তারপর একদিন পর্ব-১০

0
10

#তারপর_একদিন
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ১০
.
সকালে বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙল নির্ঝরের। সকাল গড়িয়ে যদিও দুপুরের লগ্ন তখন। আজ অফিস নেই। তবুও এতটা বেলা পর্যন্ত বিছানায় থাকতে চাইল না নির্ঝর। উঠে ফ্রেশ হওয়াটা জরুরি। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা সিতারাকে আলগোছে ছাড়ল। মেয়েটার মুখখানা ওর বুক থেকে উঠিয়ে আলতো করে চুমু দিলো কপালে, চুমুটা গাল থেকে মেয়েটার ঠোঁটেও নেমে এলো। এরপর সিতারার জড়িয়ে রাখা হাতটা আস্তে ছেড়ে নিয়ে উঠতে চাইল। তাতে মেয়েটাও নড়েচড়ে উঠল, ঘুম ভেঙে গেল। পিটপিট করে চোখ মেলে চাইলেই ওর অতি নিকটে নির্ঝরকে পেল। ওকে উঠতে দেখেই ছেলেটা মুচকি হেসে বলল, “গুড মর্নিং! যদিও এখন প্রায় দুপুর।”

সিতারার একটু লজ্জায় লাগল, তবে মুখ ফুটে কিছু বলল না। এদিকে বিছানা ছাড়তে চাওয়া নির্ঝরও আর উঠল না। মাথা উঁচিয়ে, ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইল সিতারার দিকে। মেয়েটা আস্তে করে ওকে সুধাল, “এভাবে হাসছেন কেন?”

নির্ঝরের ঠোঁটের হাসিটা বিস্তার হলো। বলল, “ভাবছি!”

“কী?”

“তোমার জেদ করা থেকে যদি আমার লাভ হয়, তবে এমন জেদ আমি সর্বদা পূরণ করতে প্রস্তুত!”

সিতারার লজ্জার মাত্রা দ্বিগুণ হলো। তবে নির্ঝরকে তা বুঝতে দিতে চাইল না, “অনেক বেলা হয়ে গেছে। উঠতে হবে তো।”

বলেই নির্ঝরের বাহুতে আলতো করে ধাক্কা দিলো। ছেলেটা সামান্য সরে যেতেই ও উঠে বসল খাটের সাথে হেলান দিয়ে। নির্ঝর ঠোঁটে বিস্তার হাসি নিয়েই বিছানা ছাড়ল। সিতারাকে বলল, “উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। তুমি বেরুলে আমি যাব।”

“আপনি যান না। আমি বাইরের বাথরুমে যাচ্ছি।”

সহসায় জবাব দেয় না নির্ঝর। সামান্য চুপ থেকে বলে, “উঁহু! লাগবে না, তুমি যাও। আমি বাইরেরটায় যাচ্ছি।”

.
মাঝে আরও দু’টো দিন কেটে গেল। নির্ঝর ও সিতারার সম্পর্কের এক আলাদাই পরিবর্তন এলো। একে অপরের খেয়াল রাখা, যত্ন নেওয়া, ও নির্ঝরের সিতারাকে আগলে রাখা! সবটাই যেন অধিক হয়ে উঠল।

দুপুরের কাজগুলো সেড়ে ড্রয়িং রুমে বসেছিলো সিতারা। তখনই নির্ঝর ফিরল অফিস থেকে। আজকে এতটা তাড়াতাড়ি আসতে দেখে সিতারা বলেই ফেলল, “আজকে এত তাড়াতাড়ি এলেন যে!”

জবাব দিলো না নির্ঝর। কাজের ব্যাগ মেঝেতেই ফেলে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। সিতারার কপাল কুঁচকে গেল। ফের সুধাল, “কি হয়েছে আপনার?”

“উম?”

ফিরতি প্রশ্ন যেন নির্ঝরের। সিতারা বলল, “এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে আজকে! সবকিছু ঠিক আছে তো?”

“হু!”

“কি হয়েছে আপনার?”

চিন্তিত কণ্ঠস্বর সিতারার। নির্ঝর হালকা মাথা ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল। আস্তে করে বলল, “ভালো লাগছিল না, মাথাটা বড্ড ধরেছে। তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম”

“আমি আপনার জন্য পানি আনছি।”

উঠে দাঁড়িয়ে বলে সিতারা। দ্রুত পায়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে নির্ঝরের সামনে ধরে। ছেলেটা তা সম্পূর্ণ শেষ করে খালি গ্লাসটা সিতারার হাতে দেয়। ও বলে, “আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি খাবার দিচ্ছি। খেয়ে একটু বিশ্রাম করলে আড়াম লাগবে।”

“তুমি খেয়েছ?”

“উঁহু! আপনি এসেছেন, এখন একসাথেই খাব।”

কথা বাড়ায় না নির্ঝর। উঠে রুমে চলে যায়। এরপর অল্প সময়ে ফ্রেশ হয়েও আসে। ততক্ষণে সিতারা খাবার রেডি করে। দুজনে একসাথে খাওয়া শেষ করে। এরপর আবদার করে বসে নির্ঝর কফির। সিতারাও বাধ্য মেয়ের মতো তা বানিয়ে নিয়ে আসে ওর কাছে।

.
সোফায় সিতারার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে নির্ঝর। সিতারা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তখন কফি খাওয়া শেষ হতেই নির্ঝর সিতারার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। ওকে বলে—মাথা টিপে দাও তো। এরপর সেভাবেই ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে, চুল টেনে দেয় সিতারা। সাথে চলে ওদের নিত্যকার কথোপকথন।
প্রায় আধাঘন্টা সময় পেরিয়ে তখন। হঠাৎই কলিং বেলের আওয়াজ। দু’জনেই অবাক হয়। এই অসময়ে কে এসেছে—ভেবে। নির্ঝর উঠে বসল তখন। সিতারা বলল, “আমি দেখছি, কে এসেছে।”

“তুমি থাকো, আমি যাচ্ছি।”

বলেই উঠে দাঁড়াল, তারপর এগুলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল শুভকে। ওকে দেখে কিছু বলতেই গেল নির্ঝর, তার আগেই শুভ ওকে থামিয়ে দিলে, “তাড়াতাড়ি সর সামনে থেকে, ঢুকতে দে আমাদের।”

ওকে এক প্রকার ঠেলেই হন্তদন্ত হয়ে বোরকা পরিহিত এক মেয়ের হাত ধরে ভেতরে ঢুকল শুভ। নির্ঝর অবাকের ন্যায় সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুভ ফের তাড়া দিয়ে বলল, “ওভাবে ষাঁড়ের মতোন দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি দরজাটা লাগা না বাপ!”

অবাকের ন্যায় দরজাটা আটকে দিলো নির্ঝর। এরপর ড্রয়িং রুমে এসে শুভর সামনে দাঁড়িয়ে সুধাল, “তুই এসময়? সাথে এটা কে?”

“আরে ভাইয়া আমি! আমাকে চিনতে পারছ না?”

বলেই মুখ থেকে নেকাব খুলে ফেলল মেয়েটা। নির্ঝর ফের অবাক হয়ে সুধাল, “আরে নীলা, তুমি? তোমরা এখানে, এভাবে কেন?”

“আমরা পালিয়ে এসেছি।”

বলল শুভ। আরেক দফা অবাক হলো নির্ঝর। বলল, “পালিয়ে এসেছিস মানে? হঠাৎ পালিয়ে আসলি কেন?”

শুভ বলল, “ওর বাপকে তো জানিস। রিকশাওয়ালার সাথে ওকে বিয়ে দিবে, তবুও আমার মতো অকর্মাকে জামাই বানাবে না। তাই ভাগিয়ে নিয়ে এসেছি মামুর বেটি’কে। এবার বুঝুক।”

“তাই বলে এভাবে? তুই…”

“তো, কি করতাম? রোজ রোজ কোথা থেকে যেন ধরে ধরে পাত্র হাজির করে বাড়িতে। এবার আনুক পাত্র, দিক মেয়ের বিয়ে!”

“বাবার রোজকার কান্ডে আমিও অতিষ্ঠ। তাই তো শুভকে বললাম—চলো পালিয়ে যাই। বিয়ে করে ক’দিন পর সামনে গেলে বাবা ঠিকই মেনে নিবে।”

বলল নীলা। শুভ ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেল। নির্ঝর সবটা শুনল, তবে বলার মতো কিছুই পেল না আর। ততক্ষণে নীলাও বোরকা’টা খুলে ফেলে চেয়ারে বসে বলল, “উফ্! বড্ড গরম আজ।”

এদিকে সিতারা নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখল। শুভকে চিনলেও এই মেয়েটাকে ও চিনে না, জানে না। বোরকা খোলার পরের নীলাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল। মেয়েটার পরনে জিন্স, ও টপস্! ওড়না নেই। কি নির্দিধায় এভাবেই বসে আছে নির্ঝর ও শুভর সামনে। তা দেখে সিতারা’ই কিঞ্চিৎ লজ্জা জমছে মনে। কিন্তু, তবুও নজর ফেলছে না মেয়েটার থেকে। মেয়েটা দেখতে সুন্দরী। সিতারার নজরে সিনেমায় দেখা নায়িকাদের চেয়ে কম লাগছে না।
নীলার নজর সিতারার উপর যেতে বেশি সময় লাগল না। কমলা রঙের সুতির কামিজ ওর পরনে, গায়ের ওড়নাটা খুব সুন্দর করে জড়িয়ে রাখা। ফর্সা মুখখানায় বড় বড় চোখের চাহনিতে তাকিয়ে আছে ওর পানে। তা দেখতেই মুচকি হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠল নীলা। সিতারার কাছে সামান্য এগিয়ে গিয়ে বলল, “তুমি নির্ঝর ভাইয়ার বউ, সিতারা?”

“হু!”

মাথা নাড়িয়ে বলে সিতারা। তাতে যেন নীলার ঠোঁটের হাসিটা বিস্তার হয়। বলে উঠে, “ইস্! তুমি তো আসলেই অনেক সুন্দরী। শুভর মুখে কত শুনেছি তোমার কথা, তখন থেকেই তোমাকে দেখার ইচ্ছে ছিল অনেক।”

সিতারা চুপ করে থাকে। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে নীলা ফের বলে, “গাধা’টা আমাকে নিয়েই আসতে চাইত না। বলত—তোমাকে দেখার পর নিজের জন্য আফসোস হবে। এখন তো সত্যিই আফসোস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইস্! কতটা ন্যাচারাল তুমি।”

লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসে সিতারা। নীলা এবার নির্ঝরের পানে তাকিয়ে বলে, “আর তুমি কি-না এই মেয়েটাকে দেখতেই পারো না নির্ঝর ভাইয়া! কিভাবে, হ্যাঁ?”

“এটাও তোমাকে বলেছে!”

বলেই একবার শুভর দিকে তাকাল নির্ঝর। শুভ দাঁত কেলিয়ে হাসার চেষ্টা করল। নীলা বলল, “তো বলবে না! ও আমাকে কোন কথা না বলে থাকতে পারে বুঝি!”

একটু থামল মেয়েটা। সামন্য সময় নিয়ে ফের বলল নির্ঝরকে, “এসব ছাড়ো, আমি তো আছি ক’দিন, তোমাদের একদম সেটিং করে দেবো। আগে আমাদের সেটিং করিয়ে দাও।”

“মানে? তোমরা তো…”

“আরে বাবা, বিয়ের কথা বলছি। কোন কাজী বা হুজুর এনে বিয়েটা পরিয়ে দাও আমাদের। বাইরে বেরুলেই দেখব, কোথা থেকে যেন বাবার লোক এসে ধরে ফেলছে আমাদের।”

.
সন্ধ্যা রাতের মধ্যই শুভ ও নীলার বিয়ে পরানো হলো, মসজিদের এক হুজুর এনে। ওদের রেজিস্ট্রি না হলেও ইসলামিক ভাবে ওদের বিয়েটা ঠিকই হলো। উপস্থিত ছিল নির্ঝর ও শুভর আরও দু’জন বন্ধু। সাক্ষী হিসেবে ওদের বিয়ে পরানো ভিডিও করে রাখা হলো। শুধু তাই না, ভিডিও’টা নীলা ওর বাবাকেও পাঠাল। এরপর বন্ধ করে ফেলল নিজেদের মোবাইল।
ওদের বিয়ের পর যখন নির্ঝরের বন্ধু দু’জন চলে যেতে চাইল, তখনই সুর তুলে শুভ বলে উঠল, “চলে যাবি যা, এর আগে আমার বাসর সাজিয়ে তবেই যাবি।”

ওর কথায় নির্ঝর একটু বিরক্তই হলো। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “ঠিকঠাক ভাবে বিয়েটাই হলো না, বাসর সাজাবি মানে? আগে আঙ্কেলেরা মেনে নিক, তারপর…”

“তুই আর কি বুঝবি বাসারের মর্ম? বিয়ের কয়েক মাস হলো, তবুও নিজের বাসর’টা বোধহয় করতে পারলি না। নিজে পারলি না বলে আমার বাসর’টাও হতে দিবি না, নির্ঝর?”
.
.
চলবে….

[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন…]