চার দেওয়াল পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
2

#চার_দেওয়াল #শেষপর্ব
জানতাম রাতুল আসবে| এসেওছিল ঠিক| ততক্ষণে আমার নিখুঁত ট্রেনিং পেয়ে সুকন্যা সম্পূর্ণ রেডি| শুধু রেডি নয় সুপার এক্সাইটেডও| সে ভাবতেই পারে নি শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পাবে| আমি নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলাম| জানি ল ড়া ইটা মোটেও সহজ নয় কিন্তু আমার নিজের জন্য, আমার অনাগত পুত্র কিংবা কন্যা সন্তানকে ভাল রাখার জন্য এই স্টেপটা আমাকে নিতেই হবে|

সুকন্যাকে চোখের ইশারা করে আমি ছাদে উঠে গেলাম| যদিও শাশুড়ি হঠাৎ বাড়িতে আসা এই অচেনা আগন্তুকটিকে দেখে খানিক বিরক্তই হয়েছিলেন কিন্তু আমার কাছে এটা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না| যে কোন উপায়ে আজ আমাকে রাতুলের স্বরূপ উন্মোচন করতেই হবে| জানতাম আমি ছাদে গেলে রাতুলও কোন না কোন ছুতো করে অবশ্যই যাবে, আর কার্যক্ষেত্রে হলও তাই| মধুলোভী মৌমাছির মতো বাড়ির সবার নজর এড়িয়ে রাতুল ছাদে উঠে এল| আমাদের ছাদটা অবশ্য ন্যাড়া, দাঁড়ালে একটু ভয় ভয় লাগে| কোনভাবে খানিক পয়সাকড়ি জোগাড় করে শ্বশুর মশাই মাথার ওপরকার ছাদটুকু ঢালাই করলেও, চারপাশে পাঁচিল তোলার সামর্থ্য হয় নি আর|

পায়ে পায়ে রাতুল আমার দিকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করল| চোখেমুখে ভ য়ের ছাপ ফুটিয়ে এমন ভাব দেখালাম ওকে হঠাৎ এখানে দেখে যেন কতই না ভ য় পেয়েছি| জানি সুকন্যা এতক্ষণে নিশ্চয়ই নিজের কাজ সেরে ফেলেছে| সিঁড়িতে কার যেন পায়ের মৃদু শব্দ পেলাম| নিশ্চয়ই অণিমা আসছে| আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা রাতুলের কানে না গেলেও সে শব্দ ঠিকই আমার কানে গেছে|

জামাকাপড় তুলতে তুলতে থমকে গেছি| আমার শাড়ির আঁচল রাতুলের হাতে, চোখেমুখে ভ য়া র্ত দৃষ্টি| হঠাৎ কেউ পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, কি করছ তুমি বৌদির সঙ্গে? এমনটা কিভাবে করলে তুমি? কেন করলে? তুমি যে বলতে ভালোবাস আমায়… সব কি মিথ্যে ছিল? আমি যে তোমায় বড্ড ভালোবেসেছিলাম|

একরাশ ধুলোর ওপর বসে পড়েছে অণিমা| চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল| শূন্য চোখে সে তাকিয়ে আছে দূরে আরো দূরের দিকে…

অণিমা, অণিমা তুমি কিন্তু আমায় ভুল বুঝছ! এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেয়ে রাতুল অণিমার কাছে দৌড়ে আসে| ছাদে নিয়ে এসে তোমার বৌদি আমায় প্রোভোক করেছিল|

কে কাকে কি করেছিল আমার যথেষ্ট বোঝা হয়েছে| আমি নিজের চোখে দেখেছি বৌদি একাই কাপড় তুলতে ছাদে এসেছিল| খানিক পরে তুমি এসেছ| প্লিজ চলে যাও রাতুল| দয়া করে এখান থেকে চলে যাও| আর কোনদিন এই বাড়িতে এসো না| প্লিজ, এসো না| ছিঃ, শেষে কিনা আমার বৌদির সঙ্গে! ভুলটা আমারই হয়েছিল তোমায় ভালবেসে| কদ্দিন বাদেই আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা| আর সেই সময় তুমি কিনা… কি ভেবেছিলে বিয়ের পরও এমনটা চালিয়ে যাবে? আর আমি কিচ্ছুটি জানতে পারব না|

আমার কাজ মিটে গিয়েছিল| জানতাম চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখলে অণিমা প্রতিবাদ করবে, করবেই| কোন মেয়েই চোখের সামনে এমনটা দেখলে চুপচাপ মেনে নিতে পারে না| আমি শুধু সুকন্যাকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম রাতুলকে ছাদের সিঁড়িতে উঠতে দেখলে অণিমাকে গিয়ে কেবল একটা কথা বলতে, রাতুল তার জন্য একাকী ছাদে অপেক্ষা করছে| যা চেয়েছিলাম একেবারে তাই হয়েছে| প্রেমিকার হাতে রাতুল ধ রা পড়েছে| এতদিন আমার সঙ্গে যে অ ন্যায় করেছে আজ তার জ বাব দিতে হবে সবার সামনে|

একটানা অভিযোগ শুনতে শুনতে রাতুলের বোধ করি ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল| বিরক্ত মুখে এক সময় অণিমার দিকে তাকিয়ে বলেই ফেলল, কে তোকে বিয়ে করবে? কি এমন সুন্দরী তুই? এমন কি আছে তোর মধ্যে যে তোকে একেবারে গয়নাগাঁটিতে সাজিয়ে ঘরের বউ করে নিয়ে যেতে হবে? যাদের সঙ্গে ঘুরব, বেড়াব তাদের সবাইকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে হলে তো মুশকিল| কোটি কোটি টাকার মালিক আরবী শেখদের মতো বাড়ির ভেতর হা রে ম খুলব নাকি? তার জন্য টাকা কে জোগাবে? তোর বাপ?

বাড়ির সবাই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল| বোধহয় বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল কিছুক্ষণের জন্য| নরম মিষ্টভাষী হবু জামাইয়ের এ কি রূপ দেখছে তারা! শ্বশুর মশাই পড়েই যাচ্ছিলেন কোনরকমে সামনের দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিলেন| এই ছেলেকেই তাঁরা ভাল ভেবে নিজের মেয়ের হাত নিশ্চিন্তে এর হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন|

এগিয়ে এসে রাতুলের কলার ধরে টানতে লাগল স্বরূপ| যেন ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে সে| চিৎকার করে বলতে লাগল, তাহলে তার বোনকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার অর্থ কি ছিল? এমন প্রতিশ্রুতি কেন দিয়েছিল সে? আর সবার সামনে এভাবে অপ মানই বা করছে কেন?

এখানে মান অপ মানের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? তখন দিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল বলে| এখন বলছি তোমার বোনকে বিয়ে করতে পারব না| ওই মেয়ে সংসার করার যোগ্য নয়| যে মেয়ে আমার কথা বিশ্বাস না করে আমাকেই সন্দেহ করে তাকে আমি কিভাবে বিয়ে করে সহধর্মিনী করতে পারি? তাছাড়া ওর কি বা যোগ্যতা আছে, আমার মতো বিত্তশালী ছেলের স্ত্রী পরিচয়ে সমাজে পরিচিতি পাবে? পড়াশোনায়ও আহামরি কিছু নয়| এসব মেয়েদের সঙ্গে দু চারদিন ঘোরা, বেড়ানো যায়… তা বলে বিয়ে| বিয়ে অত সহজ জিনিস নয়! আমার বিয়ে আগেই অন্য জায়গায় ঠিক হয়ে গেছে| ভেবেছিলাম বলব… যাক ভালই হল এইভাবে সব ক্লিয়ার হয়ে গেল|

অনেকক্ষণ হল চলে গেছে রাতুল| রেগেমেগে স্বরূপ নিজের ঘরে চলে গেছে| বোবার মতো ড্রয়িংরুমে বসে আছেন শ্বশুর শাশুড়ি|চার দেওয়াল জুড়ে শুধুই নিস্তব্ধতা| মধ্যে মধ্যে অণিমার কান্নার সুর ভেসে আসছে| ফুঁপিয়ে উঠছে সে| এতদিনকার সম্পর্ক, মান অভিমানের পালা… সব কি এক লহমায় ভুলে যাওয়া যায়? সবকিছু কি এতই সহজ? ঘরে ঢুকে অণিমার পিঠে হাত রাখি| হাত সরিয়ে দেয় না সে, বরং ফুঁপিয়ে উঠে দুহাত দিয়ে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে আমায়, কি ভুল করেছিলাম বৌদি? কি ভুল করেছিলাম বলো তুমি?

কোন ভুল নেই তোমার, শুধু একজন ভুল মানুষকে ভালবাসা ছাড়া| আমি ওকে আঁকড়ে ধরে বললাম| যে অপ মান আজ তোমায় রাতুল করল তার জবাব তোমাকেই দিতে হবে উপযুক্ত যোগ্যতা অর্জন করে| আজ থেকে আর কান্নাকাটি নয়, শুধু একটাই শপথ নাও, আমি নিজেকে তৈরি করব|

তাহলে তো তোমারও নিজেকে তৈরি করা উচিত বৌদি| সারাজীবন দাদার উপর নির্ভর করে থাকবে কেন? বন্ধ ঘরের আড়াল দৃশ্য দূষণ এড়াতে পারে কিন্তু শব্দ দূষণ? পারে কি?

অণিমার আজ বিয়ে, একজন ভাল মনের সরকারী আধিকারিকের সঙ্গে| সে নিজেই দেখেশুনে পছন্দ করেছে| অণিমা মোটামুটি নামকরা একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়ায় আর আমি এখানকার প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের রিসেপশনিস্ট| আমার চার বছরের মেয়েটা পিপির বিয়ে উপলক্ষ্যে নতুন জামা পড়ে উঠোনে খেলে বেড়াচ্ছে| রাতে ফিশ ফ্রাই খেতে পাবে বলে মুখ খানা হাসি হাসি| সেদিনের পর আমার কাছে এসে ক্ষমা চেয়েছিল স্বরূপ, আমি করে দিয়েছি|ভালই জানতাম কোন মানসিক অবস্থায় দাঁড়িয়ে ও এমনটা করেছিল! রুমে গিফ্টগুলো রাখতে এসেছিলাম এমন সময় ধুতি পাঞ্জাবি পরা দায়িত্ববান স্বরূপ এসে দাঁড়াল আমার সামনে| দরজা বন্ধ করে কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে চুপিচুপি বলল, ভাগ্যিস সেদিন নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে ভুলটা ভাঙিয়ে দিয়েছিলে, তাই হয়ত নতুন আলোয় তোমাকে চিনতে পারলাম|

( সমাপ্ত )

©️ Monkemoner dakbakso – Anindita