তারপর একদিন পর্ব-০৫

0
2

#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৫
.
বাবার প্রতি আজ নতুন করে রাগ হচ্ছে নির্ঝরের। এতদিন হয়েছে নিজের জন্য, আজ হচ্ছে সিতারার জন্য। সে জানত এসএসসি ফেইল, অশিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করছে। আজ জানল, সে বাল্যবিবাহ করেছে। ওর মতো একজন ছেলের সাথে এতটুকু পুঁচকে মেয়ের সাথে বাবা বিয়ে দিলো কি-করে? যে কি-না ওর চেয়ে প্রায় চৌদ্দ বছরের ছোট। এত অল্প বয়সী মেয়ের সাথে ও সংসার করবে কি-করে! ভেবতেই ওর মাথা ধরে আসছে। পরমুহূর্তেই কিঞ্চিৎ চমকালো নির্ঝর। সংসার মানে? ও তো এই বিয়েটাই মেনে নিতে পারে নি, তবে? তবে কি মস্তিষ্ক দিয়ে মেনে নিতে না পারলেও মনে জায়গা দিয়ে ফেলছে ও সিতারাকে? উঁহু! সেটা কি-করে হবে! আর যদি না-ই হয়, তবে এই রাতের বেলায় মেয়েটার জন্য বাইরে বেরুলোই বা কেন? কেন’ই বা মেয়েটার অসুস্থতায় ওর খারাপ লাগছে?

নিজেকে করা প্রশ্নগুলোয় নিজেই জর্জরিত নির্ঝর। উত্তরগুলো কিছুতেই পায় না। মস্তিষ্ক কেমন দিকশূন্য হয়ে পড়েছে। এর মাঝেই মানসপটে ভেসে উঠল সিতারার কথাগুলো। তখন সিতারা, “হ্যাঁ! এসএসসি ফেইল আমি। এরপর আর পড়াশোনাও হবে না। গতবছর ফেইল করলাম, এ-বছর বিয়ে হলো। এখন আমি মন দিয়ে সংসার করব আপনার সাথে।”

বলতেই কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায় নির্ঝর। সিতারার ঠোঁটে তখন মুচকি হাসি। নির্ঝর কিছুটা৷ অবাক হয়ে সুধায়, “গতবছর মানে? তুমি গত বছর এসএসসি ক্যান্ডিডেট ছিলে?”

“হ্যাঁ!”

মাথা নাড়িয়ে বলে সিতারা। নির্ঝরের কপালের ভাঁজ দৃঢ় হয়। বলে উঠে, “হ্যাঁ মানে? আমি তো ভেবেছিলাম আরও বছর তিনেক আগে পরীক্ষা দিয়েছিলে। এই মেয়ে, বয়স কত তোমার?”

“মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই, জানেন না?”

“চুপ! একদম কথা ঘুরাবে না। বলো বলছি..!”

“সাড়ে ষোলো চলছে!”

নির্ঝর যেন আঁতকেই উঠল। সিতারাকে দেখে কখনোই ওর বয়স উপলব্ধি করে নি ও। শাড়ি পরায় একটু বড় বলেই মনে হয়েছিল। আন্দাজ করেছিল বিশ, একুশ বছর বয়স হবে মেয়েটার। কিন্তু, এতটাই ছোট হবে তা ঘুনাক্ষরেও টের পায় নি নির্ঝর। ওর মতো ত্রিশ বছর বয়সী ছেলের সাথে বাবা কি-করে পারল এতটুকু মেয়ের বিয়ে দিতে? বাবাকে কিছু বলতে না পারার অনুসূচনা এবার তীব্র হলো।
নিজের কথা অনুসূচনা হোক বা অন্যকিছু, নির্ঝর বলে উঠল, “এত অল্প বয়সে বিয়েটা কেন করলে? তোমার তো পুরো লাইফটাই পড়ে আছে, তুমি চাইলে আরও সুন্দর হতো, সিতারা!”

সিতারা হেসে উঠল। যেন মজার কোন কথা শুনেছে, “অল্প বয়স বলে মনে হচ্ছে আপনার? আমাদের গ্রামে আরও কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়, জানেন?”

বলেই একটু থামল। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলল, “আর পুরো লাইফের কথা বলছেন! যার বাবা মা নেই তার পুরো জীবন তো এমনিতেই দূর্বিষহ হয়ে উঠে। সুন্দরের আশায় সেই জীবনে পড়ে থেকেই বা কি হতো। আগেও যা ছিল, এখনও তাই। আপনি না হলে অন্য কাউকে তো আমার বিয়েটা করতেই হতো!”

নির্ঝরের কেন জানি ভালো লাগে না সিতারার শেষ কথাটা। ওর অচেতন মন মানতে পারে না সিতারাকে অন্য কারোর সাথে। মনে মনে বলে উঠে, “তোমার জীবনটা সুন্দর করার জন্য আমি আছি, সিতারা!”

চমকে উঠে নির্ঝর। কি বলল ও? হঠাৎ এই মেয়েটাকে নিয়ে এতটা ভাবনা কেন ওর? উত্তর পায় না ও। সামান্য সরে আসে ও খাটের কাছ থেকে। সিতারা এক হাতে পেট চেপে, বিছানা ছেড়ে উঠতে চেয়ে বলে, “আচ্ছা, এসব ছাড়ুন তো। আমি আপনার জন্য কিছু রান্না করছি।”

নির্ঝর বাঁধা দিলো ওকে, “উঠতে হবে না। আমি বাইরে থেকে খাবার আনছি।”

“লাগবে না। আমি পারব রান্না করতে।”

“বললাম না, উঠতে হবে না। আমি যাচ্ছি বাহিরে।”

বলেই আর দাঁড়ায় না নির্ঝর, তখনই বেড়িয়ে আসে বাসা থেকে। বাইরে থেকে খাবার ও সিতারার জন্য প্যাড এবং ব্যাথার ওষুধ নেয়। এরপর বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবনায় ডুব দেয়। সিতারার প্রতি ওর আচমকাই জন্ম নেওয়া এই অদ্ভুত অনুভূতিগুলো চাইলেও মস্তিষ্ক থেকে সরাতে পারছে না, পারছে না ও মেয়েটার প্রতি এই ছোট ছোট দ্বায়িত্ব গুলো থেকে নিজেকে এড়াতে।

.
নির্ঝর যখন বাসায় ফিরল, তখন ডাইনিং রুমেই সিতারাকে পেল। খাবারগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে ওকে বলল, “উঠেছ কেন?”

“সামান্য পেট ব্যাথায় কি সারাদিন শুয়ে থাকব? কাজ নেই বুঝি!”

ব্যাথা যে ভালোই, তা সিতারার চোখ-মুখ দেখে আনন্দ করেই ফেলেছিল নির্ঝর। প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। একটা ব্যাগ ওর দিকে এদিকে দিয়ে বলল, “এটা নাও।”

“কি আছে এতে?”

“ওষুধ আছে। দু’টো একটা একটা করে খাবে, আর…”

“আর?”

“নিজেই দেখে নাও।”

নির্ঝরের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে খুলল সিতারা। দু’টো ওষুধের পাতা ও একটা বক্সের মতো প্যাকেট পেল। সহসায় বুঝল না সিতারা—সেটা কী! কপাল কুঁচকে সুধাল, “এটা কী?”

কিঞ্চিৎ অবাক হলো নির্ঝর। একটা মেয়ে হয়ে কি-না প্যাড দেখে জিজ্ঞেস করছে—এটা কী? কি বলবে বুঝতে পারল না ও। তবে কি যেন ভেবে কিছু বলতে নিতেই সিতারা চট করে বলল, “প্যাড! কিন্তু আমি তো এগুলো ব্যাবহার করি না।”

ফের একবার অবাক হলো নির্ঝর। মেয়েটা বলে কী? অবাকের রেশ নিয়েই বলতে লাগল, “করো না মানে? তুমি…”

“দেখুন, এই বিষয়ে কথা বলতে আমার কিন্তু এখন লজ্জা লাগছে।”

চুপ করে যায় নির্ঝর। আর কথা বাড়াতে চাইল না। আস্তে করে, “এখন থেকে এগুলোই ব্যাবহার করবে। আর, মনে করে ওষুধগুলো খেয়ে নিও।”

বলেই চলে গেল নির্ঝর। সিতারা হতভম্ব নিয়েই দাঁড়িয়ে রাইল। মানুষটার আজ হলো কী? হঠাৎ ওকে নিয়ে এতটা উদগ্রীবতাই বা কেন? বুঝল না সিতারা, তবে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল ঠিকই। মুচকি হাসি নিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল, “জানি, আমায় মেনে নিতে পারেন নি আপনি। কিন্তু, এবার বোধহয় ফেঁসে যাচ্ছেন এই সিতারার কাছে।”

পরদিন অফিস নেই নির্ঝরের। অনেকটা বেলা করেই ঘুম থেকে উঠল নির্ঝর। ঠিক উঠল না, ঘুম ভাঙল ওর। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। নামার পায়তারা করতেই পাশে নজর গেল নির্ঝরের। ঘুমিয়ে আছে সিতারা! ওর অনেকটা কাছে। বড্ড এলোমেলো ও অগোছালো ভাবে। পরনের শাড়িটার এক অংশও যেন ঠিক জায়গায় নেই। এলোমেলো গয়ে হাঁটুর কাছাকাছি উঠে আছে শাড়িটা, ফর্সা মেদহীন পেট উন্মুক্ত, শাড়ির আঁচলটাও নেই বুকে, বড় গলার ব্লাউজও এলোমেলো হয়ে পরে আছে গায়ের সাথে।

এমতাবস্থায় সিতারাকে দেখে মুহুর্তেই হতভম্ব হয়ে গেল নির্ঝর। ভরকে গিয়ে হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হলো। সিতারাকে ও কল্পনাও করে নি এভাবে, অথচ মেয়েটা এভাবেই কি-না ওর সামনে! যে-কোন পুরুষেরই এমতাবস্থায় কোন নারীকে দেখলে নিজের পুরুষ সত্তা জাগ্রত হতে সময় লাগবে না বোধহয়। নির্ঝরেরও লাগল না। এমন আবেদনময়ী স্ত্রী’কে দেখে ঠিক থাকতে পারল না নির্ঝর। মুহুর্তেই ওর গলা শুকিয়ে গেল, শ্বাস নিতে ভুলে গেল, চোখের পলক ফেলে সিতারার থেকে নজর ফিরিয়ে নিতেও ভুলে গেল। অবাধ্য কিছু ইচ্ছে, আকাঙ্খা তীব্রভাবে চেপে ধরল ওর মস্তিষ্কে। নাহ্! ধরে রাখতে পারল না নির্ঝর নিজেকে। হাত বাড়াল, অজান্তেই ওর এক হাত ছুঁয়ে দেবার চেষ্টা করল সিতারার উন্মুক্ত পেটে। ঠিক তখনই কিঞ্চিৎ নড়ে উঠল সিতারা। নির্ঝর তড়িৎ গতিতে সরে ফেলল ওর হাতটা, নিজের স্তম্ভিত ফিরে পেতেই জোরে করে দু’বার নিশ্বাস ফেলল। মাথার চুলগুলো চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলল, “শিট ম্যান! এখনি এটা কি করতে যাচ্ছিলাম আমি?”

সামান্য সময় নিয়ে নিজেকে স্থিতি করল নির্ঝর, সামলানোর চেষ্টা করল। সিতারার পানে একবার তাকিয়ে দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল। এরপর পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাতলা চাদরটা টেনে নিয়ে মেয়েটার গলা পর্যন্ত ঢেকে দিলো। সিতারা ফের নড়েচড়ে উঠল, ঘুমের ঘোরেই হাত বাড়িয়ে নির্ঝরের কোমড় জড়িয়ে ধরল। সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল নির্ঝর। সামান্য পর সিতারার ঘুমটা যখন ফের গাড়ো হলো, তখন ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা ছেড়ে নামল ছেলেটা। সিতারার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে।

.
সিতারা ঘুম থেকে উঠল খানিকক্ষণ পরেই। নির্ঝর যখন ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো, তখন নিজের শাড়িটা ঠিক করতে ব্যস্ত মেয়েটা। শাড়ির আঁচলটা গুছিয়ে বুকে জড়িয়েছে কেবল, তখন ওর সামনে এসে দাঁড়াল নির্ঝর। বলল, “তোমার কি জামাকাপড় আর কিছু নেই?”

“হু, আছে তো।”

“তাহলে সবসময় শাড়ি পরো কেন? জামা পড়তে পারো না!”

“ওহ্! এটার কথা বলেছেন? জামা তো সব বাড়িতে।”

“বাড়িতে মানে? এখানে আনো নি?”

থামল নির্ঝর। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলল, “এসব শাড়ি পরার দরকার নাই, এখন থেকে জামা’ই পরবে।”

কিঞ্চিৎ অবাক হয় সিতারা। মানুষটা হঠাৎ ওর জামাকাপড় পরা নিয়ে পড়ল কেন? বলল, “কিন্তু, আমি তো শাড়ি ছাড়া এখানে কিছু আনি নি।”

“আনো নি মানে? কেন আনো নি? দ্যাখো, এসব শাড়ি টাড়ি একদম পড়বে না। সামলাতে পারে না, আবার আসছে শাড়ি পরতে..!”

“আমি কি করব? আম্মাই তো সব শাড়ি গুছিয়ে দিয়েছে। আর বলেছে—সবসময় যেন শাড়ি’ই পড়ি, আপনার সামনে তো অবশ্যই।”

রাগ হলো নির্ঝরের। বাবা মা ওকে পেয়েছে’টা কী? একজন ওর জন্য ওর বউকে মোবাইল ধরিয়ে দিচ্ছে, তো আরেকজন শাড়ি! সুপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে নির্ঝর, কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “আজকেই তুমি আমার সাথে বেরুবে, যা যা লাগবে নিবে! তবুও আর শাড়ি টাড়ি পরবে না।”

বলেই রুম ছেড়ে চলে গেল নির্ঝর। সিতারা হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটার হলো কী, হঠাৎ এমন করছেই বা কেন? ওকে নিয়ে এতটা ভাবছেই বা কেন? তবে কি মানুষটার মনে ওর জন্য প্রেমের বীজ ফুটতে শুরু করেছে? ভেবেই যেন অদ্ভুত অনুভূতি হলো সিতারার। লজ্জায় লাল হয়ে উঠল মুখখানা। একরাশ লজ্জা মাখা হাসি নিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল, “আমার সুন্দর মানুষ! আপনি কি সত্যি সত্যিই ফেঁসে যাচ্ছেন সিতারাতে..!”

.
.
চলবে….