দ্বিতীয় বাসর পর্ব-০৯

0
1

#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
পর্ব- নয়
মাহবুবা বিথী

আমাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে বললেন,
—শাড়িটা বদলে ফেলো,ঠান্ডা লেগে যাবে।
উনার গলার স্বরে কিসের একটা মাদকতা ছিলো যা আমাকে মুগ্ধ করলো। মনে হলো,আমার জীবনের এতোটা বছর পার হলো কেউ এমন আকুলতার স্বরে আমাকে বলেনি,”তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।” মরার চোখদুটো দিয়ে আবারও পানি ঝরতে শুরু করলো। গলার স্বর ভারি হয়ে আসলো। আমাকে কথাটা বলে উনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে উনার গমন পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। এরপর ঘরে এসে ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ি বদলে সুতির থ্রিপিস গায়ে জড়িয়ে নিলাম।
ঘরে এসে চুলগুলো একটা শুকনো তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে রাখালাম। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝিরঝির বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। মৃদুমন্দ শীতল বাতাস এসে শরীরটাকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দরজায় কে যেন নক করছে। ভাবলাম এতো রাতে আবার কে নক করছে। ভাবলাম ইউসুফ হবে হয়তো। দরজাটা খুলতেই উনি ট্রেতে করে দুমগ চা সাথে মুড়িমাখা নিয়ে আমাকে বললেন,
—-আসতে পারি?
—-এসেইতো পড়েছেন।
ঘরে এসে টেবিলে ট্রেটা রেখে ডিভানের উপর বসলেন।এরপর আমার হাতে একমগ চা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
—-মুড়ির সাথে গরম গরম চা খেয়ে একটা নাপা ট্যাবলেট খেয়ে নিও। তা,না হলে জ্বর আসতে পারে।
আমি চায়ের মগটা হাতে খাটের কোনায় বসলাম। ওর দিকে তাকিয়ে ওর উৎকন্ঠা অনুভব করে মনে মনে বললাম,
—-এই সাতদিনের পরিচয়ে মানুষটা আমাকে নিয়ে এতো ব্যাকুল হয়ে উঠছে। এই ব্যাকুলতা কি সারাজীবন থাকবে নাকি মিথ্যা মায়া কুহুকিনীর মতো হবে। চায়ের মগে চুমুক দিয়ে বললাম,
—-দারুণ লাগছে।
আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
—-কাকে দারুণ লাগছে,আমাকে?
আমি হেসে ফেললাম। হাসি দেখে আমায় বললো,
—-আমি কি হাসির মতো কথা বলেছি?
—-না,মানে আপনার চা টা মুখে দিয়ে ভালো লাগছিলো। আর আমার ম্যাজম্যাজে ভাবটা কেটে গিয়ে শরীরে ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে। সেজন্যই বললাম। ইউসুফ সাহেবও চায়ের মগে চুমুক দিয়ে আমার দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলে বললো,
—-তুমি হয়তো ভাবছো,তোমাকে নিয়ে আমি একটু বেশী ভাবছি। আসলে কি জানোতো নুরী চলে যাবার পর থেকে আমি একটা কথা ভেবেছি যদি কাউকে কখনও নিজের জীবনের সাথে জড়াই তাকে আমি খুব আগলে রাখবো যেন নুরীর মতো আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে না যায়। ও আমাকে ভীষণ ভালো বাসতো। যেদিন ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাই সেদিনও আমার জন্য ল্যাভেন্ডার রংয়ের একটা শাড়ি পরেছিলো। চোখে কাজল পড়লো। পাংশুটো মুখে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“দেখোতো আমাকে কেমন লাগছে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
—-সুন্দর লাগছে। তবে আজ শাড়ি না পড়ে অন্য কোনো পোশাক পরে নিলে পারতে।
ও মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
—-তা পারতাম,তবে মনে হলো আর যদি নিজেকে সাজিয়ে তোমাকে দেখানোর সুযোগ না পাই।
ওর গলাটা ধরে আসছিলো। আমি ওকে আমার বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ও অঝোরে কাঁদলো। তারপর চোখ মুছে কি বললো জানেন,
—-এখন আমার ভীষণ ভালো লাগছে। তোমাকে ছেড়ে যাবার যে বিষাদের জল আমার অন্তরে জমেছিলো তা পুরোটাই বের করেদিলাম। এখন আল্লাহপাকের কাছে সহজে চলে যেতে পারবো। যিনি আমাকে এই পৃথিবীতে এতো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার তওফিক দান করেছেন,স্বামীর ভালোবাসা পাওয়ার মতো জান্নাতী নেয়ামত দান করেছেন,এতো ভালো শ্বশুর শাশুড়ী দিয়েছেন,আমার আল্লাহকে বেশী ভালোবাসা উচিত। আমি আল্লাহপাককেই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসি। এই যে তোমাদের সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছি এটা জমা রইলো। জান্নাতে আমি আমার অসমাপ্ত সব ভালোবাসাগুলো আল্লাহপাকের কাছে চেয়ে নিবো।
আসলে ডাক্তার ওর রোগ ধরতে পারছিলো না। শুধু নুরী দিন দিন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিলো।
তারপর ওকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। কেবিনে ওর পোশাক বদলে হাসপাতালের পোশাক পরানো হলো। একটু পরপর সিস্টাররা এসে ওর রক্ত নিয়ে যাচ্ছে। আমি তখন ভাবছিলাম,এতো রক্ত নিলে শেষ পর্যন্ত ওর শরীরে রক্ত থাকবে তো! জানি এসব আবেগের কথা। আসলে ওর শরীরে যতবার সুঁই ফোটানো হচ্ছে ততবারই যেন আমি ব্যথা অনুভব করলাম।
এতোকিছুর মধ্যেও আমার দিকে তার খেয়াল। একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখে আমি জেগে আছি। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে বলে,তুমি ঘুমাও নি কেন? পুরো হাসপাতাল নিরব হয়ে আছে।হয়তোবা অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি জেগে আছো কেন? শরীর খারাপ করবে গো!
তারপর কোনো ওষুধেই কাজ করছিলো না। ও নির্জীব হয়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকতো। দিন দিন শরীরের রং ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছিলো। দেখে মনে হতো কোনো রক্ত চোষা প্রাণী শরীরের সব রক্ত শুষে খেয়েছে। আমি মাঝে মাঝে ওর হাত ধরতাম। তাতে কোনো উষ্ণতা ছিলো না। ওর খুব নিঃশ্বাসের কষ্ট হতে শুরু করলো। ওকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হলো। সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রপাতি লাগানো হলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। অসমাপ্ত ভালোবাসা রেখে আমাকে ছেড়ে, এই পৃথিবী ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালো। ওর শরীর থেকে যখন যন্ত্রগুলো খুলছিলো আমার মনে হলো হাসপাতালের ডাক্তারদের চিৎকার করে বলি,
—-তোমরা যদি ওর রোগ সারাতে না পারলে তাহলে এতো কষ্ট ওকে কেন দিলে?
যাক ও চলে গেল। আসল সত্যিটা কি জানো যার চলে যাবার ডাক আসে তাকে কখনও ধরে বেঁধে রাখা যায় না। যেদিন নুরী মারা গেল আকাশ ভেঙ্গে বমষ্টি নেমেছিলো। কবরটা বৃষ্টির পানিতে থই থই করছিলো। একটু আগেও খটখটে রোদ ছিলো। তারপর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মেঘ ডাকতে শুরু করলো। এরপর ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো।
কথাগুলো বলে উনি কিছুটা নিরব হলেন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। এরপর একটা সিগারেট হাতে নিয়ে প্যাকেটটা আবার জামার বুক পকেটে রাখলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-রাত তো শেষ হয়ে এলো। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
আমি একটু হাওয়া ফুঁকে আসি।
আমি বিছানা থেকে নেমে উনার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে বললাম,
—-আপনি আর এসব খাবেন না। আমি আপনাকে মিথ্যা বলেছিলাম। সিগারেটের গন্ধ আমি সহ্য করতে পারি না।
—আজ আমাকে একটু খেতেই হবে। তোমার কথাটা রাখতে পারবো না। আসলে নিকোটিনের ধোয়ায় নিজেকে একটু পুড়িয়ে নেই যাতে ওকে হারানোর যন্ত্রণাটা কম হয়।
ইউসুফ রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমার ও একটা দীর্ঘ বিষন্নতম রাত্রি পার হতে চললো। ওর সাথে বৃষ্টিতে ভেজা, ওর বিষাদমাখা অতীতের গল্প শোনা, ওর হাতের চা মুড়ি খাওয়া, আর ওর ভালোবাসার মানুষের প্রতি ওর ভালোবাসার তীব্রতা অনুভব করা।
না আমার দুচোখে ঘুমপরীরা নামেনি। উনার ভালোবাসার মানুষের কথা শুনে আমারও রাজনের কথা মনে হলো। তারপর বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। মনে মনে বললাম,আমি একটা বোনলেজ মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। বোনলেজ মানুষের ভালোবাসা মুল্যহীন। না ওর কথা ভাবলেই সেই ফেলে আসা কষ্টের অতীতটা সামনে চলে আসে। নাহ্ আর ভাববো না ওর কথা। বরং ইউসুফকে বলবো আমি চাকরি করতে চাই। আসলে এভাবে বসে থাকলে মাথায় শুধু নানারকম চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে। তার থেকে একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকাই ভালো।

ইউসুফকে জানাতেই ও রাজী হয়ে গেল। আমাকে বললো,
–অন্য কোনো অফিসে জয়েন না করে তুমি বরং আমাদের অফিসে জয়েন করো। বাবাকে বলে আমি সব ব্যবস্থা করছি।
এরমাঝে আমার ডিভোর্সের পাঠ চুকে গেল। ও সেদিন খুব খুশী হয়ে আমাকে বললো
—-এখন তো আর কোনো বাঁধা থাকলো না। আমরা আবার বিয়ে করে নিতে পারি।
কিন্তু আমি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তিনমাস ইদ্দত কাল পালন করবো। সেটা ওকে জানলাম। সেও সাথে সাথে আমার প্রস্তাবে রাজী হলো। আমার ভালো লাগলো। কারণ আমি দ্বিতীয়বার আর কোনো ভুল করতে চাই না। সে কারনে মানুষটাকে বোঝার জন্য কিছুটা সময় হাতে রাখতে চাই। যদিও এই পৃথিবী বড় রহস্যময়। আরো বেশী রহস্য ভরা থাকে পৃথিবীর মানুষগুলো। সেই কারনে ইউসুফের রহস্য বুঝতে হলে কিছুটা সময় হাতে রাখা প্রয়োজন। প্রথমবার ভুল করেছি। হয়তো সংশোধনের সুযোগও পেয়েছি। কিন্তু এবার ভুলের চোরাবালিতে পড়ে গেলে আমি আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবো না।

চলবে