#জোৎস্না_রাতে_তুমি_আর_আমি
#পর্ব_২০
#লেখনীতে_রুদ্রিকা_বেদী
#প্রথম_ভাগ [অন্তিম পর্ব]
________________
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
__“এরা কারা?”
নেতা গোছের লোকটা জিজ্ঞেস করে উঠলো। দ্যূতি আর আরুশ দুজনের মুখ চাওয়া চাহি করে। মিলি এগিয়ে যেয়ে বলে,
__“আমি মিলি! আমি দ্যূতির….!”
__“আমার ননদ!” দ্যূতি তাড়াতাড়ি মিলির কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল কথাটা। মিলি চমকে উঠে দ্যূতির দিকে তাকাই। শুধু মিলি না শিহাব ও চমকে উঠেছে, সে ধীর পায়ে আরুশের দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। মুখটা খরগোশের মতো করে আরুশের দিকে তাকালো।
__“আর এই ছেলেটা কে?”। লোকটা আবারও জিজ্ঞেস করল।
__“তোমার এতো জেনে কি কাজ বাপু? যত্তসব! আমাদের বিয়েটা তো দিয়ে ছেড়েছেন আর এখন কি এই দুইজনকেও বিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে? বিয়ের ওয়েবসাইট খুলে বসেছেন?”
লোকটার দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করল দ্যূতি। আরুশ শিহাবের কাঁধে হাত রেখে প্রবল দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল,
__“ও আমার শালা হয়!”
শিহাব গোল গোল চোখে আরুশের দিকে তাকালো। পরিবেশটা মুহুর্তেই কেমন দম আটকে আসার মতো হয়ে গেলো। আরুশ শিহাবের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে,
__“চেপে যাও বাছা! নয়তো তোমার বিয়েও আজ হয়ে যাবে!”
শিহাব কাঠ হয়ে গেলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আরুশের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। স্যারের কথার উপর কথা বলা তার স্বভাবের মধ্যে পরে না আর তার উপরে এমন একটা কথা কানের কাছে ওমন ভাবে গুরুগম্ভীর ভাবে বললে,বিয়ে করতে চাইলেও করা যাবে না!
.
চারজনে কোনো রকমে ওই এলাকার থেকে বের হয়েছে। মিলি দ্যূতির সঙ্গে একদম চম্বুকের মতো চিপকে আছে। আর শিহাব রোবটের মতো আরুশের সাথে হেঁটে যাচ্ছে। মিলির নানা প্রশ্নে দ্যূতি প্রায় অতিষ্ট হয়ে উঠছে। একসঙ্গে এতো সব প্রশ্নের উত্তর সে কিভাবে? প্রায় বিরক্ত হয়ে সে মিলি অগোচরে পিছনে ফিরে আরুশের পানে চায়। আরুশ দ্যূতির ওমন কাতর চাহনি দেখে ফিক করে হেসে ফেলে। দ্যূতি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে ইশারা করল। আরুশ ইশারা বুঝতে পারল না এমন ভান করে শিহাবের সঙ্গে কথা বলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
__“তোরা কি কিছু বলবি? কি হয়েছে? আর তুই ওমন ভাবে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আছিস কেন? দম তো বন্ধ হয়ে আসবে!”
খেয়েছে! গলার দিকে নজর পরেছে মিলির। দ্যূতি ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে,
__“আমরা রিসোর্টে ফিরি তারপর তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো তার আগ পর্যন্ত একটু থামো!”
মিলি আর কথা বাড়ালো না কিন্তু তার মাঝে যে কৌতুহল এখনো কমেনি তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দ্যূতি অবশ্য তাতে পাত্তা দিলো না, কিছুক্ষণের জন্য চুপ হওয়ায় দ্যূতির কান একটু আরাম পেলো। দ্যূতি লম্বা শ্বাস নিয়ে সামনে তার জন্য যে দুর্যোগ আসতে চলেছে তার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ~
.
__“মানেটা কি? তোদের বিয়ে হয়ে গেছে? কিভাবে? কেন? কি দরকার ছিল?”
মিলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চারজনে রিসোর্টে ফিরেছে সবে মাত্র। রুমে না যেয়ে তারা এসেছে সেই রেস্তোরাঁয়। যেখান থেকে সকল ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে! সেখানে বসে দ্যূতি সব ঘটনা খুলে বলছিলো। শিহাব আর মিলি সব ঘটনা শুনে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা চলে গিয়েছিল। দ্যূতি আর আরুশ খুব কষ্ট করে সামলিয়েছে। দ্যূতি আরুশের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে কাতর স্বরে বলে উঠে,
__“আরুশ, এদের বোঝাতে যদি আমাদের এতো কষ্ট হয় তাহলে আমার পরিবার বিশেষ করে মা কে সব কিছু কিভাবে বোঝাবো?”
আরুশ কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ তাকিয়ে রইল দ্যূতির চোখের পানে। দ্যূতি নিজেকে সবচেয়ে বেশি অসহায় মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে। সে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে,
.
সন্ধ্যার লালচে আভা সরে যেয়ে এখন রাতের অন্ধকার ছড়িয়ে পরেছে, দ্যূতি একা একা সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে,মনে ঘুরছে সব আজে বাজে চিন্তা! কাল সকালে এখান থেকে ঢাকায় ফিরবে সবাই,আরো কয়েকদিন থাকার কথা ছিল কিন্তু আরুশ বারুণ করে দিয়েছে শেষ মুহূর্তে, এখন তাদের জন্য ঢাকা ফেরা বেশি গুরুত্ব পূর্ণ, দ্যূতিকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছে আরুশ,বেশ অনেকক্ষণ ধরেই! দ্যূতি সেটা খেয়াল করেনি! সে আনমনে পায়চারি করছে, মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে, সমুদ্রের নোনা জলের মধ্যে নিজের পা দেখছে! সমুদ্রের পাড়ে ফুরফুরে বাতাস,তাও যেন দ্যূতির মনকে রাঙিয়ে তুলতে পারছে না, তার নামের বিপরীত অর্থ আজ তার জন্য বেশি প্রযোজ্য!
অনেকক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর আরুশ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো দ্যূতির দিকে। তার মনটাও আজ কেমন করছে যেন! দ্যূতির মন খারাপ হলে যে তারও মন খারাপ হয়ে পরে, মনের কানেকশনটা চোখের কানেকশনের থেকে বেশী তীব্র! আরুশ দ্যূতিকে পিছন থেকে জাপটে ধরল, এইবার দ্যূতির কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না,সে ধীর স্থির হয়ে সামনে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আরুশ চুলে নাক গুঁজে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
__“আমি সামলিয়ে নিবো জান! টেনশন নিও না!”
__“অনেক সহজ মনে হয় হয়তো সবকিছু আপনার জন্য কিন্তু আমার জন্য নয়!” দ্যূতি তার রুক্ষ কন্ঠে বলল।
আরুশ মুখ তুলে দাঁড়ালো। সামনে তাকিয়ে তিরস্কারের হাসি হাসল দ্যূতির অগোচরে। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আগের থেকে ঠান্ডা কন্ঠে আরুশ বলতে শুরু করল,
__“চব্বিশ বছরের একটা ছেলে..যার জন্য তার মা তার সম্পূর্ণ দুনিয়া ছিল! মায়ের কোমল মিষ্টি মুখ না দেখলে যে ছেলের সকাল হতো না, একবেলা হাত দিয়ে না খাইয়ে দিলে যার পেট ভর্তি হতো না, বাড়ি ঢুকলে মা মা করে খুঁজে বেড়ানো সেই ছেলে হঠাৎই তার মায়ের থেকে যখন আলাদা হয়ে যায়, শেষ বারের জন্য নিজের মৃত মায়ের মুখ দেখতে পারে না! সেই ছেলের জন্য সত্যিই সবকিছু সহজ মনে হয়….!”
আরুশ কথা গুলো বলে দ্যূতিকে ছেড়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল। দ্যূতি যেন হারিয়ে গেলো। চোখে অশ্রু এসে জমা হয়েছে। আরুশের দিকে তাকিয়ে রইল। দ্যূতি তার অজান্তেই লোকটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে! কতোটা কষ্ট পেলে কেউ তার এতো দুঃখের কথা বলে…..
দ্যূতির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। চোয়াল শক্ত করে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করে দ্যূতি আরুশের হাত ধরল। হাতটাকে মুখের কাছে নিয়ে এসে তাতে গাঢ় চুম্বন এঁকে জল জল চোখে আরুশের দিকে তাকিয়ে ভাঙা কন্ঠে বলল,
__“আই এ্যাম সরি! আমি বুঝতে পারিনি আপনি কষ্ট পাবেন!”
আরুশ কেন জানি হাসল! তার হাসির কারণ দ্যূতি উদ্ধার করতে পারল না কিন্তু তার কাছে আরুশের এমন প্রতিক্রিয়া বড়োই আশ্চর্যজনক মনে হলো! দ্যূতি আরুশের হাত জড়িয়ে ধরে কাতর স্বরে বলল,
__“রাগ করলেন আমার উপর? আই এ্যাম সরি! কিছু বলুন! দেখুন কথা না বললে আমি পাগল হয়ে যাবো….সবাই আমার উপর রাগ করে আপনি প্লীজ করবেন না!”
দ্যূতি বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। আরুশ দ্যূতির দিকে তাকিয়ে তার উল্টো হাতে দ্যূতির চোখ মুছিয়ে দিলো। দ্যূতি আরুশের চোখে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো, দুজনের দৃষ্টিতে একে অপরের চোখে। দ্যূতি ঠোঁট ভিজিয়ে কান্না মিশ্রিত স্বরে বলল,
__“কিছু বলুন!”
__“কান্না কাটি করলে কিভাবে কথা বলবো?” আরুশ হেসে উত্তর দিলো।
দ্যূতি আরুশকে জড়িয়ে ধরল। ওর বুকে মুখ গুজে দিয়ে বলল,
__“আমি আর আপনাকে কষ্ট দিবো না, আমি ভালো বউ হবো দেখবেন!”
__“তুমি অলরেডি ভালো বউ, জান!”
বলে দ্যূতির মুখ তুলে ধরল। নিজে হালকা ঝুঁকে এসে কপালে চুমু দিলো। তারপর ফিসফিস করে বলল,
__“আমরা দুজনে মিলে আমার একমাত্র সৌভাগ্যবতী শ্বাশুড়ি মাকে সামলিয়ে নিবো!”
আরুশের বলার ধরণ শুনে দ্যূতি না চাইতেও হেসে ফেলল। খিলখিল করে হেসে দ্যূতি আরুশের চোখে চোখ রাখলো। আবার নিরবতা, শুধু সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের শব্দ। তার মাঝে দুটি প্রাণ একে অপরের হৃদয়ের ধ্বনি শুনতে পারছে। দু’জনে সেই ধ্বনিকেও উপেক্ষা করে ওষ্ঠধরের প্রতি আকৃষ্ট হলো, চুম্বনের বাঁধন যেন সেকেন্ডে গাঢ় হয়ে উঠল………
কালো সাদা ক্যানভাসে,
রাঙিয়ে দিতে, এলে তুমি!
প্রেমের অজানা জোয়ারে,
ভাসিয়ে নিলে আমায় তুমি!
ভালোবাসতে শিখিয়ে দিলে
রূপকথার ন্যায়ে,
থেকো সারাজীবন
প্রিয় সঙ্গ হয়ে!
লেখনীতে~#রুদ্রিকা_বেদী
প্রথম ভাগের সমাপ্তী………..
[প্রথম ভাগ শেষ, দ্বিতীয় ভাগ আপনারা চাইলে অবশ্যই আসবে]
রুদ্রিকা বেদী-Rudrika Bedi