#একদিন_দেখা_হয়েছিল
নাজনীন ফারিয়া
পর্ব-৩
বাবার এই সতর্কবাণী নিয়ে বাকি সবাই তেমন না ভাবলেও ভাইয়ার কপালে ভাঁজ পড়তে দেখলাম। আমারও একটু অন্যরকম লাগল। হঠাৎ বাবা কেন আমাদের এগুলো বলবে!
তার পরেরদিনই বেশ সকাল সকাল আমরা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গ্রাম বাংলার রাস্তা—এ যেন প্রকৃতির নিখুঁত আঁকা চিত্র, যেখানে মাটির গন্ধে মিশে থাকে শত বছরের ইতিহাস। এ রাস্তা কেবল চলার পথ নয়, এ যেন গ্রামীণ জীবনের শিরা-উপশিরা, হৃদয়ের ছন্দ আর প্রাণের স্পন্দন।
সকাল বেলা সূর্যের কোমল আলো গাছপালার ফাঁক গলে পরে সেই সরু পথগুলোতে। ধূলিমাখা সে রাস্তার ধারে ধারে ফুলের গন্ধে ভরে ওঠে বাতাস। পায়ে চলা সেই পথে হাঁটলেই যেন শোনা যায় মাটির নিচে রূপকথার ঢেউ।
সেই পথ ধরেই আমরা সবাই এগিয়ে যাচ্ছি। একসময় ঠিক বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। একই জায়গায় একপাশে বাবার চাচার বাসা আর একপাশে আমাদের নিজেদের বাসা। আমাদের সবার থাকার ব্যবস্থা এই পুরাতন বাসাতেই হলো। আমরা আসব বলে এটি আগে থেকেই বাবার চাচাতো ভাই মানে সবুজ চাচা পরিষ্কার করে রেখেছিলেন। একটি ড্রইংরুম, ডাইনিংরুম এবং পাঁচটি বেডরুম এখানে। ছোটো চাচা জানালেন, এর মধ্যে তিনটা ঘর ছিল তাদের তিন ভাইয়ের আর একটি দাদা-দাদীর। আর একটি ঘর! এটি কার বলতে যেয়েও যেন আর বললেন না তিনি। কিন্তু তার মুখে স্পষ্ট আমরা চিন্তার ছায়া দেখলাম, বোধহয় কিছুটা বেদনাও মিশে ছিল তার সাথে।
বাবা আর চাচারা তাদের তিনটা ঘরই নিল। আমাদের তিন বোনের জন্য দাদা-দাদীর ঘরটা দেওয়া হলো আর ভাইয়া আর মুগ্ধের জন্য ড্রইংরুম বেঁছে নেওয়া হলো। যদিও আরেকটা বেডরুম ফাঁকাই ছিল কিন্তু ওটার তালা আর কেউ খুলল না। মুগ্ধ কয়েকবার ওই ঘর খোলার কথা বললেও কেউ পাত্তা না দেওয়াতে সে থেমে গেছিল।
একটা বিয়ে মানেই কেবল দুটি মানুষের মিলন নয়, এটা যেন গোটা গ্রামের জীবনযাত্রার মধ্যে নতুন ঢেউ। পাড়ার ছেলেরা টুকটুকে রঙিন গেট বানাচ্ছে, মেয়েরা উঠানে আলপনা আঁকছে, আর বড়োরা ব্যস্ত—কে কখন খাবে, কী রান্না হবে, কে উঠবে কোন ঘরে, কতজনের জায়গা হবে। সব মিলিয়ে বিয়ে বাড়ি একদম জমজমাট। আমরা হলুদের দিন গিয়েছিলাম। আমাদের পৌঁছানোর আগে ছোটো করে হলুদ হলেও সন্ধ্যায় হলুদের অনুষ্ঠান। তাই আমরা বিকাল হতেই সবাই তৈরি হওয়া শুরু করেছি।
সন্ধ্যার পরপরই হলুদের অনুষ্ঠান শুরু। বাড়ির ছোট সদস্য থেকে বড় সদস্য, প্রত্যেকে নাচে-গানে মেতে উঠেছে। আমরা ভাইবোনেরাও তাতে শামিল হয়েছি। কনেকে হলুদ ছুঁয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করছি। তখনই শুনলাম বরের বাড়িতেও নাকি আজ হলুদের অনুষ্ঠান আছে। তাই ও বাড়ি থেকে কিছু লোক এ বাড়িতে এসেছে, ঠিক তেমনই এ বাড়ি থেকেও কিছু লোক ও বাড়িতে যাবে। সবুজ চাচা আর চাচী এসে আমাদের ভাইবোনদের যেতে বললেন। কিন্তু ভাইয়া আর টিনার যাওয়াতে বিশাল অনীহা। তারা যাবে না বলে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিক চলে গেল। এদিকে মীনা আর মুগ্ধ যাওয়ার জন্য লাফিয়ে উঠেছে। অগত্যা মায়ের নির্দেশে তাদের সাথে আমাকেও যেতে হলো তাদের দেখে রাখার জন্য।
কিন্তু যাওয়ার সময়ই দেখা গেল, যে গাড়িটা এসেছে তাতে ঠিক সবাইকে ধরছে না। এদিকে কেউ নামতেও নারাজ। তাই আমিই নেমে গেলাম। আমার এমনিতেও এত হৈ-হুল্লোড় ভালো লাগছে না। কেমন যেন ক্লান্তবোধ করছি। তখনই সবুজ চাচার ছেলে মিরাজ এসে দাঁড়াল। এই ছেলেটা শুরু থেকেই বেশ কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কখন আমাদের কী প্রয়োজন, কোথায় কোন সমস্যা, সবকিছুর দেখভাল করছে। হয়তো তাদের বাড়ির অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে এসেছি এজন্যই এতকিছু। কিন্তু মায়ের কেমন জানি একটা খটকা লেগেছে। মা তখন বলছিলেন, ছেলেটা নাকি খুব আগ বাড়ানো স্বভাবের।
মিরাজ এসেই আমাকে তার সাথে বাইকে যেতে বলল আর ওই গাড়িটাকে রওনা দিতে নির্দেশ দিল। সাথে সাথে সেও চলে গেল তার বাইক আনতে। সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে আমি তার কথায় সম্মতি বা অসম্মতি, কিছুই জানাবার সুযোগ পেলাম না। এদিকে মীরাজের সাথে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না। কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। মা জানতে পারলেও হয়তো রাগ করবেন। তাই ঠিক করলাম মিরাজ আসলেই তাকে বারণ করে দিয়ে বাড়িতে চলে যাব।
তখনই পিছন থেকে বাইকের আওয়াজ হলো। আমি ঘুরে তাকাতেই যেন আমার পুরো শরীর জমে স্থির হয়ে এলো। বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে গেল। শরীর কাঁপতে থাকলো। আমি যেন দাঁড়াবার শক্তিটাই হারিয়ে ফেলেছি। মুহূর্তেই কিছু আবছায়া ঘটনা চোখের সামনে প্রতিফলিত হতে থাকল। এই মানুষটাকেই তো সেদিন সন্ধ্যায় আলো -আঁধারির মাঝে দেখে নিজের মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছিলাম। এই মুখের মানুষটাকেই তো কত পথে পথে খুঁজেছি। কতদিন রেলস্টেশনে যেয়ে বসে থেকেছি। মনে মনে হাজার অভিমান-অভিযোগ রাখলেও কেন যেন আজ নিজেকে সংযত করতে পারছি না। চোখ দুটো কেমন যেন বাঁধ হারা বান নামাতে চাইছে।
এদিকে মানুষটা কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন এই দৃষ্টি দিয়েই সামনের মানুষটাকে ভস্ম করে দিবে। তার কপালের রগটাও কেমন ফুলে ফুলে উঠছে।
“এই মেয়ে, তোমাকে কী বলেছিলাম? বলেছিলাম না, আর কখনও অন্য কারও সাথে রিকশায় উঠে না যেতে? আর আজ কীনা, তুমি সোজা বাইকে উঠে যাচ্ছিলে? এত্ত সাহস!”
কঠিন স্বরে কথা গুলো বলে শেষ দিকে তিনি ধমকিয়েই উঠলেন। ফলস্বরূপ আমি কেঁপে উঠে একটু পিছিয়ে গেলাম। এতক্ষণ চোখ যেই বাঁধন মেনে চুপ ছিল, সেটা ভেঙে গেল। টপটপ করে পানি পড়তে থাকল। এটা দেখে তার মন হয়তো একটু নরম হলো। এদিকে আমার মনে আরও অভিমানের বাসা বাঁধল। একে তো এতদিন নিখোঁজ ছিল। আর আজ সামনে এসেই ধমকাধমকি।
“শোনো, এত্ত সাহস দেখাতে যেও না। সোজা বাড়ির দিকে যাও। এদিকে কিছু চেনো নাকি তুমি!”
তার কথা শুনে পিছন ফিরে এক দৌঁড়ে বাড়িতে যেতে নিলাম। কিন্তু হঠাৎ হাতে বাঁধন পাওয়াতে পিছন ঘুরে তাকালাম। মানুষটা আমরা হাত ধরে রেখেছে! অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই তিনি নরমকণ্ঠে বলে উঠলেন,
“এই মেয়ে, ভালোর জন্যই তো বলেছি। মিরাজকে আমি ছোটো থেকেই চিনি। ওর স্বভাব মোটেও ভালো না। আর তুমি কীনা ওর সাথেই বাইকে যেতে চাচ্ছিলে! দূরে থেকো ওর থেকে।”
নরম স্বরে কথা গুলো বলে থামলেন। আর এদিকে আমার চোখের অশ্রুজল থামছে না। একে তো এতদিন খোঁজার পর আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষটা হঠাৎ আমার সামনে, অন্যদিকে আবার তার এমন ধমক। আমি যেন সবকিছু গুলিয়ে আগের সেই টালমাটাল অবস্থায় চলে যাচ্ছি। হঠাৎ তিনি হাত বাঁড়িয়ে আমার চোখের পানিটুকু মুছে দিলেন। চমকে উঠলাম আমি। তার ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে যেন এবার সম্পূর্ণই জমে গেলাম। তিনি ধীরে ধীরে বলে উঠলেন,
“কেঁদো না প্লিজ! তোমাকে কাঁদতে দেখে আমার বুকের মাঝে ব্যথা শুরু হয়েছে। মনে হয়, হৃদপিন্ডে মারাত্মক রক্তক্ষরণ হচ্ছে।”
———
সকালের সোনালী রোদ চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে সকাল সাতটা বেজে দশ মিনিট। অথচ এই সকালেই এই বাড়িতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেউ অতিথিদের আপ্যায়ন করছে, কেউ আবার রান্নার আয়োজন করছে। আজকেই তো তাদের মেয়ে পরের বাড়ি চলে যাবে। তাই কেউ আবার সেটা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছে। আমি এই সকালে উঠেই কিছুক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই জানালার এদিকটাতে তাকালেই বহমান নদী দেখা যায়। সেই নদীর দিকে একমনে তাকিয়ে রইলাম। কালকে রাতের বেলায় আর কিছু হয়নি। মানুষটার ওই স্বীকারোক্তি শুনে আমি আর দাঁড়াতে পারিনি, এক ছুটে বাড়ির ভিতর চলে এসেছি। কেন যেন মনে হচ্ছে তার সাথে আবার দেখা হবে। আর খুব শীঘ্রই দেখা হবে। একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে ঘর থেকে বের হলাম।
সকাল থেকেই সবাই বেশ ছুটোছুটি করছে। মা-চাচীদেরও দেখলাম হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছে। আমি বের হতেই আমাকে নাস্তা দেওয়া হলো। নাস্তা খেতে খেতেই হঠাৎ আমার গলায় যেন সব গুলো খাবার বেঁধে গেল। আমি দ্রুত পানি নিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম। তারপর চোখ মুছে সামনের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম। সামনে আমার বহু কাঙ্ক্ষিত মানুষটি এসে দাঁড়িয়েছে। সে ছুটে ছুটে বিয়ের স্টেজ সাজাচ্ছে। হঠাৎ একজন চিৎকার করে ডাকলো, ”এই কাব্য, এদিকে আয়।” আর মানুষটা ছুটে সেদিকে গেল।
আমি বসে বসে সবার কাজই দেখছিলাম। মাও রান্নার কাজে সাহায্য করছে। হঠাৎ মা উঠে সামনে যেতে নিলেই নিচে একটা বাঁশে বেঁধে পরে যেতে নেন। তখনই কাব্য ছুটে এসে মাকে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই নির্বাক। কারণ মা পড়ে গেলে তার হাতের গরম পাতিলের খাবার সব তার গায়ে পড়তো। মাও খানিকটা ভয় পেয়ে যান। তখনই সবাই এসে মাকে ধরাধরি করে বসান। কাব্যও সাথে ছিলেন।
– একটু সাবধানে কাজ করবেন। এক্ষুণি কী অঘটন ঘটছিলো বলুন তো।
মা কাব্যের দিকে একটু স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখে হালকা হাসি রেখে বলেন,
“তুমি তো ধরে নিলে। নাহলে সত্যিই অঘটন ঘটে যেত।”
তারপর তিনি সবুজ চাচার স্ত্রীর দিকে তাকান। তার তাকানো দেখেই আমরা সবাই বুঝেছি, তিনি ছেলেটার পরিচয় জানতে চান। চাচী হাসিমুখেই দ্রুত বলে উঠেন,
” আরে ও তো..”
কিন্তু এতটুকু বলেই তিনি থেমে যান। তার মুখে বিব্রতার ছাপ। পুনরায় মুখ খুলে তিনি বলেন,
” মিরাজের এক বড় ভাই। আমাদের বাড়ির লোকই বলা যায়।”
এই উত্তর শুনে কাব্য কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চাচীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। চাচীও কেমন যেন নজর ঘুরিয়েছেন ওর থেকে।
হঠাৎ কাব্য এগিয়ে এসে মায়ের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসেন। সাথে তার চঞ্চল চোখ, যে দুটি এদিক ওদিক ঘুরিয়ে কোথাও আঘাত আছে কিনা, সেটি নীরিক্ষণে ব্যস্ত।
– মামীমা, আপনি কোথাও ব্যথা পাননি তো?
অতিসাধারণ প্রশ্ন! কিন্তু তার এই সাধারণ কথাতেও মা চমকে উঠলেন। কয়েকবার পলক ফেলিয়ে কাব্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
– তুমি তো আমার জা কে চাচী বলেই ডাকছ শুনলাম। আবার আমি তো মিরাজেরই চাচী। আমাকে হঠাৎ মামীমা বললে যে!
– জানি না, আপনাকে হঠাৎ আমার মামীমা বলে ডাকতে ইচ্ছে হলো। আমি মামীমা বলেই ডাকব।
কাব্য কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হালকা হেসে উত্তরটা দিল। কিন্তু মা আর চোখ ফেরাতে পারলেন না। একভাবে কিছুক্ষণ কাব্যের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হঠাৎ কাব্যের হাত দুটো ধরলেন৷ তারপর কিছুটা কাতর স্বরে বললেন,
“কখনও ওভাবে আমার মামীমা ডাক শোনার ভাগ্য হয়নি। বাবা, তুমি আমাকে প্রাণভরে মামীমা বলে ডেকো।”
(চলবে)