#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৩
.
শুভ চলে গেল মোটামুটি থাকার মতো ব্যাবস্থাটা করেই, সাথে দু’জন লোকও। ওরা চলে যেতেই সিতারা কাজে লেগে গেল। দক্ষ হাতে সবকিছু গুছিয়ে, ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কারও করে ফেলল বাসাটা। সন্ধ্যা রাত হয়ে গেছে ততক্ষণে। সিতারা গুটিগুটি পায়ে রুমে এলো, ল্যাপটপ নিয়ে খাটে বসে থাকা নির্ঝরের সামনে দাঁড়িয়ে আস্তে করে সুধাল, “রান্না কি করব?”
ল্যাপটপে ব্যস্ত থাকা নির্ঝর শুনতে পায় না। সিতারা ফের ডেকে বলল, “এই যে, শুনছেন!”
“কি সমস্যা?”
মাথা তুলে ডাকায় নির্ঝর, কপালে ভাঁজ ফেলে বলে। একই কথা দু’বার বলার কিঞ্চিৎ বিরক্তই হলো সিতারা, “বলছি, রান্না কি করব?”
চুলা থাকলেও বাসায় রান্না করার মতো কিছুই নেই, তা ভুলেই বসেছিল নির্ঝর। সিতারা বলায় মনে পড়ল, তবে জবাব না দিলো না ও। ল্যাপটপ রেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, এরপর নিজের মোবাইল ও ওয়ালেট নিয়ে ছোট করে বলল, “আমি আসছি!”
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“তোমার মুখে অন্ন তুলে দেবার জেগার করতে।”
সিতারার অপমানবোধ লাগল কথাটায়, মুখখানা ছোট করে মাথা নিচু করে ফেলল। মানুষটা কেমন যেন! বিয়ে হয়েছে ওদের কয়েকদিন হলো। এই কয়েকদিনে ওদের কথা হয়েছে সীমিত! গুণে গুণে মাত্র কয়েকবার। হঠাৎই ওদের বিয়ে, বিয়ের দিনেই দাদী মারা যাওয়ায় ওদের দূরত্বও ছিল অনেক। গ্রামে কাটানো ওই ক’দিন দু’জনই ছিল নিজেদের মতো আলাদা। তবে শ্বাশুড়ীর কথায় বাধ্য হয়েই নির্ঝরের কাছে ওর যেতে হয়েছিল! কি লাগবে, না লাগবে তা জানতে। যখনই মেয়েটা নির্ঝরের সাথে কথা বলতে গেছে, তখনই এমন খোঁচা দেওয়া কথা শুনতে হয়েছে ওকে।
নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইল সিতারা। নির্ঝর খুব একটা গুরুত্ব দিলো না, সে বেড়িয়ে গেল রুম ছেড়ে। সিতারাও ওর পিছনে এলো। নির্ঝর ডাইনিং রুম পেরিয়ে দরজার কাছে আসতেই থেমে গেল। পিছন ফিরে সিতারাকে উদ্দেশ্য করে হঠাৎই বলে উঠল, “একা থাকতে পারবে?”
চমকে উঠল সিতারা। মানুষটার মুখে এ-কথাটা যেন আশাই করে নি ও। অবাক হয়ে জবাব দিতেও ভুলে গেল। নির্ঝর এবার কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠে বলল, “এ্যাই মেয়ে, কি সমস্যা?”
“নাহ্! মানে আমি, পারব.. নাহ্! না.. ভয় লাগবে, কারেন্ট গেলে আমি…”
ধমক খেয়ে কি বলল নিজেই যেন বুঝতে পারল না সিতারা। নির্ঝরের বিরক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পেল। ফের একবার ধমকে উঠে মেয়েটাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “দ্যাখো মেয়ে, আমার সাথে একদম ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলবে না। তুমি…”
“আসলে আমি.. অন্ধকারে ভয় পাই। কারেন্ট চলে গেলে?”
বিরক্ত হওয়া নির্ঝরের এবার হাসি পেল সিতারার বোকার মতো প্রশ্ন করায়। তবে দমিয়ে রাখল নিজেকে৷ গ্রামের মতো শহরে খুব একটা কারেন্ট যায় না। আর গেলেও এত বিল্ডিংয়ে নিশ্চয়ই জেনারেটরের ব্যাবস্থা আছে।
কিছু না বলে পকেট থেকে নিজের মোবাইল বের করল নির্ঝর, সিতারার দিকে বারিয়ে দিয়ে, “এটা তোমার কাছে রাখো, সমস্যা হলে…”
“লাগবে না, আমার কাছে আছে।”
“আছে মানে? কি আছে?”
“মোবাইল আছে।”
বলেই ডাইনিং রুমের এক কোনায় ফেলে রাখা নিজের ব্যাগের দিকে এগিয়ে এলো সিতারা। এরপর চেইন খুলে একটা বাটন মোবাইল বের করে এগিয়ে এলো নির্ঝরের কাছে। ওর দিকে বারিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি বরং এটাতে আপনার নাম্বার টুকে দিন।”
নির্ঝর অবাক হলো। সুধাল, “তোমার কাছে ফোনও আছে?”
“নাহ্! এটা তো আব্বা দিয়েছে।”
“আব্বা মানে? তোমার বাবা তো..!”
“আপনার আব্বা দিয়েছে শহরে আসার সময়।”
নির্ঝরের অবাকের মাত্রা বৃদ্ধি পেল। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে সুধাল, “বাবা দিয়েছে মানে? আমার কাছে তো ফোন আছেই, তাহলে তোমাকে কেন ফোন দিয়েছে!”
“তা তো জানি না। কিন্তু এটা দিয়ে বলল—আপনি যদি আমাকে কিছু বলেন, বকাবকি করেন, তবে যেন আব্বাকে ফোন দিয়ে জানায়।”
শুকনো ঢোক গিলল নির্ঝর। তার বাবা যে পিছনে পিছনে এতকিছু ভেবে রেখেছেন, তা ভেবেই অসহায়ত্ববোধ করল। ওকে কিছু না জানিয়ে ওর বিরুদ্ধে নালিশ করার জন্য ফোনও দিয়ে দিলো মেয়েটাকে? আর, এই মেয়েটাও ধেই ধেই করে তা নিয়ে এলো! নাহ্! ওকে ঠিক বিশ্বাস করা যাবে না। কখন জানি বাবাকে ফোন করে ওর বিরুদ্ধে নালিশ করে ফেলে।
নির্ঝর আর কথা না বাড়িয়ে সিতারার মোবাইলে নিজের নাম্বার তুলে দিলো। এরপর মেয়েটাকে ভালোভাবে দরজা আটকে দিতে বলে বেড়িয়ে গেল নির্ঝর খাবার আনতে।
.
পরেরদিন নির্ঝরদের ফ্ল্যাট সাজাতে সমস্ত জিনিসপত্র আনা হলো। সকাল থেকে সবকিছু একে একে গোছানোও হলো। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হবার লগ্নে হালকা পাতলা জিনিসপত্রে পুরো বাসাটা সাজানো হলো। দুই রুমের ছোটখাটো এক বাসা। মাঝামাঝি সাইজের দুটো রুম, রুমের মতোই মাঝারি সাইজের ডাইনিং রুম। ডাইনিং রুমের সাথেই ছোটখাটো এক গ্যেস্ট রুমের মতো খোলামেলা এক রুম। যেটায় সোফা রেখে ডাইনিং রুম হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছে।
সিতারা পুরো বাসাটা ঝাড়ু দিয়ে মুছেও ফেলল। এরপর ডাইনিং রুমে বসে থাকা নির্ঝর ও শুভর সামনে এলো। বাসার কাজ শেষ হলে, গোছল সেড়ে সোফায় বসে টিভি দেখছিল ওরা দু’জন। সিতারা শুভকে উদ্দেশ্য করেই সুধাল, “ভাইয়া, কি খাবেন?”
আজ সারাটাদিনে শুভর সঙ্গে বেশ ভালোই কথাবার্তা হয়েছে সিতারার। ছেলেটা বেশ রশিক মানুষ, আর সিতারাও কথা বলতে খুব ভালোবাসে। সারাদিন এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে বলতে ওদের মাঝে খুব ভালো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সহজ হয়ে উঠেছে। তাই ওকেই জিজ্ঞেস করল। শুভ অবাকের সুর তুলে বলল, “আরে ভাবী, আপনি রান্নাও জানেন?”
সিতারা মাথা নাড়িয়ে বলে, “ওইত, একটু আধটু!”
“তাহলে তো আপনার হাতের রান্না খাওয়া আমার সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু সমস্যা একটাই, আমার বন্ধু আমাকে মারবে।”
“মারবে মানে?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল সিতারা। নির্ঝরও কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল। শুভ ওর দিকে একবার নজর ফিরিয়ে সিতারাকে বলল, “নাহ্! মানে, রান্না করতে গিয়ে আপনার হাত পুড়ে টুড়ে গেলে আমার বন্ধু আমাকে আস্ত রাখবে বলে মনে নয়? বেচারা আপনার হাতটাই আজ পর্যন্ত ধরতে পারল না..!”
“শুভ, চুপ করবি!”
কিঞ্চিৎ ধমক দিয়ে বলল নির্ঝর। এদিকে সিতারা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বেচারা, কি রান্না করবে—তা জিজ্ঞেস করতে এসেও বিপাকে পড়ল। আস্তে করে বলল, “আমার অভ্যাস আছে।”
“তুমি বরং খিচুড়ি রান্না করো। রাতে বেশিকিছু করতে হবে না।”
চট করে বলে উঠল নির্ঝর। সিতারা আর দাঁড়াতে চাইল না, চলে গেল সেখান থেকে।
.
প্রথমবারের মতো সিতারার হাতের রান্না খেয়ে বেশ অবাক হলো নির্ঝর। মেয়েটার হাতের রান্না এত দারুণ হবে, তা ভাবতেও পারে নি। সকালেও বাইরে থেকে খাবার এনেছিল নির্ঝর, সেটাই দুপুর পর্যন্ত চালিয়েছে। রাতেই প্রথম মেয়েটার হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগ হলো। খিচুড়ি, বেগুন ভাজি ও ডিম ভাজি! বরাবরই নির্ঝরের পছন্দের খাবার। পছন্দের খাবারটা যেন আরও মজার হয়ে উঠল ওর কাছে।
খেতে খেতে আচমকাই সিতারার পানে তাকাল। প্রথম দেখা সেই ফ্যাকাসে মুখের সিতারাকে আজ বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। গোছলের পর তেল ওয়ালা ভেজা চুলগুলোও কেমন যেন সুন্দর লাগছে। ফর্সা মুখখানায় জ্বলজ্বল করা নাকফুলে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে! ফর্সা! কথাটা ভাবনায় আসতেই কিঞ্চিৎ অবাক হলো নির্ঝর। হ্যাঁ! গত কয়েকদিনের চেয়ে আজকে অত্যাধিক ফর্সা লাগছে সিতারাকে। কিন্তু কিভাবে? না-কি মেয়েটা আগে থেকেই এমন ন্যাচারাল ফর্সা ছিল, শুধু সে-ই খেয়াল করে নি?
.
খাওয়া দাওয়ার পরই শুভ চলে গেল। এরপর থাকা নিয়ে হলে বিপত্তি। নির্ঝর সিতারাকে সরাসরি বলল—অন্য রুমে থাকতে। কিন্তু সিতারা রাজি হতে চাইল না। সে একা থাকতে পারে না, সেই সাথে অন্ধকারে ভয় পায়। নির্ঝর বিরক্ত হয়েই বলল, “এ্যাই মেয়ে, কি সমস্যা তোমার?”
“একা থাকতে ভয় করে আমার।”
“দু’দিন থাকো, ঠিক অভ্যাস হয়ে যাবে।”
সিতারা মাথা নাড়িয়ে বলে, “উঁহু! হবে না। তাছাড়া কাল রাতে তো এক ঘরেই ছিলাম।”
“কাল ওই রুমের খাট, বিছানা কিছুই ঠিক ছিল না। তুমি…”
“আপনি এমন করবেন না, আমার বড্ড ভয় লাগে। আপনাকে আমি একটুও বিরক্ত করব না, তিন সত্যি!”
ছলছল চোখে তাকায় সিতারা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা হলো নির্ঝরের, বারণ করার ক্ষমতা হারাল। খুব বেশিক্ষণ তাকিয়েও থাকারও সাহস হলো না। খাটের কাছে এগিয়ে এসে নিজের বালিশ একপাশে করে নিলো। এরপর সিতারাকে বলল, “লাইট অফ করে এসে শুয়ে পড়ো।”
চলবে…
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন..!