তারপর একদিন পর্ব-০২

0
1

#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০২
.
বিয়ে করা বউকে পাশে নিয়ে হাটতে ব্যাপক লজ্জা লাগছে নির্ঝরের। ওর মনে হচ্ছে, রাস্তার মানুষজন ওকে অদ্ভুত ভাবে দেখছে। দেখবে না-ই বা কেন! সুট বুট পরা ছেলের সাথে গ্রামের এক খ্যাত মেয়ে! পরনে তার হাফ হাতা ব্লাউজের সাথে লালখয়েরী রঙের সুতির শাড়ি, তেল দেওয়া বেণী করা চুলে ফ্যাকাসে মুখখানা। একহাতে তার ব্যাগ, অপর হাতে টিনের এক বাক্স। নির্ঝর ভুলেও যেগুলো হাতে নেবার চেষ্টা করে নি। বরং নিজের লাগেজ নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত হাটার চেষ্টা করছে। মেয়েটাও ওর সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে, একটু দৌড়ে ওর পাশে চলার চেষ্টা করছে। কিন্তু, নির্ঝর থামবে না বলে যেন পণ করে ফেলেছে। উপায় না পেয়ে মেয়েটা ওকে ডেকে উঠল, “শুনুন, একটু আস্তে হাটেন!”

শুনেও যেন শুনল না নির্ঝর। দু’হাতে ব্যাগ ও টিনের বাক্স নিয়ে মেয়েটা ফের একবার ছুটল, পাশ ধরার চেষ্টা করল। ভাবল—লোকটা বোধহয় ওকে শুনতে পাচ্ছে না। কিছু সম্মোধন করে না ডাকলে শোনার কথাও তো নয়। কি বলে ডাকবে, ফের ভাবতে গিয়েই মনে পড়ল—জি বাংলা, স্টার জলসার নাটকে অনেক দেখেছে, ওর মতো গ্রামের মেয়েদের শহুরে ছেলেদের সাথে বিয়ে শহরের বাবু! বলে ডাকে। ও’ই ও কি ডাকবে! কথাটা ভাবনায় রেখে ডেকেই ফেলল, “শহরের বাবু, আস্তে হাটেন।”

চট করে থেমে গেল নির্ঝর। মেয়েটার ওর সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। আশেপাশে একবার নজর ফিরিয়ে চাপা স্বরে নির্ঝর বলল, “সমস্যা কি? এসব কি নামে ডাকছ আমাকে?”

“আসলে, আপনি…”

“এই মেয়ে, গুণে গুণে আমার চেয়ে দশ কদম পিছনে হাটবে, একদম পাশাপাশি আসার চেষ্টা করবে না। তোমার মতো খ্যাত, গাঁইয়া মেয়েকে নিজের পাশে জাস্ট সহ্য করতে পারছি না।”

বলেই সামনে হাঁটার জন্য পা বাড়াল নির্ঝর। মেয়েটা তৎক্ষনাৎ ওকে ডেকে উঠল, “শহরের বাবু, শুনুন!”

থেমে গেল নির্ঝর, রাগ হলোও ওর। মাঝ রাস্তার পরোয়া না করে কিঞ্চিৎ চেঁচিয়েই উঠল এবার, “শ্যাট আপ! এসব উল্টাপাল্টা নামে একদম ডাকবে না আমাকে।”

নির্ঝরের ধমকে গুটিয়ে গেল মেয়েটা, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে ওর। নিজ গ্রামের বন্দী জীবন ছেড়ে শহরে পা রাখা এই প্রথম তার। পুরোটাই অচেনা এক মানুষের সাথে। যদিও এই মানুষটার সাথে ওর কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর সবাই ওকে বলেছে—এখন স্বামী’ই ওর সব, সবচেয়ে কাছের, আপন মানুষ! সে মানুষটা যদি জাহান্নামেও নিয়ে যায়, তবে সেখানেও ওর যেতে হবে। সেও চলে এসেছে। শহরের মাটিতে পা ফেলার পর থেকেই মানুষজন ওকে কিভাবে যেন দেখছে, ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। স্বামী নামক মানুষটার ধমকে এবার কান্নাও পাচ্ছে।

কান্না আটকে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল মেয়েটা। মাথা নিচু করেই মিনমিন করে সুধাল, “তাইলে কি বলে ডাকব?”

“ডাকবে না, কোন কিছু বলেই আমাকে ডাকবে না তুমি। গট ইট?”

শেষ কথাটা বুঝল না মেয়েটা, তবুও মাথা ঝাঁকাল। নির্ঝর বলল, “চাঁদ না তারা, কি নাম তোমার! এবার চলো। আর মনে থাকে যেন, গুণে গুণে দশ কদম পিছনে হাঁটবে আমার।”

“সিতারা! তারা নয় আমার নাম।”

সিতারার খুব খারাপ লাগে যখন ওকে কেউ তারা বলে ডাকে। অথচ তারা ছাড়া সিতারা নামে কেউ ওকে ডাকেই না। মা খুব শখ করে নাম রেখেছিল ওর ‘সিতারা জাহান’! মা, বাবাই এই নামে ডাকত ওকে। মা বাবা মারা যাবার পর সাথে সাথে নামটাও যেন বিলুপ্ত প্রায়, তারা নামটাই যেন গ্রামে ওর পরিচয় এখন।
নির্ঝর সিতারার কথা শুনল কি-না বোঝা গেল না। সে নিজের মতো করে হাটতে লাগল। মেয়েটাও আর দাঁড়াল না, ফের নির্ঝরের সাথে পাল্লা দিয়ে এগোতে থাকল।

.
বিশাল বড় এক বিল্ডিংয়ের সামনে সিএনজি থেকে নামতেই অবাক হয়ে তাকাল সিতারা। এতবড় বিল্ডিং সচক্ষে দেখার ভাগ্য হয় নি ওর। সিরিয়ালে দেখেছিল শুধু। এত বড় বড় বিল্ডিং যে বাস্তবে থাকতে পারে, সেটাই যেন জানা ছিল না ওর। মাথা উঁচিয়ে শুধু দেখতেই থাকল মেয়েটা।
নির্ঝর সিএনজি ভাড়া দিয়ে নিজের লাগেজ নিয়ে সামান্য এগিয়ে গেল। এরপর সিতারার কথা মনে পড়তেই দাঁড়িয়ে গেল। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে বলল, “এই মেয়ে, এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো!”

নির্ঝরের ডাকে মিষ্টি করে হাসল সিতারা। ঠোঁটে বিস্তার হাসি নিয়েই হাটতে লাগল। তবে মেয়েটার হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নির্ঝর লিফটের ভেতরে ঢুকে যখন ওকেও ভেতরে আসতে বলল, তখনই মেয়েটার হাসি মুখটা চুপসে গেল। কপালে ফের ভাজ ফেলে নির্ঝর বলল, “দাঁড়িয়ে আছ কেন? আসো!”

“এটা কি? যাব না আমি।”

“যাবে না মানে?”

“যাব না আমি এটার ভেতর। আমার ভয় করছে।”

বিরক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পেল নির্ঝরের। লিফটে উঠতে কেউ ভয় পায়? অথচ এই মেয়েটাকে দেখো, ভয়ে গুটিয়ে গেছে। বিরক্ত কণ্ঠেই বলে উঠল, “এটা লিফট! এটার ভেতরে আসলে তুমি মরে টরে যাবে না, যে ভয় পেতে হবে। আসো বলছি!”

“নাহ্! না, যদি আঁটকে যাই, আর বেরুতে না পারি, তখন? যাবো না আমি… ওই, ওই তো আঁটকে যাচ্ছে। বের হন আপনি, আহ্…”

লিফটের দরজা আটকে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল সিতারা। নির্ঝর চট করে দরজার মাঝে পা রাখল, দরজা খুলে গেল। চোখেমুখে একরাশ বিরক্তিতে তাকাল ভীতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সিতারার পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “এখানে দাঁড়িয়ে একদম সিনক্রিয়েট করবে না বলে দিলাম, আসো বলছি…”

বলেই মেয়েটার বাহু ধরে লিফটের ভেতরে টেনে নিয়ে আসল। সিতারা আরও একবার ‘আহ্’ বলে মৃদু আর্তনাদ করল। দু’হাতে থাকা ব্যাগ ও ট্রাংক হুর মুর করে নিচে পড়ল। নির্ঝর বলল, “একদম বাজে বকবে না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবে।”

বলেই লিফটের বাটন চাপল। দরজা বন্ধ হয়ে যখন ঝাঁকি হয়ে লিফট চলতে শুরু করল, তখন আরও একবার মৃদু আর্তনাদ করল সিতারা। ভয়ে নির্ঝরের হাতের বাহু চেপে ধরল। নির্ঝর কপাল কুঁচকে একবার তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।

নয় তালা বিল্ডিংয়ের ছয় তালায় এসে থামল লিফট। দরজা খুলে যেতেই হুর মুর করে বেড়িয়ে এলো সিতারা। বুকে থুতু দিয়ে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়াল। নির্ঝর কপালে ভাঁজ ফেলেই সেগুলো পর্যবেক্ষণ করল। তবে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে সিতারার ব্যাগ ও ট্যাংকটা হাতে নিয়ে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিলো। এরপর নিজের লাগেজ নিয়ে বেড়িয়ে এলো লিফট থেকে।
লিফট থেকে বেড়িয়ে বাম পাশে কয়েক কদম হাঁটলেই নির্ঝরের ফ্ল্যাট। দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে শুভ। এহসান তালুকদারের পাঠানো টাকায় খাট এনেছে, সাথে নির্ঝরের আগের বাসার টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র! সেগুলোই দু’টো লোক নিয়ে গোছাচ্ছিলো। বাকি জিনিসপত্র আসবে আগামীকাল। হঠাৎ নির্ঝর ও সিতারাকে দেখে এগিয়ে এলো শুভ। সিতারাকে দেখে লম্বা এক সালাম দিলো, “আসসালামু আলাইকুম! ভাবী। কেমন আছেন ভাবী?”

এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতে ভেতরে ঢুকছিল সিতারা। হঠাৎ সালাম শুনে হকচকিয়ে গেল। নিজের থেকে এত বড় একটা লোকের মুখে আপনি শুনে অস্বস্তি হলো। ধীর কণ্ঠে সালামের জবাব নিয়ে আস্তে করে বলল, “জি.. জি! ভালো আছি।”

“এখন আরও ভালো থাকবেন। নিজের ঘরে, নিজের বরের কাছে এসেছেন না! ভালো থাকবেন, কাউকে ভালো রাখবেন, এটাই তো চাই।”

বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসল শুভ। এদিকে নির্ঝর বেশ বুঝল, কথাটা ওকে খোঁচা দিয়েই বলেছে। কিছু না বললেও কটমট চাহনিতে নজর ফেলতে ভুলল না শুভর দিকে। শুভ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সিতারার হাতের ব্যাগগুলো টেনে নিয়ে বলল, “আরে ভাবী, এগুলো আমাকে দিন তো। আপনার হাত কি এগুলো তোলার জন্য? আপনার হাত হবে শুধুই আমার বন্ধুকে আদর করার জন্য।”

সিতারা বেশ লজ্জায় পেল। এদিকে নির্ঝর শুভকে এক ধমক দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। শুভ যেন পরোয়া করল না ওর ধমককে। সিতারাকে উদ্দেশ্য করে ফের বলল, “জার্নি করেছে তো, আমার বন্ধুর মাথা তাই একটু গরম হয়েছে। আপনি আদর করে মাথায় একটু পানি ঢালুন.. থুক্কু, পানি খাওয়ান, দেখবেন ঠান্ডা হয়ে গেছে।”
.
.
চলবে….