#প্রাণনাশিনী
#পর্ব_১২
#সুহাসিনি_মিমি
চৌধুরী বাড়ির হলরুমের পরিবেশে টানটান উত্তেজনা বিরাজমান। তোফাজ্জল সাহেব ব্যস্ত নিজ ভাইয়ের সঙ্গে শহরের ব্যবসার লাভ ক্ষতি সম্পর্কের আলাপচারিতায়।মঞ্জু বেগম বসে আছেন সোফায়। তনয় বসে দাদির সঙ্গেই। হাতে টিভির রিমোট।
এমন সময় শরীর টান টান করে ভিতরে প্রবেশ করল নাওফিক। প্রবেশ পথের দিকে একপল চেয়ে যে যার কাজে পুনরায় মনস্থির করে ফেলল। নাওফিক সোজা এসে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে ঠাস করে বসল দাদির পাশে। পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে এক ঝটকায় তনয়ের হাত থেকে রিমোটটা কেরে নিয়ে ইউটিউব খুলে একটি বিয়ের গান ছাড়লো সেথায়।
তোফাজ্জল সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে একবার ছেলের দিকে পরপর আবার টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কপাল ভাঁজ করলেন। এই ছেলের হাবভাব বুঝা দায়। এর মাঝেই নাওফিক আকস্মিক সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেই উঠল,
–“ভাবছি বড়োদের কথা শুনলেই লাভ। আমি আবার মহৎ ব্যক্তি। গুরুজনদের অসম্মান করতে জানিনা। বিয়ে করবো। আর সেটা এই সপ্তাহের মধ্যেই।”
হলরুমের ভিতর উপস্থিত থাকা সকলের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো নাওফিক এর এহেন কথায়। যেন এখানে কোনো সিনেমার দৃশ্য চলা অবস্থায় কেউ পস করে রেখেছে সিনটা। একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে মূলত তাড়া সকলে ঠিক শুনলো কিনা যাচাই করতে। তোফাজ্জল সাহেবের হাত থেকে পত্রিকার কাগজ টা পরে গেলো অমনি। মুঞ্জু বেগমের পান চিবুনি থেমে গেলো। কিচেন থেকে সবেই বেরিয়ে এসেছিলেন জর্ণা বেগম। ছেলের এহেন কথা শুনতেই হাতে থাকা চায়ের কাপ টা ঠাস করে পরে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার পরও ধ্যান কাটেনি কারো।
–“আমার কথা কি কেউ শুনতে পায়নি নাকি? এমন খাম্বার মতো একেকটা ভেস ধারণ করে রাখছেন কেন? ”
নাওফিকের পুনরায় চেঁচিয়ে বলা কথায় ধ্যান ছুটলো সকলের। পুনরায় যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো আবারো। জর্ণা বেগম কাজের মেয়েটিকে ডেকে উঠলেন পরে থাকা কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করার জন্য।
–“আম্মা আমি কি বলেছি শুনতে পেয়েছো? বিয়ে করবো আমি।”
–“আহ সব বিষয়ে মস্করা করতে হয়না তেজ। সবসময় ইয়ার্কি ভালো লাগেনা। ”
নাওফিক হতোভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। বলল অবাক কণ্ঠে,
–“আমি সিরিয়াস আম্মা। আপনাদের এতদিন নাতি-নাতনি ছাড়া থাকাটা আমার নিজের কাছেও খারাপ লাগে ভাবতে। আমি ছেলে হয়ে এটা আর সহ্য করতে পারছি না। তাই ভাবছি এবার বিয়েটা করেই ফেলবো।”
–“তুই কি সত্যি বলছিস তেজ? সত্যিই তুই বিয়ে করবি বাবা?”
জর্ণা বেগমের কণ্ঠে প্রবল বিস্ময়ের ঝড়। হাতের কাজ ফেলে রেখে এক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। নাওফিক বুক সোজা করে ঠোঁটে লাজুক হাসি টেনে জবাব দিল,
–“হ্যাঁ, আম্মা।”
কথাটা শোনামাত্রই জর্ণা বেগম মুখে দুই হাত চাপা দিয়ে উঠলেন আশ্চর্যে।
–“ওগো শুনছো? আমাদের তেজ বিয়ে করতে রাজি হয়েছে! আল্লাহ্! আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না!”
তারপর হঠাৎ কিচেনের ভেতর দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
–“ওই মর্জিনা! তাড়াতাড়ি একটা মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে আয়! এমন সু খবরে সকলরে মিষ্টি খাওয়া যলদি!”
নাওফিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
–“আরে আম্মা, মিষ্টি পরে খেয়ো। আগে আমার পুরো কথাটা তো শুনো!”
–“তোর সব কথা শুনবো বাবা বল কি বলবি? কোন মেয়েকে পছন্দ হয়েছে তোর? কাকে বিয়ে করতে চাস তুই? গ্রামের সবথেকে সুন্দর মেয়েটাকে আমি তোর বউ করে আনবো বাবা। বল তুই কি আলাদা করে কাউকে পছন্দ করিস? ”
ঘরের সকলে তখন একসাথে তাকালো নাওফিকের দিকে। কৌতূহলে টান টান হয়ে আছে মুহূর্তটা। নাওফিক গলা খাঁকারি দিয়ে মুখে জড়তা ও এক চিলতে লজ্জা মিশিয়ে বলল,
–“আমি একজনকে পছন্দ করি আম্মা!”
–“বল বাবা, কে সে মেয়ে? কোথায় থাকে? নামটা শুধু বল, আমি আর তোর বাবা এখনই চলে যাবো সম্মন্ধ নিয়ে!”
নাওফিক একটু ইতস্তত করল। অতঃপর চোখ নিচু করে বলল,
–“এই গ্রামেই থাকে। হান্নান চাচার মেয়ে… সুবহা।”
এই নাম শোনামাত্রই যেন হলরুমে হঠাৎ করেই থেমে গেলো মুহূর্ত টা। জর্ণা বেগমের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো অমনি। সাথে সাথে মুখ মলিন হয়ে গেল জর্ণা বেগমের। তোফাজ্জল সাহেব এতক্ষন যাবৎ ছেলের হেয়ালিপনা চুপচাপ সহ্য করলেও এবার আর চুপ থাকতে পারলেন নাহ। ধৈর্যচ্চুত হলেন পুরোপুরি। তেতে উঠে বললেন,
–“বেয়াদব ছেলে। কোন আক্কলে তুমি এই কথা মুখে আনলে? লজ্জা করল নাহ একবারও এই কথা মুখ ফুটে বলতে?”
নাওফিক হাল ছাড়ল না। গলায় যুক্তির দৃঢ়তা এনে বলল,
–“বিয়ের কথা বলছি আব্বা। এতে লজ্জার কী আছে? এতদিন তো আপনারাই আমার পিছে লেগে ছিলেন ‘বিয়ে করিস না কেন’ ‘বয়স হয়ে গেল’, এসব বলে বলে। এখন যখন বলছি করব তখন এত আপত্তি কেন?”
তোফাজ্জল সাহেব রাগে গর্জে উঠলেন,
–“তুই বিয়ে কর—একটা নয়, শতটা কর! কিন্তু হান্নানের মেয়েকে? তোর নিজের বয়সটা দেখেছিস? নালায়েক! কোন আক্কলে হান্নানের মেয়ের কথা মুখে আনলি তুই ? তোর সাথে যায় ওই মেয়ের সঙ্গে? শেষমেশ ওরকম একটা বাচ্চা মেয়ের উপর নজর পড়তে হলে তোর?”
–“আজব এমনে বলতাসেন কেন আব্বা? আপনাগো কি নাতি পুতি দেখার শখ নাই? বাচ্চা কাচ্চা নিয়া খেলবেন নাহ?”
তোফাজ্জল সাহেব ধৈর্য হারিয়ে বললেন।
–“নালায়েক! ওই মেয়ে নিজেই তো এক বাচ্চা। তুই আবার বাচ্চা কাচ্চার কথা চিন্তা ভাবনা করছিস কোন আক্কলে?”
–“ওটা কোনো সমস্যা না আব্বা। আপনি ছোট টাকে সামলাবেন, আমি বড়োটাকে ম্যানেজ করবো ! সিম্পল!”
তোফাজ্জল সাহেব রীতিমতো থতমত খেয়ে গেলেন। ছেলের এহেন অহেতুক যুক্তিসংঘত কথায়। কপাল চাপড়ে বললেন,
–“জর্ণা! তোমার ছেলের মাথা গেছে! পাগলা গারদে দিয়ে এসো একে! হুশ-হাঁস সব গেছে ওর! তাই আবোল তাবোল বকছে।”
–“আহা এভাবে বলছেন কেন? তুই কি সত্যিই সুবহাকে পছন্দ করেছিস বাবা?”
নাওফিক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
–“পছন্দ তছন্দ জানিনা মা। বিয়ে করলে ওকেই করবো। নাহলে বিয়েই করবো না।ক্যানসেল!”
–“তোর বাবার কথায় কান দিস নাতো তেজ। আমি আজই যাবো হান্নান ভাইয়ের বাড়িতে। সুবহা তো আমারও বেশ পছন্দ। কি মায়াবী মেয়েটা!”
তোফাজ্জল সাহেব হতবাক। চোখ কপালে তুলে বললেন,
–“তোমারও মাথা গেছে, জর্ণা? ছেলের মাথা গেছে বুঝলাম এখন দেখছি তুমিও ওর পেছনেই হাঁটছো! হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে চাও?”
জর্ণা বেগম নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন,
–“আমার ছেলে যখন এই মেয়েকে বিয়ে করবে বলে বলেছে তাহলে এই মেয়েই হবে আমার ছেলের বউ। আমার বেশি কিছু দরকার নেই।”
–“তুমি যেখানে খুশি যাও। আমি এই বিয়েতে নেই। বলে দিলাম।”
বলেই তোফাজ্জল সাহেব রাগে গজ গজ করতে করতে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলেন।
ওদিকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল সুস্মিতা। হাতে ছিল একটু আগে খাওয়া কফির মগ। নিচে নামতেই এমন কথাবার্তা শুনে হাত থেকে কফির মগটা ঠাস করে পরে গেলো নিচে। সেই শব্দের উৎসে সবাই তাকালো সেদিকে। মেয়েটার চোয়ালে টানটান উত্তেজনা আর মনে হাজারটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে ভিতরটা।
শুধু কান ঘেঁষে ভেসে আসছে একটাই নাম “সুবহা”।
পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল সুস্মিতার।
পায়ের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া গ্লাসের টুকরোগুলোর দিকে চেয়ে থাকল সুস্মিতা। চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা জল। ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে। গলার স্বর হারিয়ে ফেলেছে সে। প্রিয় পুরুষের মুখে অন্য নারীর নাম সহ্য করার ক্ষমতা আছে কারো? তারও তো নেই। এই ক্ষমতা যে কোনো মহিয়সী নারীদেরও নেই। সেখানে তার থাকবে কি করে? ছোট বেলা থেকে পছন্দ করে এসেছে নাওফিক কে।যদিও অনুভূতি টুকু ছিল শুধুই একপাক্ষিক। তারপরও তো একাই কতশত স্বপ্ন দেখে এসেছে সে এতদিন। আজ সেই পুরুষের মুখে অন্য নারীর নাম! তাও আবার সোজা বিয়ে করতে চাওয়া। এইজন্যই কি তাকে এতটা অপছন্দ করে নাওফিক। তার মনে অন্য নারী আগে থেকেই বাসা বেঁধে ছিল বলেই?
নাওফিক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সুস্মিতার কাঁদো কাঁদো চেহারা দেখে বিরক্তির ছায়া পরলো ওর। ভ্রু কুঁচকে সেখান থেকে যেতে যেতে বিড়বিড় করল,
–“এসে পরসে সিন্ ক্রেইট এর মা! যত্তসব!”
নাওফিকের চলে যাওয়ার পায়ের শব্দটা যেন আরও তীক্ষ্ণ হয়ে বাজল সুস্মিতার কানে। কাঁচ ভাঙার শব্দের চেয়ে বেশি বিদ্ধ করল সেই নির্লিপ্ত চলে যাওয়া। মেয়েটা তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত আঁখিপল্লব মেলে তাকিয়ে রইলো সেদিকটায়।
**
সুবহার ফুপু জেসমিন বেগম চুপচাপ বসে আছেন তাকে থাকতে দেয়া কক্ষটিতে। চুপচাপ বসে থাকলেও তার ভেতরে চলছিলো এক কঠিন ভাবনা। দীর্ঘক্ষণ ভাবনার পর অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন তিনি।
এইবার ভাইয়ের মেয়েকে একেবারেই নিজের ঘরে তুলে নেবেন পার্মানেন্টলি।
সিদ্ধান্ত টা শুধু নিজের জন্যই নেয়া নয় বরং তার ছেলে শুভ্রর জন্য শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে উপনোনীত হয়েছেন তিনি। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ঠিক করেছেন ভাইয়ের মেয়েকেই ছেলের বউ করে ঘরে তুলবেন জেসমিন বেগম।
সুবহার মতো এমন মায়াবী, মার্জিত আর নরম মেয়ে এই যুগে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমন একটা মেয়েকে বউ করে পেলে শুভ্রর জীবনটাই বদলে যাবে বলে মনে করেন জেসমিন বেগম। তাছাড়া ভাইয়ের মেয়ে হওয়ায় বিষয়টা আরো সহজেই নিজের আয়ত্তে আনতে পারবেন তিনি। ছেলেও তার হাতছাড়া হবেনা কোনোদিন। তা না হলে আজকাল কার ছেলেদের আজ বিয়ে হতেই গতকাল দেখা যায় বউ ছাড়া কিচ্ছুটি বুঝে না! উঠতে বসতে শুধু বউ আর বউ!
তৎক্ষণাৎ নিজ থেকে নেয়া সদ্য এই সিদ্ধান্ত জানাতে উঠে দাঁড়ালেন জেসমিন বেগম। নিজের পরিকল্পনা মতোই ভাইকে বিষয় তা জানালে প্রথমে হান্নান সাহেব খানিক দ্বিধা করলেও, বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে নীরবে একটা সময় সম্মতি জানালেন তিনি।
বিলকিস বেগমও শুনে একটু থমকালেও পরক্ষনে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বুঝানোর ন্যায় বললেন,
–“আপার বাড়ি তো চেনা পরিচিত। আর তাছাড়া তুমি নিজেই বলো ওখানে মেয়ের মতোই থাকবে আমাগো সুবহা। এ যুগে তো এমন ভরসার জায়গা মেলা দায়।”
নিজ সহধর্মিনীর এহেন সম্মতিস্বরূপ কথায় ভাবুক হান্নান সাহেব রাজি হয়ে গেলেন বোনের দেয়া প্রস্তাবে। আর শুভ্রও তো তাদের চেনা। এমনিতেই নম্র-ভদ্র, দায়িত্ববান আর পরিণত মানসিকতার ছেলে শুভ্র। সুবহার পাশে এমন একজন থাকলে তাদের মেয়েটাও ভালো থাকবে। নিশ্চিন্তে থাকবে এই ভেবেই শেষমেশ রাজি হয়ে যান দুইজনেই।
জেসমিন বেগম ততক্ষণে পুরো প্ল্যান বানিয়ে ফেলেছেন। একটা ছোট পরিসরের পারিবারিক ভাবেই আজ বিকেলে সামান্য আয়োজন করে আংটি পরিয়ে দিবেন সুবহা কে।
**
বিকেল হতেই চেয়ারম্যান তোফাজ্জল চৌধুরী ও তার সহধর্মিণী জর্ণা বেগম বেশ কয়েকজন সহযোগী আর একগাদা মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে এসে হাজির হলেন পাটোয়ারী বাড়ির সামনে।
অন্যদিকে হান্নান সাহেব বাজারে যাবার জন্য কেবলই সদর দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন অমনিই নিজ বাড়ির সামনে চেয়ারম্যান সাহেব আর তার স্ত্রী কে দেখে ভারি অবাকই হলেন তিনি। কি ব্যাপার চেয়্যারম্যান সাহেব হঠাৎ তাদের বাড়িতে! সঙ্গে আবার তার স্ত্রী!
তারওপর আবার এতগুলো মিষ্টির বাক্স দেখে চোখ বড় হয়ে এলো হান্নান সাহেবের।
— “আরে! তোফাজ্জল ভাই? আপনি হঠাৎ আমাদের বাড়িতে?”
তোফাজ্জল সাহেব কিঞ্চিৎ রসিক ভঙ্গিতে জবাব দিলেন,
–“কেন হান্নান তোমাদের বাড়িতে আসা আমাদের বারণ নাকি?”
হান্নান সাহেব খানিক অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বলেন,
— “আরে তা নয় ভাই। আপনি ব্যস্ত মানুষ। আপনাদের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আজ হঠাৎ নিজের বাড়ির সামনে দেখে অবাকই লাগলো।”
— “ভেতরে যেতে বলবে না নাকি আমাদের?”
— “আরে আরে, অবশ্যই আসেন ভাই! কই গো শুনছো? দেখো তো কারা এসেছে!”
বলে ভেতরে হাঁক ছাড়লেন হান্নান সাহেব।
বিলকিস বেগম দরজা দিয়ে বেরিয়েই বিস্মিত হয়ে দাঁড়ালেন। জর্ণা বেগম এগিয়ে গেলেন সামনে। সালাম জানিয়ে বললেন,
–“কেমন আছেন আপা?”
কৌতুহলী গলায় বললেন বিলকিস বেগম,
— “আল্লাহর রহমতে ভালো। আপনারা হঠাৎ? আমাগো শ্রেয়ান কি কিছু করছে?”
— “আরে না না, তেমন কিছু নয়।”
–“ওনাদের ভিতরে নিয়ে যাও বিলকিস!”
বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে বসার রুমে বসলেন তোফাজ্জল সাহেব আর জর্ণা বেগম। চারোপাশে একবার চোখ বুলিয়ে কাউকে খুঁজলেন তারা। পুরো বাড়ি ফাঁকা দেখে একটা সময় বলেই বসলেন,
— “বাড়িতে আর কেউ আপা ? সুবহা কোথায়?”
— “ছিলো তো এতক্ষণ। ওর ফুপুরা আসছে শহর থেইকা। তাদের একটু গ্রাম ঘুরাইয়া দেখাইতে নিয়া গেছে।”
–“ওহ, আচ্ছা…”
তোফাজ্জল সাহেব গলা পরিষ্কার করে বললেন,
–“হান্নান মিয়া, আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলি না। পছন্দ ও করিনা। আমরা আজ তোমাদের বাড়িতে এসেছি একটা বিশেষ কারণে। তোমার মেয়ে সুবহা ওর জন্যই এসেছি আরকি। আমার ছেলের জন্য তোমার মেয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছি। ”
হান্নান সাহেব ও বিলকিস বেগম দুজনেই এক সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন সাথে সাথেই। প্রায় অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন হান্নান সাহেব,
–“মানে… আপনি আমাগো সুবহার কথা বলতাসেন তোফাজ্জল ভাই?”
তোফাজ্জল সাহেব উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। হান্নান সাহেব বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
–” কিন্তু…হঠাৎ আপনাদের বড় ছেলে রেখে ছোট ছেলেকে বিয়ে করাতে চাচ্ছেন যে বরং? ”
তোফাজ্জল সাহেব গম্ভীর গলায় জবাবে বললেন,
–“তোমার বোধহয় শুনতে ভুল হয়েছে হান্নান। তনয় নয় আমাদের বড় ছেলে তেজ ওর জন্যই এসেছি এখানে!”
তোফাজ্জল সাহেবের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা সদ্য বুলিতে বজ্রাঘাত হানে বিলকিস বেগমের মাথায়। চোখ কুঁচকে রাগে গলা উঁচু করে বলে উঠেন আগে ভাগেই,
— “কি বলছেন এসব তোফাজ্জল ভাই? ওই দামড়া পোলার লগে আমার এই পিচ্চি মেয়ের বিয়া দিবেন? আমার সুবহা তো এখনো স্কুলের গণ্ডিও পার হয়নি!”
জর্ণা বেগম শান্ত গলায় বলেন,
— “আপা, আমি বুঝতে পারছি কথাটা হঠাৎ শুনে একটু বিস্ময় লাগছে। কিন্ত আমাদের ছেলেটা এতদিন পর আজ মুখ ফুটে নিজের বিয়ের কথা বলেছে। আপনাদের মেয়ে সুবহা আমাদের ভীষণ পছন্দ। জানি বয়সের তফাৎ টা একটু বেশিই তবে সুবহা কে আমরা ছেলের বউ নয় বরং মেয়ের মতো করেই রাখবো!”
বিলকিস ততক্ষণে বেশ রেগে গিয়ে বললেন,
–“আপনাগো ছেলে কি চায় না চায়, তাতে আমাগো কি আসে যায়? আমার মাইয়া আমি ওই পোলার সঙ্গে জীবনেও বিয়া দিমুনা। আর তার চেয়ে বড় কথা আমাগো মাইয়ার বিয়া ঠিক হইয়া গেসে!”
–“আহ বিলকিস চুপ থাকো। তুমি ভিতরে যাও। ওনাগো জন্য ঠান্ডা শরবত বানিয়ে নিয়া আসো যাও। ”
–“ওনি কি বলে গেলো হান্নান ভাই? সুবহার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে? ”
–“তোফাজ্জল ভাই আপনি আমাদের গ্রামের গর্ব। আপনার মতো মানুষ আমাদের বাড়িতে এসেছেন এটাই আমাদের জন্য অনেক সম্মানের। আপনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। মান্যতাও আছে। কিন্তু আপনার প্রস্তাবটা রাখতে পারছি না ভাই। আমি আমার একমাত্র বোনকে কথা দিয়েছি। মেয়েকে আমি ওর হাতেই তুলে দেবো। সেই কথা আমি ভাঙতে পারবো না। সে যতো বড়ই প্রস্তাব হোক। কথা একবার দিলে সেটা ভাঙা আমার স্বভাবে নেই।আমার সিদ্ধান্তের জন্য যদি আপনারা কষ্ট পান তাহলে দয়া করে আমায় ক্ষমা করবেন।”
জর্ণা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখ নামিয়ে নিলেন আলগোছে। কত আশা নিয়ে এসেছিলেন এখানে। ছেলের জন্য বিয়ের কথা পাকা করে যাবেন বলে। অথচ সবকিছু কেমন নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। ছেলেকে বাড়ি ফিরে কি জবাব দিবেন তিনি? তোফাজ্জল সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন শুধু,
–“তোমরা যা ভালো মনে করো তাই করো হান্নান। তোমাদের মেয়ে। তোমাদের ইচ্ছে। কোনো জোড় জবরদস্তি নেই। তোমাদের যেখানে ইচ্ছে মেয়েকে তোমরা সেখানেই তুলে দিবে এতে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।”
বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন তোফাজ্জল সাহেব নিজ সহধর্মিনী কে নিয়ে। হান্নান সাহেব সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললেন শুধু।
চলবে….