তারপর একদিন পর্ব-০১

0
1

#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
সূচনা পর্ব

“পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি কী এসএসসি ফেইল, গ্রামের অশিক্ষিত একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য?”

“তোর মন, তুই ভালো বুঝবি! আমি কি জানি?”

“চুপ শ্লা! বিয়ে ভাঙার বুদ্ধি দিতে না পারলে একদম চুপ থাকবি।”

বন্ধুকে ধমকেই উঠল নির্ঝর। এদিকে নির্ঝরের ধমক’কে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে গা ঝাড়া ভাব নিয়ে খাটে বসল ওর বন্ধু শুভ। বলল, “এমন তেজ যদি নিজের বাপের সামনে দেখাতে পারতি, তবেই আর আমাকে বিয়ে ভাঙার বুদ্ধি দিতে হতো না।”

ছোট ছোট চোখে বন্ধুুর দিকে তাকাল নির্ঝর। তেজ দেখিয়ে বলল, “তোর কি মনে হয়, বাবা সিদ্ধান্ত নিবে, আর আমি ওই খ্যাত মেয়েকে বিয়ে করব? আমার একটা স্টাটাস আছে না!”

“ওহ্! তারমানে তোর বাপের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবি। এত সাহস আছে তোর!”

খানিকটা অবাক স্বরে বলল শুভ। নির্ঝর তাতে খ্যাক করে উঠল। ধমকে উঠে বলল, “কেন? বাবাকে কি আমি ভয় পাই? ভয় পাই বাবাকে? বিয়ে আমার! আমার সিদ্ধান্ত’ই শেষ সিদ্ধান্ত!”

“কিসের সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা হচ্ছে?”

হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠস্বরে থেমে গেল ওরা দু’জন। নির্ঝর কিঞ্চিৎ চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল। দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন এহসান তালুকদার। নির্ঝরের বাবা। কিছুটা ভয় পেল ছেলেটা। বাবা কিছু শুনে ফেলেনি তো? সংশয় নিয়ে নিজের সাফাই দিতে নির্ঝর আস্তে করে বলল, “আসলে বাবা, বিয়ের কেনা-কাটা করার কথা বলছিলাম। একটা প্রস্তুতি আছে না।”

“ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি শুধু যাবে, কবুল বলবে, ব্যাস!”

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো নির্ঝর। বন্ধুর মিইয়ে যাওয়া দেখে মুখ চেপে হাসল শুভ। ও জানত, এমন কিছুই হবে। এহসান তালুকদার চলে যাবার উদ্যোগ নিতেই জোরে করে বলে উঠল, “আঙ্কেল, মেনুতে কিন্তু রোস্ট থাকা চাই। বন্ধুর বিয়ে বলে কথা, কবজি ডুবিয়ে না খেলে হবে!”

কথাটা শুনলেও প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না, চলে গেলেন তিনি। এদিকে শুভর কথায় ফের ক্ষিপ্ত নির্ঝর, “শ্লা! আমার বিয়ে ভাঙতে এসেছিস, নাকি খেতে? রোস্ট থাকা চাই, না…!”

মারার উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যেতেই দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল শুভ। এদিকে প্রচন্ড রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল নির্ঝর। রাগটা ওর নিজের উপর, কেন আসতে গেল গ্রামে? বাবাকে যে ওকে বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা হিসেবে পরিয়ে দেবে, তা জানলে কি আর এ-মুখো হতো? উঁহু! কখনো না।

নির্ঝরের বেড়ে ওঠা ধুলোমাখা এই গ্রামে হলেও বসবাস তার এখন শহরেই। পড়াশোনার জন্য অল্প বয়সেই শহরে যায় ও, এরপর আর গ্রামের মুখো হয় নি। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বড়সড় এক ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করছে। অনেক বড় বড় লোকজনের সাথে ওঠা বসা ওর।
হঠাৎ দাদীর অসুস্থতার খবর দিয়ে ওকে গ্রামে আসতে বলেন এহসান তালুকদার। এরপর মৃত্যুশয্যা দাদী নাতির হাত ধরে নিজের শেষ ইচ্ছের কথা জানান—একমাত্র নাতির বিয়ে দেখেই ম’রতে চান। দাদীর আবদারেই বাবা ওকে বিয়ের কথা জানান। মতামত চান না, নির্ঝরের বিয়ে ঠিক করেছেন—সেটাই সরাসরি বলেন।

বাবার মুখের উপর ‘রা’ করার সাহস নেই নির্ঝরের। একমাত্র ছেলে হলেও বাবার কড়া শাসন ও বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ওর। এজন্য ছোট বেলা থেকেই বাবার প্রতি ভীতি কাজ করে, কথাগুলো একবাক্যে মেনে নেয়।
নিজের বিয়ের মতো এত বড় সিদ্ধান্ত বাবার কথায় মেনে নিলেও মনে মনে রাগ হয় ওর। বিয়ে করতে আপত্তি নেই নির্ঝরের। তাই বলে গ্রামের একটা খ্যাত মেয়েকে? সাথে আবার এসএসসি ফেইলও!

মেয়েটাকে বিয়ের জন্য ঠিক করেছে নির্ঝরের দাদী। ওনার দূরসম্পর্কের নাতনি হয়। মা বাবা নেই। বড্ড কঠিন অবস্থায় চাচা চাচীর কাছে মানুষ হয়েছে মেয়েটা। তাদের সাথেই বাধ্য হয়ে মৃত্যুশয্যা দাদীকে দেখতে এসেছিল। তখনই নিজের একমাত্র নাতির জন্য পছন্দ করে ফেলে মেয়েটাকে, মরার আগে বিয়েটা দেখে যেতে চান। মা বলতে প্রাণ এহসান তালুকদারও আর সময় নষ্ট করলেন না। সাথে সাথেই তোড়জোড় শুরু করে দিলেন বিয়ের জন্য।

মেয়েটাকে এক নজর দেখেছে নির্ঝর। দাদীর পছন্দের পর মেয়েটাকে আর যেতে দেন নি এহসান তালুকদার, এ বাড়িতেই রেখেছেন। তালুকদার বাড়ির টানা বারান্দা, দাদীর ঘরের সামনে বারান্দায় কতগুলো মানুষের সাথে বসে ছিল মেয়েটা। তখনই শুভ মেয়েটিকে দেখিয়ে ওকে বলেছিল, “ওই দ্যাখ, তোর হবু বউ!”

প্রথমবারের মতো মেয়েটাকে দেখে দ্বিতীয়বার আর তাকায় নি নির্ঝর। তাকাতে ইচ্ছেই করে নি। ধুলোমাখা পুরাতন এক শাড়ি মেয়েটার পড়নে, তেল দেওয়া চুলগুলো বেনি করা ফ্যাকাসে মুখখানা! এক নজর দেখেই তার তাকাতে ইচ্ছে করে নি। শহরের মর্ডান মেয়েদের সাথে ওঠাবসা ওর, এতকাল স্বপ্নও দেখে এসেছে কোন এক মর্ডান মেয়েকে বিয়ে করার। অথচ তার বিয়ে ঠিক হলো কি-না এমন একটা মেয়ের সাথে? নাহ্! আর ভাবতে পারছে না নির্ঝর। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। এক্ষুনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলে বোধহয় স্বস্তি পেত।

.
নির্ঝরের ভাবনাকে উপেক্ষা করে বিয়েটা হয়েই গেল। কবুল বলে, রেজিস্ট্রি খাতায় সাইন করে থম মেরে বসে রইল। নতুন বউকে বসানো হলো হলো ওর পাশে, গ্রামের মানুষগুলো একে একে এসে দোয়া করে গেল! তবুও হেলদোল করল না নির্ঝর।

এদিকে নির্ঝরের বিয়ের কয়েক ঘন্টা পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন দাদী। তালুকদার বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা অধিক হলো। সবাই ভীড় জমালো মৃত্যুশয্যা মানুষকে এক নজর দেখার জন্য। কেউ থাকল তো কেউ চলেও গেল। রাত তখন মধ্য প্রহর পেরিয়ে শেষ প্রহরে, তখনই নির্ঝরের দাদী পৃথিবী ছাড়লেন। তালুকদার বাড়ি শুদ্ধ লোকজন শোক করলেও নির্ঝরের রাগটা তিরতির করে বাড়তে থাকল, রাগ হলো দাদীর উপর। বিড়বিড়িয়ে গালি দিয়ে বলেও ফেলল, “মরবি যখন একদিন আগেই মর, বুড়ি! আমাকে বিয়েটা করতে হতো না। আমাকে আধমরা করে তবেই কেন মরতে হলো তোর?”

এখন আর কিছুই ওর হাতে নেই। তবে হ্যাঁ! গ্রাম ছাড়লে তবেই যেন ওর স্বস্তি। মনে মনে ভেবেই নিলো নির্ঝর—মেয়েটাকে এখানে রেখে একবার চলে যেতে পারলে আর এ-মুখো হবে না ও। এরপর নানান বাহানায় তালাকও দিয়ে দেবে।
কিন্তু, এহসান তালুকদার আরও একবার ছেলের ভাবনাকে বাস্তবতায় রুপ দিতে দিলেন না। দাদীর মৃত্যুর কয়েকদিন পর চাকরির অযুহাতে শহরে যেতে চাইলেই তিনি বললেন, “যাবে যখন বউকেও সাথে নিয়ে যাও। বিয়ে যখন করেছ, তখন দ্বায়িত্বও নিতে হবে।”

“তুমি তো জানো, আমি ব্যাচেলর বাসায় ভাড়া থাকি।”

বাহানা দিতে বলল নির্ঝর। কিন্তু এহসান তালুকদার দমে যাবার মানুষ নন। বললেন, “ছেড়ে দাও ওটা, নতুন বাসা নিয়ে বউকে নিয়ে উঠো। নিজের সংসার গুছিয়ে নাও।”

“কিন্তু বাবা, এত তাড়াতাড়ি ঢাকা শহরে তো বাসা পাওয়া সম্ভব নয়।”

“ভাত ফেললে যেমন কাকের অভাব হয় না, তেমনি টাকা ঢাললে বাসার অভাব হবে না। প্রতিমাসে বাড়িতে যে টাকা পাঠাতে, সেটা আর পাঠাতে হবে না। আরও যদি তোমার প্রয়োজন হয় আমাকে বলবে, আমি পাঠিয়ে দেবো।”

“কিন্তু বাবা, বাসা তো…”

“তোমার বন্ধুকে বলো, ভালো একটা বাসা খুঁজতে। বৌমাকে সাথে নিয়ে তবেই তুমি ঢাকায় ফিরবে।”

এক কথার মানুষ এহসান তালুকদার, বলেই চলে গেলেন। নির্ঝর নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই ঝামেলাকে যতই দূরে ঠেলতে চাইছে, ততই যেন তার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। শুভও চলেও গেছে ওর বিয়ের দিনেই। আর উপায় পেল না নির্ঝর, বাবার মুখের উপর কথা বলার সাহসও নেই ওর। বাধ্য হয়েই শুভকে কল দিলো, নতুন বাসার খোঁজ করার জন্য।

বন্ধু ভক্ত শুভ রাতের মধ্যেই এক বাসা ঠিক করে ফেলল। নির্ঝরকে নতুন বাসার ছবি পাঠিয়ে, কনফার্ম করতেও ভুলল না।
দু’দিন পর বাবার বাধ্যগত ছেলে হয়েই বউকে নিয়ে পারি দিতে হলো শহরে। চেনা শহরে এক অচেনা মেয়েকে নিয়ে। যে কি-না সম্পর্কে ওর বউ। বউ হলেও নামটাও জানত না নির্ঝর। সবার মুখে শুধু ডাকতে শুনেছে। আজ আসার সময়ও মেয়েটাকে ওর মা ডাকছিল—তারা বলে। ‘তারা’! মেয়েটার মতোই নামটাও নির্ঝরের কাছে খ্যাত মনে হচ্ছে। এই মেয়েটাকে এখন কিভাবে সহ্য করবে—তা ভেবেই যেন ওর মাথা ধরে যাচ্ছে। কিন্তু এই মুহুর্তে কোন কোন প্রতিক্রিয়াই করতে পারছে না নির্ঝর। ওর চোখের সামনে এখন কেবল ভার চাপানো এক বাস্তবতা।
.
.
চলবে কি..??