দ্বিতীয় বাসর পর্ব-১০

0
1

#বড় গল্প
#দ্বিতীয় বাসর
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী

এদিকে ইউসুফের বাবা ইসহাক চৌধুরীও আমাকে অফিসে বসার অনুমতি দেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ঘরে বসে থেকে
হাঁপিয়ে উঠছিলাম। প্রথমদিন অফিসে গিয়ে সবার সাথে পরিচিত হলাম। অফিসে আমার পরিচয়টা গোপন রাখা হয়েছে। বিয়েতে অফিসের কাউকে ডাকা হয়নি।সে কারনে ওরাও আমাকে চিনতে পারেনি। তবে প্রথমদিন অফিসে এসেই কাজের প্রেসারে পড়ে গেলাম। অবাক করার বিষয় হলো এখানে ইউসুফকে একদম ভিন্ন চরিত্রে দেখলাম। সেই কেয়ারিং মানুষটা এখানে রাফ এন্ড টাফ। আমি আসলে ওর পার্সোনাল এসিসট্যান্ট হিসাবে জয়েন করেছি। আমাকে ফোনে ওর রুমে ডেকে পাঠালো। কাঁচের দরজা খুলে বললাম,
—-May l come in sir
—yes,
ভিতরে আসা মাত্রই ইউসুফ ওর সামনের চেয়ারটায় আমাকে বসতে বললেন। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন,
—-আজ একটার সময় একটা মিটিং আছে। প্রেজেন্টেশন বানাতে হবে। আমি ডিক্টেট করছি তুমি রাফ কপি করে নিয়ে যাও। সেটাকে প্রেজেন্টেবল করে তৈরী করবে।
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। এরপর ইউসুফ চেয়ার থেকে উঠে রুমের ভিতর হেঁটে হেঁটে বলা শুরু করলেন।কিন্তু আমি ওর সাথে তাল দিয়ে সাথে সাথে লিখতে পারছি না। একসময় না পেরে বললাম,
—-স্যার একটু ধীরে বললে হয় না? আমি আপনার সাথে তাল মিলিয়ে লিখতে পারছি না।
সাথে সাথে ইউসুফের গলার স্বর চড়া হয়ে গেল। আপনাকে তো প্রেমপত্র লিখতে বলা হয়নি যে মনের মাধুরী মিশিয়ে গুছিয়ে লিখবেন। এটা একটা মিটিং এর সামারী। চটজলদি লিখতে হবে। আর হা মনে রাখবেন এরকম ঢিলা ঢালা মানুষ কর্পোরেট সেক্টরে অচল। এখানে টিকে থাকতে হলে নিজেকে অনেক বেশী অ্যাক্টিভ হতে হবে। সাথে সাথে আমার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। ইউসুফ অবাক হয়ে আমারদিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললো,
—ঠিক আছে, তুমি যাও।
আমিও উনার কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলাম। একটু পরেই দেখলাম পুরো অফিসে ফিসফাস শুরু হয়ে গেল। অফিসের সিইও মিটিং ক্যান্সেল করেছে। ছোটো বড় সবাই আমার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। এই নতুন পিএর জন্য আজকের মিটিং ক্যান্সেল হলো। আমার খুব অস্বস্তি বোধ হলো। আমার সীটের ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়েছে ইউসুফ ওর রুম থেকে কাঁচের স্বচ্ছ দেওয়াল দিয়ে আমার দিকে লক্ষ্য রাখতে পারবে।
সবাই ফিসফাস করলেও আমার নিজের কাছে খারাপ লাগছে। প্রথমদিন এসেই কাজে অদক্ষতা দেখানোটা নিজের কাছে নিজেকেই অপরাধী মনে হতে লাগলো। কাজ করতে না পারার কারণে আমার আফসোস হতে লাগলো। আমি ঠিক করলাম আজকের মিটিংয়ের সব ডিটেইলসগুলো সংগ্রহ করবো পাশাপাশি আগের করা প্রেজেন্টেশনগুলো ল্যাপটপে দেখে নিবো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১.৩০ বাজে। মিটিং যদিও ক্যান্সেল হলো তারপরও ফাইল রেডী করে উনাকে দেখাতে চাইলাম।যাতে নেক্সট মিটিং এ আর ভুল না হয়। হয়তো উনি লাঞ্চে চলে যাবেন সে কারণে তড়িঘড়ি করে উনার রুমের দরজায় পৌঁছালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাবার উপক্রম হলো। উনি অবশ্য ধরে ফেললেন। সেসময় ইউসুফ সাহেব বের হওয়াতে এই ঘটনা ঘটলো। প্রথমে আমি ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করলাম। পরে তাকিয়ে দেখি একজোড়া গভীর কালো বিদগ্ধ চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমাকে এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন আমি খুব মহামুল্যবান বস্তু। মোবাইলের রিং টোনে আমাদের ধ্যান ভাঙ্গলো। ফ্লোরের সবাই উঠে এসে ততক্ষণে আমাদের ঘিরে ধরেছে। আমরা নিজেদের সামলে নিলাম। ইউসুফ সবার দিকে রাগান্বিত স্বরে বললো,
—এখানে কি মুভির সুটিং হচ্ছে যে আপনারা দাঁড়িয়ে দেখছেন। সময় নষ্ট না করে যে যার কাজে চলে যান।
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—কি ব্যাপার অন্ধের মতো চলাফেরা করো নাকি? দেখেশুনে চলতে পারো না? আর হাতে ওটা কিসের ফাইল?
—-মিটিংয়ের ফাইল,
—-মিটিংতো ক্যান্সেল হয়ে গেছে তাহলে ফাইল আনার দরকার কি ছিলো?আজকে প্রথমদিন বলে বিষয়টা হজম করে নিলাম। কিন্তু এরপর এরকম হলে আমি মেনে নিবো না।
একথা বলেই গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। ফাইলটা আমার টেবিলে রেখে অফিসের পরিবেশ থেকে নিজেকে কিছুটা আড়াল করতেই ক্যান্টিনে গিয়ে লাঞ্চ সেরে ফেললাম। আর মনে মনে ভাবলাম,প্রথম যা কান্ডকারখানা ঘটলো এখানে কাজ করবো কিভাবে? বুঝতে পারছি না আমি কেন এতো নার্ভাস ফিল করছি। এমনসময় পিছনে অফিসের কিছু ছেলে মেয়ে নোংরা ইঙ্গিত করে বললো,
—-বস পটানোর গুন আছে বলতে হবে।কিভাবে কয়েক ঘন্টায় পটিয়ে ফেললো। স্যার কখনও মিটিং ক্যান্সেল করেনি। অথচ নতুন পিএটার ভুলের কারণে কোনো রকম উচ্চবাচ্চ্য ছাড়াই মিটিং ক্যান্সেল করলো।
আর একজন পুরুষ কন্ঠে বললো,
—-বলতেই হবে পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো রুপ আছে।
তবে একজন মেয়ে বলে উঠলো
—-ভিআইপি মাল,তোরা আবার লাইনে দাঁড়িয়ে যাস না।
পুরুষ কন্ঠে একজন বললো,
—-,বসের শিকারে চোখ দিলে চাকরি থাকবে না।
একথা বলে ছেলেমেয়েগুলো হাসাহাসি করতে লাগলো।
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম,
ছেলেরা না হয় এসব ইভটিজিং করে তাই বলে মেয়েরাও সমানতালে অংশ নিলো।
ঐ ছেলেমেয়েগুলোর পাশের টেবিলে আরো একটা মেয়ে এতোক্ষন লাঞ্চ করলো। ঐ মেয়েটা আমার সামনের টেবিলে বসে। সে আমার সামনে এসে চেয়ার টেনে বসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—আমি জঁুই
,আমি হাত বাড়িয়ে বন্ধুত্ব গ্রহন করে বললাম,
—-আমি জুলেখা।
—-এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে এরা অপরের ভালো সইতে পারে না। তখন কিছু আপত্তিকর কথা বলে নিজেদের হিংসার জ্বালা জুড়ায়। ওদেরকে জাস্ট ইগনোর করবে। আড়াইটার মধ্যে আবার টেবিলে গিয়ে বসতে হবে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
—+সোয়া দুটো বাজে। চলো উঠা যাক।
আমিও এসে টেবিলে বসলাম। আর ঐ কথাগুলো আমার ভিতরে কেমন একটা বিশ্রী অনুভূতির সৃষ্টি করলো।

এর মাঝে একদিন নওশাদ ফোন দিয়েছিলো। একমাত্র এই পৃথিবীতে আমার মামাতো ভাইটা মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে আমার খোঁজ খবর করে। ওর কাছেই জানলাম,
রাজনের কথা। ও নাকি এখন সারাদিন বাসায় বসে থাকে। খুব একটা বের হয় না। আর রাজনের ভাই সুজন বিয়ে করে আলাদা থাকে। এটা নিয়ে ওদের মা অশান্তি করার চেষ্টা করেছিলো। এবং সুজনকে বলেছিলো আলাদা থাকা যাবে না। তখন সুজন নাকি বলেছে,
—আমি তোমার বড় ছেলের মতো বোকা নই যে তোমার কাছে থাকবো। তুমি নিজের স্বার্থের জন্য ভাইয়ার জীবনটা তছনছ করেছো। আমি এই ভুল করতে নারাজ। তাই তোমার থেকে আলাদা থাকবো।
নওশাদ আর সুজন একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করার সুবাদে ওদের মাঝে যোগাযোগ আছে। নওশাদ অবশ্য আমাকে একটা অনুরোধ করেছিলো। সেটা আমার পক্ষে রাখা সম্ভব হলেও আমি রাখবো না। আমার মামাতো বোন মীমের জন্য এই অফিসে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। কারণ মীম কখনও আমার শুভাকাঙ্খি ছিলো না। কথায় আছে পঁচা শামুকে পা কাটে।
নওশাদের কাছে কথাগুলো শুনে ভাবলাম,সুজনের মতো রাজন যদি এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারতো হয়তো জীবনটা আমাদের অন্যরকম হতে পারতো। কতশত স্বপ্ন বুনেছিলাম আমরা দুজন। মনপ্রাণ উজার করে ওকে ভালোবেসেছিলাম। ওর জন্য ওদের বাড়ির সব অপমান মাথা পেতে নিলাম। তবুও এ বাঁধন ছিঁড়ে গেল। হয়তো এটা ছিঁড়ে যাওয়ার ছিলো। সময়ের সাথে সাথে মানুষও পরিবর্তন হয়। একসময় মনে হতো রাজনকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। অথচ দিব্বি বেঁচে আছি। আর ওর চেহারাটাও মনে আয়নায় ঝাপসা হয়ে আসছে। এটাই জীবনের বাস্তবতা। ওর জন্য আমার আফসোস হয়। সব থেকে ও লুজার হলো বেশী।
অফিসের কাজ শেষ করে বের হয়ে উবারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমনসময় বিশাল এক প্রাডো গাড়ি সামনে এসে দাঁড়ালো। আমিও গাড়ির আগুন্তককে দেখে চমকে উঠলাম। গাড়ি থেকে ইউসুফ সাহেব নেমে আমাকে ড্রাইভিং সীটের পাশে বসতে বললেন। আমি একটু ইতস্তত করতে লাগলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
—-অফিসের বাইরে আমরা শুধুই বন্ধু। চলো,আজ একটি লং ড্রাইভে যাবো।
আমিও আর অমত করলাম না। কাল পরশু সাপ্তাহিক ছুটি আছে। তাই আজকে একটু বেড়ানো যেতো পারে। বুঝতে পারছি হয়তো বিয়ে নিয়ে কথা বলবে। গাড়ি ছুটে চলছে। ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছে,
“এনেছি আমার শত জনমের প্রেম আখি জলে গাঁথা মালা
ওগো সুদুরিকা আজো কি হবে না শেষ তোমারে চাওয়ার পালা।”
চলবে