রুশো পর্ব-০৪

0
15

রুশো

__________________________

পরেরবার ওরা যোগাযোগ করেছিল দিন সাতেকের মধ্যে। সেবার আর মেইলে নয়, সরাসরি। অফিস শেষে বেরিয়েই মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিল খুব পরিচিত একজন মানুষের সাথে; হানিফ আঙ্কেলের পিএ। রুশোর ভাষায় হানিফ আঙ্কেল, ওর বাবার রিটায়ারমেন্ট পরবর্তী ব্যবসায়ীক বন্ধু, দেশের শীর্ষ দশ বিজনেসম্যানদের মধ্যে একজন। রুশো তখনই আন্দাজ করতে পেরেছিল এতদিনের উদ্ভট নম্বরগুলোর ছোটো ছোটো ক্লিপস পাঠিয়ে ওর নার্ভে চাপ প্রয়োগ করা ব্যক্তিদের সারিতে বাবার কাছের বন্ধুটিও একজন। অবাক হয়নি, শীতল দৃষ্টিতে একবার পিএ লোকটার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় শুধু জানতে চেয়েছে, কোথায় যেতে হবে তার সাথে? বিশেষ বাক্য ব্যয় সেও করেনি পাল্টা। শুধু অপ্রয়োজনীয় স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রুশোকে ঢাকার বাইরে, হানিফ জোয়ার্দারের রেস্ট হাউজে।
রেস্ট হাউজের লোকেশন অপেক্ষাকৃত সুনসান জায়গায়, প্রায় ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। বাইরে থেকে হুট করে আন্দাজ করা যায় না ভেতরে মানুষ থাকতে পারে। এমন একটা জায়গায়, নিরস্ত্র শত্রুপক্ষের সামনাসামনি পড়ে যাওয়া, যেকোনো কিছুই হতে পারত ওর সাথে। অথচ ওর মধ্যে এসবের ফিলিংস ছিল না। অবাক হওয়া, ভয় পাওয়া এসব যেন ভুলেই গিয়েছিল রুশো।
তবে ওর নিউট্রাল আচরণ ততক্ষণ, যতক্ষণ অবধি না রেস্ট হাউজে অপেক্ষমান ঐ মানুষগুলোর মুখ দেখতে পায়। বিগত কয়েক মাসের অমানসিক প্রেশার ওর অনুভূতির সব অংশগুলোকে শুষে নিলেও ভেতরে পা রাখার পর নতুন করে নিজের মধ্যে একটা অনুভূতিশক্তি ফিরে পেল রুশো, বিস্মিত হবার শক্তি।
রাজসিক কায়দায় সাজানো ড্রইংরুমজুড়ে যখন চকচকে আসবাবপত্রের রঙ ছাপিয়ে ওখানে উপস্থিত মানুষগুলো বিশেষভাবে নজর কাড়ল তখন আর ও বিস্মিত না হয়ে পারলই না। তারপর, এক পা এক পা করে যতটা এগিয়ে যাচ্ছিল ততটাই ওর মনে হচ্ছিল, একপাল হিংস্র শেয়ালের মধ্যিখানে বেখেয়ালেই হেঁটে হেঁটে এসে পড়েছে ও। যেই শেয়ালগুলো মাস কয়েক আগে ছিঁড়েখুঁড়ে ওর বাবাকে শেষ করে দিয়েছিল বন্ধুর রূপ ধরে। হয়তো বাবাকেও ডেকেছিল সেদিন রাতে, কোনো প্রলোভন দেখিয়ে, আজ যেমন তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। তাহলে আজ কি তার শেষ হওয়ার পালা?

এমন প্রশ্ন একবার মাথায় নড়েচড়ে উঠলেও তা প্রতিষ্ঠা পেল না হানিফ জোয়ার্দারের কথাতে। সে বেশ স্বাভাবিকভাবেই রুশোকে ওয়েলকাম করে নিয়ে গিয়ে বসালো একপাল কুটিল রাজনীতিবিদদের মধ্যে। ভেতরে একটা আশংকা খানিক পরপর মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেও বাইরে রুশো দীঘির জলের মতো শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখল সবাইকে। অদ্ভুতভাবে ওখানে উপস্থিত সবাইকেই ও চিনত। চিনবে নাইবা কেন? এরা সবাই গোটা দেশের পরিচিত মুখ, প্রেস মিডিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বিভিন্ন কায়দায় হরহামেশা ছবি দেখা যায় এদের। একেজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর আসন দখল করে আছে। কিন্তু এরা আজ হুট করে হানিফ জোয়ার্দারের সাথে কেন? থিতু হতেই প্রশ্নটা ভেসে এলো রুশোর মাথায়। ওকে অবশ্য উত্তর খুঁজতে কষ্ট করতে হয়নি। পরক্ষনে ড্রিংক্সের গ্লাসে অল্পঅল্প চুমুক দিতে দিতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ওকে বলে উঠল,
— ইউ মাস্ট বি?
— রুশো, রুশো চৌধুরী। সান অফ আহসান চৌধুরী, রিমেম্বার?

পাশে থেকে বিগলিত স্বরে মনে করিয়ে দিল হানিফ। রুশোর ভ্রু কুঁচকে আসতে চাইলেও কঠিন মুখে বসে রইল চুপচাপ। দেখে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হাসলেন। মুখে চুকচুক শব্দ করে মেকি দুঃখ ফোটাবার চেষ্টা করে বললেন,
— আহসান, ভালো মানুষ ছিল। ইন্ট্যালিজেন্ট, কাম। পার্টনারশিপে এলে আমাদের বিজনেসটা..

কথা শেষ না করেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকাল। রুশোর এসব মেকি নাটক দেখে গায়ের রক্ত ফুটছিল অনবরত। দাঁতে দাঁত চেপে ক্রমাগত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছিল ও উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলার থেকে। হানিফ জোয়ার্দার বোধহয় কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিল ওর চোখমুখ দেখে। তাই খানিক বাদে খুক খুক করে গলা ঝেড়ে সরাসরি রুশোর উদ্দেশ্যে বলল,
— এতক্ষণে তুমি নিশ্চয়ই বুঝেই গিয়েছ রুশো, আহসানের মৃত্যুর পেছনের কারণ আর কে জড়িত রয়েছে তা আমাদের জানার বাইরে নয়। আর সেসব তোমাকে বিস্তারিত বলব বলেই এখানে ডেকে নিয়ে আসা।
— আর সেটায় আপনাদের ইন্টারেস্ট কি?
— হুমম, গুড কোয়শ্চন। আই লাইক ইট। আমাদের ইন্টারেস্ট! আমাদের ইন্টারেস্ট হলো মিস্টার রুশো চৌধুরী, এটা।

হাতের ইশারা করতেই সামনের দেয়ালে লাগানো স্ক্রিনে একঝাঁক মানুষের ছবি ভেসে উঠল। রুশো দেখতে পেল প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধানসহ কয়েকজন মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তির সিঙ্গেল কিছু ছবি দিয়ে একটা চার্টের মতো বানানো। কিন্তু এদের ছবি এভাবে একসাথে কেন? ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে হানিফ জোয়ার্দার উত্তর দিল,
— উই ওয়ান্ট দেম ডেড। অ্যান্ড তুমি আমাদের একজন এজেন্ট হবে রুশো। ইউ উইল বি আনাদার লিভিং এজেন্ট অফ আওয়ার্স, দ্য সাটানস (শয়তান)।
— হোয়াট? আপনারা পাগল হয়ে গেছেন। দিস ইজ ইম্পসিবল। পিএম কে মা-র-বেন আপনারা? পিএমকে! এত সহজ!

প্রবল রাগে গর্জন করে উঠেছিল রুশো। আর একমুহুর্ত বসতে চাইছিল না ওখানে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কিছু করে ফেলার আগে তখনই চলে আসতে চাইছিল। হানিফ আটকাল। এতবড় প্রস্তাব হুট করে শুনে ফেলার পর ওর প্রতিক্রিয়া যে এমন কিছুই হবে, আন্দাজ করতে পেরেছিল নিশ্চয়ই। তাই তো ওর মনের অসাড় দিকটাকে আরও ইন্সটিগেট করে পুরো ওকেই নিজেদের হাতের পুতুল করতে ছবি সরে গিয়ে র-একটা ফুটেজ প্লে হয়ে গেল সেকেন্ডের ব্যবধানে।
অবাক চোখে তাকিয়ে রুশো দেখল ওর বাবা, একটা গলফ কোর্সে নিজের প্রিয় স্টিক হাতে নিয়ে তারই বয়সী দুজন সহচরের সাথে পাশে হাঁটতে হাঁটতে গম্ভীর মুখে কিছু আলোচনা করছে। তিনজনের ঐ কথোপকথনে বাবা যতটা না বাক্য ব্যয় করছে তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি এক্সপ্রেসিভ ওয়েতে কথা বলছে বাকি দু’জন। যেন বিশেষভাবে জোর দিয়ে ওর বাবাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। বিপরীতে রুশোর বাবা যে ওদের কথায় সায় দিতে চাইছে না তা ওনার ল্যাঙ্গুয়েজে স্পষ্ট। তা দেখে লোকগুলোও ভীষণ ইম্পালসিভ হয়ে উঠছে সময়ে সময়ে।
এবং তাদের এই কথোপকথনের দৃশ্য চলল মাত্র মিনিট দুয়েক। তারপর একসময়, ওদের সমস্ত জোরজবরদস্তিকে ডিনাই করে রুশোর বাবা যখন চলে আসবে মাঠ থেকে, তখুনি কথা নেই, বার্তা নেই অকস্মাৎ একজন তার হাতের স্টিক দিয়ে রুশোর বাবার মাথায় আঘাত করে বসল।

আহসান চৌধুরী শক্ত-সামর্থ্য মানুষ। অতটুকু আঘাতে তার কিচ্ছু হবে না স্বাভাবিক। তবু, হঠাৎ আঘাতে কিছুটা টলে উঠলেও পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে সে ঠিকই ফাইট ব্যাক করতে তেড়ে এলো। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। বোধহয় তার লাক খারাপ ছিল, অথবা বিপরীতের দুই ব্যক্তির অভিসন্ধি শুরু থেকে তাকে মা-র্ডা-র করারই ছিল। তাই তাকে ওভাবে আঘাত পেয়েও তেড়ে আসতে দেখে চট করে কিছু একটা ইশারা করল দু’জনের একজন, সাথে সাথেই বুলেটের তীক্ষ্ণ শব্দে ভরে উঠল গোটা ঘর। কোথা থেকে বুলেট এলো, কারা ছুঁড়ল তার হদিস নেই।
বিস্ফারিত চোখে রুশো শুধু দেখল,ঠিক গাছ থেকে খসে পড়া একটা রুগ্ন পাতার মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ওর বাবার শরীর। বুলেটটা সরাসরি তাঁর বুক আর গলা সংলগ্ন স্থানকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। অনবরত রক্তের স্রোত গড়াতে গড়াতে চোখের সামনে তড়পে তড়পে নিস্তেজ হয়ে গেল ষাটোর্ধ হয়েও শক্ত সামর্থ্য সুপুরুষ আহসান চৌধুরী।
________________

এতদিন নানাভাবে ওর বাবার মৃত্যুর দিনের নানারকম ফুটেজ পাঠানো হচ্ছিল রুশোকে, সেখানে কোথাও বুলেটের শব্দ স্পষ্ট ছিল না। দু তিন সেকেন্ডের ভিডিও, শব্দের জায়গা কোথায়? রুশো ধরতে পারেনি, এতদিন নানা বাহানায় প্রভোক করে শেষ অস্ত্র হিসেবে এই শব্দটাকে শয়তানগুলো মূলত জমিয়ে রেখেছিল সময় এলে ওকে পুরোপুরি কাবু করবে বলে। নইলে গোটা কথোপকথনের মিউট ভিডিওতে শুধু শেষাংশে কেন বুলেটের শব্দ যুক্ত হলো? বাবা হারানোর ব্যথায় কাতর ছেলের মাথায় প্রশ্নটা খেলেনি তখন।

শুনতে শুনতে আমিই ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
— তুমি কথাগুলো শোনার চেষ্টা করনি রুশো?

ও কেমন অসামঞ্জস্যভাবে মাথা নাড়ল। বলল,
— নাহ্। মনে হচ্ছিল আমি স্টাক হয়ে গেছি রাইনা। প্রেজেন্টে থেকেও পাস্টের ঐ সময়টায়। ঐ ২৫৪ কিলোমিটার দূরে গলফ ক্লাবে, আমার বাবার লা-শের পাশে।
— ওনাকে পোর্টেই কেন ডিসপোজ করে দিল? সবাই জানল, কেইস হলো। ওদের ধরা পড়ে যাওয়ার চান্সেসও তো ছিল।
— ছিল না রাইনা। ওরাই ল মেকার, ওরাই কন্ট্রোলার। খুব ভালো করেই জানত ওদের বানানো আইন কখনোই মুখ ফিরিয়ে ওদের গলায় ফাঁসির দড়ি হবে না। এছাড়া বাবাকে ওপেনলি পোর্টে ডিসপোজ করা ওদের পাঠানো একটা মেসেজ ছিল।
— মেসেজ?
— ওয়েল কাইন্ড অফ ওয়ার্নিং। ওয়ার্নিং টু অল অফ দেম যারা পিএম এর দলের লোকের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্ল্যান করছিল বাবার মতই অন্য একটা পার্টির সাথে মিশে। পিএম সবই জানত। চাইলে তাদেরও ধরতে পারত, কিন্তু তারা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল। এছাড়া পলিটিক্সে কেউ ক্লিন থাকে না। দ্যাটস হোয়াই বন্ধুর মুখোশ পরে থাকা তাদের সবার কাছে পিএম লয়্যাল কুকুরদের দিয়ে ওয়ার্নিং পাঠিয়েছিল।

রুশোর কাছে দুর্বোধ্য সব কথাগুলো শুনে আমার খুব অস্থির লাগছিল। পাওয়ার, পলিটিক্স, মা-র্ডা-র! আমার সাদামাটা জীবনের পাশে হুট করে এসব জটিল শব্দের জাল কেন? জীবনকে এভাবে তো কল্পনা করিনি আমি কোনোদিন।
তেইশ বছরের ছোট্ট জীবন, গোটাটা আমার রঙিন কেটেছে। নিজের পরিবার, পড়াশোনা, ছবি আঁকা এসব নিয়ে। আর গোছানো এই ছকের বাইরে অন্য পৃথিবীর একাংশকেও আলাদাভাবে কোনোদিন ভাবিনি, ভাবার সময়ই পাইনি। এই যে আমার ভাবনা ছকের বাইরে একটা মানুষের আগমন, এটাও তো হুট করে। যদিও শুরুতে আমি একে মেনে নিতে চাইনি, পিছিয়েছি নিজের ছকের কথা মনে করে বারবার। তবু, এই মানুষটা, নিজের জীবনের ভয়ানক গল্প আপাদমস্তক লুকিয়ে মিথ্যে একটা মুখোশ পরা স্বল্প পরিচিত মানুষটা, এত দৃঢ়ভাবে তার পদক্ষেপ রাখল আমার হৃদয়ে। শক্ত বাঁধনে আটকে থাকা আমার মনের দরজাটা বৈশাখী হাওয়ার তোড়ে খুলে গেল সব বাঁধন কেটে। এরপর, চেষ্টা ভুলে সব মেনে নিয়ে, আমি যখন তাকে আর আটকাতে চাইলাম না,ভেসে যেতে চাইলাম হাওয়ার তোড়ে উদ্দেশ্যহীন পথে, তখনই তার মিথ্যে খসে পড়ল এত নির্মমভাবে? এতবড় সত্যির আঘাত, অন্যায় না করেও এতবড় শাস্তি সত্যি কি আমার প্রাপ্য? সত্যিই প্রাপ্য?

বুকের ভেতর অশান্তির প্রবল হাওয়া। চোখ ভেসে যেতে চাইছিল জলে। তবু নিজের আবেগকে সামলে, একবুক ভয় নিয়ে আমি একসময় জানতে চাইলাম,
— তোমার বাবা কেমন কাজের সাথে জড়িত ছিল রুশো?

প্রশ্ন শুনে ছোট্ট শ্বাস ফেলল ও। চোখ বন্ধ করে বোধহয় শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করল। কতটা পারল জানা নেই, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে হাসল একবার। অপরাধী গলায় বলল,
— সামথিং নেগেটিভ।
— নেগেটিভ?
— মানি লন্ডারিং। আমাদের শিপিং এর বিজনেস ছিল। সামহাউ ঐ বিজনেস করতে গিয়ে এসব রাঘববোয়ালদের সাথে পরিচয় হয় বাবার। তারপর ফলস ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে তার মানি লন্ডারিংয়ের রোডে জার্নি শুরু।
— ম…মানি লন্ডারিং!

থমকে গিয়েছিলাম আমি শুনে। এরা পুরো পরিবার ক্রিমিনাল। এদের রক্তে ক্রাইম বীজের মতো মিশে। এমন একটা ছেলের সাথে আমাদের বিন্দুমাত্র চেনাপরিচয় আছে, শুনলেও আমার বাবা….
নাহ্ আর ভাবতেই পারছিলাম না আমি। ভয়ে, লজ্জায়, ঘৃণায় আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। দু চোখে যে তখন বান ডেকেছে টের পাইনি। টের পেলাম যখন আরও একবার অসহায় মুখে আমার ঝরে পড়া অশ্রুবিন্দুগুলো আগলে নিতে হাত পেতে দিল রুশো। আহত স্বরে ধীরে ধীরে বলল,

— আ..আই নো রাইনা। হি ওয়াজ এ্য টোটালি গ্রে ক্যারেক্টার। কি..কিন্তু লোকটা আমার বাবা ছিল। আমার বাবা, যাকে কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি হাউ মাচ আই লাভড হিম। হয়তো বাবাও পারেনি কিংবা বলেনি কোনোদিন। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম, সবসময়, বাবা কীভাবে আমাকে নিজের কাছে আটকে রাখতে চাইত। হাউ হি ক্রেভড হিজ সানস প্রেজেন্স।
— আর তুমি আজকের এই ঘটনার সাথে কীভাবে জড়িত?

ওর আবেগে সায় না দিয়ে প্রশ্ন করে ফেললাম আমি। দ্বিতীয়বার এই প্রশ্নে একটু থেমে গেল রুশো। কাঁপা কাঁপা হাতে আমার ভিজে ওঠা গালের সমস্ত কান্নার ছাপ মুছে দিয়ে বলল,
— রিমেম্বার? আমি মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। টেকনিক্যাল দিকটা আমিই হ্যান্ডেল করেছিলাম।
— তোমার মিনিমাম লজ্জা নেই রুশো? এত সহজে, এত সাবলীল গলায় কীভাবে সব স্বীকার করছ? বিন্দুমাত্র ভয়ও কি নেই তোমার মাঝে?

সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম আমি একসময়। বিনিময়ে রুশোও ক্ষেপে গেল মুহুর্তের জন্য। গম্ভীর গলায় বলল,
— লজ্জা! কিসের লজ্জা? দে ডিজার্ভ দিস। ইভেন ওরা এর চাইতে ভয়াবহ মৃত্যু ডিজার্ভ করত। এক সেকেন্ডের মৃত্যু দিয়ে তো আমি ঋণী বানিয়ে দিলাম ওদেরকে। হাহ।

কথাগুলো বলার সময় রুশোর মুখে একটা প্রেতের মতো ছায়া ফুটে উঠল যেন। দেখে আমি ভীষণ ভয় পেলাম। স্বল্প দিনে তৈরি হওয়া ওর বুদ্ধিদীপ্ত সুপুরুষ চেহারা খসে পড়ে একটা দানবের ছবি টের পেয়ে বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল। ওখানে আর এক মুহুর্ত ব্যয় করতেও আমার মস্তিষ্ক সায় দিচ্ছিল না। তবু, বেহায়া বেপরোয়া মনের ডাক শুনে বসে রইলাম। স্থির থাকতে পারছিলাম না যদিও। কাঁদছিলাম অনবরত। ভয়ের ছায়া ছাপিয়ে অবিশ্বাসে। ঠিক সে সময়ে রুশো নিজের সত্ত্বায় ফিরে এলো। শক্ত করে আমার দু-হাত জড়িয়ে ধরে আর্দ্র গলায় বলল,
— আ..আর ভয়? আমার এখন শুধু একটাই ভয় রাইনা। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। জানি না, কীভাবে কখন, কেন তোমাকে আমার মনটা চেয়ে ফেলল এত! এখন আর তোমাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা ও নিতে পারবে না। আমি কি করব রাইনা বলো? কি করা উচিৎ আমার। আমার যে এখন শুধু তোমাকে চাই। শুধুই তোমাকেই চাই।

চলবে,
Sara