একদিন দেখা হয়েছিল পর্ব-০৪

0
1

#একদিন_দেখা_হয়েছিল
নাজনীন আক্তার
পর্ব-৪

গ্রামের মেঠোপথ ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় বিয়ের গাড়ি। পেছনে ফেলে যায় একটি ঘর, একটি বাড়ি আর অনেক আপনজন। মা আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদছেন, বাবা দূরে তাকিয়ে নিঃশব্দে চোখ মুছছেন, ভাইটি মুখ নিচু করে কষ্ট লুকাতে চাইছে। বিয়ের শঙ্খধ্বনি মিলিয়ে যায় কান্নার রোলের মাঝে। একদিকে নতুন জীবনের আশার আলো, অন্যদিকে পরিচিত গৃহের আলোর নিভে যাওয়া। একটা বাড়ির জন্য শুরু, আরেকটা বাড়ির জন্য শেষ।

কনে বিদায়ের পর বাড়ির পরিবেশ বেশ নরম হয়ে এসেছে। আগের মতো আর হৈহুল্লোড় নেই। যেকোনো সামান্য শব্দেও যেন বিষাদ মিশে আছে। সেই বিষাদের আঁচও আমার উপরে পরেছে। আমরা কাল সকালে চলে যাব। এই অচেনা পরিবেশ থেকে ফেরত যাব আমাদের চিরচেনা জায়গায়। আর কখনও এখানে আসব কীনা তারও ঠিক নেই। হয়তো অনেকগুলো বছর পর এমনই কোনো অনুষ্ঠানে আসব। কিন্তু কাব্য! তার কথা ভাবতে যেয়ে বুকের ভিতর ধক করে ওঠে। চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয়। কালকের পর থেকে তাকে আর দেখতে পাব না। এদিকে তার সাথে তেমন কথাও হয়নি। যোগাযোগের বিন্দুমাত্র উপায়ও নেই।

অভিমানে আমার মন নীল হয়ে আসে। সে তো একবারও কথা বলার চেষ্টা করল না। তবে কি আমিই শুধু মরিয়া হয়ে উঠেছি তার জন্য? দিনের পর দিন আমি একাই মনে সুপ্ত আশা নিয়ে বেঁচেছি? সে কি একটুও ভাবেনি আমার কথা। একটি বড় নিঃশ্বাস নিয়ে জানালার ধারে যেয়ে দাঁড়ালাম। সামনে বহমান নদী আর হালকা শীতল বাতাস মনে প্রশান্তি বয়ে এনে দিচ্ছে। এতে ভাবনাগুলো যেন আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠছে। অভিমানগুলো আরও তীব্র হয়ে ধাক্কা দিতে থাকল। সব শেষে তার সাথে সরাসরি কথা বলব ঠিক করলাম। কথা বললে হয়তো তার মনের আন্দাজ করতে পারব একটু। সম্পূর্ণ না বুঝলেও কিছুটাতো বুঝব! এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ জানালা দিয়ে তাকে দেখলাম। নদীর ধারে কিছু পুকুর আছে। তারমধ্যেই একটা পুকুর পাড়ে তিনি বসে আছেন।

————

” মনা! একা নদীর ধারে এসেছো কেন? ভয়ডর নাই একটু?”

আমি তার দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বাতাসের শো শো শব্দ, পাতার নড়াচড়া শব্দ, পাখির ডাক, এছাড়া আর আলাদা কোনো শব্দ নেই। তারপরেও তিনি পিছনে না তাকিয়েই কথাটি বললেন। আমিই যে এসেছি তিনি কীভাবে বুঝলেন?

-আপনি কীভাবে বুঝলেন? অন্যকেউ হতে পারতো।

তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে তারপর মাথা দুলিয়ে হালকা হাসলেন। ঠোঁট বেশি প্রসারিত হয়নি, কিন্তু তারপরেও এই হাসিটাকে আমার পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর হাসি বলে মনে হলো। আমার চোখে দেখা সবথেকে সুন্দর হাসির অধিকারী মানুষটি তিনি।

-কেন যেন মনে হলো, তুমিই এসেছো। তোমার গন্ধ চিনতে পারি হয়তো।

-গন্ধ নিয়েও মানুষ চেনা যায়?

– হয়তো যায়। তো হঠাৎ এখানে এলে কেন?

আমি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। কথাগুলো মনে মনে কিছুক্ষণ আওড়ে নিয়ে বেঁধে বেঁধে যাওয়া বুলিতেই শুরু করলাম।

– এক.. একদিন দেখা হয়েছিল!
একদিন ট্রেনে আপনার সাথে দেখা হয়েছিল। আপনার কি মনে আছে?

তিনি চোখ বন্ধ করে নিলেন। তারপর নিচের ঠোঁটটা একটু দাঁত দিয়ে শক্ত করে কেটে নিলেন। মনে হলো কেমন যেন মনে মনে উত্তর গুছিয়ে নিচ্ছেন। তারপর ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে থাকলেন। আমি অবাক হলাম। এমন করছেন কেন তিনি!

-মনে না থাকার কী আছে! একটা মেয়েকে বিপদে পরতে দেখে তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসেছি। আরও তুমি আমার আত্মীয়া। ভুলে যাবার কথা না।

-আপনি আমাকে চিনলেন কীভাবে?

– তোমাদের ফ্যামিলি ফটো পূর্বে দেখেছি।

আমি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকলাম। এত সহজসরল উত্তর! আমার আর কীইবা বলার আছে। আমি কাতরস্বরে বললাম,

– আর কী অন্য কোনো ব্যপার নেই কাব্য?

-কী ব্যপার থাকবে মনা?

তিনি চোখ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন। চোখে মুখে যেন অদ্ভুত বিরক্তি। আর আমি! নিজেই নিজেকে বিদ্রুপের হাসি দান করে ওই স্থান থেকে চলে এলাম।

—————-

মানুষ সারাজীবন আশা নিয়েই বেঁচে থাকে। এক আশা পূরণ হলে সতুন আশার সৃষ্টি হয়। না পুরণ হলেও অন্য আশা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। আমি এতদিন এক আশা নিয়ে বেঁচে ছিলাম। আশা পূরণের সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ বলেও নিজের মনকে বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু তার এই হঠাৎ দেখা পাওয়া! আমাকে তো আবার ভেঙে চুড়ে দিল। কিন্তু এবার আমি শক্ত থাকলাম। ওই কিশোরী বয়সের মতো ভেঙে নিজেকে নিঃশেষ করার বয়স আর নেই। গ্রাম থেকে বেশ কয়েকদিন হলো আমরা ঢাকায় নিজেদের বাড়িতে এসেছি। এসে থেকেই নিজের মনকে কঠিন ধমক দিয়ে শক্ত করেছি। যে মানুষটার মনে আমার জন্য আলাদা কোনো অনুভূতিই নেই, তার জন্য কেন কষ্ট পাব আমি! এসবের ফলে শান্ত আমি যেন আরও চুপ হয়ে গেলাম।

আমার এই হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া নিয়ে মা খুব বিচলিত হলেন। তিনি এক রাতে আমার ঘরে এলেন। কী হয়েছে জানার খুব চেষ্টা করলেন। কিন্তু তী বলব তাকে? বলার তো কিছুই নেই। মা অনেক্ষণ জোড়াজুড়ির পর হাল ছেড়ে দিয়ে আমার সাথে গল্প করতে লাগলেন। গল্পের বিষয়বস্তু তার দূরসম্পর্কের এক বোনের ছে়লে। পেশায় ইন্জিনিয়ার। বয়স ২৬। পরিবার ভালো। আর ছেলের নানান গুণের কথাই গল্পের বিষয়বস্তু। আমি বুঝি, মা এই ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করতে চান। কিন্তু সাহস করে বলতে পারেন না। আমি যে এতদিন “বিয়ে” শব্দটা শুনলেই রেগে যেতাম। আর আমার বাবার কড়া নির্দেশ, আমার অমতে কিছুই হবে না।

আমার হঠাৎ কী যেন হলো! হয়তো কাব্যের প্রতি তীব্র রাগ আর অভিমানে, নাহলে নিজের অনুভূতির অসম্মান দেখে আমি এক চরম সিদ্ধান্ত নিলাম। সেবার প্রথম মায়ের কথাতে সায় দিলাম। বিয়ে করতে এখন প্রস্তুত আমি। যার সাথে ইচ্ছা বিয়ে দিক। চোখ বন্ধ করে “কবুল” বলে দিব।

আমার এই সিদ্ধান্তে মা প্রথমে অবাক হলেও ভীষণ খুশি হন। তার মেয়েকে বিয়ে দিবেন, খুশি তো হবেনই। তিনি দ্রুত বাড়ির সবাইকে বিষয়টা জানান। সবাই অবাক হয়েছেন। তারপরের ঘটনাগুলো তেমন বলার মতো নয়। কিন্তু এইসব ঘটনায় যেন হুট করে আমার জীবন পাল্টে দিল। বাড়ির বড়রা ছেলের বিষয়ে বিস্তর খোঁজ নেন। তার পরিবারের মানুষদের সাথে কথা বলেন। সবকিছুই বেশ অনুকূলে যাচ্ছে। আর যার ফলাফল একটি বিবাহ! আমার বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেল।

সবাই মিলে বিয়ের আনন্দে মেতে উঠেছে। বাড়ির প্রথম বিয়ে। সবাই অনেক খুশি। বিয়ের কেনাকাটা, আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দেওয়া, মেন্যু ঠিক করা, কত কাজ! সবাই কাজগুলো ভাগ করে নিয়ে বেশ আনন্দে করে যাচ্ছে। আর সবকিছুর মাঝে আমি একটি নিশ্চল পুতুল চরিত্রে নিজেকে রেখেছি। আমার নিজের কোনো কাজ নেই। যে যা বলে শুনছি, যা করতে বলছে করছি। কেমন নিজেকে অনুভূতিহীন মনে হচ্ছে। বাড়ি থেকে কয়েকদিন পরই চলে যাব, তাই বেশ সমাদরও পাচ্ছি। কিন্তু কোনোকিছুই আমাকে ছুঁতে পাচ্ছে না। মাঝেমাঝে শুধু পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়ার তীব্র কষ্ট অনুভব করছি। কিন্তু আর কি কোনো কষ্ট অনুভব করছি না? উঁহু! ভাবতেও চাই না এসব।

কিন্তু আমি ভাবতে না চাইলেও, জীবন কি এত সহজে ছেড়ে দিবে আমায়? আমার হলুদের আগের দিন রাতে এক মেসেজ এলো আমার ফোনে। পরেরদিনই হলুদ আর তার পরেরদিনই বিয়ে। ঠিক এসময় এমন মেসেজ। মেসেজটা অনেকটা এমন,

“মনা, আমার সাথে কি একটু দেখা করতে পারবে?”

আমি অবাক হলাম। এসময় এমন মেসেজ কে দিবে! নাম্বারটাও অপরিচিত। তাই প্রথমে ঠিক পাত্তা দিলাম না। কিন্তু ঠিক রাত বারোটার সময় আবার মেসেজ এলো।

“আমি তোমাদের বাড়ির বাগানে এসে দাঁড়িয়েছি।
তাড়াতাড়ি এসো।”

এবার আমার টনক নড়ল। আমি দ্রুত জানালার ধারে যেয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। সত্যিই একটা আবছায়া দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু অবয়ব দেখে চিনতে পারছি না। কিন্তু কে দেখা করতে আসবে এমন লুকিয়ে-চুড়িয়ে! মনের মধ্যে একজনের নাম ভেসে আসলেও, মনের কথায় ঠিক পাত্তা দিলাম না। আবার উড়িয়ে দিতেও পারলাম না! তাই যাব কী যাবনা ভাবতে ভাবতেই বাগানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম!

(চলবে)