আমি যে কে তোমার পর্ব-৪+৫

0
1

#আমি_যে_কে_তোমার

(৪র্থ পর্ব)

আমানের ঘরে ফেরার তাড়া না থাকার আসল কারণ ওর মা শর্মিলী আহসানের মৃত্যু। বাবা আর্মি অফিসার থাকায় নিজ কাজেই ব্যস্ত থাকতেন। দেশের বাইরেই কাটিয়েছেন লম্বা একটা সময়। শর্মিলী আহসান যদিও ডাক্তার ছিলেন, ভীষণ ব্যস্ত জীবন তবুও দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় আমানের জন্য বরাদ্দ থাকতো।

আমানের পছন্দের খাবার, নাস্তা নিজ হাতে তৈরী করতেন। আমানের যতো গল্প, যতো আব্দার সব কিছুই ছিলো মায়ের কাছে। মায়ের সাথেই বাইরে ঘোরাঘুরি, খুনসুটি – সবকিছুই। এস এস সি পরীক্ষা থেকে শুরু করে সব বড় বড় পরীক্ষার সময় ওর মা ছেলের মঙ্গল কামনায় রোজা থাকতেন। অথচ জীবন যুদ্ধের বড় পরীক্ষায় একা করে দিয়ে চলে গেলেন।

আমানের বাবা আগে থেকেই কম কথা বলতেন, তার উপরে শর্মিলীর মৃত্যুর পর সেই কম কথা বলা স্বভাব যেন কথা বলতে ভুলে যাওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। সারাদিন বই পড়েন আর নিজের কাজ, খাওয়া – সবকিছুই একদম সময় মতো করেন। যেন এখনো সার্ভিসে আছেন। এই যেমন আমানকে রাতে ফিরে একা একাই খেতে হবে। ওর বাবার রাতের খাওয়ার টাইম ঠিক ৮ টা। এর মধ্যে বড় কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হলে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না।

আমান ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে গোসল করে নেয়। বাসায় একজন কাজের খালা স্থায়ীভাবে থাকেন। সাথে তার ছোট এক নাতিও থাকে। তারাই ঘরের সব কাজ করে। এছাড়া দারোয়ান আর ড্রাইভার আলাদা থাকে। আমানের মনে হয় কথা বলার কেউ নেই। মাঝে মাঝে একা একাই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে যেয়ে বসে। আবার খুব খারাপ লাগলে গিটারটা নিয়ে শুধু শুধুই এলোমেলো ভাবে তারগুলোর উপর হাত বুলিয়ে যায়।

আমানের মামী খুব লেগেছে ওর বিয়ের জন্য। নানান ধরণের সুন্দরী, শিক্ষিত, অভিজাত পরিবারের মেয়েদের ছবি ওর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠায়। আমান সামান্য হাসে, একটু দেখে কি দেখে না তারপরে রেখে দেয়। আমান আসলে বিয়ে করতে ভয় পায়। ওর মনে হয় এই বাড়িটাতে কোন নারী এসে সুস্থভাবে বাস করতে পারবে না। আমান মনে করে যাকে বিয়ে করে আনবে, তাকে সুখি করতে না পারলে সেই দায়ভার অবশ্যই আমানের। ওর মা যে অবেলায় চলে গেলো এর জন্য দায়ী একটা গাড়ি হলেও এই এক্সিডেন্টের বহু আগেই ওর মায়ের মৃত্যু ঘটেছে, আত্মীক মৃত্যু। মা যেন শুধু আমানের জন্যই বেঁচে ছিলেন, যেই আমান বড় হলো, বুঝতে শিখলো ওমনি ওকে একা করে চলে গেলেন।

মায়ের অভিমান ছিলো বাবার প্রতি – এটা আমান ঠিক বুঝতো যদিও ওর মা কখনোই এটা বুঝতে দিতো না। তবুও আমান জানে, অবহেলায় শর্মিলী আহসান ভেতরে ভেতরে কতোটা ক্ষয়ে গিয়েছিলেন। আমান তো জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখছে ওর বাবা আলাদা ঘুমায়, নিজের বেডরুমে কারো প্রবেশ করা একদম পছন্দ করে না। ওর বাবা মাকে একসাথে বসে কখনো গল্প করতে দেখে নি, একসাথে বেড়াতে যেতে দেখে নি। দুই জনের মধ্যে একদম ফরমাল সম্পর্ক ছিকো। এসব দেখতে দেখতে আর মায়ের এভাবে চলে যাওয়ায় আমানের মনের মধ্যে একটা ভয়, আতংক কাজ করে। ওর মনে হয় – এই বাড়িতে যে মেয়ে আসবে, সে সুখি হবে না! অকালে ছেড়ে চলে যাবে। এজন্য আমান সিদ্ধান্ত নিয়েছে – জীবনে বিয়েই করবে না!

মারিয়া কথাটা শুনে অবাক হয়ে যায়। আরো অবাক হয় যখন টেবিলের সামনে ওর সব প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট আর কাগজপত্রগুলো দেখে। অফিস থেকে জানালো মারিয়া ওর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে, যে পুলিশ অফিসার স্যার ওকে উদ্ধার করেছিলেন উনিই নাকি ব্যবস্থা করেছেন। আগামীকাল মারিয়া ব্যাংকে যেয়ে নিজের নামে একাউন্ট খুলবে। এরপর মাসে মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ওর একাউন্টে জমা হয়ে যাবে।

ভর্তি হওয়ার জন্য যে সকল ডকুমেন্টস দরকার সবকিছুই এনজিও অফিস থেকে লোক যেয়ে এনেছে। আমান সাথে একজন পুলিশের এ এস আইকে দিয়েছিলো। পুলিশ দেখে ওর সৎ মা সুড় সুড় করে সব বের করে দিয়েছে। মারিয়ার ভীষণ ভালো লাগে। ওর মনে হয় জীবন মারিয়াকে সেকেন্ড চান্স দিচ্ছে। মারিয়া অবশ্যই এই সুযোগ কাজে লাগাবে।

মারিয়ার তরুণী মনে একটা নাম, একটা ছবি স্থায়ীভাবে গেঁথে যায় – আমান আহসান। মারিয়ার উদ্ধারকর্তা, যার ওছিলায় জীবনে একটা সুযোগ পেতে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই কখন যেন আমানকে ওর মনের সবচেয়ে নাজুক কিন্তু সবচেয়ে দামী জায়গায় বসিয়েছে।

আগামীকাল থেকে মেডিক্যাল কোচিং শুরু। মারিয়ার ইচ্ছা এম বি বি এস এ ভর্তি হওয়ার। সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বাকিটা আল্লাহর হাতে। আজ খুব ইচ্ছা করছে, আমানের সাথে একটু কথা বলতে কিন্তু মারিয়া জানে এটা কোন মতেই সম্ভব নয়। আমান আর কখনোই ওর সামনে আসে নি। অথচ মারিয়ার জীবন সুন্দর করার জন্য যা যা করার দরকার পর্দার অন্তরালে থেকে ঠিকই করে যাচ্ছে।

(চলবে)

#আমি_যে_কে_তোমার

(৫ম পর্ব)

এই স্টেশনে ছয় মাসের বেশি পার হয়ে গেলো। আমান বুঝতে পারে আর বেশিদিন এখানে টিকতে পারবে না। এখানে একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে যারা আমানকে তাদের দলে নিতে পারছে না। এইসব মাদকের বিরুদ্ধে আমান ভীষণ কঠোর। আমান যে সার্কেলের দায়িত্বে আছে, তারা সবাই আমানের উপর বিরক্ত। আমান নিজে যেমন দূর্নীতি করে না, অন্যেরা দূর্নীতি করলেও সহ্য করে না। আর এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আমান সব সময় চাইতো তদন্তের কাজে থাকবে। হয় সি আই ডি বা পিবি আই তে পোস্টিং নেবে। কিন্তু ওর মামা’ই বলেছিলো – ফিল্ডে কিছুদিন কাজ করতে, কিছু অভিজ্ঞতা নিতে। কিন্তু পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে দেখা যাবে হুট করে আমানের বদলি হয়ে যাচ্ছে আর বদলি হলো এমন জায়গায় যে হাহুতাশ করা লাগছে।

আমানের মামা বড় পদে থাকায় এখনো টিকে আছে। যদিও মামার পরিচয়ে সে মোটেও পরিচিত হতে চায় না। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে। আমানের সরাসরি যিনি বস, উনি নানান অজুহাতে আমানকে নানাভাবে লাঞ্ছিত করছেন, মামার দাপট দেখায় বলে অপমানিত করছেন। আমান এসব কথার উত্তর দেয় না। কারণ কথায় কথা উঠে। আমান তো আর উনার মুখের উপরে দূর্নীতিবাজ বলে দিতে পারে না। তাতে আরো শত্রুতা বাড়বে। আমান নবীন অফিসার। আরো বহুদিন এই সার্ভিসে থাকতে হবে, অহেতুক এসব আজেবাজে লোকের সাথে লাগালাগি হয়ে ওর সার্ভিস বুকে কালি লাগাতে দিতে পারে না। এজন্য গতকাল রাতেই পুরো পরিস্থিতি বর্ণনা করেছে ওর মামার কাছে। অনুরোধ করেছে সি আইডি হেড অফিসে পোস্টিং দেয়ার। অথবা এমন তদন্তকারী কোন অফিসে। মামা অবশ্য আগে রাজী না হলেও গতরাতে রাজী হয়েছেন। কারণ উনার নিজস্ব সোর্স থেকেও জানতে পেরেছেন আমানের বস, এই এসপি প্রচন্ড রকম দূর্নীতিবাজ আর বিভিন্ন জায়গায় লিংক লবিং মেইনটেইন করে চলে। ভাগ্নেকে আর পরীক্ষায় ফেলতে চান না।

হয়তো খুব দ্রুতই পোস্টিং হয়ে যাবে – নিজের রুমে বসে এসবই ভাবছিলো আমান। দুপুর পার হয়ে গিয়েছে। আজ কেন জানি আর লাঞ্চই করা হয় নি। ওর অফিসে ডিউটি করা ছেলেটা দুইবার বলে গেছে – স্যার, লাঞ্চ করলেন না? আমান এটা সেটা বলে পাশ কাটিয়ে গেছে৷ কিছু মানুষ ওকে ভীষণ ভালোবাসে। তার মধ্যে এই ছেলেটা। নিজে যেচে খাবার আনে, চা কফি বানিয়ে আনে। জোর করে নাস্তা খেতে দেয়। আরেকজন আছে – জরিনা খালা। উনি এই অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। উনার মেয়ের সিজার হলে হাতে টাকা ছিলো না বলে অফিসে বসে খুব কান্নাকাটি করছিলো। আমান চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। তারপর থেকে উনি আমানকে কি যে স্নেহ করেন বলার না। মনে হতে পারে, উপকার করেছে এজন্যই এমন ব্যবহার। কিন্তু আমান তো কতোজনেরই কতো উপকার করে, কই সবাই তো মনে রাখে না। তার উপরে এই অফিসে আমানের অবস্থান এখন খুব নাজুকই বলা যায়। পুরো অফিস একদিকে আর আমান আরেকদিকে। মাঝে মাঝে তো আমান শংকিত হয়ে পড়ে যে শত্রুতা করে ওর ড্রয়ারে মাদক রেখে চাকরিটা না খায়!

কিন্তু এই দুই চারজন আছে বলেই আমান এখনো ভালো আছে। হঠাৎ করে ওর গানম্যান ঢুকে বলে

– স্যার একটা মেয়ে আপনার সাথে দেখা করতে চায়

– মেয়ে?

– জি স্যার। নাম বললো মারিয়া।

আমান এই নামে কাউকে চিনে কিনা মনে করতে পারলো না। কিন্তু প্রতিদিন নানা কাজে ওর অফিসে নানান ধরণের লোক আসে। নানান অভিযোগ নিয়ে। সুতরাং এটা ওর জন্য নতুন কোন বিষয় নয়। আসতে বলে।

মেয়েটা রুমে ঢুকতেই আমান এবার চিনতে পারে। আরে এ তো সেই মেয়েটা, যাকে সে বিয়ের পোষাকে থানার হাজতখানা থেকে উদ্ধার করেছিলো! এখানে কেন আসলো? কোন সমস্যায় পড়লো না তো?

আমান মেয়েটাকে বসতে বলে। কিন্তু মারিয়া নামের মেয়েটা চেয়ারে না বসে আমানকে অবাক করে দিয়ে আমানের সামনে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করতে যায়।

– আরে করো কী, করো কী বলতে বলতে আমান বিব্রত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

এতে যেন আরো সুযোগ পেয়ে যায় মারিয়া। সুন্দর করে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলে। আমান বিব্রত হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

– রাগ করবেন না স্যার। আমার আজ মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। আমি চান্স পেয়েছি। আমি স্বপ্নেও ভাবি নি নি এমন একটা জীবন পাবো, আবার পড়ালেখা করার সুযোগ পাবো। আমার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিলো আমি ডাক্তার হই, আমার মায়ের সেই ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে। এই সবকিছুই আপনার সাহায্য ছাড়া কোন মতেই সম্ভব ছিলো না। আপনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জন্য ফেরেস্তা।

কথা বলতে বলতে মারিয়া কেঁদে ফেলে। ওর বড় বড় দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে থাকে। আমানের মনটা ভিজে যায়, অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে যায়।

– আরে এ তো দারুণ খবর। এই খবর শুধু মুখে শোনা যায় নাকি! তুমি তো বিরাট কাজ করে ফেলেছো মেয়ে। একদম তাক লাগিয়ে দিয়েছো।

আমান বেল বাজায়। ওর গানম্যান আর পিওন দৌড়ে আসে। আমানকে উচ্ছ্বসিত দেখে ওরাও খুশি হয়। দৌড়ে যেয়ে দই, মিষ্টি, নানান রকম ফল কিনে আনে। অফিসের সবাই খায় আবার মারিয়ার সাথেও দিয়ে দেয়।

– তোমার সাথে হয়তো আর দেখা হবে না মারিয়া। আমি খুব শিঘ্রীই বদলি হয়ে যাচ্ছি। তবে তুমি তোমার পড়াশোনা শেষ না করা পর্যন্ত বৃত্তি পাবে, সে ব্যবস্থা আমি করবো। যেই টাকা হলে তুমি মোটামুটি চলতে পারবে সেটা আমি অবশ্যই দেখবো। কিন্তু মেডিকেলে তো অনেক খরচ, আমি কয়েকটা ব্যাংকেও কথা বলবো ওরা অনেক সময় মেধা বৃত্তি দেয়। দেখি, সেখান থেকে কিছু আদায় হয় কিনা। আর এনজিও অফিসারকে এক উকিলের সাথে পরিচয় করে দেবো। তোমার এই অভিশপ্ত বিয়ে থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করবে। ভালো থেকো মারিয়া, নিজের খেয়াল রেখো।

ভীষণ খুশি নিয়ে সুসংবাদ দিতে এক বুক সাহস নিয়ে মারিয়া এখানে দৌড়ে এসেছিলো। কিন্তু আমানের – ‘আর দেখা হবে না ‘ কথায় বুকটা দুমড়েমুচড়ে গেলো যেন। কষ্টে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। সেই জমানো কষ্টের অশ্রু গোপন করে আমানের অফিস থেকে বের হয়ে আসলো।

কিছু দূর আসার পরে পিছনে ফিরে তাকালো, আমানের অফিসের দিকে। মৃদু স্বরে ফিসফিস করে বললো
‘আপনিও ভালো থাকবেন’।

(চলবে)