কোন প্রিয় নামে ডাকি পর্ব-১২

0
1

#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [১২]
প্রভা আফরিন

সুহাসের সঙ্গে চারুর দেখা হয়েছে দুইবার, কোনো না কোনো অঘটনের মাধ্যমে। আর দুইবার-ই চারুর কার্যক্রম দেখে সুহাস মনে মনে মেয়েটাকে আধপাগল ভেবে নিয়েছে। হয়তো চারুও তাই। এবারের দেখা হওয়াটা অতি সাধারণ বলেই কেমন একটা খাপছাড়া লাগছে। সুহাসকে দেখে চারুও চুপ হয়ে গেছিল। এদিকে প্রিয়তি প্রথমবার বাড়িতে আসা চারুর জন্য নাশতা আনতে চাইলে চারু উঠতে দিলো না। বলল, “রাখো তোমার ফর্মালিটি। এই পা নিয়ে বেশি নড়াচড়া করার দরকার নেই। দুদিন টানা রেস্ট নিলেই দেখবে ক্যাঙারুর মতো লাফাতে পারছো।”

সুহাস চলে যাচ্ছিল। চারুর কথা শুনে থমকে গিয়ে বলল, “পায়ে কি হয়েছে, প্রিয়?”

প্রিয় ঠোঁট উলটে বলল, “রাস্তায় পড়ে গেছি।”

“বাইকের ধাক্কা খেয়ে।” বাক্যটা সম্পূর্ণ করে দিলো চারু।

প্রিয় কৃতজ্ঞতার সুরে বলল, “চারু আমাকে নিয়ে এলো বাড়িতে। এত করে বললাম কিছু হয়নি, মেয়েটা শুনলোই না।”

সুহাস উদ্বিগ্ন মনে এগিয়ে এলো। পা-টা দেখতে চাইলে প্রিয় নিষেধ করল। সুহাস তবুও সন্দিগ্ধ, “লুকাস না গা’ধী। ভালো করে বল বেশি চোট পেয়েছিস কিনা।”

চারু ফোড়ন কেটে বলল, “চোট পেলেও বা কি? এখন তো আপুকে দিয়ে মাছ, মাংস সব কা’টাবেন। আহত মানুষটাকে একটু রেস্ট করতেও বলেনি কেউ।”

সুহাসের বুঝতে বাকি রইল না কিছু। মায়ের আচরণের জন্য নতুন মেয়েটির সামনে লজ্জিতও হলো বেশ। সে গলা উঁচিয়ে বলল, “তুই ঘরে গিয়ে রেস্ট কর।”

প্রিয় শুরুতে রাজি হতে পারল না। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে যেমন লাগা যায় না, তেমনই এক বাড়িতে থেকে চাচির সঙ্গে ঝামেলা করা যায় না। শত হোক তিনি প্রিয়কে আশ্রয় দিয়েছে। সেই কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে প্রিয়রও কিছু দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি দায়বদ্ধতা প্রকাশের নয়। তাই নিজের শরীরের মায়ায় সুহাসের কথা মানতেই হলো। কিন্তু মানলেন না আইরিন। ছেলের কথা শুনে জ্বলে উঠে বললেন,
“মায়ের কষ্ট চোখে পড়ে না তোর? সারাদিন খেটে মরছি, রাতে হাঁটুর ব্যথায় কাতরাই সেগুলো দেখিস না? আরেকজন চাকরির নাম করে সারাদিন বাইরে থেকে এসে কাজ দেখে অসুস্থতার নাটক সাজায় সেগুলো দেখে দরদ উথলে ওঠে!”

সুহাস বিরক্ত সুরে বলল, “আমি আগেই বলেছি একজন বুয়া রাখো। তাহলে এত ঝামেলা হয় না।”

“বুয়া রাখব টাকা কি গাছে ধরে? দুটো টাকা আয় না করে শুধু ব্যয় করলেই হবে?”

সুহাস এবার ভাবুক গলায় বলল, “আমার কথা তো সেটাই। যে মানুষ না পারতে দুটো টাকা ব্যয় করে না, সে আজ এত মাছ, মাংস এনেছে কী কারণে?”

আইরিন এ কথায় যেন সামান্য টলে গেলেন। তবে দমে গেলেন না। বললেন, “ঘরে বিয়ের যোগ্য মেয়ে থাকলে এসব করতেই হয়। তোর মাথায় এসব ঢুকবে না। কাল ঋজুরা যেন আসে সেটা নিশ্চিত কর।”

সুহাস তাচ্ছিল্য করেই যেন বলল, “এসব করে কোনো লাভ নেই, মা। ওই মাছ তোমার বড়শিতে গাঁথবে না।”

“সেটা নাহয় আমাকেই বুঝতে দে। বড়শিতে না হলে জাল দিয়ে ধরব।”

সুহাস ও তার মায়ের চেঁচামেচি ঘরে বসে টুকটাক শুনতে পেল চারু। স্বগোতক্তি করে বলল, “এটা চাচি না কেচি? ক্যাচক্যাচ করে যাচ্ছে।”

প্রিয় শুনতে পায়নি সে কথা। বলল, “একা একা কি বিড়বিড় করছো?”

“তোমার সৌভাগ্যের প্রশংসা করছি।”

প্রিয় আমতা আমতা করে বলল, “একটা সংসারে থাকলে এগুলো হয় রে, বোন। কেউ কারো মনের মতো হতে পারে না। আমার কথা বাদ দাও। অফিস শেষে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি না গিয়ে এতদূর চলে এলে। বাড়িতে টেনশন করবে না?”

চারু সরল হাসল। বলল, “আমার অপেক্ষায় কেউ নেই।”

“মানে?”

“মানে পরিবার বলতে যাদের বোঝায়, বাবা-মা, তারা কেউই নেই।”

প্রিয় করুণ চোখে চাইল। সে চোখের ভাষা বুঝতে পেরে চারু হাত তুলে বলল, “আরে মা’রা যাওয়ার কথা বলিনি। আসলে বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না।”

প্রিয় কপাল কুচকে বলল, “জানো না কেন?”

“শুনেছি বাপটা নে’শা করত। মা হতদরিদ্র ঘরের হয়েও নিজ চেষ্টায় একটু লেখাপড়া শিখেছিল, বই পড়তে খুব ভালোবাসত। রুচিও নাকি বেশ সৌখিন ছিল। আমার নে’শা’খোর বাপের নজর গেছিল মায়ের ওপর। তাই কৌশলে চরিত্রে বদনাম দিয়ে বিয়ে করেছিল। সেই থেকে মায়ের রুচিতে অরুচি ধরল। বর বেকার, তাই লোকের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাত। পাশাপাশি বরকে নে’শার টাকা দিতে হতো। না দিলে মা’র’ধোর করত। মা সবই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমার ছোটো ভাইটা পেটে আসার পর নাকি বাপ পর’কী’য়া করতে শুরু করে। ছোটোবেলায় ভাবতাম পর’কী’য়া মানে পরের উপকার করা, হা হা! বড় হয়ে বুঝলাম বাপটা খুবই নোংরা মানুষ ছিল। মা তখন থেকেই আলাদা হয়ে যায়। এরপর বাপটা কই নিরুদ্দেশ হয় মা জানত না। কয়েক বছর বাদে মায়েরও নাকি নতুন কেউ জুটেছিল। তাই আমাকে আর ভাইকে নানির কাছে ফেলে তিনিও নিরুদ্দেশ। আমার অবশ্য ছোটোবেলার স্মৃতি স্পষ্ট মনে নেই। বাবা-মায়ের চেহারাটাও ভুলে গেছি। ভালোই হয়েছে। নাহলে কোনোদিন যদি দেখা হয়ে যেত তারাও লজ্জা পেত, আমিও পেতাম। তারচেয়ে আঠারো কোটি মানুষের মাঝে লুকিয়ে থাকুক। এতেই মঙ্গল।”

“তাহলে নানি তোমাদের ভাই-বোনকে বড় করেছেন?”

“উঁহু, ব্যবহার করেছেন।”

“মানে?”

চারু বেশ তাচ্ছিল্যের সুরেই বলল, “আমার নানি বেশ শক্ত-সামর্থ্যবান নারী ছিলেন। সারাদিন রোদে পুড়েও ক্লান্ত হতেন না। সেইসঙ্গে ছিলেন দারুণ চালাক। তাই তো আমার ছোট ভাইটাকে কোলে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়াতেন।”

প্রিয় মুখে হাত চাপা দিলো, “কী বলছো?”

চারু হেসে বলল, “নিম্নবিত্ত শ্রেণির স্বার্থপরতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই আপু। ভিক্ষার টাকা সব নানি কই লুকাতেন তিনিই জানেন। আমাকে আর ভাইকে খেতে দিতেন দুমুঠো ভাত। ওই খেয়েই নানির প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলাম। নানির কাছে বহু আবদার করে সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। বারো বছর বয়স যখন, নানি একদিন বললেন,
‘হইছোস বাপের মতো কালাকুলা, দেখতে লাগে কাঠির মতোন। তাও যদি গতরে একটু জোয়ার থাকত তা দিয়া বেডাগো বশ করতে পারতি। দুইটা টেকা আয় বাড়ত।’
সেদিন আমি বুঝে গেছিলাম বাইরের চেয়ে ঘরের মানুষটা আমার জন্য বেশি বিপদজনক। কিন্তু যাওয়ার জায়গা তো ছিল না। এই কালো, রোগা, লম্বা শরীরটা সমাজের চোখে তাচ্ছিল্যের শিকার হলেও আমার কাছে আশীর্বাদ ছিল। এর জন্যই নানি আমায় দিয়ে কুকর্ম করাতে চেয়েও পারতেন না। পরতাম শার্ট-প্যান্ট। অচেনা মানুষ আমায় ছেলে ভাবত। তারপর একদিন রোড এক্সিডেন্টে নানি মা’রা গেল। আমি আর আমার ভাই এক অর্থে বেঁচেও গেলাম, আরেক অর্থে কূলও হারালাম। নানির ভিক্ষার জমানো টাকাগুলো পেয়েছিলাম চৌকির তলার মাটি খুড়ে। এরপর ভাইকে আর ভিক্ষায় নামতে দেইনি। পানির বোতল, চা বিক্রি, পত্রিকা বিলি যখন যে কাজে সুবিধা তাই করেছে। নিজে টেনেটুনে পড়েছি। তবে ভাইটাকে ভালো কিছু বানাতে চেয়েছি। আমিই ওকে পড়াতাম। ও এখন ঢাকা কলেজে পড়ে। হোস্টেলে থাকে। কোনো কাজ করতে দেই না এখন। মাসে মাসে খরচাটা পাঠিয়ে দেই। আর নিজে চলি যাযাবরের মতো। ভাইটা যেদিন বড় একটা চাকরি নেবে সেদিন থেকে আমার অবসর।”

চারু বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। প্রিয় কাছে এসে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “নিজেকে এতকাল কত দুঃখীই না ভাবতাম। এখন মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করছি আমায় এত ভালো রাখার জন্য। তোমার কাছে আমার দুঃখ কিছুই না। তোমার প্রতি আমার সম্মান বেড়ে গেল বোন।”

চারু লাফ দিয়ে উঠে বলল, “এহহে! এইসব সেন্টিমেন্টাল আবেগ দেখাবে না। এসব বিষয়কে আমি কখনো দুঃখ ভাবিনি। ভেবেছি চ্যালেঞ্জ। তাই মোকাবিলা করে টিকে থাকার পথটাও পেয়ে গেছি। দুঃখ ভাবলে দুঃখ বাড়ে। পথ আর মেলে না।”

প্রিয় মুগ্ধ চারুর প্রতি। মেয়েটাকে যত জানে আরো যেন আগ্রহ বাড়ে। ওর ইচ্ছে করল চারুকে আজ নিজের কাছে রেখে একটু যত্ন করে। কিন্তু সে নিজেই আরেক জনের সংসারে থাকে৷ চারুকে রাখলে চাচির রোষানল বাড়বে বৈ কমবে না। ওর দ্বিধার মাঝে চারু হুট করে বলে উঠল, “তোমার ঘরটা ভালো লেগেছে। আজ বরং আমি এখানেই থেকে যাই। তোমার অসুবিধা হবে না তো?”

প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষায় রইল না চারু। বিছানায় পা উঠিয়ে শুয়ে পড়ল। অন্যদিকে প্রিয় পড়ে গেল দুর্বিপাকে। চাচিকে কী বলে মানাবে!

প্রিয় পা খুড়িয়ে বের হলো রুম থেকে। চারু বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল তখনই। রুম থেকে বের হয়ে কোনো দিশা পেল না। পাশের রুমের দরজা খোলা দেখে সেখানে উঁকি দিয়ে দেখল এটাচ বাথরুম আছে। কোনোকিছু না ভেবে চারু সেই বাথরুমে ঢুকে গেল। ঘরটা ছিল সুহাসের। মিনিট খানেক পরেই সুহাস ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো।

চলবে…