একদিন দেখা হয়েছিল পর্ব-০২

0
1

#একদিন_দেখা_হয়েছিল
নাজনীন আক্তার
পর্ব-২

আমি চমকে উঠলাম। তিনি আমার নাম জানেন! কীভাবে জানেন! কে তিনি! কীভাবে চিনেন আমাকে! কিন্তু কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি রিকশায় উঠে চলে গেলেন। অদূরে মিলিয়ে গেলেন। আর আমি একমনে ওদিকে তাকিয়ে রইলাম। তখনও যদি জানতাম, তার সাথে এই স্বল্পক্ষণের আলাপ আমার মনে কী বিশাল প্রতিক্রিয়া ফেলবে! কী বিশাল পরিমাণ ভালোবাসার জন্ম দিবে! তাহলে হয়তো তাকে যেতে দিতাম না। ধরে বেঁধে তাকে রেখে দিতাম! কিংবা তাকে খুঁজে পাওয়ার পথ জেনে নিতাম!

তারপরের দিনগুলো আমার খুব এলোমেলো কাটলো। আমি ঠিকমতো খেতে পারিনা, ঘুমাতে পারিনা, কারও সাথে কথা বলি না, সারাক্ষণ শুধু অন্ধকার রুমে বসে থাকি। আর ওই মানুষটার কথা ভাবি। চোখ বন্ধ করে ওইদিনের স্বল্প সময়টুকু বারবার মনে করার চেষ্টা করি। আর নিজেকে দোষারোপ করি। এতো বোকা আমি! মানুষটার নাম পর্যন্ত জেনে নেইনি! এই বোকামোর জন্য চোখে পানি পর্যন্ত চলে আসতো। ভিতর ভিতর যেন দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকলাম। আমার এই টালমাটাল অবস্থা বাড়ির সবাইকে নাড়িয়ে দিল। তাদের সদা বাড়ি মাথায় তুলে রাখা মেয়ের এত্ত শান্ত অবস্থা তাদেরও চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল।

ঠিক সেসময় এসে হাল ধরলেন আমার বড়ভাই মৃদুল। ভাইয়া তখন কেবল অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছেন। পড়াশোনা নিয়ে ভিষণ ব্যস্ত থাকেন। তার দুনিয়া বোধহয় বই আর ভার্সিটি নিয়েই। কিন্তু আমার এই ভীষণ এলোমেলো অবস্থায় সেবার তিনিই আমাকে সামলে নিয়েছিলেন। প্রথমেই আমার সব কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তারপর শুরু করলেন তার বিভিন্ন কৌতুহলী প্রশ্ন। আমি সব মিনমিনিয়ে উত্তর দিচ্ছিলাম। আর যত তিনি শুনছিলেন ততই যেন অবাক হচ্ছিলেন।

– হ্যাঁ রে ময়না, ছেলেটা কি আমাদের এলাকার? নাকি অন্য জায়গার?
-জানিনা ভাইয়া। ঠিকানা তো বলেনি আমাকে।
-আমাদের শহরের কি?
– এখানেই তো ট্রেন থেকে নামল। এই শহরেরই হবে তাহলে।
-কী পড়াশোনা করছে?
-জানি না।
-নামটাতো জানিস?

“কিচ্ছু জানিনা ভাইয়া, কিচ্ছু না। শুধু জানি খেতে পারছি না আমি, খেতে গেলেই তাকে মনে করে আমার প্লেট ভেসে যাচ্ছে চোখের পানিতে৷ আমি ঘুমাতে পারছি না, চোখ বন্ধ করলেই তাকে মনে পড়ছে। আমি কারও সাথে কথা বলতে পারছি না। দুদণ্ড ঠিকমতো স্থির হয়ে বসতে পারছি না আমি। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে, কেন তার ব্যপারে কিছু জানতে চাইলাম না। কেন তাকে এভাবেই চলে যেতে দিলাম।”

কাঁদতে কাঁদতে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। ভাইয়া আস্তে আস্তে আমাকে সামলে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চোখ বন্ধ করে কিছু বলতে শুরু করলেন।

“জানিস মনা, আমি তখন ইন্টারে পড়তাম। আমাদের সাথে নীরা নামের একটা মেয়ে পড়তো। সবসময় চুপচাপ থাকতো৷ গম্ভীর, মুখ ভার করে রাখতো। ঠিক ওই বয়সের সাথে ওর ব্যবহারটা যেন মানানসই না। কলেজে আসতো, ক্লাস করতো, কারও সাথে কথা বলতো না। কোনো বান্ধবীও নেই। কিন্তু জানিস, এই অন্যরকম একটা মেয়েকেই কেন যেন আমার ভালো লেগে যেতে থাকলো। তারপর একদিন মেয়েটা ক্লাসে একটা গান গাইল। ওর ওই ‘আমারও পরানও যাহা চায়’ গানটা শুনে মনে হয়েছিল, এই মেয়েটাকেই তো আমার দরকার। আমার সারাজীবনটাকে গানের ছন্দে বেঁধে রাখতে একেই প্রয়োজন। মেয়েটাকে দিনদিন যেন আরও ভালোবাসতে থাকলাম। আমার অল্প বয়সের প্রথম আবেগের নাম ছিল নীরা।”

এতটুকু বলেই ভাইয়া থেমে গেল। আর আমি স্পষ্ট দেখলাম, ভাইয়ার চোখে পানি চিকচিক করছে। আমার এই জীবনে ভাইয়ার চোখে আমি পানি দেখিনিহ। আর আজ সে যেন বহুকষ্টে পানি আটকিয়ে রেখেছে।

“নীরাকে প্রতিদিনই আড়চোখে দেখতাম। ক্লাসের সব বেঞ্চে ওর নাম লিখে ভরে ফেলেছিলাম। সব বন্ধুরা আমার এই পাগলামি দেখে হাসতো, মজা নিতো। নীরাও হয়তো বুঝতো, কিন্তু কখনও কিছু বলেনি। কিন্তু এই সবকিছুর প্রভাব পড়লো পড়াশোনায়। সেবার টেস্টে আমার রেজাল্টে ধস নামলো। সব স্যার ম্যামরা তো অবাক। সবসময় ফার্স্ট পজিশনে থাকা ছেলেটার এমন অবস্থা! বাবাও অনেক চিন্তায় পরে গেছিল। আমিও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সামনেই তো বোর্ড পরীক্ষা। সবাইকে চিন্তায় দেখে আমার নিজেরও কেমন অসহায় লাগছিলো। ঠিক সেসময় নীরা আমার সাথে প্রথম কথা বললো।

ও কিন্তু সেদিন আমাকে কোনো সান্ত্বনা দিতে কথা বলেনি। বরং ও হেসে হেসে এই পৃথিবীর একজন বোকা মানুষের কথা বলেছিল। যেই বোকা মানুষ একজন মেয়েকে ভালোবেসে নিজের জীবন উচ্ছন্নে দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু যার জন্য দিয়েছে, সে আদৌতে ছেলেটাকে পছন্দও করে না। সেদিন নীরা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমার এক তরফা ভালোবাসার বিন্দুমাত্র মূল্যও তার কাছে নেই। আমি ঠিক কতটা বোকামি করে তার জন্য নিজের জীবন নষ্ট করছি! আমার ভালোবাসা কতটা অপাত্রে ঢালছি।”

সবটুকু বলে ভাইয়া থামলো। নিজেকে একটু সামলে নিলো হয়তো।

“মনা, তোর কি মনে হয়না যে তুইও অপাত্রে নিজের ভালোবাসা দিচ্ছিস?”

আমি চমকে উঠলাম। দৃষ্টি এদিক ওদিক করে জলদি উত্তর দিতে চাইলাম।

-কিন্তুুউউ, কিন্তু ভাইয়া আমি তো তার কথা জানি না। হতে পারে সেই মানুষটাও আমাকে আমার মতো করে ভুলতে পারছে না।
– তুই বড় আপার বাসা থেকে কতদিন হলো ফিরেছিস?
-চারমাস হতে গেলো।
– আচ্ছা মনা, তুই নাহয় তার সম্পর্কে কিছুই জানিস না। কিন্তু সে তো জানে। তোকে ভালোভাবে চিনে। তোর বাসাও চিনে। তবে সে কেন এতদিনে একটিবার তোর খোঁজ করতে এলো না? কিংবা তোর সাথে যোগাযোগও করার চেষ্টা করলো না! তোর মতো এই এলোমেলো অবস্থা যদি তারও হতো, তবে সে এতদিনে আমাদের বাড়ির সামনে হাজির হতো। কিন্তু তার অমন হয়নি।

আমি ফ্যালফ্যাল করে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সত্যিই তো! আমি তার পরিচয় না জানলেও সে তো জানে। সে তো পারতো একবার আমার সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু করলো না। তবে কি তার মনে আমি একটুও দাগ কাটিনি! সেদিনের কথা কি তার মনেও নেই!

– জানিস মনা, একতরফা ভালোবাসা খুবই ভয়ংকর। এই সর্বনাশা জিনিস তোকে ভেঙেচুড়ে শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু দিনশেষে দেখবি, তুই যার জন্য শেষ হলি সেই তোকে দেখে হাসছে। শ্রেষ্ঠ বোকা মানুষ বলে তোকে উপাধি দিচ্ছে। তাই এই বোকামো না করে নিজের কথা ভাব। পড়াশোনার মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখ।”

ভাইয়ার সব কথা শুনে অভিমানে আমার সর্বাঙ্গ নীল হয়ে এলো। অনুভূতির চারা যেখানে সবেমাত্র মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল তা সেখানেই যেন সেটা নুইয়ে পড়লো। একরাশ অভিমানে আমার মন যেন শক্ত হয়ে এলো।

সেদিনের মতো ভাইয়া আর কিছু বলেনি। শুধু যাওয়ার সময় ভাইয়া আমার মাথায় হাত রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল।কেন যেন মনে হয়, ভাইয়া সেদিন ভাবছিল, যদি নীরা তার কথা নাই ভাবতো তবে কেন সেদিন নীরা তাকে বোঝাতে এসেছিল। তার সেই কঠোরভাবে বোঝানোতেই তো আজ সে তার ডিপার্টমেন্টের সেরা স্টুডেন্ট। কিন্তু ভাইয়া আমার এই টালমাটাল অবস্থায় কিছুই বলতে পারেনি। শুধু চলে যাওয়ার সময় নীরার কথা জানতে চাইলে বলেছিল, কলেজের পর থেকেই নীরার কোনো খোঁজ জানে না সে।

সেবারের মতো আমি নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে যেন পড়াশোনায় ডুবিয়েছিলাম। যত তার কথা মনে পড়তো তত হায়ারম্যাথের কঠিন কঠিন অঙ্ক, রসায়নের কঠিন বিক্রিয়া, ফিজিক্সের কঠিন থিওরিতে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। আবার আগের ময়নার মতো হাসিখুশিতে বাড়ি ভরিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আদৌতে কি পেরেছিলাম নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে? সেই তো নিস্তব্ধ রাতগুলোতে বুকের ভিতর ভিষণ দহন হতো। একজনকে আর দেখতে না পাবার যন্ত্রণা হতো। সবকিছু মিলিয়ে আমার হাসিখুশি থাকা স্বভাবটা যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল।

—————–

তারপরের কিছু বছর আমার এমনই কাটলো। সাদামাটা রঙহীন। তখন আমি ভার্সিটিতে পড়ছি। পড়াশোনার চাপ, নতুন বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘোরাফেরা, এমনই চলছিল। হঠাৎ একদিন বাসায় এক বিয়ের দাওয়াত এলো। আমার বাবার চাচাতোভাইয়ের মেয়ের বিয়ে। সেই বিয়ে উপলক্ষ্যে গ্রামে যেতে হবে। আমাদেরও গ্রামে বাড়ি আছে, কিন্তু সে বাড়িতে কেউ থাকে না। আমার দাদাজান বহু আগে ওখান থেকে এসে শহরে বাড়ি করে স্থায়ী হয়েছেন। তাই আমাদের কখনও গ্রামে যাওয়া হয়নি আর।

এবার তাই গ্রামে যাবার একটা সুযোগ পেয়ে সবাই মেতে উঠল। সবাই প্রথমবারের মতো নিজেদের গ্রামে যেতে চায়। কিন্তু বাঁধ সাধলেন আমার বাবা। তিনি হঠাৎ কেন যেন আমাদের যেতে দিতে চাইলেন না। কেমন অদ্ভুত মন খারাপের রেশ তার সারা চেহারায় ঘুরে যেতে থাকল। তিনি বাড়ির সবথেকে বড়, তাই কেউ আর তার কথার অমান্য করে কিছু বললেন না। কিন্তু হঠাৎ সবার উৎসাহে, আশায় ভাটা পড়াতে সবাই একটু দুঃখ পেল। সেসময় আমার মেজো চাচা আর মা হাল ধরলেন। বাবাকে একদিন তারা দুজন খুব করে বোঝালেন। তাদের এক গোপন মিটিং চলল প্রায় ঘন্টা ধরে।সেই গোপন মিটিং শেষে বাবা আমাদের সব ভাইবোনদেরকে তার ঘরে ডাক পাঠালেন। এর মধ্যে ছিলাম আমি, আমার বড় ভাই মুদুল, আমার মেজো চাচার দুই মেয়ে টিনা আর মীনা, ছোট চাচার এক ছেলে মুগ্ধ। টিনা আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট, এবার কলেজে পড়ছে। আর মীনা আর মুগ্ধ একই বয়সের। ক্লাস নাইনে পড়ছে ওরা।

– তোমরা হয়তো শুনেছ, আমরা একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গ্রামে যাচ্ছি। প্রথমে আমি তোমাদের নিয়ে যেতে না চাইলেও এখন নিয়ে যাব ঠিক করেছি। তোমাদেরও গ্রাম দেখা উচিত। তোমাদের ভিটে বাড়ি, তোমাদের বাবা-চাচারা কোথায় বড় হয়েছে, এটা দেখার কৌতুহল তোমাদের থাকতেই পারে। আমি এতে বাঁধা দেব না।

বাবা তার কঠিন মুখশ্রি নিয়ে শান্ত স্বরে কথাগুলো বললেন। আর ভঙ্গ হয়ে যাওয়া আশা পুনরায় জোড়া লাগাতে আমাদের ভাইবোনদের মুখ চকচক করে উঠল। সবার মনে হইহই করে উঠলেও বাবার সামনে সবাই চুপ থাকল। সবাই যে বাবাকে বড্ড ভয় পায়। হয়তো ভয় এর থেকেও বেশি সম্মান করে, এজন্য তার সামনে কেউ কখনও মাথা উঁচু করে তাকায় না। মেজো চাচা আর ছোট চাচাও পর্যন্ত এখনও বাবার কথার বাইরে কিছু করেন না।

– তোমরা বিয়েতে যাবে, আনন্দ করবে, হৈ-হুল্লোড় করে সময় কাটাবে, গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখবে, সবকিছুই করবে। কোনোকিছুতেই তোমাদের বাঁধা নেই। কিন্তু কিছু কথা মাথায় রাখবে। এই বাড়ির সম্মান কিন্তু তোমাদের হাতে। তোমাদের সব কাজের মাধ্যমেই এ বাড়ির সম্মান বজায় থাকবে। কাজেই নিজেরা সংযত থাকবে। এমন কিছু করবে না যাতে বাড়ির সম্মান নষ্ট হয়। তোমরা বড় হয়েছ, আশা করছি এর থেকে বেশি কিছু বলে তোমাদের বোঝাতে হবে না।

বাবার এই সতর্কবাণী নিয়ে বাকি সবাই তেমন না ভাবলেও ভাইয়ার কপালে ভাঁজ পড়তে দেখলাম। আমারও একটু অন্যরকম লাগল। হঠাৎ বাবা কেন আমাদের এগুলো বলবে! আর গ্রামে যাওয়ার কথা ওঠাতে বাবাই কেন প্রথম বাঁধা দিয়েছিল!

(চলবে)