#লাস্ট_হোপ
#পর্ব৫
#কলমে_সুমনা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছে এক নিঃশব্দ শিল্প— “সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ”। চারপাশে ছায়া-ঢাকা কড়ই, শিমুল আর অর্জুন গাছেরা যেন পাহারায় রয়েছে তার সারল্যরূপের। চারপাশের ছায়াগুলো দুপুর গড়ালেই মাথার ওপর নেমে আসে, যেন কেউ অদৃশ্য চাদর মেলে দেয় শিল্পের অঙ্গনজুড়ে।
মঞ্চটা অর্ধবৃত্তাকার, লালচে ইটের টাইলসে মোড়ানো। তার সামনের অর্ধবৃত্তাকার লালচে দ্বিতীয় সিঁড়িটিতে বসে আছে দুজন। ফারিয়া একটু রেগে বলল,
“ধুর, আজকের দিনটাই খারাপ।”
তটিনী আর্ট পেপার হাতে এগিয়ে এসে ওদের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল,
“মুরাদ চত্বরে কি হয়েছে?”
ইরাদ স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“র্যাগ দিচ্ছিল।”
তটিনী সাথে সাথেই চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“তুমি ছেলেটাকে চেনো? না জেনেই ওর সাথে তর্ক করে এলে জানো এরপরে কি হতে পারে?”
ইরাদ থতমত খাওয়ার পরিবর্তে আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলল,
“অপরাধী যেই হোক না কেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষাই আমার আম্মু আমাকে দিয়েছে।”
তটিনী এবার বললো,
“ও রিদওয়ান চৌধুরী,ছাত্রলীগের সভাপতি। তুমি আন্দাজও করতে পারছো না আজকের দিনটার কত দাম তোমাকে দিতে হবে।”
কিঞ্চিত ঠান্ডা গলায় বলল,”সব শিক্ষা সবজায়গাতে প্রয়োগ করতে নেই। করলে হয়তো আজকে তোমার আব্বু..”
আভা ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দা থেকে একপ্রকার দৌড়ে এল। হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল,
“কিরে তটিনী তাড়াতাড়ি চল। আজকে সেই প্রজেক্টটা সাবমিট করতে হবে।”
তটিনী যেতে অসম্মতি জানালে এক প্রকার জোর করেই ওকে টেনে নিয়ে গেল আভা। ইরাদ চোখ ছোট ছোট করে বিচক্ষণী দৃষ্টিতে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়েই বলে উঠল,
“তোর এক্সামপলটা একটু উইয়ার্ড হলেও আভার ক্ষেত্রে মানানসই।”
ফারিয়া ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“তুই কি ভাবছিস বল তো?”
“যতটা আভা চাইছে, ততটাই। ওর কথাগুলোর মধ্যে কেমন জানি ঠান্ডা ঠান্ডা একটা কিছু থাকে। মনে হয় ও মুখে হাসলেও যেন ভেতরে হাসে না।” বলেই ফারিয়ার দিকে তাকালো ইরাদ।
———————-
মীর মোশাররফ হলের সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ইরাদ। রাস্তাটা যেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নীরব এক অধ্যায়। দুই পাশে গাছের সারি—কখনো শিমুল, কখনো কৃষ্ণচূড়া, আবার কোথাও ঘন বটগাছ ছায়া ফেলে রেখেছে অলস দুপুরের মতো। ফোনের রিংটোন কানে যেতেই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো ইরাদ। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটা দেখামাত্রই ইরাদের ঠোঁট জোড়া মৃদু প্রসারিত হলো। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই আশালতা রহমান হুংকার দিয়ে উঠলো,
“ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েই কি তুই এডাল্ট হয়ে গিয়েছিস? সাড়ে চারটার বেশি বাজে অথচ বাড়ি ফেরার নাম নেই। আড্ডাবাজিতে বসে পড়েছিস।”
ইরাদ এক ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“আমি এইচএসসি পরীক্ষার পরেই অলরেডি এডাল্ট হয়ে গিয়েছি আম্মু। তুমি মনে হয় এতো দিন খেয়াল করো নি কোনো ব্যাপার না কালকেই তোমাকে একটা চশমা এনে দেব।”
আশালতা রহমান এবার চেঁচিয়ে বলল,
“এ কেমন অসভ্য মেয়ে আমার পেটে ধরেছিলাম?”
পরক্ষণেই ইরশাদ রহমানকে জিজ্ঞেস করল,
“সত্যি করে বলো এটা কার মেয়ে? যে হাসপাতালে আমার ডেলিভারি করিয়েছিলে খোঁজ নাও নিশ্চয়ই বাচ্চা বদল হয়েছে নাহলে আমার মেয়ে এমন হতেই পারে না।”
মায়ের সাথে কথা বলতে বলতেই অন্যমনস্ক হয়ে সামনের ৬ ফুট ওয়ালের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যায় ইরাদ— কিন্তু সে তার পা মাটিতে থাকলেও বডি হাওয়ায় ভাসছে এটাও সম্ভব? এক চোখ খুলতেই দেখল সামনে কোনো দেয়াল নয় বরং একটা পুরুষ অবয়ব। ব্ল্যাক জিন্স, ভিতরে সাদা শার্ট উপরে ব্ল্যাক ব্লেজারে ফর্সা ব্রাউন চোখের ছেলেটা পৃথিবীর সবথেকে সুদর্শন লাগছে। ইরাদের নীল চোখ যেন সেই বাদামী চোখের মণিতেই হারিয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ পরেও ইরাদের কোনো হেলদোল না পাওয়ায় ওকে ছেড়ে দিল ছেলেটি। ইরাদ এবার আবিষ্কার করল ও সত্যিই রাস্তার পিচের উপর পড়ে আছে সেই সাথে কোমড়েও চিনচিনে ব্যথা। ইরাদ উঠে বসে হুংকার দিয়ে বললো,
“বাসা থেকে বের হওয়ার আগে চোখগুলো ড্রয়ার থেকে বের করে সাথে নিয়ে আসবেন।”
#চলবে…
#লাস্ট_হোপ
#পর্ব৬
#কলমে_সুমনা
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ঘেরা ইটের তৈরি দোতলা বাড়ি, নেমপ্লেটে লেখা “কমিশনার হাউজ”। মূল ফটকে পুলিশ গার্ড, পাশে ছোটো একটি বাগান—যেখানে বিদেশি ফুল আর ক্যাকটাসের গাছ। বারান্দায় কাঠের দোলচেয়ার, মাঝে মাঝে ঝিমিয়ে বসে থাকেন ইরশাদ রহমান। বসার ঘরে পুরনো কাঠের শোকেস, যার ভেতরে পুরনো ফাইল আর দেশি বিদেশি বই। তার নিজস্ব ঘরটা নির্জন, শুধু একটি টেবিল, কিছু নথি আর জানালার পাশে রাখা ধোঁয়ায় ঢাকা চায়ের কাপ। এই বাড়িটা যেন ইরশাদ রহমানের মতোই—গম্ভীর, সংযত, আর অনেক না বলা গল্পে ভর্তি। সাড়ে ৫টায় বাসায় ফিরেই শব্দ করে সদর দরজা লাগিয়ে দিল ইরাদ। আশালতা রহমান সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে একগাল হেসে বলল,
“তুই মরলি নাকি?৫ টা বাজে, এখনো বাসার পথ ধরলি!”
ইরাদ চুপচাপ গলায় বললো,
“তোমার মেয়ে মরার আগেও একটু নাটকের মঞ্চে দাঁড়াতে চায়, আম্মু।”
আশালতা রহমান একটু গম্ভীর স্বরে বলল,
“এই যে মঞ্চ-নাটক এসব শুরু করছিস, তোর আব্বুর স্বপ্ন ছিল তুই বিজ্ঞানী হবি। সে স্বপ্নে এখন গরু চরছে!”
ইরাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আব্বুর যে গরুর খামার আছে আগে বলো নি তো?”
আশালতা রহমান একটু সাবধানী সুরে জিজ্ঞেস করল,
“শুন, তুই কি প্রেমটেম করছিস নাকি?”
ইরাদ ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি দিয়ে জানাল,
“প্রেম না, আপাতত র্যাগ খাচ্ছি, সেটা খুব রোমান্টিক একটা অভিজ্ঞতা।”
আশালতা জোরে চেঁচিয়ে বলল,
“তোর আব্বুর পরিচিত এক সাইকোলজিস্ট আছে কালকেই উনার চেম্বারে যাব। তুই একটা অসামাজিক হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন।”
ইরাদ ফিসফিস করে বলল,
“আচ্ছা আম্মু, একটা কথা বলো, তুমি ছোটবেলায় কি কখনো রোমিও জুলিয়েট পড়ছিলে?”
আশালতা এবার জোরে বললো,
“না, আমি রাঁধুনি রেশমা পড়েছি। আর এখন তোকে পড়াবো দাওয়ায় লাঠি কেমনে খেতে হয়!”
“লাভ ইউ, ড্রামাটিক মম।”বলে দৌড় দিল ইরাদ। পেছন থেকে আশালতা বলল,
“একটু সাবধানে হাঁটিস, গতবার তো বাঁকা গাছেও ধাক্কা খেয়েছিলি!”
মায়ের কথাটা কানে যেতেই সকালের অসভ্য লোকটার কথা মনে পড়ে গেল ইরাদের। দূর থেকে একটা কোকিলের ডাক কানে আসছে কিন্তু বসন্তের প্রেমের আগমন আপাতত পিচের উপর পড়ে থাকা ইরাদ অথবা ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকা রায়ান কারো মনেই ঘটেনি। রায়ান এবার এক হাতে ইরাদকে টেনে তুলে হাতে একটা ৩.৫ পাওয়ারের চশমা ধরিয়ে দিল।ইরাদের গলায় ঝোলানো আইডি কার্ড দেখে বললো,
“দ্বিতীয় বর্ষ! এজন্যই আমাকে চেনো না। কালকে ক্লাস শেষ করে যে কারো সাথে এক কাপ কফি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করবে হুঁ ইজ রায়ান আহমেদ। আশা করি উত্তর টা পেয়ে যাবে।” বলেই গটগট করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে ইরাদ জোরে জোরে কতগুলো বকা দিয়ে দিল। রায়ানের কানে কিছু ঢুকলো কিনা কে জানে! ইরাদ নিজের পা দিয়ে রাস্তার পিচে একটা লাথি দিয়ে বলল,
“জঘন্য লোক একটা!”
————————–
ইরাদের নাট্যচক্রের সাথে যাত্রার প্রায় দুমাস হয়ে গিয়েছে। টারজানের দোকানে ঝাঁঝালো ঘ্রাণে ভরপুর বাতাস। বেঞ্চে বসে আছে ইরাদ, তটিনী আর ফারিয়া। তাদের সামনে আধখাওয়া ফুচকার প্লেট, আর সূর্যের তাপে মাথার উপর ধোঁয়া উঠছে ফুটন্ত টকজলের হাঁড়ি থেকে। চারপাশে কোলাহল, কিন্তু তাদের ঘিরে যেন একটুকরো নীরব দ্বীপ।
তটিনী চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলে,
“ফুচকার মতোই কিছু মুখ আছে—মশলা ঢোকানো, ভেতরে পোড়া কিছু লুকানো। চিবিয়ে না খেলে আসল স্বাদ বোঝা যায় না।”
ইরাদ ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বলল,
“এই মেয়েটা আবার শুরু করলো! বুঝতেই পারছি না ফুচকা খাচ্ছি, না ক্রাইম সিনে বসে আছি।”
ফারিয়া ফুচকার টকজল চেটে চেটে বলে,
“আমার মনে হচ্ছে ক্যাফেটেরিয়া আজকে ছুটি নিলে ভালো হতো। টারজানই আজকের হিরো! বাই দ্য ওয়ে আপু তুমি গোয়েন্দা ছিলে কখনো?”
তটিনী হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে,
“সবার হাতেই চাবি ছিল, কিন্তু দরজা খুলেছিল মাত্র একজন। তাহলে তালা ভাঙল কে?”
ইরাদ হাসতে হাসতে বলে উঠল,
“আপু, আমি বলছি—তোমার মাথার ডায়েট ঠিক কর! বেশি ফুচকা খেলেই বোধহয় চিন্তা জটিল হয়ে যায়।”
তটিনী এবার ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
“যে বেশি প্রশ্ন করে, সে আসলে কিছু জানে। আর যে চুপ থাকে, সে হয়তো প্রশ্নই হতে পারে।”
#চলবে…?