#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
পর্ব- সাত
মাহবুবা বিথী
ওয়াশরুম থেকে ড্রেস চেইঞ্জ করে এসে বিছানায় বসলাম। দরজার ওপাশে ইউসুফের কথা শুনতে পারছি। মনে হলো ওর বাবার সাথে কথা বলছে। আড়ি পেতে আমি কখনও কারো কথা শুনি না। কিন্তু এখানে কথাগুলো রুম থেকেই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
—-কিরে বাবু,এতো রাতে ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলি কেন? ও ঘরে ঘুমাবি না?
ইউসুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—-না বাবা,আমি স্টাডি রুমে ঘুমাবো।
—-কেন,কোনো সমস্যা?
—-সমস্যা কিনা জানি না তবে আমাদের বিয়েটা সঠিক হয়নি।
—-কি বলছিস তুই? তোর মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে।
—না বাবা,আমি একটুও ভুল বলছি না। তোমার কর্মচারী রাজন তার বোনের সাথে আমার বিয়ে দেননি।
—-তাহলে ও কে?
—-ও রাজনের স্ত্রী জুলেখা।
—-আমি তোর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। ওকি পাগল নাকি জুয়াড়ী? যে নিজের স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে দিবে?
—-মায়ের বুদ্ধিতে করেছে।
—-বুঝলাম না,
—-তুমি যখন ওকে আমার জন্য মেয়ে দেখতে বলেছিলে ও তখন বাড়িতে গিয়ে মায়ের সাথে আলোচনা করে। ওর মা তোমার ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ের লোভ সামলাতে পারেননি। রাজনের কাছে ওর বোনের কথা বলে। কিন্তু তুমি যে ক্যাটাগরীর পাত্রী চেয়েছো ওর বোন সেই মাপের নয়। সেক্ষেত্রে রাজন বলে তুমি হয়তো ওর বোনের ক্ষেত্রে রাজী হবে না। তখন ওর মা বলে, জুলেখাকে পাত্রী হিসাবে আমাদের দেখাবে। এরপর আমরা রাজী হলে নিদিষ্টি দিনে ওর বোনের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যাবে। সমস্যা হলো তুমি যে পাত্রী দেখার দিন বউ তুলে আনবে এটা ওরা ভাবতে পারেনি। যারফলে ওদের কূটবুদ্ধিও সফলতা পায়নি।
—-রাজন তো আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে।
—-যাই হোক আমার জন্য মনে হয় ভালোই হয়েছে। জুলেখাকে আমার ভালো লেগেছে।
ওর বাবা সবটা শুনে কি বললো সেটা জানার জন্য দরজার পাশে কান পেতে দাঁড়ালাম। আসলে আমি খুব অস্থিরতায় ভুগছি। যদি এরা আমাকে গ্রহন না করে তাহলে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? আমি মনে মনে আল্লাহকে বললাম,মাবুদ তোমার এতো বড় পৃথিবীতে আমার একটা থাকার জায়গা দাও। সেখানে আমি যেন নিশ্চিন্তে বাস করতে পারি। কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলাম।
—তুই কি সিদ্ধান্ত নিবি?
—-উনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। উনি যদি রাজনকে ডিভোর্স দিয়ে দেয় তাহলে আমার সাথে উনার বিয়েতে কোনো বাঁধা থাকবে না।
—-জুলেখা কি রাজী হবে?
—-ডিভোর্সের ক্ষেত্রে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। তবে ও বাড়িতে আর ফিরে যাবে না তা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে। আর ফিরে যাবেই বা কেন? মায়ের কথায় প্রভাবিত হয়ে যে স্বামী নিজের বউয়ের সাথে এরকম আচরণ করতে পারে তাকে ডিভোর্স দেওয়াই উচিত। তবে তোমার রাজন সুবিধার মানুষ না। জুলেখাকে এ বাড়ি থেকে পালাতে বলেছিলো। ও পালিয়ে না গিয়ে আমাকে সব সত্যিটা বলে দিয়েছে। জুলেখার এই আচরণটা আমার ভালো লেগেছে।
—যাক,বড় অসম্মানের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি। তবে এর শাস্তি রাজনকে পেতেই হবে।
দুজনেই নিরব হয়ে আছে। মৌনতা ভেঙ্গে ওর বাবা বললেন,
—-উপর থেকে কোনো মানুষকে দেখে তার ভিতরটা চেনা যায় না। রাজনকে আমি ভীষণ পছন্দ করতাম। এতো অল্প বয়সে পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। ওকে আমার খুব সংগ্রামী মনে হতো। যারা জীবনে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে তারা মানুষ হিসাবে সৎ হয়। অথচ রাজনের ক্ষেত্রে আমি ভীষণ শকড।
—প্রতিটি মানুষের একটা খারাপ দিক থাকে বাবা। রাজনের খারাপ দিক হলো ওর মায়ের কথায় প্রভাবিত হওয়া।
—এটা তুই কি বললি বাবা? বাবা মায়ের কথায় প্রভাবিত হওয়া কি দোষের?
—-দোষের হবে কেন? তবে যাঁচাই করতে তো সমস্যা নাই। কথাটা সঠিক না ভুল। তারপর সঠিক যুক্তি দিয়ে বাবা মাকে বোঝানো।
—-যাক যা হবার হয়ে গেছে। এখন জুলেখা কি ওর বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে দিবি?
—-বাবা,এই পৃথিবীতে ওর কেউ নাই। ছোটোবেলায় বাবা মাকে রোড এক্সিডেন্টে হারিয়েছে। বাবা,তুমি কি জুলেখাকে এ বাড়িতে থাকার অনুমতি দিবে?
—-কেন দিবো না? কিন্তু যদি কোনো ঝামেলা হয়?
—-মনে হয় হবে না। তারপরও জুলেখার সাথে আলোচনা করে নিবো।
এরপর আর কোনো কথা শুনতে পেলাম না। ওদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। মনে হলো ওরা এখানে কেউ নেই। আমি বারান্দায় এসে বসলাম। আকাশের অস্ত যাওয়া চাঁদের দিকে তাকালাম। ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাস বইছে। লনের গাছগুলো সে হাওয়ায় নড়ছে। অপার্থিব সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ছে।
বিছানায় শুইতে ইচ্ছা করছে না। আমার একটা খারাপ অভ্যাস আছে। বিছানা চেইঞ্জ হলে ঘুম আসে না। তারপর রুমে এসে মনে হলো এই ঘর তো আমার না। এই বিছানায় শোয়ার অধিকার এখনও আমার হয়নি। ডিভানটার উপর আধশোয়া হয়ে বসে রইলাম।
এক দুঘন্টার আলাপে মানুষ চেনা যায় না। তবে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। মানুষটাকে বড্ড আপন আপন লাগছে। আচ্ছা, রাজনকে তো অনেক আপন লাগতো। এতো ভালেবেসে বিয়ে করলাম অথচ বিয়ের পর কিভাবে বদলে গেল। আমি কি ভুল ভেবেছিলাম?
ভাবতাম এই মানুষটা বিয়ের আগে যতটা আমার আপন হয়েছে বিয়ের পর হয়তো আরো বেশী আপন হবে। অথচ বিয়ের পর ততটাই দুরত্ব তৈরী হয়ে গেল। বিয়ের পর দিনের পর দিন ঐ সংসারে নিজেকে অপাংক্তেয় মনে হতে লাগলো। মাঝে মাঝে ভাবতাম, রাজন কি আমাকে সত্যি ভালোবেসেছিলো নাকি আমি এতিম বলে আমাকে করুনা করে বিয়ে করেছিলো। সে কারণে ও বড় নিশ্চিন্ত ছিলো। শত অত্যাচার সহ্য করে আমাকে তো ওখানেই পড়ে থাকতে হবে। বিয়ে করে আমার অনেক বড় উপকার করেছে। সুতরাং ওর কাছে আমার আর কিছু চাইবার নেই।
নাহ্ ওর কথা আর ভাববো না। আমি মোবাইল টা হাতে নিয়ে ফেসবুকে ইউসুফের নাম দিয়ে সার্চ দিলাম। অনেকগুলো ইউসুফ চৌধুরী নাম সামনে আসলো। আমি ছবি দেখে ওর প্রোফাইলে ঢুকলাম। স্ক্রল করতে লাগলাম।হঠাৎ একটা ছবি দেখে অবাক হলাম। ইউসুফের সাথে মেয়েটা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। মনে হলো ওর স্ত্রী হবে। তবে অবাক করা বিষয় আসলেই ঐ মেয়েটার সাথে আমার চেহারার অদ্ভুত মিল রয়েছে। বিশেষ করে কপাল থেকে চোখ পর্যন্ত একই রকম। ইউসুফ তাহলে মিথ্যা বলেনি। আচ্ছা উনার অন্তরে এখন নিজের স্ত্রীর জন্য ভালোবাসা বিদ্যমান। সেখানে নতুন করে আমাকে কিভাবে ভালোবাসবে? নাকি ইউসুফের কাছেও আমাকে সারাজীবন ফেলনা হয়ে থাকতে হবে?
এরপরে আমার জীবনের সময়গুলো দ্রুত পার হতে লাগলো। রাজনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়নি। ও ডাক যোগে নিজের পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলো। যাক শেষপর্যন্ত এটুকু আত্মসম্মান বোধ দেখাতে পেরেছিলো। তবে আমার বিষয়টা বাড়িতে গোপন রাখা হয়েছিলো। ঘরের চার /পাঁচজন কাজের লোক,দারোয়ান, ড্রাইভার সবাই জানতো আমি রাজনের বোন। তবে রাজন চাকরি ছেড়ে দেওয়াতে অফিসে কানা ঘুষা চলতো। এর মাঝে সাতদিন সময় পার হয়ে গেল। আমি রাজনের কাছে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছি। রুমের লাইট অফ করে বারান্দায় এসে বসলাম। রাত দশটা বাজে। এতেই পুরো বাড়ি নিরব। এরা খুব নিয়মতান্ত্রিক। রাত আটটার মধ্যে ডিনার করে ফেলে। চারিদিক বেশ অন্ধকার হয়ে আছে। লনের গাছগুলোকে ভৌতিক লাগছে। এখন কৃষ্ণপক্ষ চলছে। রাত গভীরে চাঁদের আলো ফুটে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। উঠে এসে দরজা খুলে দেখলাম ইউসুফ এসেছে। আমাকে দেখে একগাল হাসি দিয়ে বললো,
—-,লাইট অফ করে শুয়ে আছেন শরীর ভালো আছে তো?
—-হুম,ভালো আছি।
—-চলেন একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
আমি মোবাইল ওপেন করে দেখি রাত বারোটা বাজে। মনে মনে ভাবলাম, বারান্দায় দুঘন্টা সময় পার হয়ে গেল টের পেলাম না। আমি অবাক হয়ে বললাম,
—এতো রাতে কোথায় যাবেন?
—+পুরান ঢাকায়। ওখানে খাসীর পায়া দিয়ে লুচি খাবো।
আমি আমতা আমতা করছিলাম। উনি হয়তো সেটা বুঝতে পেরেছেন। সে কারনে বললেন,
—আমি গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে যাবো। ভয়ের কিছু নাই।
আসলে ভয় ডর বলে কথা না। এতোরাতে আমি কখনও ঢাকা সিটিতে বের হই নাই। তবে মনটা উনার সঙ্গ নিতে চাইছে।
চলবে