না। দেখলে না আমাদের বিয়ের দিন কি কান্ড ঘটলো।”আজ অবদি সহ্যই করে নিলাম। আপনি শুনলে অবাক হবেন, বিয়ের তিনদিন পরে আমরা স্বামী স্ত্রী একসাথে হতে পেরেছি। মানে যাকে বাসর বলে। তাও আমার বড় ননসকে রাজন খবর দিয়ে এনেছে। সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। এরপর থেকে শুরু হলো কঠিন জীবন। সেই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সংসারের পিছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। কিন্তু কারো মন পাইনি। এমনকি রাজনও আমার কথা ভাবতো না। আমার শাশুড়ী নিত্য খোঁটা দিতো। আমি নাকি ডাইনি। তার ছেলেকে যাদু করেছি। আমার যাদুটোনার মোহে পরে তার ছেলে আমার মতো অজাত কুজাতের মেয়ে ঘরে এনেছে। অন্য জায়গায় বিয়ে হলো তার ছেলে ফ্লাট গাড়ি দামী ফার্ণিচার কতকিছু পেতো। মাঝে মাঝে উনি রাজন ঘরে থাকা অবস্থায় ও এসব কথা বলতো কিন্তু রাজনের মুখ দিয়ে একটা টু শব্দের প্রতিবাদ বের হতো না। একবার তো আমাকে বাড়ীর সবাই মিলে চোর সাজালো। তাও রাজন প্রতিবাদ করলো না।
—-কিভাবে চোর সাজালো আপনাকে? নিজের সংসারে নিজে চোর হয় এই কাহিনী তো কখনও শুনিনী।
—-শোনেনি। কারন আপনি যে পরিবেশে বড় হয়েছেন সেখানে হয়তো এতো নীচু মনের মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটেনি।
—কিভাবে হলো শোনা যায়?
—-অবশ্যই। কারণ আমার স্বামী কতটা কাপুরুষ ছিলো তা জানতে হলে ঘটনাগুলো আপনার জানা দরকার। কতটা অপদার্থ ছিলো যে নিজের স্ত্রীর অপমান তার অন্তরে আঘাত করেনি কিংবা এটা ওরই অপমান সেটাও বোঝার মতো জ্ঞান ওর মস্তিস্কে ছিলো না। সেদিন অফিস থেকে এসে রাজন শার্ট খুলে আলানায় রেখে ওয়াশরুমে যায়। এমনসময় দীপা এসে আমাকে বলে,
—-ভাবী, তোমার কাছে দু’হাজার টাকা হবে?
—-না,তোমার ভাই তো আমাকে কখনও হাত খরচের টাকা দেয় না।
দীপা একটু ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,
—-টাকা আছে কি নাই সেটা বলবে। আমার ভাইয়ের বদনাম বলতে বলিনি।
মনে মনে বললাম,বলি এক আর বুঝে আর এক। যাক ওর মতো ও যা ইচ্ছা বুঝুক। এরপর দীপা ওর ভাইয়ের পকেট থেকে টাকা নিয়ে আমাকে বললো,
—-আমার মাথাটা ধরেছে, এক কাপ চা বানিয়ে দাওতো।
আমি কিচেনে চা বানাতে গেলাম। এরপর শুনতে পারছি রাজন চিৎকার করে বলছে,
—-আমার পকেটে এই মাত্র দুহাজার টাকা রেখে আমি ওয়াশরুমে গেলাম। এরমধ্যে টাকাটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেল।
অমনি আমার শাশুড়ী বলা শুরু করলেন,
—-আমি কি এমনি তোর বউকে অজাত কুজাতের মেয়ে বলি? দেখ ঘরে তুই চোর আমদানি করেছিস।
ইউসুফ হা হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আপনি সাথে সাথে প্রতিবাদ করলেন না কেন?
—-তা আবার করিনি? যখনি দীপাকে বললাম,তুমি তো এই মাত্র তোমার ভাইয়ের পকেট থেকে টাকা নিলে। সেটা বলছো না কেন?
দীপা তখন নাকি কান্না কেঁদে আমার শাশুড়ী মাকে বললো,
—-ভাবির সাহস দেখেছো আম্মু? নিজে চুরি করে আমার কাঁধে দোষ চাপাচ্ছে?
আমি অবাক হয়ে দীপার মুখে জলজ্যান্ত মিথ্যা কথাগুলো শুনলাম। এরপর আমার শাশুড়ী আমার ঘর সার্চ করতে শুরু করলেন। কেন জানি মনে হলো টাকাটা দীপা আমার রুমের কোন একটা জায়গায় রেখে আমার চোর সাজাবে। হলো তাই। আমার শাশুড়ী মা তোষকের তলা থেকে টাকাটা বের করে রাজন দেখিয়ে বললো,
—-দেখ, কি বউ ঘরে এনেছিস?
রাজন আমাদের কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
—-আপনি চাকরির চেষ্টা করতে পারতেন?
—-চেয়েছিলাম,রাজন অনুমতি দেয়নি। আসলে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। শেষে জীবনের প্রতি হাল ছেড়ে দিলাম। রোবটা টাইপ একটা মানুষে পরিনত হলাম।
—-আপনার মামার বাসা থেকে কেউ যোগাযোগ করেনি?
—নওশাদ করতো। ওর মুখেই শুনেছিলাম,মীম নিজের পছন্দে এক বড় লোকের ছেলেকে বিয়ে করেছিলো। কিন্তু সুখী হতে পারেনি। ওদের সাথে তাল মেলাতে পারছিলো না বলে ডিভোর্স হয়েছিলো।
ইউসুফ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—একটা অনুমতি চাইছি।
আমি একটু ধাক্কা খেলাম। তারপর চিন্তিত হয়ে বললাম,
—-বলুন,কিসের অনুমতি চাইছেন?
—-একটা সিগারেট ধরাতে পারি? আসলে সবসময় খাই না। হঠাৎ কালে ভদ্রে খাই।
আমি রাজনের কাপুরুষচিত আচরণে যেমন অবাক হয়েছিলাম তেমনি ইউসুফের ভদ্রতাবোধেও অবাক হলাম। নিজেকে কিছুটা সামলে বললাম,
—আপনার ঘর, আপনার বাড়ি সেখানে আমার অনুমতির দরকার কি?
—অবশ্যই দরকার আছে। আপনি সিগারেটের গন্ধ সহ্য নাও করতে পারেন।
আমি আসলেই সিগারেটের গন্ধ নিতে পারি না। কিন্তু মানুষটার ভদ্রতাবোধে আকৃষ্ট হয়ে বললাম,
—-সমস্যা নাই,ধরাতে পারেন।
—-আপনার কথাগুলো শুনে আমার খুব কষ্ট লাগছে।আপনার জীবনের যেটুকু ঘটনা জানলাম তাতেই আমি আর নিতে পারছি না। আর আপনি কেমন করে এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে এখনও সুস্থ আছেন। এটাই আল্লাহপাকের এক বিশাল রহমত। হয়তো এতো কষ্টের বিনিময়ে আল্লাহপাক আপনাকে এতো সুখ দিবেন যা আপনার কল্পনারও বাইরে।
—সেই বিশ্বাস নিয়ে এখনও বেঁচে আছি।
উনি আমার থেকে একটু দূরে গিয়ে আপনমনে সিগারেট টানতে লাগলেন। আর ধোয়াগুলো বারান্দার গ্রীলের বাইরে ছাড়ছেন। রাত মনে হয় শেষ হতে চললো। চাঁদটা অস্তরাগে চলে যাচ্ছে। আমি ভাবছি এরপর আমার জীবনটা কিভাবে বয়ে যাবে? কেমন যেন অস্থির লাগছে। ইউসুফ সাহেব আমার কাছে এসে বললেন,
—-ঘুমাবেন না? রাত তো শেষ হতে চললো।
—-আজ আর ঘুম আসবে না। ভাবছি ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিবে জানি না।
ইউসুফ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আমি একটা সমাধান দিতে পারি।
উৎসুক হয়ে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
—আপনি যদি রাজনকে ডিভোর্স দিয়ে দেন তাহলে কিন্তু এর একটা সুন্দর সমাধান হতে পারে। যতদিন এই সমস্যার সমাধান না হচ্ছে আপনি এ বাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।
আসলে আমি যাবো কোথায়? অগত্যা উনার প্রস্তাব না মেনে আমার তো আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। আমি রুমে এসে বিছানায় বসলাম। ইউসুফ সাহেবও ঘরে চলে আসলেন। আমাকে বললেন,
—-ঘুম না আসলেও বিছানায় একটু গড়িয়ে নিন। আমি অন্য রুমে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করবো।
এরপর আমার দিকে একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললেন,
—এখানে আমার নাম্বার আছে। কোনো প্রয়োজন হলে ফোন করবেন।
আমি একটু চমকে উঠলাম। রাজনও আমাকে প্রথম পরিচয়ের দিন ঠিক একই কথা বলেছিলো।রোকেয়া হলে আমাকে উঠিয়ে দিয়ে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলেছিলো,
“এখানে আমার ফোন নাম্বার আছে।দরকার লাগলে অবশ্যই ফোন দিবেন।”
সেই মানুষটা কিভাবে বদলে গেল। আমাকে কার্ড হাতে নিয়ে বসে থাকতে দেখে ইউসুফ বললেন,
—-কি ব্যাপার আপনি হারালেন কোথায়?
আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম,
—হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠলো।
—-এজন্যই তো একটু ঘুমাতে বললাম। আমি রেস্ট করুন।
একথা বলে ইউসুফ রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। উনি যত সহজে আমাকে ডিভোর্স দিতে বললেন আদৌ কি আমার কাছে ততটা সহজ? কত স্মৃতি আমার ওর সাথে জড়িয়ে আছে। আচ্ছা রাজন কি পারবে আমাকে ভুলে থাকতে? দিনের পর দিন ওর মায়ের অন্যায়গুলো হজম করতে গিয়ে ভাগ্য আজ ওকে খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমি তো জানি,ওর চাকরি থাকবে না। এরপর—-
কত স্বপ্ন কত আশা নিয়ে ওকে ভালোবেসেছিলাম। অথচ বিয়ের পর যেখানে ভালোবাসা তীব্র হবার কথা সেটা না হয়ে তা যেন অন্ধকারে ঢেকে গেল। ঠিক অমাবশ্যার মতোন।
চলবে