কোন প্রিয় নামে ডাকি পর্ব-০৭

0
1

#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [৭]
প্রভা আফরিন

প্রিয়তি ভিজিটিং কার্ডটা ভালোমতো দেখল। হ্যাঁ, এই ঠিকানাই লেখা। ঝা চকচকে মোড়কে আবৃত এ স্টুডেন্ট ভিসা কোম্পানিতে ঋজু চাকরি করে। প্রিয় মনে মনে দ্বিধান্বিত হলো এমন জায়গায় কেন ডাকল ঋজু! প্রিয়র যোগ্যতা বড়োজোর টিউশনি ও কেজিতে মাস্টারি করা অবধিই। এর বাইরে জীবনে কিছু করে দেখেনি। অভিজ্ঞতা শূন্য। অনার্সের সার্টিফিকেটটাও এখনো জোটেনি। এই যোগ্যতায় কোন সোনার হরিণ পাবে সে? প্রিয় ভেতরে ঢোকার আত্মবিশ্বাসটাই পেল না। ফোন করল ঋজুকে। ঋজু চারতলা থেকে ছুটে এলো। প্রিয়কে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল, “শিরদাঁড়া বাঁকা কেন? ভয় লাগছে?”

“তো লাগবে না? আমার কি যোগ্যতা আছে এখানে চাকরি নেওয়ার?”

“আত্মবিশ্বাস হলো প্রথম যোগ্যতা। আমি তো জানতাম নিজের ওপর এইটুকু বিশ্বাস তোমার আছে। তুমি যদি নিজেই নিজেকে যোগ্য করার চেষ্টা না করে অযোগ্য ঘোষণা করো তাহলে অন্যরা তোমায় কেন মূল্যায়ন করবে?”

প্রিয় মুখ নিচু করে ফেলল। ঋজু ক্ষণকাল চুপ থেকে আবার বলল, “আমাদের এখানে স্টুডেন্টরাও জব করে তোমায় বলেছিলাম না?”

প্রিয় মাথা নাড়ল। ঋজু বলেছিল ফোনে। ঋজু আবার বলল, “তাহলে এতটা নার্ভাস হওয়া কেন? আমি কিন্তু নিজে তোমার নাম রেফার করেছি। জব হোক বা না হোক আমার নামটা ডুবিয়ো না।”

প্রিয়তির নার্ভাসনেস কাটাতে রোডসাইড একটা দোকান থেকে চা কিনে খেল। ঋজুও সঙ্গ দিলো। চায়ের কাপ খালি হওয়ার পর প্রিয় মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল, “আমি আপনার নাম না ডোবাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এরপরেও যদি ডুবে যায় তো নিজেই সাঁতরে তীর খুঁজে নেবেন।”

ঋজু হেসে বলল, “দ্যটস দ্য কনফিডেন্স। তুমি তো ইংলিশে অনার্স করছো, ইংলিশে ভালো বিধায় এ সাবজেক্টেই বেশি টিউশনি করেছো জানি।”

“ঠিক জানেন।”

“কম্পিউটারও জানো শুনেছি।”

“হ্যাঁ, সুহাস ভাইয়ার কাছ থেকে নিজ আগ্রহেই শিখেছিলাম কিছু।”

“এ দুটোই তোমার প্রধান যোগ্যতা। আমরা শুরুতে ইংরেজির ওপর দক্ষতা ও কম্পিউটার জানা কর্মীই খুঁজি। বাকিটা শিখিয়ে নেওয়া যায়। ভাইবা রুমে আমিও থাকব। ঘাবড়াবে না একদম। অল দ্য বেস্ট।”
___________

রেবেকা খানম ঢাকায় এসেছেন সপ্তাহখানেক হলো। উদ্দেশ্য নিজের চিকিৎসা ও ছেলের একলার সংসারটাকে একটু গুছিয়ে দিয়ে যাওয়া। অবশ্য একলার সংসারটাকে পরিপূর্ণ করার সাধ অনেকদিন ধরেই প্রকাশ করে আসছেন। ছেলেটা পাত্তা দিচ্ছে না। রেবেকার মাঝে মাঝে মনে হতো ছেলের বোধহয় পছন্দ আছে। তবে ঋজু সর্বদা অস্বীকার করেছে। কেমন মেয়ে পছন্দ উনার ছেলের তাও নিশ্চিত নন। সব মিলিয়ে রেবেকা বিভ্রান্ত।

ঋজুর অফিস শেষে রেবেকা প্রতিদিন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কেনাকাটা করেন। ঋজু একা রান্না করে খাবে, তাই হাড়ি-পাতিল সবই তিনি নিজেই পছন্দ করে কিনে দিচ্ছেন। আজ মশারি ও পর্দা কিনতে যাওয়ার কথা। তাই রেবেকা আগেভাগেই তৈরি হয়ে নিচ্ছিলেন যেন ছেলের সময় ব্যয় না হয়। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। অচেনা জায়গা, অচেনা মানুষজনের মাঝে রেবেকা খানম সম্পূর্ণ নতুন বলে কারো সঙ্গে মেশেন না। তিনি কিছুটা সংশয়ে দরজা সামান্য ফাঁকা করে উঁকি দিলেন। দেখলেন দুজন নারী দরজার ওপারে। দ্বিধার সুরে বললেন, “কাকে চাই?”

“আরে ভাবি, আমি আইরিন বলছি। সুহাসের মা। চিনেছেন?”

রেবেকা চিনলেন অনায়াসে। ওদের বাড়িতেই তো ছিল ঋজু। কৃতজ্ঞচিত্তে দরজা খুলে দিলেন উনি। আইরিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকে বোরকার মুখ খুলল। রেবেকা ইতস্তত করে বললেন, “আসলে বুঝতেই পারছেন ছেলের নতুন ঘর। বসতে দেওয়ার চেয়ারটাও নেই। টুকটাক দুজনে মিলে কিনছি আরকি।”

আইরিন বললেন, “আরে ভাবি সংকোচ করবেন না। ঋজু আমারও ছেলে, ওর বাড়িতে আবার আমাকে আলাদা সমাদর করতে হবে নাকি?”

রেবেকা কৃতজ্ঞতার সুরে বললেন, “আপনারা ছিলেন বলেই ছেলেটা দূরে আছে জেনেও নিশ্চিন্তে ছিলাম। কোনোদিন এই ঋণ শোধ করার সুযোগ এলে অবশ্যই করব।”

এ কথায় আইরিনের হাসি আকর্ণবিস্তৃত হলো। তিনি হাত ধরে মেয়েকে কাছে টেনে বললেন, “এই যে আমার মেয়ে সুজানা। এবার ম্যাট্রিক দেবে। চিনেছেন?”

রেবেকা হেসে সুজানাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “সেই বালিকা বয়সে শেষ দেখেছিলাম। মেয়ে তো মা শা আল্লাহ বড় হয়ে গেছে।”

“আপনাদের দোয়ায়, ভাবি। ঋজু যতদিন আমাদের বাড়িতে ছিল ও তো ঋজু ভাই ছাড়া একবেলাও খায়নি। এখন চলে আসায় ফাপড় হয়ে গেছে। বায়না ধরেছে ঋজুকে দেখে যাবে। আমিও ভাবলাম ছেলেটা কি খাচ্ছে কীভাবে থাকছে দেখে আসি৷ আপনার সঙ্গে দেখা করারও ইচ্ছে ছিল। তাই চলে এলাম। ডিস্টার্ব করলাম না তো?”

রেবেকা তড়িঘড়ি বললেন, “ডিস্টার্ব হবো কেন? আপনার যখন ইচ্ছে চলে আসবেন। এই অচেনা শহরে ছেলেটাকে দেখার জন্য কেউ আছে জেনে আমিও শান্তি পাই।”

সুজানা ঋজুর মাকে ছোটোবেলায় দেখেছে কিনা ঠিক মনে করতে পারছে না। ভেবেছিল ঋজুর মা কোনো আটপৌরে মফস্বলি গৃহিণী হবেন। কিন্তু সামনে থেকে দেখে ধারণাই বদলে গেল। ঋজু যেমন স্মার্ট, তার মাও এই বয়সে দারুণ স্মার্ট। বেশভূষা, কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি সবেতেই মার্জিত রুচিশীলতার ছাপ ফুটে উঠেছে। সুজানা দুজনের অহেতুক কথাবার্তায় বিরক্ত হচ্ছে। সে এসেছে ঋজুকে দেখতে অথচ তার দেখা নেই। ও বলে উঠল, “ঋজু ভাইয়া কোথায়, আন্টি? দেখছি না তো।”

“ও তো অফিসে মামণি। আসার সময় হয়ে গেছে।”

“আপনি নাকি অসুস্থ, আন্টি? এখন কেমন আছেন?”

“ভালো আছি মা। তোমরা খাটে বসো আমি দুই মিনিটে আসছি।”

রেবেকা চলে গেলেন রান্নাঘরে মেহমানদের জন্য নাশতা প্রস্তুত করে আনতে।
____________

প্রিয়তি ভাইবা উতরে গেছে সাবলীলভাবে। যতটা ভয়ংকর ভেবেছিল ততটাও নয়। তবুও প্রিয়র মন খারাপ। ও সকলের কথার ধরনেই বুঝেছে ওরা একজন স্মার্ট ও প্রেজেন্টেবল মেয়ে খুঁজছে। প্রিয় সে তুলনায় বেমানানই। হয়তো ঋজুর রেফারেন্সে চাকরি হয়েও যেতে পারে। কিন্তু কাজে স্বস্তি কি মিলবে?

ভাইবা শেষে প্রিয় অফিসেই রয়ে গেছিল। ঋজু ওকে কাজগুলো নিজের হাতে দেখিয়েছে। বলেছে, “চাকরি হোক বা না হোক, দেখতে অসুবিধা কই? তাছাড়া একটা এসিস্ট্যান্ট পেলে আমার প্রেশারও কমে যায়। এ জন্যই তোমায় এত সাদর করছি। এর বেশি কিছু ভেবো না আবার।”

দুপুরে ঋজুর সঙ্গেই খেয়েছে প্রিয়তি। বিকেলে একসঙ্গে অফিস থেকে বের হয়ে রিকশা নিল। প্রিয় শুরুতে গাইগুই করল, “আপনি চলে যান আমি বাসে উঠে চলে যাব।”

ঋজু সংকোচের কারণ ধরতে পেরে বলল, “তুমি এসো তো। দুজনে অনায়াসে বসতে পারব।”

প্রিয়র আপত্তি তুললেও ঋজুর সামনে সেসব বাঁধা টিকল না। অগত্যা একসঙ্গে বসতে হলো। প্রিয় এর আগে চাচির সঙ্গে বাজারে যেতে বেশ কয়েকবার রিকশায় উঠেছিল। চাচি বাজারে গেলে ওকেই সঙ্গে নিতো জিনিসপত্র বহনের জন্য। রিকশায় চড়ে বলতো, “তোর তো আস্ত একটা রিকশা লাগবে। ধর আমায়, নাহয় পড়ে যাব।”

সেই সংকোচে প্রিয় একটু সরে সরে বসছিল যেন ঋজুর বসতে অসুবিধা না হয়। ঋজু বুঝতে পেরে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এভাবে চাপতে থাকলে পড়ে যাবে তো। পরে তো ঠেলে ফেলে দিয়েছি ভেবে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে। এই বয়সে মা’ম’লা খাওয়ার সাধ নেই। নাও, ধরে বসো আমায়।”

প্রিয় হাত ধরল না। শেষমেষ ঋজু নিজেই ওর ঠান্ডা নরম হাতটা আঁকড়ে ধরল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেল প্রিয়র ফোলা দুটি গালে শিমুল ফুলের রঙ ধরেছে। বিকেলের কমলাটে আলোয় সে রঙ বড্ড আদুরে দেখাচ্ছে। প্রিয়র লজ্জা বাড়াতে ঋজু চাপা হেসে বলল, “তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো, অপ্রিয়?”

প্রিয় অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “না, লজ্জা পাওয়ার ভান করছি।”

“তুমি বরং ভানই করো, বেফাঁসে সত্যি বলার জন্য আমি তো আছিই।”

চলবে…