#মায়াবতী
#পর্ব_২
#SF_Tabassum
স্নিগ্ধার ফোন রাখতেই রাহার ফোন আসলো। আমি লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে রিসিভ করলাম। ভাগ্যিস একটু আগে ফোন দেয় নাই। ওয়েটিং পেলেই আমাকে রিমান্ডে নিতো। অনেকক্ষণ রাহার সাথে কথা বললাম।
তবুও মনের ভিতরের অস্থিরতা কেন যেন কমছে না। আমার চোখের সামনে শুধু স্নিগ্ধার সেই দরদ মাখা মুখটা ভেসে উঠছে। কিন্তু আমি কেন ভাবছি? আমি তো ওকে নিয়ে ভাবতে চাই না। আমার সাথে কি হচ্ছে কছুই বুঝতে পারছি না।
উঠে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। পুরো শহর যেন নিস্তব্ধতায় ছেঁয়ে গেছে। দূর থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আমার কোন কালেই ছিলো না। শুনেছি নিকোটিনের ধোয়ায় নাকি সব ক্লান্তি, অস্থিরতা দূর হয়ে যায়। একবার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এর স্বাদ নিয়েছিলাম। এক টান দিতেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। ওইদিনের পর থেকে সিগারেটের সাথে সাথে সেই বন্ধুদের সঙ্গও ত্যাগ করেছিলাম।
।
-কিরে এতো সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস?
-ওহ মা সরি! তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। নতুন একটা টিউশন পেয়েছি সেখানেই যাচ্ছি।
-তোকে কতবার বলেছি এসব টিউশন ছাড়। আমি এখনো বেঁচে আছি। তোকে চালানোর মতো ক্ষমতা আমার আছে।
-তুমি আর কতদিন কষ্ট করবে মা? এখন সময় এসেছে আমার দায়িত্ব নেয়ার। আর যাদের মাথার উপরে বাবার ছায়া নেই, তাদের জীবনে স্ট্রাগলের শেষ নেই।
মুনতাহা |
-উফফফ মা! তুমি কথায় কথায় এতো ইমোশনাল হয়ে যাও কেন বলো তো?
মুনতাহা আঁচলে চোখ মুছলো।
-আচ্ছা মা আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি গেলাম।
-আরে খেয়ে তো যা। এভাবে খালি মুখে যেতে হয় না।
মুনতাহা পিছন থেকে ডেকে বলে।
-সময় নেই মা। বাহিরে খেয়ে নিবো। আল্লাহ হাফেজ।
মুনতাহাকে একবার জড়িয়ে ধরে এক ছুটে বেড়িয়ে গেলো।
।
বিকাল পাঁচটায় অফিস শেষ করে বেড় হলাম। আজকে প্রচুর কাজের চাপ ছিলো। এখন উদ্দেশ্য টং এর চা। এই মুহুর্তে এক কাপ চায়ের ভীষণ প্রয়োজন অনুভব করছি।
চা খেতে খেতে হঠাৎ এক দৃশ্য দেখে চোখ আটকে যায়। রাস্তার ধারে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে খেলছে একটি মেয়ে। কি সুন্দর সেই দৃশ্য। দেখেই বোঝা যায় এরা সবাই পথশিশু। একটু ভালো করে তাকাতেই দেখলাম মেয়েটা আর কেউ নয় স্নিগ্ধা। বাচ্চাদের সাথে কি সুন্দর করে হাসছে। আমি এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে আছি। কে বলবে এই মেয়ের মনে এতো কষ্ট লুকিয়ে আছে। চট করে ফোন থেকে এই দৃশ্যটি ক্যাপচার করে নিলাম।
আমার চা একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বিল মিটিয়ে ওই দিকে অগ্রসর হই। কিন্তু আমি যাওয়ার আগেই স্নিগ্ধা রিকশায় উঠে চলে যায়। বাচ্চাগুলো স্নিগ্ধার প্রশংসায় ভাসছে। জানি না কেন তবে মনে মনে এক অন্যরকম ভাল লাগা কাজ করছিলো।
.
রাতে বিছানায় শুয়ে ছবিটা দেখছিলাম। তখনই খেয়াল আসে, দেখিতো স্নিগ্ধার ওই নাম্বারে হোয়াটসঅ্যাপ আছে কিনা। আর পেয়েও গেলাম। আমি ছবি সেন্ড করে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ঠিক দুই মিনিট পরেই কল আসলো।
‘আপনি কোথায় পেলেন এই ছবি?’
‘সেটা জানা কি খুবই জরুরি?’
‘খুব জরুরি না হলেও জরুরি তো বটে।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বী… এখন বলেন কোথায় পেলেন এই ছবি?
‘রাস্তার ধারে।’
‘মানে??’
‘হ্যা.. রাস্তার ধারেই পেয়েছি।’
‘আপনি ওখানে ছিলেন তাই না?’
‘হা হা হা’
‘হাসছেন কেন আপনি? আমি কি হাসির কিছু বলেছি?’
‘নাহ কিছু না।’
‘আপনার অফিস তো ওখানেই তাই না?’
‘বাহ! আমার সম্পর্কে তো ভালোই খোঁজ খবর নিয়েছেন দেখছি।’
‘আপনার বায়োতে অফিসের নাম লেখা ছিলো। আর ওই অফিস তো ওখানেই।’
‘আপনি তো খুব ইন্টেলিজেন্ট!’
‘ব্যঙ্গ করছেন আমাকে?’
‘এই না না সেই সাহস কি আমার আছে!’
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দিলাম। আমি কেন স্নিগ্ধার সাথে এতো কথা বলছি নিজেও জানিনা। তবে ওর সাথে কথা বললে এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে।
.
এখন রোজই স্নিগ্ধার সাথে কথা হয়। বলতে গেলে ওর সাথে কথা না বললে আমার ঘুম হয় না। রাহার সাথে কথা বললে আমার ভালো লাগে। কিন্তু স্নিগ্ধার সাথে কথা বললে শান্তি অনুভব হয়। আমি দেখা করতে চাইলে ও রাজি হয়ে যায়।
আমরা লেকের পাড়ে বসে আছি। আজ স্নিগ্ধা খোলা চুলে এসেছে। বাতাসে চুলগুলো উড়ে বার বার ওর মুখে পড়ছিলো। নিজ হাতে ওর উড়ন্ত চুল সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।
আমি ঝালমুড়ি নিয়ে আসি। দুজনে অনেকক্ষণ গল্প করি। মেয়েটা কথায় কথায় খিলখিল করে হাসে। হাসলে তাকে অপূর্ব লাগে। আমি মুগ্ধ নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকি। সন্ধ্যা হয়ে আসলে স্নিগ্ধাকে ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমিও চলে আসি।
।
স্নিগ্ধা মায়ের জন্য কয়েকটা শাড়ি কিনতে এসেছে। প্রয়োজন ছাড়া সে কখনো নিজের জন্য কিছুই কিনবে না। তার সবটুকু চিন্তা শুধু স্নিগ্ধাকে নিয়েই। মুনতাহার শাড়ি গুলো অনেকটা পুরোনো হয়ে গিয়েছে। তারপরও সেই শাড়ি পরেই নির্দ্বিধায় স্কুলে যায়। তাই তো আজ স্নিগ্ধা নিজে মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে এসেছে। ওহ হ্যাঁ মুনতাহা একজন স্কুল শিক্ষিকা।
শাড়ির দোকান থেকে বেড় হতেই অন্য দোকানে চোখ যায়। সেখানে কাউকে দেখতেই ওর দুটো চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। স্নিগ্ধার বাবা আনোয়ার হোসেন তার অন্য ছেলে মেয়েদের নিয়ে শপিং করছেন। কত হাসিখুশি সে তাদের সাথে। তার যে আরও একটি সন্তান আছে সেই ব্যাপারে তার কি খেয়াল আছে? সে কি জানে স্নিগ্ধা একটুখানি বাবার আদর পাওয়ার জন্য কতটা ছটফট করছে? স্নিগ্ধার খুব ইচ্ছে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার।
ধীর পায়ে সেদিকে যেতে থাকে স্নিগ্ধা। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে ব্যাগগুলো পড়ে যায় হাত থেকে।
-হেই ইউ.. অন্ধ নাকি চোখে দেখতে পাও না?
আনোয়ার হোসেন মেয়েকে থামিয়ে দূরে সড়িয়ে দিলেন।
-আহহা, মামুণি এভাবে কাউকে বলতে হয় না।
স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বলে,
-কিছু মনে করো না মা। ছোট মানুষ তো তাই কি বলতে কি বলে ফেলেছে।
-না-না ইটস ওকে আমি কিছু মনে করি নি বা.. আঙ্কেল।
বাবা বলতেও গিয়েও আঙ্কেল বললো।
স্নিগ্ধা ব্যাগ গুলো তুলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে নিজেকে সামলাতে পারতো না। আনোয়ার হোসেনের মনে স্নিগ্ধার জন্য কেমন একটা টান অনুভব হয়। মনে হচ্ছে যেন খুব কাছের কেউ। কত মায়াবী, সরল সেই চেহারা। মেয়ের ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসেন তিনি।
।
আজ স্নিগ্ধা কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে আছে। অন্যদিনের মতো উচ্ছ্বাস নেই মনে। কিছু বললে তার হু হা জবাব দেয় শুধু। বুঝতে পারলাম কিছু হয়েছে। কয়েকবার জিজ্ঞেস করতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমি ঘাবড়ে গেলাম কিছুটা। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো
-স্নিগ্ধা! কি হয়েছে?
–
-কি হয়েছে আমাকে বলো।
কয়েকবার জিজ্ঞেস করতেই জবাব আসলো।
-আচ্ছা… আমার বাবার কি একবারের জন্যও আমার কথা মনে পড়ে না? তার কি ইচ্ছে হয় না আমাকে দেখার? আচ্ছা আমি কি দেখতে খুবই খারাপ বলুন না?
আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। একজন সন্তানের জীবনে তার বাবার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা আমি খুব ভালো করেই জানি। আমার যখন দশ বছর বয়স তখন আমার বাবা পরোপারে পাড়ি জমান। কিন্তু বাবা থেকেও না থাকার কষ্টটা সহ্য করা যায় না।
বহু কষ্টে স্নিগ্ধাকে শান্ত করলাম। অনেক রাত পর্যন্ত কথা হলো আমাদের। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর মুখে একটুখানি হাসি ফুটলো।
ফোন রেখে ঘরজুড়ে পায়চারি করছি। কেমন যেন অস্থিরতা অনুভব করছি। আমি কি স্নিগ্ধার প্রতি এটাচ হয়ে যাচ্ছি? না না এটা হতে পারে না। আমি তো রাহাকে ভালবাসি। আমি ওকে ঠকাতে পারবো না। কি যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মাথা কাজ করছে না। রাহার সাথে এই বিষয়ে কথা বলা দরকার।
চলবে??