কোন প্রিয় নামে ডাকি পর্ব-১০

0
1

#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [১০]
প্রভা আফরিন

অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পর প্রিয়তি দেখল মালেকা বেগম তার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি প্রিয়তির একমাত্র খালা। মায়ের সঙ্গে প্রিয়র দেখাদেখি ও কথা বন্ধ থাকলেও খালার সঙ্গে কালেভদ্রে দেখাসাক্ষাৎ হয়। খালার আগমনের পেছনেও যে মায়ের হাত আছে তা প্রিয় জানে। মালেকা বেগম বোনঝিকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। প্রিয়কে আদর করে পাশে বসিয়ে বললেন, “কিরে মা, তুই নাকি চাকরি নিয়েছিস? এত দুঃসময় চলতেছে বলবি না? আমরা কি সব ম’রে গেছি?”

কথাটা আইরিনের গায়ে লাগল বেশ। জবাব দিতেও কার্পণ্য করলেন না, “দুঃসময় বলতে কি বোঝাতে চাও, মালেকা? ওরে কি খেতে দেই না? অভাবে রাখছি বলতে চাও?”

মালেকা হাসিমুখে জবাব দিলেন, “সব কথা নিজের গায়ে মাখো কেন, আইরিন? কীভাবে রাখছো তা কি জানি না, না দেখি না? আর আমি আসলে সব সময় কাছে ঘুরঘুর করো কেন? আমাদের একলা ছেড়ে দেও না। ভয় পেয়ো না, তুমি যেভাবে ছোটো থাকতে ফুসমন্তর দিয়ে মেয়েটারে মায়ের থেকে মুখ ফিরায়ে রেখে নিজের ঘরের বান্দি বানায়ে রাখছো, আমি সেইভাবে তোমার বিরুদ্ধে ফুসমন্তর দেবো না।”

আইরিন ফোঁস করে জ্ব’লে উঠলেন। এই অযাচিত মেহমানটিকে তিনি একদমই সহ্য করতে পারেন না। আবার মালেকার ধারালো জবানকে ভয়ও করেন। তাই মালেকা এলে তিনি সর্বদা এদিকে কান পেতে থাকেন। কে জানে কোন কুবুদ্ধি দিয়ে যায় মেয়েটাকে। তিনি মালেকার কথার জবাবে লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে একহাতে প্রিয়র বাহু ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি কী তোকে মায়ের বিরুদ্ধে ফুসমন্তর দিয়েছি? বলেছি মায়ের সাথে দেখা না করতে? তোর খালা এসে আমাকে এই কথা শোনায় কোন সাহসে?”

মালেকাও জবাব দিতে ছাড়লেন না, “ওকে বলতে হবে কেন? উপরের দিকে চাইলেই বোঝা যায় আকাশের অবস্থা। তার জন্য অন্যকে জিজ্ঞেস করতে হয় না। মুখ খুলাইয়ো না আইরিন। তুমি যে কোন স্বার্থে প্রিয়রে নিজের সংসারে ধরে রাখছো তা কি জানি না?”

জোকের মুখে একদলা নুন পড়ল। কথার বাণে পরাজিত আইরিন ফোঁসফোঁস করতে করতে স্থান ত্যাগ করলেন। প্রিয় সবটাই নিরবে দেখল। আগে যখন খালা এলে চাচি ঝামেলা করতেন, ও কেঁদে ফেলত। খালাকে মানা করত যেন না আসে। কেননা তিনি চলে গেলে তো চাচি প্রিয়র সঙ্গেই বোঝাপড়া করবেন। তবে এখন আর দুজনের মাঝে সে প্রবেশ করে না। প্রিয় জানে চাচির সীমাবদ্ধতা কোথায়, এমনকি জানে খালার সীমাবদ্ধতা। তাই কাউকেই থামানোর প্রয়োজন অনুভব করে না। ওদের সীমাবদ্ধতাই ওদের থামিয়ে দেয়।

মালেকা আইরিনের প্রসঙ্গ ছেড়ে বললেন, “মা ফোন দিলে ধরিস না কেন?”

“এটা বলতে পাঠিয়েছে তোমায়?”

“বুবুর পাঠাতে হবে? আমি কি আমার বোনঝিকে দেখতে আসতে পারি না?”

“পারবে না কেন? কিন্তু প্রতিবার এসে আরেকজনের হুকুম তামিল করো তো, তাই বললাম।”

মালেকা প্রিয়র দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “সংসার সামলেই তো জীবন পার হয়ে যায়। তার মাঝখান থেকে যখন সময় বের করে তোকে দেখতে আসতে চাই তখন যদি বুবু তোর জন্য কোনো খবর পাঠায় সেটা কি হুকুম তামিল করা হয় নাকি? আমি ভাই স্পষ্ট কথা বলি। জগতে সবাই সবার স্বার্থটাই আগে দেখে। আমার স্বার্থ আমার সংসার, তাই ওটাকে সামলেই অন্যকিছুর জন্য সময় বের করি। তোর চাচা-চাচি তাদের স্বার্থের জন্যই তোকে রেখেছে। কিছুটা বাধ্যও হয়েছে। নাহলে তোর আর যাওয়ার জায়গা ছিল কই? ওদেরই আশ্রয় দিতে হতো। তোর বাবা মা’রা যাওয়ার পর তোকে নিয়ে যখন বুবু এ বাড়িতে ছিল কম কষ্ট করেনি। বুবু বুঝে গেছিল এভাবে জীবন চলবে না। তাই দ্বিতীয় বিয়ে করে নিরাপত্তা খুঁজেছিল। ভেবেছিল নিজে থিতু হয়ে তোকেও কাছে রাখবে। কিন্তু ততদিনে চাচা-চাচি মিলে তোর মনটাকে বিষিয়ে দিয়েছে বুবুর প্রতি। দোষ কাকে দেব? ভাগ্যকে দিতে পারি। তোর বাবা না মা’রা গেলে তো আর এতকিছু হতো না।”

প্রিয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “জীবন তো মানিয়ে নেওয়ার। তাই দোষারোপ করা ছেড়ে দিয়েছি। নিজের ভালোর জন্য যা করা উচিত তাই করছি।”

মালেকা খুশি হয়ে বললেন, “তোর চিন্তাভাবনায় কত বদল এসেছে রে প্রিয়। আগে তো শুধু কাঁদতি। যাক আলহামদুলিল্লাহ। আমি চাই তুইও নিজ স্বার্থ বুঝে চলতে শেখ। তাহলে আর চিন্তা নেই।”

“চা খাবে, খালা?”

“খাব। তবে বাইরে। তোকে নিয়ে বেরোবো।”

প্রিয় রাজি হলো। খালা যতবার আসেন প্রিয়কে সঙ্গে নিয়ে বের হন। বাইরে ভালোমন্দ খাওয়া-দাওয়া করেন। কিন্তু ওর চাচা-চাচির বাড়িতে পানিও স্পর্শ করেন না।
_____________

সন্ধ্যার সন্নিকটে বাড়ি ফিরল ঋজু। মায়ের টেস্টের রিপোর্টগুলো হাসপাতাল থেকে আনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে। রিপোর্টগুলো নিয়ে পরবর্তী তারিখে আবার হাসপাতালে যেতে হবে। রেবেকা ছেলের জন্য খাবার প্রস্তুত করে বসে আছেন। ঋজু গোসল সেরে ফিরতেই বললেন, “রিপোর্ট দেখে কি বুঝলি?”

“বুঝতে পারছি না। ডাক্তার দেখালেই নিশ্চিত হতে পারব।”

“শুধু শুধু টাকা নষ্ট। এগুলোকে বলে বয়সের দোষ। সবারই হয়। তাই বলে পানির মতো টাকা খরচ করতে হবে?”

ঋজু মায়ের কথায় পাত্তা দিলো না। রেবেকা আবার বললেন, “তারচেয়ে তুই আমায় বউমা এনে দে। তোর চিন্তা, সংসারের চিন্তা কমে গেলে দেখবি এমনিতেই সুস্থ হয়ে গেছি।”

ঋজু উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসল শুধু। রেবেকা আবার বললেন, “আজকে সুহাসের মা, বোন এসেছিল দুপুরে।”

ঋজুর ভ্রু কুচকে গেল, “হঠাৎ ওরা?”

“দাওয়াত দিয়ে গেল। আমাকে নাকি রেঁধে খাওয়ানোর ইচ্ছে ওনার। শুক্রবারে তোকে নিয়ে দুপুরে যেতে বলেছে। মা মেয়ে বেশ ভালো।”

“আচ্ছা যাব।”

“মেয়েটাকে নিয়ে দুঃখ করছিল খুব। ষোলো না পেরোতেই মানুষের কু নজরে পড়তে আরম্ভ করেছে।”

ঋজু অগুরুত্বপূর্ণ কথার মতোই দায়সারা উত্তর দিলো, “অন্যের নজর কাড়ার ইচ্ছে থাকলে সুনজরের পাশাপাশি কুনজরও সইতে হবে।”

“মেয়েটাকে তো বেশ চালাক-চতুর মনে হলো। আগেভাগে বিয়ে দিয়ে দিতে চায়। আমাকেও বলল যেন ভালো পাত্র পেলে জানাই।”

ঋজু এবার ভ্রুকুটি করল, “তুমি আবার সুজানাকে নিয়ে বেশি ভাবতে যেও না। যাদের মেয়ে তারাই ভাবুক। আমাদের এত কথা শুনে কাজ নেই।”

“আমারও তো একটা বিবাহযোগ্য ছেলে আছে। ভাবনা কি কম?”

“ভাবনা কমিয়ে দেব। শুধু একটু দোয়া করো আমার জন্য। সবটা যেন সহজ হয়ে যায়।”

ঋজু মাকে সামান্য ইঙ্গিত দিয়েই সরে পড়ল। রুমে ঢুকে প্রিয়তির ফোনে কল করে বলল, “হ্যালো অপ্রিয়! তোমার কি কারো প্রিয়তমা হতে ইচ্ছে করে?”
_____________

সন্ধ্যা সাতটা। সুহাস অফিস থেকে ফেরার পথে একটা মেয়েকে রাস্তার পাশ দিয়ে দিশেহারার মতো দৌড়াতে দেখে কিছুটা অবাক হলো। নগরবাতির আলোয় বোঝা গেল একটা কুকুর মেয়েটিকে তাড়া করেছে। রাত-বিরেতে একটা বিপন্ন মেয়েকে ফেলে চলে যেতে ইচ্ছে করল না সাহায্যপরায়ণ সুহাসের। সে বাইক টেনে ছুটন্ত মেয়েটার কাছে নিয়ে স্পিড কমিয়ে বলল, “বাইকে উঠুন। ধরতে পারবে না।”

মেয়েটি লাফিয়ে বাইকে উঠতেই সুহাস স্পিড বাড়িয়ে মুহূর্তেই সেখান থেকে হাওয়া হয়ে গেল। কিছুদূর এগিয়ে একটা লোকারণ্য গলিতে বাইক থামাল সুহাস। মেয়েটি বাইক থেকে নেমে কৃতজ্ঞ সুরে বলে উঠল, “অনেক ধন্যবাদ ভাই। আপনি না থাকলে আজকে চৌদ্দটা ইনজেকশনের গু’তা খাওয়া কনফার্ম…”

বলতে বলতে থেমে গেল মেয়েটি। সুহাসও হেলমেট খুলে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। দুজন দুজনের দিকে চেয়ে একইসঙ্গে বলে উঠল, “আপনি?”

একই দিনে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হতে পারে এটা ওদের ভাবনার বাইরে ছিল। সুহাস বিরক্তি নিয়ে বলল, “আমার বাইকের সামনেই বারবার আপনাকে বিপদে পড়তে হয়?”

চারুও কঠিন গলায় বলল, “কেন? আপনার বাইকের সামনে বিপদে পড়তে কি স্পেশাল পারমিশন দরকার পড়ে? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে আপনি আমায় ফলো করেন।”

সুহাস তাচ্ছিল্যে হেসে উঠল, “নিজেকে আয়নায় দেখেন নিয়মিত?”

“দেখি। দেখি বলেই আমার গা দিয়ে ঘামের দুর্গন্ধ বের হয় না।”

সুহাস চরম বিব্রতবোধ করল। তার গায়ে আসলেই ঘামের দুর্গন্ধ। কটমট করে বলল, “আপনি একটা চরম অকৃতজ্ঞ মেয়ে। আমি আপনাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলাম তার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়ার বদলে আমার গায়ের ঘামের গন্ধ বিশ্লেষণ করছেন?”

চারু মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, “আপনিও ভালো মানুষ না। নাহলে একজনের উপকার করার পর তার পূর্ব পরিচয়ের জেরে খোঁচা মারতে আসতেন না। সকালে আপনার জন্যই সবার সামনে পড়ে গিয়ে মান-ইজ্জত প্লাস্টিক হয়ে গেছিল। তারওপর সরিও বলেননি। তাই আমিও ধন্যবাদটাও উইথ ড্র করলাম। সমান সমান। টা-টা!”

চারু উলটো ঘুরে পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল। সুহাস হতভম্ব হয়ে বিড়বিড় করল, “আস্ত ধড়িবাজ মেয়ে!”

চলবে…