#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী
—আমি একটু রেডী হয়ে আসি।
—-খুব বেশী সময় দিতে পারবো না। পনেরো মিনিটের মধ্যে রেডী হয়ে নীচে নামুন। আমি নীচের হলরুমে অপেক্ষা করছি।
আমি একটা পারপেল কালারের টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি পড়লাম। চুল গুলো পরিপাটি করে একটা হাত খোপা বেঁধে নিলাম। চোখ ভর্তি করে কাজল পড়লাম। চোখে কাজল দিতে গিয়ে মনে পড়লো,এক সময় কাজল পড়তাম রাজনের জন্য। আজ কার জন্য পড়ছি? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম। তাহলে কি আজ ইউসুফ সাহেবের জন্য পড়েছি। তা কি করে হয়? সাত বছর একসাথে থেকে একটা মানুষকে আপন করতে পারলাম না।আর সাতদিনে কিভাবে সম্ভব? নিজেকে নিজের কাছে বোকা মনে হলো। পরে এটা ভেবে সান্তনা নিলাম,আমি তো নিজের জন্যও সাজতে পারি। নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলে মনের ভিতর প্রশান্তি বিরাজ করে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিলাম। বেশ সুন্দর লাগছে আমায়।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আমার পায়ের শব্দে ইউসুফ আমার দিকে তাকায়। নীচে নামা অবদি ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। সেই দৃষ্টিতে ছিলো একরাশ মুগ্ধতা। ও সোফা থেকে উঠে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা গাড়ির চাবিটা নিয়ে বের হলো। আমিও ওর পিছু পিছু বের হলাম। ওর প্রিমিও গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশের সীটে আমাকে বসতে বললো। আর ও ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিলো। ইউসুফদের বাড়িটা বেলীরোডের পিঠাঘরের গলিতে ডুপ্লেক্স বাসা। অনেকটা জায়গা জুড়ে বাড়িটা তৈরী করা হয়েছে। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে নানা রকম ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। বাগানের মাঝখান দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি ঐ পথ দিয়ে বের হয়। পিছনের দিকটায় নানা ধরনের ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। লনে একটা বড় হাসনাহেনা গাছ লাগানো রয়েছে। সেখান থেকে সুবাস এসে পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে।
রাতের আধার কেটে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ইউসুফ গাড়ি চালানো অবস্থায় আমাকে বললো,
—-আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। পারপেল কালারটা আপনার গায়ে বেশ ফুটেছে। জানেন, নুরীকেও পারপেল কালারটা বেশ মানাতো।
নুরী কে জানার জন্য আমি ওর দিকে তাকাতেই বললো,
—-ও আপনাকে বলা হয়নি,নুরী আমার স্ত্রী। আপনার সাথে ওর চেহারার অদ্ভূত মিল রয়েছে। আপনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম। মনে হলো নুরী নামছে। জানেন,ও আমাকে ভীষণ ভালোবাসতো। এতোটাই ভালোবেসেছিলো যে আমি ওর স্মৃতি নিয়ে আজীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।
উনার কথাগুলো শোনার সাথে সাথে আমার ভিতরে শুন্যতার সৃষ্টি হলো। আমার একধরণের কষ্ট বোধ হলো।
দৃষ্টিটা জানালা দিয়ে বাইরে মেলে ধরলাম। এতো রাতেই মানুষের বেশ আনাগোনা। এই সময় আবার একটা মিছিল বের হলো। ইউসুফ গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে রাখলো। মিছিলটা চলে যাবার পর গাড়িটা আবার চলতে শুরু করলো। আমরা পুরাণ ঢাকায় ঢুকলাম। আমার অবশ্য এখানকার রাস্তাঘাট সম্পর্কে অতটা জানাশোনা নেই। ইউসুফ আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-কি ব্যাপার এতো নিরব কেন?
—-নুরীর ভালোবাসাকে ছাপিয়ে পারবেন আর কাউকে ভালোবাসতে?
ইউসুফ মুচকি হেসে বললো,
—-অন্য কেউ হলে পারতাম না। তবে আপনাকে মনে হয় পারবো।
একটা হোটেলের সামনে এসে গাড়ীটা থামলো। উনি নেমে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখেই একটা ছেলে দৌড়ে এসে বললো,
—ভাবিসাব নাকি?
—-হুম,একটা টেবিল পরিস্কার করে মুছে দে।
ইউসুফ আমাকে নিয়ে একটা কর্ণার টেবিলে বসলো। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-এখানকার খাসীর পায়া আর লুচি খেলে আপনার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে।
—-,তাহলে তো খাওয়া যাবে না।
আমার কথা শুনে ইউসুফ হেসে ফেললো। তারপর মুখটা মলিন করে বললো,
—-নুরী চলে যাবার পর আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। মনের অজান্তে আমি খেতে বসলেই ওর হাতের রান্নার স্বাদ খুঁজতাম। তারপর আমার এক বন্ধু আমাকে এখানে নিয়ে আসে। সেদিন বহুদিন পর পেটপুরে খেয়ে ছিলাম। তারপর থেকে মাঝে মাঝে এখানে আসি।
ইউসুফ হাঁক দিয়ে বললো,
—-আব্দুল কুদ্দুস তাড়াতাড়ি কর,
খানিক পরেই গরম গরম লুচি আর খাসীর পায়া চলে আসলো। সাথে লেবু কাঁচামরিচ আর পিয়াজ। পায়ার উপর বেরেস্তা দেওয়া আছে। খুব লোভণীয় লাগছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি এতো রাতেও দোকানে মানুষ গমগম করছে। কেন জানি আমার মুডটা অফ হয়ে গেল। অথচ বের হওয়ার সময় খুব আনন্দ নিয়ে বের হয়েছিলাম। বিয়ের পর আমার স্মৃতিতে নাই রাজন এভাবে কখনও আমাকে নিয়ে বের হয়েছে। রাজনের সাথে যেখানেই গিয়েছি নয়তো ওর মা আর নয়তো ওর বোন সঙ্গে ছিলো। এজন্য ইউসুফ যখন আমাকে নিয়ে বের হতে চাইলেন এক ধরনের অদ্ভূত ভালো লাগা আমার শরীর মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
খাওয়া শেষ করে গাড়িতে উঠলাম। ইউসুফ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন,
—-খাবারটা আপনার ভালো লাগেনি?
আমি ওর আগ্রহে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য বললাম,
—-আপনি যতটা বলছিলেন ঠিক ততটা নয়। মোটামুটি।
—-আপনার কি কোনো কারণে মুড অফ?
—-নাহ্,আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
—-ওহ্ আগে বলবেন তো,
ফেরার সময় রাস্তা অনেকটা ফাঁকা ছিলো। তবে খাবারটা আসলেই খুব মজার ছিলো। খুব দ্রুত গাড়ি চালিয়ে আমরা বাসায় পৌঁছে গেলাম। আমাকে ইউসুফ বাসায় ঢুকতে বলে নিজে গাড়িটা গ্যারেজ করে গেট খুলে বাইরে বের হলো। আমি ডেকে বললাম,
—-এতো রাতে আবার কোথায় যাচ্ছেন?
—-একটু হাওয়া ফুঁকে আসি।
আমিও ঘরে না গিয়ে ছাদে গিয়ে বসলাম। বুকের ভিতরটা হঠাৎ ভারী হয়ে এলো। আমি বুঝতে পারছি ওর মুখে নুরীর কথা শুনে আমার হৃদয়ে কুঠুরীতে আঘাত লেগেছে। আমি দেখেছি এখনও ইউসুফের চোখে মুখে নুরীর প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান। নিজেকে বড় নিঃস্ব মনে হলো। আরো কষ্ট লাগে যখন উনি বলেন,আমার চেহারার সাথে নুরীর চেহারা মিল রয়েছে। সে কারনেই নাকি আমাকে পছন্দ করেছেন। তাহলে কি সারাজীবন আমাকে নুরী নামের এক নারীর প্রতিচ্ছায়া হয়ে বেঁচে থাকতে হবে? তাহলে আমার আমিটার কোনো মুল্য কি নেই এই জগতে? আকাশে হঠাৎ মেঘের আনাগোনা। শীতল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। একটু পরেই অঝোরে বৃষ্টি নামলো। আমিও মন খুলে কাঁদলাম। হেঁচকি তুলে আমার কান্না আসলো। বহুদিন পর আমি মন খুলে কাঁদলাম। পুরো শাড়ি ভিজে আমার শরীরের সাথে লেপ্টে রয়েছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে ছাদের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির পানি আর চোখের পানিতে আজ আমি একাকার। কেন যেন উনার মুখে নুরী নামটা শুনলে আমি ভীষণ শুন্যতা অনুভব করি। হঠাৎ আমার কাঁধে একটা উষ্ণ হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালাম। দেখি ইউসুফ আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আমার কাঁধ থেকে ওর হাতটা সরিয়ে দিলাম। উনি অবাক হয়ে বললেন,
“জুলেখা আমি তোমার বন্ধু হতে চাই”
অন্ধকারে উনার চোখ মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে কন্ঠের আকুলতা শুনে অনুভব করলাম উনার বুকেও এক আকাশ বিষাদ জমে আছে। তবে কেন যেন মনে হলো এসব কিছু আমার জন্য নয়। নুরী নামে এক ভাগ্যবতী রমনীর জন্য। সে আমার দিকে এগিয়ে এসে আবার হাত ধরতে চাইলো। আমি ছাদের রেলিং এ সেঁটে দাঁড়ালাম। সে রেলিং হাত দিয়ে দাঁড়ালো। আমি তার দুই হাতের গন্ডীর মধ্যে আটকে রইলাম। ওর গাঢ় নিঃশ্বাসের স্পর্শ আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
—-তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? কিসে এতো কষ্ট পাচ্ছো?
রাজনের কথা মনে পড়ছে?
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। রাজনের জন্য আমার কোনো কষ্ট অনুভব হয় না। কিন্তু আমার কষ্ট তো হচ্ছে। তবে আমি অবাক হয়ে ভাবছি, কেন নুরীর প্রতি ওর স্বামীর ভালোবাসা দেখে কষ্ট হবে। ইউসুফ নামের এই মানুষটার আমার জীবনে আসার কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না। এ যেন এক অলৌকিক যোগাযোগ। কতরাত আমি আল্লাহপাকের দরবারে মুক্তির জন্য কেঁদেছি। আমাকে পথ দেখাতে বলেছি। বরং আমার তো খুশী হওয়ার কথা। মৃত জেনেও যে মানুষটা তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা সম্মান অক্ষুন্ন রাখে এমন একজন মানুষকে পাশে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তবে আমি এটা ভেবে অবাক হচ্ছি এত অল্প সময়ে একটা মানুষকে ভালোবাসা যায়।
ইউসুফ আমার কাছে এসে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
—+আমি তোমার দায়িত্ব নিতে চাই। সারাজীবন তোমাকে আমি এমনভাবে আগলে রাখবো যেন এক ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে না পড়ে।
ও আমার হাত ধরে ছাদ থেকে নীচে নামিয়ে আনলো।
চলবে