একদিন দেখা হয়েছিল পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
1

#একদিন_দেখা_হয়েছিল
নাজনীন আক্তার
পর্ব-৭ এবং সমাপ্তি পর্ব🌿

ভাইয়ার কথা শুনে আমি কেঁদে ফেললাম। কী করব আমি! আজ আমার হলুদ। সবাই বিয়েবাড়িতে মেতে উঠেছে। এখন কীভাবে বিয়ে ভাঙার সংবাদ দিব! বাবা-মা কি মেনে নিবেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কান্নার গতি আরও বাড়ল। কিন্তু তখনও আমি জানতাম না যে জীবন আমার জন্য আরও বড় চমক রেখেছে। শুধু আমার জন্যই নয়, গোটা খান পরিবারের জন্য। প্রায় ত্রিশ বছর পর খান পরিবারে একজনের আগমন ঘটবে। যিনি খান পরিবারের একান্তই আপনজন!

খুব সকাল থেকেই আমাদের গোটা বাড়ি বিয়ের কাজে লেগে পড়েছে। মা-চাচীরা রান্নায় ব্যস্ত। বাবা-চাচারা বিয়ের নানা আয়োজনে যুক্ত রয়েছেন। আর ছোট ভাইবোনেরা নাচে-গানে বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছে। আত্মীয়-স্বজনও আসতে শুরু করেছে। ঠিক এমন সময় বাড়ির সদর দরজায় এসে দাঁড়ালেন এক যুবক। লম্বা, সুদর্শন, সাদা পান্জাবি-পাজামা পরিহিত, হাতের ঘড়ির দিকে নজর দিতে দিতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তখন আমরা বাড়ির সদস্যেরা প্রত্যেকে দরজার সামনে বসার ঘরেই ছিলাম। প্রথমে ছোট চাচা যেয়ে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। আর তিনি বেশ সুন্দর করে নরমকণ্ঠে সালাম দিয়ে চারিদিকে নজর দিলেন। তারপর ধীর কণ্ঠে বললেন,

“আমি কাব্য। আমি বাড়ির বড়দের সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই। খুবই ব্যক্তিগত কিছু কথা।”

কাব্যের কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। কী ঘটতে চলেছে আন্দাজ করতে পারছি। তাই ভয়ে আমি যেন দাঁড়াবার শক্তিটুকুও পাচ্ছি না। কিন্তু আজ ভয় পেলে চলবে না। আজকে সাহস করে বাবার সামনে দাঁড়াতে না পারলে আমার এই গোটা জীবনই আফসোসে নিঃশেষ হয়ে যাবে। মেজো চাচা কিছু বলতে নিলেই মা তাকে থামিয়ে দিলেন। মায়ের চোখ-মুখ চিক চিক করছে। মা কি তবে আগেই বুঝতে পেরেছেন! তিনি কি কাব্যের পরিচয় সম্পর্কে অবগত! মা সবাইকে থামিয়ে শুধুমাত্র বাড়ির সদস্যদের নিয়ে ভিতরের ঘরে গেলেন। সবাই ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে কিছু একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার আছে, নাহলে মা এভাবে দায়িত্ব নিয়ে তাকে ভিতরে আনতেন না।

প্রথমে মেজো চাচাই তাই কথা উঠালেন,

“তুমি কে? আমাদের বাড়ির মেয়ের বিয়ে। আজ তার হলুদের অনুষ্ঠান। তাই বেশি কথা বলবার সময় নেই আমাদের। আর বড় ভাবি আপনি কি চিনেন ওকে?”

“হ্যাঁ চিনি, তোমরাও চিনবে একটু পর। আর হ্যাঁ, আমার মেয়ের বিয়ের আয়োজনের থেকেও এখন ওর সাথে কথা বলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সবাই ওর কথা মন দিয়ে শুনবে। ও কী বলতে চাই, কেন এসেছে সেটা প্রত্যেকের জানা জরুরি।”

এতটুকু বলেই মা থেমে গেলেন। এ বাড়িতে মা কে বড় বউ হিসেবে অনেক সম্মান করা হয়। বাবা সাধারণত একটু চুপচাপ, গম্ভীর থাকেন। তাই যেকোনো ব্যপারে সবাই মায়ের সাথে আলোচনা করেই বাবার কানে দেন। আর মায়ের সিদ্ধান্তকে সর্বদা সম্মান করা হয়। এবারও তাই কেউ তার উপর কথা বলেননি। শুধু বাবা একটু কপাল কুঁচকে কাব্যের দিকে তাকান। তখন কাব্যও একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বাবার কাছে কিছুটা এগিয়ে আসেন।

“এ বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে আমি জানি। বিয়ের অনুষ্ঠান। ঠিক সেই অনুষ্ঠানের আগেরদিন বাড়িতে হাজির হওয়া সঠিক কোনো কাজ নয়, এটিও আমি জানি। কিন্তু কিছু করার নেই আমার। বিয়ের খবর সবেমাত্র কালকে পেয়েছি। আগে জানলে হয়তো আগেই আসতাম।”

সবাই কাব্যের দিকে নজর দিয়েছেন। মন দিয়ে ওর কথা শুনছে বলার থেকে বোঝার চেষ্টা করছে বলাই শ্রেয়। কাব্য এতটুকু বলে এবার পুনরায় বাবার দিকে তাকান। তারপর চোখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করেন।

“দয়া করে আমার কথাগুলোকে বেয়াদবি হিসেবে নিবেন না। আমি ময়নাকে পছন্দ করি। পছন্দ করি বলার চেয়ে প্রচন্ড ভালোবাসি বলাই শ্রেয়। আমি সকলের মতামত নিয়ে ওকে বিয়ে করতে চাই।”

সবাই যেন চমকে গেল। এমন কথা কেউ আশা করেননি। ছোটো চাচা কিছু বলতে নিলেই, কাব্য পুনরায় বলে উঠেন,

“ময়নার এতে কোনো আপত্তি নেই।”

এবার সবাই চুপ করে গেলেন। কারোরই আর কিছু বলার নেই। শুধু ছোট চাচা একবার আমার দিকে তাকিয়ে সত্যতা জানতে চাইলেন। আর আমি মাথা উপর-নিচ করে হ্যাঁ বোঝালাম। কিন্তু আমার বাবা আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি চিৎকার করে উঠলেন। হয়তো ত্রিশ বছর আগেই ফেরত গিয়েছেন।

“চুপ কর ছেলে। বাড়ি এসে এসব বলার সাহস পাও কোথায়! বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পরে অন্য সম্পর্কে যাওয়া শুধু ভুল নয়, অন্যায়ও। খান বাড়ি কখনও এমন ঘটনা প্রশ্রয় দেয়নি আর কোনোদিন দেবেও না। আমি কোনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে দেব না।”

“ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি! সেই ইতিহাসে তো বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর সম্পর্ক হয়েছিল কিন্তু আমাদের এমন হয়নি। বরং আমরা একে অপরকে চারবছরের বেশি সময় ধরে পছন্দ করি। সম্পর্কের একটু ভুল বোঝাবুঝিতেই ময়না বিয়েতে হ্যাঁ বলেছিল। ও ভুল করেছে। কিন্তু এই ভুলের জন্য এত বড় শাস্তি দিতেন পারেন না। অনেকগুলো জীবন নষ্ট হয়ে যাবে এতে।

কিন্তু চিন্তা করবেন না। ইতিহাসের পুরাবৃত্তি আমি সত্যিই হতে দেব না। আপনারা মত না দিলেও ময়নাকে নিয়ে আমি পালিয়ে যাব না। কারণ একজনকে আমি দেখেছি, যিনি শুধুমাত্র পালিয়ে বিয়ে করার কারণে কী নিদারুণ কষ্ট পেয়েছেন। তিলে তিলে শেষ হয়ে গেছেন। সেই একই কষ্ট আমি আর কাউকে পেতে দিব না।”

কাব্যের এহেন কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে তাকালেন। সবারই একি প্রশ্ন ও কীভাবে এসব জানলো! এগুলো যে অনেক গোপন কথা। কাব্যের পরিচয় নিয়ে সবার মনেই তখন নানা সংশয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাব্য আবার নরম কণ্ঠে বলে উঠলেন,

“আমি ময়নাকে ভালোবাসার পর এতগুলো বছর শুধু নিজেকে যোগ্য করে তোলার পিছনেই শ্রম দিয়েছি। আমি এখন বেশ ভালো একটা চাকরিও করছি। আমাকে শুধু একটি সুযোগ দিন। আপনাদের মেয়েকে আমি মাথায় তুলে রাখব। পৃথিবীর কোনো কষ্ট ওকে ছুঁতে পর্যন্ত পারবে না। সবকিছুর সামনে আমি কাব্য ঢাল হয়ে দাঁড়াব। একবার তো বোনকে হারিয়েছেন, এবার অন্তত একটু বুঝুন। নিজেদের আদরের বোনকে হারিয়ে নিশ্চয়ই আপনারাও ভালো নেই। আপনাদের বোনও কখনোই ভালো ছিল না। আপনারা কি জানেন, আপনাদের বোন পরিবার থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। তার ভুলের শাস্তি কি এত বেশি হওয়াও উচিত? আর আমরাও তো কোনো ভুল করিনি। তবে আমাদেরকে মেনে নিবেন না কেন?”

কাব্যের কথায় সবাই চমকে উঠলেন। একমাত্র বোনকে হারানোর কষ্টও সবাই নতুন করে অনুভব করছেন। আবার সেই বোনের এমন পরিণতির কথা শুনছেন। বাবা হঠাৎ পাশে থাকা সোফায় বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে এরপর দৃষ্টি দিলেন আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে নানান চিন্তা আর কস্টের ছাপ আছে। আমি এই দৃষ্টি দেখে নিজেকে আটকাতে পারলাম না। দৃষ্টি সরিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিলাম। বাবা হয়তো আমার না বলা কথাটুকু বুঝলেন।

“তোমার বাবা-মাকে ডাকো। কোন সংসার থেকে এসেছো সেটাও তো জানা জরুরি। আর নয়ন.. নয়ন কোথায়?”

বাবার কথা শুনে সবাই বাবার দিকে তাকান। চাচাদের মুখেও সন্তুষ্টির ছাপ দেখা যাচ্ছে, হয়তো তারাও এমনটাই চাচ্ছিলেন। তারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কাব্যের দিকে তাকান। কিন্তু মুহূর্তেই একটি গলা ভেসে আসলো দরজার ওপাশ থেকে।

“সংসার নিয়ে কোনো অসন্তুষ্টি থাকবে না। আশা করছি, বড়ভাইজানের তার বোনের সাজানো সংসারের উপর পূর্ণ আস্থা আছে।”

একটি দৃঢ় কণ্ঠে সবাই দরজার দিকে তাকালেন। মুহূর্তেই সবার চোখে-মুখে চমকের ঝিলিক দেখা গেল। কারণ দরজায় তো আর কেও নয়, স্বয়ং সুরুজ মির্জা দাঁড়িয়ে। যিনি ত্রিশ বছর আগে এই বাড়িতে এসেছিলেন। এবাড়ির মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। সবাই অবাক চোখে কাব্যের দিকে তাকান। কাব্য সবার চাহনীর উত্তর দিতে বলে উঠেন,

“হ্যাঁ, আমি নয়নতারা খান আর সুরুজ মির্জার সন্তান কাব্য মির্জা।”

এটুকু শোনার সাথেই আমি বাবা-চাচাদের নজর পরিবর্তন হতে দেখলাম। তারা দরজার ওপাশে নজর দিয়েছেন। বাবার চোখ ছলছল করতে লাগল। আমি বুঝলাম কাউকে দীর্ঘদিন ধরে এক নজর দেখার আকাঙ্খা তার চোখে ফুটে উটেছে। কাব্যও হয়তো বুঝল। তাই উত্তর দিতেই বললেন,

” মা বছর পাঁচেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। হয়তো খুব তীব্র অভিমান নিয়েই পৃথিবী ছেড়েছেন। তাইতো তার মৃত্যুর খবর আপনাদের জানাতে বারণ করে গেছিলেন।”

———————————————–

আজ আমাদের সপ্তম বিবাহবার্ষিকী। বেশ ভোরে উঠেই আমি সব গুছিয়ে নিয়েছি। আমরা আজ ঘুরতে যাব। বিছানার দিকে তাকাতেই এক সুদর্শন পুরুষকে নজরে পড়ল। এক হাত উপরে উঠিয়ে চোখের উপর রেখে সোজা হয়ে ঘুমাচ্ছেন। উঁহু, এই সুদর্শন পুরুষটি আমার স্বামী! আর তার পাশেই একই ভঙ্গিতে, হাত চোখের উপর রেখে ঘুমিয়ে আছে আমার রাজপুত্র, “নিহান”। বাপ-ছেলে সবকিছুতে এক রকম।

আমি আমার সব কাজ গুছিয়ে নিচ্ছি। হঠাৎ পিছন থেকে দুটি হাত আমার গলা জড়িয়ে নিল। তারপর ধীরে ধীরে আমার কোমরেও দুটি হাতের অস্তিত্ব টের পেলাম। এরপরের ঘটনাটুকু আমার জানা। প্রথমে ছেলে দুই হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে কপালে একটা চুমু দিবে। আর তারপরে তার বাপ দিবে। প্রতিদিন সকালেরই নিত্য ঘটনা।

” মাম্মাম, আমরা আজকে কোথায় ঘুরতে যাব?”

আমি ছেলের কথা শুনে একটু হাসলাম। এরপর ঘাড় ঘুরিয়ে কাব্যের দিকে তাকালাম। কাব্যও আমার সাথে তালমিলিয়ে হালকা করে হাসলেন।

“ওহহো মাম্মাম, আমি বলি। আজ তোমাদের বিবাহবার্ষিকী। তাই আমরা কোথাও ঘুরতে যাব, আর সেখানে ট্রেনে করে যাব। কিন্তু মাম্মাম, আমরা ট্রেনেই যাব কেন?”

কাব্য এবার নিহানকে কোলে তুলে নিলেন। ওর কপালে একটা চুমু এঁকে আমাকে তার কাছে টেনে নিলেন। তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“কারণ আমাদের.. একদিন দেখা হয়েছিল! এক পড়ন্ত বিকেলে কোনো এক ট্রেনের কামরায়।”

(সমাপ্ত)