#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ০৯
.
সিতারাকে রুমে এনে শুইয়ে দেয় বিছানায়। ফ্যানটা অন করে ফের খাটের কাছে মেয়েটার সামনে এসে দাঁড়ায়। এই মুহুর্তে ঠিক কি করবে, বুঝে উঠতে পারে না নির্ঝর। চিন্তায় মাথা চেপে ধরে ছেলেটা। নিস্তেজ সিতারাকে ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে উঠল।অস্থির নির্ঝর পকেট থেকে ওর মোবাইল বের করল। এরপর কল দিলো ও সিকিউরিটি গার্ডকে। রিসিভ হতেই নির্ঝর বলল, “ডক্টরের সাথে কথা বলেছেন? আসতে বলেছেন ওনাকে?”
অপর পাশ থেকে বোধহয় পজিটিভ জবাবই আসল। নির্ঝর, “আমাকে নাম্বার দিন ডক্টরের। আর, উনি আসলে দ্রুত আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসবেন।”
বলেই কল কাটল নির্ঝর, অপেক্ষায় রইল না গার্ডের জবাবের। তৎক্ষনাৎ কল দিলো ডাক্তারকে। ডাক্তারের অবস্থান জেনে নিলো, এরপর প্রাথমিক ভাবে জ্ঞান ফেরানোর ব্যাপারটা জেনে নিলো ওনার থেকে। কল কেটে সিতারার পাশে বসে ছেলেটা। বেড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পর পর দু’বার ছিটিয়ে দেয় সিতারার মুখে। জ্ঞান ফিরল না তাতে মেয়েটার। এবার ডাক্তারের বলা মতে সিতারার মাথার নিচে হাত দিয়ে সামান্য উঁচু করে তুলে। এরপর কাঁধে আস্তে করে চিমটি কাটে। প্রথমবার আস্তে কাটলেও দ্বিতীয়বার সামান্য জোরেই কাটল। জ্ঞান ফিরল সিতারার। নড়েচড়ে উঠে চোখ মেলে চাইল। ওকে তাকাতে দেখে নির্ঝর ডেকে উঠল, “সিতারা! সিতারা, ঠিক আছো তুমি!”
চারদিকে নজর বুলিয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করল সিতারা। নিজেকে রুমে পেলেও তখনকার ভয়টা মন থেকে গেল না। সামনে নির্ঝরকে দেখেই উঠে ওকে জড়িয়ে ধরল, বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। নির্ঝরও ওকে আলগোছে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। মেয়েটার ভীতি কাটাতে পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “সিতারা, শান্ত হও। দ্যাখো, আমাদের রুমেই আছো তুমি।”
“আমার.. আমার খুব ভয় করছে।”
কম্পনরত কণ্ঠ সিতারার। নির্ঝর অভয় দিয়ে ফের ওকে বলল, “ভয় নেই, আমি আছি তো।”
“আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না তো, নির্ঝর! বাবা মায়ের মতো আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবেন মা তো?”
“উঁহু! যাবো না।”
অভয় পেয়ে কমে আসে সিতারার ফোঁপানোর মাত্রা, নির্ঝরের বুকে মিশে যেতে চায়। নির্ঝরও শক্ত করে জড়িয়ে নেয় মেয়েটাকে। এই তো, ওর-ও উতলা বুকটা এতক্ষণে শান্ত হলো যেন। স্বস্তি পেল নিমিষেই। কেন? তার কারণ খুঁজল না।
মিনিট পাঁচেক পর ডাক্তার নিয়ে হাজির হলো সিকিউরিটি গার্ড। সাথে লিফটে ফেলে আসা ব্যাগগুলোও নিয়ে এলো। ডাক্তার সিতারাকে দেখে ওর পালস্ চেক করল, এরপর বিপি। বিপি অনেক কম মেয়েটার। সাথে এটাও জানাল—অন্ধকারে ফোবিয়া আছে সিতারার। ধীরে কাটাতে পারলে ভালো। নয়ত, মেয়েটাকে কখনোই অন্ধকারে একা রাখা যাবে না। এরপর কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে, চলে যায় ডাক্তার।
নির্ঝর ওষুধ আনতে বাইরে যেতে চাইলে, কিছুতেই ওকে ছাড়ে না সিতারা। মেয়েটাকে এভাকে একা বাসায় রেখে যেতে ওরও মন সায় দেয় না। পরবর্তীতে সিকিউরিটি গার্ডকেই ওষুধ আনতে পাঠাতে বাধ্য হয়।
.
রাত খুব বেশি নয়। তবুও খাইয়ে, ওষুধ খাইয়ে সিতারাকে ঘুমিয়ে যেতে বলল নির্ঝর। মেয়েটার গায়ে হঠাৎই তাপমাত্রা বাড়ল, জ্বরে নাজেহাল হয়ে পড়ল। দুপুরের রান্না করা খাবার ছিল, সেগুলোই মেয়েটাকে খাইয়ে ওষুধ খাওয়ালো। শুয়ে সিতারা নির্ঝরকে পর পর দু’বার ডাকল, “আপনি শুবেন না!”
অফিসের কিছু কাজ ছিল নির্ঝরের। তাই ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে বলল, “আমার একটু কাজ ছিল। তুমি ঘুমিয়ে পরো।”
“উঁহু! পরে করিয়েন।”
“পরে করলে তো হবে না, সিতারা। তুমি…”
“কালকে তো ছুটি, অফিসে যেতে হবে না। তাহলে পরে করলে হবে না কেন?”
নির্ঝরের মনে পড়ল কালকে ছুটির দিন। সিতারার হঠাৎ অসুস্থতায় মাথা থেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিল ওর। এবার আর কথা বাড়াল না। ল্যাপটপ রেখে রুমের বড় লাইট’টা অফ করল। এরপর বিছানায় এসে। হাসি ফুটে উঠল সিতারার ঠোঁটে। নির্ঝর শুয়ে পড়তেই ও বলল, “শুনুন না!”
“হু! বলো।”
“আমি একটু আপনার বুকে মাথা রাখি!”
সিতারার পানে তাকাল নির্ঝর। বারণ করতে মন চাইল না। বরং ওর মন সায় জানিয়ে বুকে টেনে নিতে চাইল মেয়েটাকে। বলেও উঠল, “আসো!”
সময় নষ্ট করে না সিতারা। এগিয়ে এসে মুখ লুকাল নির্ঝরের বুকে, একহাতে ছেলেটার টি-শার্ট খামচে ধরে অপর হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। সামান্য সময় নিয়ে সিতারা বলল, “জানেন, আজকে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
“হু! বুঝতে পেরেছি।”
বলল নির্ঝর। আলতো করে মেয়েটার গায়ে হাত রাখল। সিতারা বলল, “তখন মনে হচ্ছিল, আবারও আমার সবকিছু হারিয়ে অন্ধকারে ডুবে যাবে।”
“অন্ধকার ভয় পাও বলে এমন মনে হচ্ছিল। এসব ছাড়ো। মেডিসিন নিয়েছ, এখন ঘুমিয়ে যাও। আরাম লাগবে।”
“আমার মনে হচ্ছিল আপনাকেও আমি হারিয়ে ফেলব। বাবা মায়ের মতো ওই অন্ধকারেই আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলব।”
“সিতারা, বললাম না ঘুমিয়ে যেতে।”
সিতারা বিড়াল ছানার মতো নাক-মুখ ঘেঁষল নির্ঝরের বুকে। জড়িয়ে রাখা হাতের বাঁধন দৃঢ় করে বলতে লাগল, “জানেন, বাবা মা’রা যাবার পর আমার জীবনের সব শখ আহ্লাদ চলে গেল। আমার ভালোবাসাটুকু নিয়ে মা’ও চলে গেল একটা সময়, ওমনি এক অন্ধকার রাতে। তারপর আপনি এলেন আমার জীবনে। একসময় আমার সবটা জুড়ে, আমার সব হয়ে গেলেন। এরপর… এরপর যদি আপনিও হারিয়ে যান, তবে আমি কিভাবে থাকব!”
“এই, তুমি কিন্তু…”
“আমি জানি, আপনি আমায় মন থেকে মেনে নিতে পারেন না। মেনে নিতেও হবে না। শুধু এভাবেই একটু আমাকে জায়গা দিয়েন, আমি সারাজীবন না-হয় আপনার পায়েই পড়ে থাকব। তবুও আমার জীবন থেকে আপনি হারিয়ে যাবেন না, প্লিজ!
“সিতারা, তোমাকে বললাম না চুপ করতে..!”
কিঞ্চিৎ ধমকেই উঠল এবার নির্ঝর। সিতারাকে নিজের বুক থেকে উঠিয়ে ফের বলল, “এসব উল্টাপাল্টা কথা দ্বিতীয়বার যেন আমার সামনে না বলা হয়। নয়ত আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।”
ছলছল কথা চোখ সিতারার। টুপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল চোখের পানি। নির্ঝর তা আলতো করে মুছে দিয়ে ফের সিতারাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো। বলল, “এবার চুপচাপ ঘুমাও!”
সিতারা ফুঁপিয়ে উঠল। মানুষটার একটু যত্নে ওর ভীষণ কান্না পেল। নির্ঝর ফের ধমকে উঠল ওকে, “আর কান্না করবে তো, আমি বিছানা ছেড়ে উঠে যাব কিন্তু।”
পর পর দু’বার নাক টেনে এবার থেমে গেল সিতারা। নির্ঝর মুচকি হাসল। নিশ্চুপে ভাবনায় ডুবল মেয়েটাকে নিয়ে।
.
সময় তখন প্রায় এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। সিতারার নড়াচড়াতে ঘুম ভাঙল নির্ঝরের। এতক্ষণ জেগে থেকে সবেই চোখ দু’টো লেগে এসেছিল ওর। কাঁচা ঘুমটায় বিরক্ত হয়ে ও ঘুম ঘুম কণ্ঠেই সিতারাকে বলল, “উম্! এত নড়ছ কেন?”
“গরম লাগছে, ছাড়ুন।”
“লাগবে না, চুপচাপ ঘুমাও।”
“উঁহু! ঘুম লাগছে না।”
জড়িয়ে রাখা হাতটা ছাড়ে নির্ঝর, সামান্য মাথা তুলে তাকায়। ততক্ষণে সামান্য সরে গিয়ে গায়ের কাথাটা ফেলে দেয় সিতারা। পরনের শাড়ির অবস্থা ওর নাজেহাল। তবে বিশেষ গুরুত্ব নেই সেদিকে। ঘেমে যাওয়া মুখ, গলা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে সিতারা। নির্ঝর উঠে বসে, মেয়েটার কপাল, গাল ও গলায় হাত রেখে চেক করে জ্বরের মাত্রা। নেই। জ্বর ছেড়ে গেছে বলেই গা ঘেমে উঠেছে। নির্ঝর বলল, “জ্বর তো ছেড়ে গেছে, এজন্যই গা ঘেমে উঠেছে। ফ্যান দেবো!”
ওকে সুধালেও জবাবের আশায় থাকল না। বিছানা ছেড়ে উঠল নির্ঝর৷ গিয়ে ফ্যান চালু করল। এরপর ওয়াশরুমে যেতেই সিতারাও উঠে বসল বিছানায়। অনেকটা সময় নিয়েই নির্ঝর বেড়িয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। ও এলে সিতারা গেল। চোখেমুখে পানি দিয়েই বেড়িয়ে এলো। মুখ মুছে বিছানায় গেল কিছুটা সময় নিয়েই। নির্ঝর ওকে সুধাল, “কী হয়েছে?”
“জানি না, একটুও ঘুম আসছে না।”
“চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ো, ঘুম আসবে নি।”
“হু!”
ছোট্ট করে জবাব দিয়ে শুয়ে পড়ল সিতারা। এবার আর পারমিশন নিলো না, নিজেই নির্ঝরের বুক দখল করে নিলো। নিস্তব্ধ রাতে নীরবতায় কাটল বেশ কিছুক্ষণ। এরপর সিতারাই সুধাল, “শুনুন, একটা কথা বলব?”
“বলো।”
“এই যে, আমি আপনার এত কাছাকাছি থাকছি, আপনাকে জড়িয়ে ধরেছি, আপনার বিরক্ত লাগছে না?”
“হঠাৎ এই কথা কেন?”
“এমনি জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। আগে তো আমাকে বিরক্ত লাগত আপনার।”
নির্ঝর জবাব দেয় না। মূলত কিছুই বলতে পারে না। জবাবই বা দেবে কি? সত্যিই তো, আগে মেয়েটাকে সহ্যই করতে পারত না। কিন্তু এখন… এখন মেয়েটা একটুখানি সন্নিকটে থাকলেই যেন ওর স্বস্তি মিলে। জবাব দেয় না নির্ঝর। সিতারা ফের বলে, “কি হলো, কথা বলেন না কেন?”
“চুপচাপ ঘুমাও তো, অনেক রাত হয়েছে।”
“উঁহু! আপনি বলেন।”
“সিতারা, ঘুমাও বলছি।”
গম্ভীর কণ্ঠস্বর নির্ঝরের। তাতেও সিতারা চুপ করল না। বলে উঠল, “আপনার এই চুপ থাকাটা যে আমার বড্ড লোভ জাগিয়ে দেয়।”
নির্ঝর এবারও নিশ্চুপ। সিতারা সুধাল, “জিজ্ঞেস করবেন না, কিসের লোভ?”
“কিসের?”
“আপনার আদর পাবার লোভ, একটুখানি ভালোবাসা পাবার লোভ!”
“সিতারা, তুমি…”
“আমাকে একটুখানি ভালোবাসলে কি আপনার খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ! হবে। এবার চুপ করে ঘুমাও।”
“তাহলে একটুখানি আদরই না-হয় করেন।”
নির্ঝরের বুক থেকে মাথা তুলে ওর গলার ভাঁজে ডুবিয়ে বলল সিতারা। ছেলেটা ওকে সরানোর চেষ্টায় কিঞ্চিৎ ধমক দিয়ে, “এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”
“বউকে একটু আদর করতে বলা, বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে আপনার?”
ছেলেটার চোখে চোখ রেখে বলল সিতারা। নির্ঝর যেন কোন এক ঘোরে ডুবল। মেয়েটার চাহনিতে ওর গলা শুকিয়ে এলো। সিতারা ফের বলল, “একটু আদর দিলে কি হবে? বড় নয়, ছোট ছোট আদরই না-হয় দিন, একটু ভালোবাসুন।”
কি নিদারুণ আবদার মেয়েটার। শুকনো গলায় ঢোক গিলল একটু ভেজানোর চেষ্টায়। লাভ হলো না। বরং ওর তৃষ্ণা বাড়ল। সিতারার গোলাপি ঠোঁটে তাকিয়ে দ্বিগুণ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ল। অজান্তেই নির্ঝরের এক হাত চলে গেল সিতারার গালে। মেয়েটার গাল ও কানের কাছাকাছিতে হাত রেখে বলে ফেলল, “দিনকে দিন তুমি আমাকে এতটা বেহায়া বানিয়ে তুলছ কেন, সিতারা?”
“আপনার বউ বলে, আপনার অধিকার আছে বলে।”
কথাটায় কিছু একটা হলো নির্ঝরের, চুম্বকের ন্যায় মেয়েটার কাঁপা কাঁপা ঠোঁট ওকে টানল। নিজের পুরুষত্ব যেন মুহুর্তেই বেড়িয়ে এসে মেয়েটার ঠোঁটে দখল করে নিলো। এত বছরের দীর্ঘ পিপাসা মিটিয়ে তবেই যেন ছাড়ল ও সিতারাকে।
সিতারা কাঁপছে, নির্ঝরের বাহুডোরে থেকেও মেয়েটা কাঁপছে। নির্ঝর আলগোছে ওকে ফের কাছে টানল। তাতে যেন আরও বিপত্তিই ঘটল। নিজের পুরুষত্ব আরও এবার জাগ্রত হতে সময় নিলো না। এবার ছোট্ট চুমুতে নয়, বরং পুরো সিতারাকেই নিজের করে পাওয়ার বাসনা জাগল। দেড়ি করল না ও। আস্তে করে ডাকল মেয়েটাকে, “সিতারা!”
“হু?”
“আজকে তোমাকে একটু বেশিই আদর করলে কি কিছু মনে করবে!”
.
.
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন…. ]