চার_দেওয়াল
Monkemoner dakbakso – Anindita
বাড়িতে আজ আবার রাতুল এসেছে| রাতুল আমার ননদ অণিমার হবু স্বামী| শ্বশুর-শাশুড়ি-স্বরূপের কাছ থেকে তাই শুনেছি| বিয়ের কয়েকদিন পর থেকেই দেখেছি এ বাড়িতে ছেলেটার অবাধ আনাগোনা| সে নাকি শুধু অণিমার মাস্টার্স কমপ্লিট হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, শেষ হলেই ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যাবে| অণিমা রাতুল বলতে এক ঢোঁক জল বেশি খায়|
শ্বশুর শাশুড়িও দেখেছি রাতুলকে নিয়ে গদগদ| এসে দাঁড়ালে কি করবে কি বলবে ভেবেই পায় না| তা গদগদ হওয়ারই কথা| লোকে আমাদের মধ্যবিত্ত বললেও আদতে আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার| সেখানে রাতুলের নিজস্ব দোতলা বাড়ি, গাড়ি| ভাল বেসরকারি চাকরি| মোটামুটি সুন্দরী অণিমার জন্য তা হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিলই বটে| রাতুল এলেই বাড়িতে চিকেন আসে, একটু ভাল মাছ| আমিই রান্না করি| পেনশন পেলেই শ্বশুরমশাই আলাদা করে টাকা তুলে রাখেন এগুলোর জন্য| কখনো কখনো স্বরূপও মর্জি বুঝে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে, তখন দু চারদিন টানাটানি করে সংসার চালিয়ে নিতে হয়|
স্বরূপকে বিয়েটা করেছিলাম ভালোবেসেই| একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে মোটামুটি মাইনের চাকরি করে স্বরূপ| আমাদের সংসার চলে যায়, তবে বিলাসিতার কোন জায়গা নেই| ওই মাইনে থেকেই এখন বোনের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে| বাড়িতে টিভি, ফ্রিজটুকুই যা আছে, সেটাও আমার বাপের দেওয়া| শাশুড়ির এই দুটোই দাবী ছিল, বাবা কোনরকমে মিটিয়েছে| এসি, গাড়ি কিছুই নেই, কোন কালে হবে বলেও মনে করি না| কিছুদিনের মধ্যে নতুন সদস্য আসবে আমাদের মাঝে, তার খরচখরচা… বুঝে নিয়েছি মধ্যবিত্ত জীবনটা এভাবেই কোনরকমে কেটে যাবে|
মাস চারেক হল শরীরে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব টের পেয়েছি| যদিও স্বরূপ ছাড়া এখনো কাউকে বলি নি| শ্বশুর শাশুড়ির ইচ্ছে নয় এখুনি বাচ্চা কাচ্চা নিই| ভয় যদি স্বরূপ সংসারে টাকার পরিমাণ কমিয়ে দেয়| যদি বোনের বিয়ের জন্য টাকা জমানো বন্ধ করে দেয়| শ্বশুরের পেনশনের টাকা তো ওষুধ আর রাতুলের পেছনে চলে যায়| রাতুল এত বড়লোক, কিন্তু এই সংসারের কোন দায়িত্বই নিতে চায় না, এমন ভাব দেখায় যেন অণিমাকে বিয়ে করে এই গরীব পরিবারকে সে উদ্ধার করে দিচ্ছে| অণিমাও সবসময় রাতুলের মন মর্জি বুঝে চলে| রাতুলের গার্লফ্রেন্ড বলে সে বন্ধু মহলে বেশ সম্মান পায়|
স্বরূপের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করেছি আমার কনসিভ করার কথাটা ছ’মাস পর বাড়িতে জানাব| জানি জানতে পারলেই শাশুড়ি মা আমায় বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন| সি সেকশনের নাকি অনেক খরচা, স্বরূপ বলছিল একদিন| শাশুড়ি মা কিছুতেই চাইবেন না স্বরূপ আমার পিছনে খরচ করুক| তাঁরা চেয়েছিলেন আগে অণিমার বিয়েটা হয়ে যাক, কিন্তু স্বরূপের জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে| সত্যি বলতে কি যদি আমার বাবার খরচ চালানোর ক্ষমতা থাকত, ওখানেই চলে যেতাম| একটু বিশ্রাম তো জুটত এসময়| কিন্তু কিভাবে যাব? আমি জানি এই বিয়ে দিতেই বাবার বাজারে বেশ কিছু দেনা হয়েছে| আমি যদিও পণ দিয়ে বিয়ে করতে চাই নি কোনদিন কিন্তু উপায় ছিল কই? আমাদের কলোনির ঘরের দরজায় রাতবিরেতে টো কা, অশা লীন ই ঙ্গিতে জেরবার হয়ে যাচ্ছিলাম| বিয়ে ছাড়া বাঁ চার উপায় ছিল না| তখনই যেন এক দেবদূতের মতো স্বরূপ আমার জীবনে আসে| মাস দুয়েক প্রেম করার পর দুই পরিবারের সম্মতিতে আমার বিয়ে ঠিক হয়|
দিনে দিনে চেহারাটা ভারী হচ্ছে বুঝতে পারি| কাজের গতিও আগের থেকে স্লথ| সংসারের কাজ সময়মতো না পেলে শাশুড়ি মা বিরক্ত হন বুঝতে পারি, কিন্তু আমিই বা কি করব? শরীর যে আর চলতে চায় না| বাবাকে বললে হয়ত নিয়ে যাবে কিন্তু বাবার ঘাড়ে বসে বোঝা বাড়াতে আমি চাই না| মন্দের মধ্যে একটা ভাল, আমার প্রেগন্যান্সিতে বমি ভাব নেই| বমি ভাব থাকলে এতদিনে বাকিরা না বুঝলেও শাশুড়ি মা ঠিক বুঝে যেতেন! অভিজ্ঞ মানুষ কিনা! আজকাল মাঝেমধ্যে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকান, আমি এড়িয়ে যাই|
এমনিতে রাতুল খালি হাতেই আসে| এই সংসারের জন্য কোনদিন কিছু হাতে করে আনতে দেখি নি| অণিমার জন্য অবশ্য মাঝেমধ্যে টুকটাক জিনিস নিয়ে আসে, সেসব আবার অণিমা গর্ব করে দেখায়| সেদিন অবাক হয়ে দেখলাম রাতুলের হাতে মিষ্টি| অথচ এই মুহূর্তে বাড়িতে কেউ নেই| শাশুড়ি গেছেন ভজন শুনতে, শ্বশুর বন্ধুদের আড্ডায়| অণিমাও খানিক আগে এক বন্ধুর সঙ্গে বেরোল| একা দরজা খুলতে একটু ইতস্তত বোধ হচ্ছিল, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল রাতুল এ বাড়ির জামাই কম, ভিআইপি বেশি| সে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল শুনলে শ্বশুর মশাই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবেন| তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলাম|
মিষ্টিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনার জন্য নিয়ে এলাম|
হঠাৎ মিষ্টি? কেন? আমি যে অবাক হয়েছি তা আমার গলার স্বরেই দিব্যি বোঝা গেল|
এমন সুন্দর মিষ্টি গোলগাল চেহারা আপনার, একটু মুখ মিষ্টি না করলে চলে? হেসে বলল রাতুল| হঠাৎ করে কো মরে হাত রেখে এক ঝটকায় কা ছে টানল আমাকে, আজ বরং আমি তোমাকে নিজে হাতেই একটা মিষ্টি খাইয়ে দিই| কাউকে কিছু বলার দরকার নেই| এই মিষ্টি মুখ কেবল তোমার আমার|
ভ য়ে কেঁপে উঠলাম| এমন সাহ স কিভাবে হল রাতুলের? কি করতে চাইছে আমার সঙ্গে? একা আমি এখন কি করব? হাতের কাছে কিছুই যে নে ই|
আমাকে বাঁচাতেই বোধহয় শব্দ করে কলিং বেলটা বেজে উঠল| আমায় ছেড়ে ভদ্র ছেলের মতো চেয়ারে বসে পড়ল রাতুল| যেন এতক্ষণ কিছুই হয় নি| ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে সজোরে হোঁচট খেলাম, পাশে থাকা চেয়ারের হাতল ধরে কোনরকমে নিজেকে সামলে নিলাম, রাতুলের ঠোঁটে শ য় তানি হাসি, কখন পা টা আগে বাড়িয়ে দিয়েছে টেরও পাই নি| কোনরকমে হেঁটে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম| বাইরে স্বরূপ দাঁড়িয়ে| রাতুলকে এই সময় এ বাড়িতে দেখে ও ও বোধহয় অবাক হল| তুমি এখানে?
রাতুল অপ্রস্তুত হওয়ার ছেলেই নয়, এক গাল হেসে বলল, অণিমা বলেছিল থাকবে, তাই এসেছিলাম| কিন্তু অণিমাই তো দেখছি নেই| কাল সঙ্গে যেন বেরিয়েছে| নামটাও আমাকে বলে যায় নি| আপনার বোন দেখছি বেশ খামখেয়ালী| ভবিষ্যতে সংসার করবে কিভাবে?
বোনের খামখেয়ালের দাম মেটাতে দাদাকে বাড়ির হবু জামাইয়ের জন্য ফিশ ফ্রাই আর চপ নিয়ে আসতে হয়| খাওয়া দাওয়া সেরে রাতুল চেয়ারে বসে আড়চোখে আমায় মা প তে থাকে, এর আগেও দেখেছি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে… কিন্তু এমন অ দ্ভু ত আচরণ এই প্রথম| অস্বস্তি কাটাতে রান্নাঘরে চলে গেলাম| খানিক পরে দেখি রাতুল সেখানেও এসে দাঁড়িয়েছে, আসতেই পারে| বাড়ির হবু জামাই বলে কথা, এ বাড়ির সর্বত্র তার অবাধ গতি| ঈষৎ ঠাট্টার সুরে বলে ওঠে, বৌদি আপনার ফিগার যা দেখছি ফাটাফাটি, অণিমা আপনার ধারে কাছেও আসে না| প্রেম করেছিলাম তাই, নইলে…
আমি আর সহ্য করতে পারি নি| সব্জি কাটার ছু রিটা তুলে নিয়ে বলি, আপনি এখুনি ঘরে যান, আর এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি কিন্তু চেঁচাতে বাধ্য হব|
ছু রি দেখে হাসলেও চেঁচানোর কথা শুনেই ভেজা বেড়ালের মতোই ল্যাজ গুটিয়ে পালাল রাতুল| কিন্তু আমার বুক থেকে ভয়ের ভাব গেল না| কি করতে চাইছে রাতুল আমার সঙ্গে? সবাই শুয়ে পড়লে রাতের বেলা স্বরূপকে সব কথা খুলে বললাম| শুনেই গম্ভীর হয়ে গেল স্বরূপের মুখ|
( ক্রমশ )