#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
৩.
ফাইলটা আরও ঘন্টাখানেক আগে দিয়ে গেছে। রাফি এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। অক্ষরের রূপে মুগ্ধ হয়ে নয়। চিন্তার ধাক্কায় তার দৃষ্টি কাগজের লেখায় থাকলেও মনোযোগ “হাসি কুঞ্জে” আটকে আছে। বাড়ির সবকিছুই এলোমেলো। ঠিক কোনদিক থেকে গোছানো শুরু করলে সবটা সুন্দর হয়ে উঠবে সে জানে না। আজকাল নাবিলাকে নিয়ে খুব বেশি চিন্তা হয়। যাদের সাথে মেশে তাদের সবাই লাফাঙ্গা ধরনের। ধনী বাবার আদরের দুলাল। মেয়েগুলো আরেক কাঠি সরেস। তাকে ফোন দিয়ে কয়েকবার বিরক্ত করার চেষ্টা করেছে। পাত্তা না পেয়ে মেসেজের দিকে গেছে। যেসব মেসেজ তারা কাঠিয়েছে ওগুলো পড়তে যেয়েই রাফির মুখ লাল হয়ে এসেছে। নাবিলাকে ডেকে বলতেও পারেনি তোর বান্ধবীরা আমাকে এসব মেসেজ পাঠায়। উপায় না পেয়ে ব্লক করেছে। সমস্যা কিছুটা কমলেও মূল রয়েই গেছে। পড়াশোনার দিকে কোনো মন নেই। কেবল বাপের টাকায় কেনা মার্সিডিজ, বিএমডাব্লিউ আর ল্যাম্বর্গিনি দিয়ে শহর দাপিয়ে বেড়াতে পারে এরা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো থানায় তাদের গাড়িসহ পাওয়া যায় নিয়ম ভাঙার অভিযোগে। সম্ভবত প্রত্যেকটা থানার কর্মরত অফিসারদের তাদের টাকার উত্তাপ জানাতেই এই মিশন। তাতে তাদের সফলই বলা যায়। সবাই তাদের চিনে গেছে। সাথে সাইয়েদ নাবিলাকেও। সাইয়েদ গার্মেন্টসের উত্তরাধিকারী হিসেবে পরিচিতি আগে থেকে কিছুটা থাকলেও এবার তাতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। রাফি কপাল চেপে ধরে। নাবিলা কোনো বিপদে পড়বে না তো?
“মে আই কাম ইন স্যার?”
“ইয়েস।” রাফি কপাল থেকে হাত সরালো। ফাইলের শুরুতে চোখ দিলো আবার। এই নিয়ে পঞ্চমবার।
“আসসালামু আলাইকুম বস! ক্যায়া হালচাল হ্যা?”
চোখ ওঠাতেই যাকে রাফি দেখতে পেলো তাকে সহসাই চিনলো না। ঘন দাঁড়ির আড়ালে মুখের অর্ধেকটাই ঢাকা পড়েছে। কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ দুটোর দিকে তাকালো। সেখানে কি যেন চিক চিক করছে। সুখ?
“কী রে! চিনতে পারিস নি?” ছেলেটা অবাক হয়ে বলল।
রাফি বিস্মিত গলায় বলল, “অনিক!”
“ইয়েস বস!” গর্বিত হাসলো ছেলেটা।
রাফি বিস্মিত ভঙ্গিতেই উঠে দাঁড়ালো। অনিক ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। তরল কণ্ঠে বলল, “কেমন আছিস দোস্ত?”
রাফি অনিকের পিঠে হাত রাখলো, “দেশে আসলি কবে?”
“কালকে বিকেলে ল্যান্ড করেছি।”
“কিছুই তো জানাসনি।”
“সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
“সাকসিড। সারপ্রাইজড হয়েছি।”
“তোর মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। ছাড় ব্যাটা! এতো চিপকা চিপকি বউয়ের সাথে করবি। আমার সাথে কি?” অথচ রাফির হাত কেবল অনিকের পিঠ ছুঁয়ে আছে। কিন্তু অনিকই দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে রাফিকে।
রাফি অনিকের বুকে ধাক্কা দিলো, “শালা দাঁড়ি রেখেছিস। ঐ মুখে এসব বলিস কিভাবে!”
“দাঁড়িটা সেই লাগছে না?” থুতনিতে হাত বুলিয়ে দিলো অনিক। পুরো মুখে শোভা পাচ্ছে ঘন দাঁড়ি।
“কি মনে করে?”
দাঁড়িতে হাত রেখেই অনিক বলল, “আর বলিস না। বউয়ের তাড়া খেয়ে। দাঁড়ি রাখো দাঁড়ি রাখো বলে ঘ্যানঘ্যান করত শুধু। আমিও ভাবলাম এবার রেখেই ফেলি। মুখ দেখেই যেন আইডেন্টিটি বোঝা যায়।”
রাফি অনিকের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। বউ ঘ্যানঘ্যান করে এটা বলার সময় তার চোখ দুটো মোটেই বিরক্ত ছিল না। বরঞ্চ কণ্ঠের মেকি বিরক্তির নকল জাল ছিন্ন করে চোখের তারা জানান দিলো তারা কতো সুখী।
রাফি নিশ্বাস ছাড়ল, “বস। কি নিবি? চা না কফি?”
“তোর এখানে কোনটার দাম বেশি? সেটা খাবো।” বসতে বসতে বলল অনিক।
“কোল্ড কফি নে। ওটা ভালো বানায়।” রাফি বলল।
“দে তাহলে। তোর খবর বল।”
রাফি কফি অর্ডার করে বলল, “দেখতেই তো পাচ্ছিস।”
“তা তো পাচ্ছিই। চোখের নিচে দু ইঞ্চির ডার্ক সার্কেল বানিয়েছিস। চোয়ালের হাড় বেরিয়ে যাচ্ছে। সমস্যা কি?”
রাফি হাসলো, “কোনো সমস্যা নেই।”
অনিক কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, “আরে শালা! সমস্যা তো গোড়ায়!”
“কোথায়?”
“বিয়েই করিসনি। তোর তো চারদিকেই সমস্যা।”
“সব সমস্যার সমাধান বিয়ে?”
“আরে হ্যাঁ! বিয়ের উপরে কোনো ওষুধ নাই। মাথায় ব্যাথা? বিয়ে কর। বুকে ব্যাথা? বিয়ে কর।”
“তা তুই কয়টা বিয়ে করলি? চারটার বেশি তো করার স্কোপ নেই। মাথা ব্যাথা হলে কি করিস?”
“একটা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। ভদ্রমহিলা আমার মুখে অন্য মহিলার নামই শুনতে পারে না। এসব শুনলে আগে আমাকে মারবে তারপর নিজে মরে যাবে। তারপর আমার বাচ্চাদের কি হবে?”
“বাচ্চাদের?” রাফির কপালে ভাঁজ পড়ল।
“আকাশ থেকে পড়ছিস কেন? মনে হচ্ছে জানিসই না।”
“সিঙ্গাপুরে তোর একটা বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাদের হলো কিভাবে?”
“ডিমেনশিয়া হয়েছে তোর রাফি। হোয়াটস অ্যাপ চেক কর। আমি বলেছিলাম না যমজ হয়েছে? টু ইন ওয়ান শট। বেচারি খুব কষ্ট দিন কাটাচ্ছে রে রাফি! তোর মতো চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়েছে। রাতে ঘুমাতেই পারে না।” অনিক গড়গড় করে কথা বলতেই থাকলো। রাফি অপলক তাকিয়ে দেখলো অনিকের বিষন্ন মুখ। কারো শুকনো চেহারা দেখতেও এতো ভালো লাগে?
“দেখ দোস্ত আমার মেয়ে হয়েছে এক জোড়া। দুই দিন গেলেই বিয়ে দিয়ে শ্বশুর হয়ে যাবো। তোর কি হবে? বাচ্চা হতে হতে তো সিনিয়র সিটিজেন হয়ে যাবি।” কফি আসাতে চুপ করে গেলো অনিক।
স্টাফ চলে গেলে রাফি বলল, “বিয়ে টিয়ে করে লাইফ হেল বানানোর কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।”
অনিক অবাক হয়ে বলল, “আমার লাইফ হেল হয়েছে?”
“সবার তো হয় না।” রাফি কফিতে চুমুক দিলো।
“তাহলে তোর হবে এটা ভাবছিস কেন?”
“কারণ আমি জানি আমার হবে তাই।”
“কেন তুই কি গণক?”
“গণক হতে হবে কেন? অ্যাজিউম করছি।”
“বুয়েট থেকে পড়াশোনা করে তোকে বাপের গার্মেন্টস সামলাতে হবে এটা অ্যাজিউম করেছিলি?” কণ্ঠ উঁচু করল অনিক।
রাফির ঠোঁটে হালকা একটা হাসি খেলে গেলো। সেখানে স্পষ্ট দুঃখের ছাপ দেখতে পেলো অনিক। নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এভাবে কতদিন?”
“যতদিন শ্বাস চলে।”
“একা থাকতে কষ্ট হয় না?”
“চিৎকার চেঁচামেচি, অসম্মান, বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে কম।” রাফি হাসলো।
“দেখে শুনেই কর। মন মাসনিকতা মেলে এমন কারো সাথে।”
“মা বাবার লাভ ম্যারেজ ছিল অনিক।” অনিক চুপ করে গেলো। রাফি বলল, “তুই মনে হচ্ছে আমাকে বিয়ে দিতেই দেশে এসেছিস। আবার যাবি কবে?”
“তুই কি আমাকে তাড়াতে চাচ্ছিস? আমি আর যাচ্ছি টাচ্ছি না।”
রাফি অবাক হয়ে বলল, “কেন? চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছিস নাকি!”
“হুঁ।”
“কেন! এতো ভালো চাকরি!”
“ধুরু! ঐ ফার্স্ট ক্লাস চাকরি করে এসি গাড়িতে চড়ে পোষাচ্ছিল না। জিরো পয়েন্টের জ্যামের জন্য বুকটা খা খা করছিল।”
“ফালতু।”
“তুই তো বলবিই। ওখানে মেয়ে দুটো একদম একা থাকে। দাদা, নানা, চাচা, মামা কাউকেই পায় না। তাছাড়া..” চুপ করে গেলো অনিক।
“তাছাড়া?”
“বাদ দে। তোকে বিয়ে করাবো এটা আমার এবারের ফার্স্ট মিশন।”
“একদম না অনিক!”
“একদম হ্যাঁ রাফি!” অনিক দাঁত বের করলো। রাফি নিশ্বাস ছাড়ল। আবার কোন ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে কে জানে।
__________________________________________
“আপা এই মাসের বেতন।” সাঈদ কয়েকটা নোট এগিয়ে দিলো। আফরিন হাত বাড়িয়ে নিলো দুমড়ে মুচড়ে থাকা নোটগুলো। গুনে দেখলো একশ পঁচিশ টাকা। সযতনে রেখে দিলো পার্সের নির্দিষ্ট ভাগে।
আরেকজন বলল, “আপা আমার ব্যাতন কালকে দিবে। তারপর আপনারে দিবো।”
আফরিন ঠিকাছে বলার আগেই সাঈদ কষে একটা ধমক দিলো, “ঐ ব্যাতন কি? হ্যাঁ ব্যাতন কি? আপা বলছে না বেতন বলতে?”
“মুখ দিয়া আইসা পড়ে।” ছেলেটা মিনমিন করে বলল।
“আইসা না এসে।” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল সাঈদ। ছেলেটার আগ্রহ আছে। যেকোনো কিছুই প্রথমবারে অনেকটা আয়ত্ত্বে নিয়ে আসতে পারে।
আফরিন হেসে বলল, “কাজের জায়গায় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবে। আমার সাথে বললে সমস্যা নেই।”
“আপনি তো জানেন না আপা ও সবসময় এভাবেই কথা বলে। কখনও শুদ্ধ করে বলে না।”
আফরিন তাকালে ছেলেটা বলল, “পরেরবার থেইকা বলমু।” সাঈদ চট করে ছেলেটার পিঠে একটা ধাক্কা দিলো। সংশোধনের ভঙ্গিতে ছেলেটা বলল, “বলব বলব।”
নুরি এগিয়ে এলো তর্কাতর্কি শেষে। মুঠো করে ডান হাত এগিয়ে দিলো আফরিনের দিকে। আফরিনও মুঠ করেই নিলো। গুনে দেখলো না। ওভাবেই পার্সের একপাশে রেখে দিলো। নুরি ফিসফিস করে বলল, “আপা আব্বা অসুস্থ হয়ে গেছিল। তাই জন্য..”
আফরিন নুরির হাত ধরে বলল, “তোমার মাখানো ঝালমুড়ি খাবো নুরি।”
নুরির শুকনো মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো, “আজকেই খাওয়াবো আপা।”
আফরিন চোখে হাসলো। এই বার জন ছেলেমেয়েকে দেখতে বাচ্চা বলে ভ্রম হয়। অথচ জীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতে এরা এত বার ধাক্কা খেয়েছে যতবার আফরিন তার তেইশ বছরের জীবনেও খায়নি। নিজেকে মাঝে মাঝে এই ছেলেমেয়েগুলোর সামনে নস্যি মনে হয়। এরা সবাই নিজেদের পরিবারের উপার্জনের অবলম্বন। কেউ মানুষের বাড়িতে কাজ করে, কেউ আবার হোটেলে। সাঈদ ছেলেটা টোকাই। নুরি ফুল বিক্রি করে। বার জন বার রকম পেশায় নিযুক্ত।
আফরিনেদের এলাকার এক কোনেই এদের বাস। সবাই বলে বেদে। চালচলন বা জীবনাচরণ কোনোটাই আশপাশের মানুষের সাথে মেলে না বলে এদেরকে সবাই এড়িয়ে চলে। খারাপ বা ভালো কোনো ব্যবহারই করে না। আফরিন দেখেছে এদের বাড়ির পুরুষ সদস্য মানেই অলস। একজনও কাজ করে না। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমায় আর রাতভর গলির মোড়ের ভাঙা বাড়িতে বসে তাস খেলে। বিড়ির সাথে তখন আরো কিছু খায় বলেও শুনেছে। ফলে অর্থ উপার্জনের সাথে তাদের দুর দূরান্তের সম্পর্ক নেই।
শুরুতেই অবশ্য কাজ বাদ দেয়নি এরা। স্বামীদের ফালতু খরচ দেখে কয়েকজন বউ কাজ শুরু করলো। তাদের দেখাদেখি আরো কয়েকজন। লোকগুলো দেখলো তারা কাজ না করলেও সংসার ভালোভাবেই চলে যাবে। তাই অনতিবিলম্বে কাজে ইস্তফা দিয়ে তাসের ডিউটি শুরু করলো। ফলে নিতান্ত শখের বশে বউগুলো যেই কাজ শুরু করেছিল সেটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেলো। নুন আনতে পান্তা ফুরায় পরিস্থিতি হয়ে গেলো। তাদের মাঝে যেসব বউ কোনো কারণে কাজ চালিয়ে যেতে পারল না তাদের বাচ্চাদেরকেই তখন পথে বের হতে হলো।
আফরিন চোখে চশমা দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। এই ছেলেমেয়েগুলোর কথা মনে হলে নিজেকে অথর্ব মনে হতো। বই খাতার সাথে এদের কোনোদিন সম্পর্ক হবে না ভাবলে নিজেকে দোষী মনে হতো। বাবার সাথে কথাটা বলতেই তিনি উৎসাহ দিলেন। বললেন তুইই শুরু কর। আফসানা অবশ্য বলেছিলেন সবাই ঘুমিয়ে থাকলে তোর একার চিৎকারেই কাজ হবে কেন? মোশাররফ হোসেন দ্বিমত করেছেন। সবাই ঘুমালে কি সেও ঘুমাবে? নিজের জাগ্রত বিবেকের মূল্য চোকাতে হলেও তো কিছু করতে হবে। সেই থেকে শুরু। বাচ্চাগুলোর বাবা মা আজও তাকে সন্দেহের চোখে দেখে। সভ্য পাড়ার একজন এসে যেচে তাদেরকে সাহায্য করছে বিষয়টা মানতে পারে না।
তবে ছেলেমেয়েরা তাকে সাদরে গ্রহণ করেছে। তাদের যেন কখনও মনে না হয় আফরিন তাদের দয়া করছে এজন্য নাম মাত্র কিছু বেতন নিয়ে থাকে সে। মাস শেষে যে যেটাই দেয় বিনা বাক্যে সেটাই নিয়ে নেয়।
এতে অবশ্য এই চালা ঘরের ভাড়া ওঠে না। তাছাড়া আফরিন নিজের উপরে একটা দায়িত্ব নিয়েছে। কেউ তাকে দেয়নি। না দিলেই কি। সে তো জানে তাকে কীসের প্রতিদান দিতে হবে।
একটা লেডিস শপিং মলে ক্লাস শেষে ডিউটি করে আফরিন। সকালে বাচ্চাদের পড়ায়। কখনও কোনো সমস্যা হলে বিকেলে। তবে সেটা খুব কমই। কারণ শপিং মলের পাঁচ ঘণ্টা তার বাঁধা সময়। মাস শেষে ওখান থেকে যেই টাকাটা পায় সেটা খুব হিসেব করে খরচ করে আফরিন। আজ তার বেতন পাওয়ার কথা ছিল। তাই ক্লাস শেষে একটু তাড়াতাড়িই গেল।
。。。。。。。。。。
লেডিস শপিং মল বলে পুরুষদের এদিকে খুব একটা আসতে দেখা যায় না। তবে আফরিন দেখলো পাঁচ জনের একটা দল আসছে। দুটো ছেলে তিনটে মেয়ে। ছেলে গুলোর চুল কাটার ধরন দেখেই রুচির পরিচয় অনেকটা পাওয়া যায়। বাকিটা পরিষ্কার হলো পরণের পোশাক দেখে। সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলো আফরিন। অযাচিত আচরণের পর দুটো থাপ্পড়ে মনের আক্রোশ মিটতে পারে তবে স্মৃতির কাটা থেকে যায়। একটু পর পর গলায় হুল ফোঁটায়। তাই আফরিন সেই উৎস থেকেই দূরে থাকতে চায় যার থেকে অযাচিত ব্যবহারের আশঙ্কা আছে।
মেয়েগুলো প্রথমে ড্রেসের কর্নারে গেলো। ওখানে আগে থেকেই একজন ছিল বলে আফরিনকে যেতে হলো না। কিন্তু অন্যদিকে তার ডাক পড়ায় আফরিন এগিয়ে গেলো। যান্ত্রিক কণ্ঠে খানিকটা মিষ্টতা এনে বলল, “আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি ম্যাম?”
একটা ছেলে শিষ বাজালো। তাতে আফরিনের মাপা হাসিতে একটুও চিড় ধরলো না। সে সন্তর্পনে ছেলে দুটোর পাশ কাটিয়ে মেয়েদের কাছে যেয়ে দাঁড়ালো।
মেয়েগুলোকে দেখেই চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। অকারনেই শরীর এদিকে ওদিকে দোলাচ্ছে। একটু পরপর কি যেন বলছে আর অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ছে। সেই হাসির ভার তাদের দেহ বহন করতে পারছে না। ফলে হেলে দুলে বন্ধুর কাঁধে পড়তে হচ্ছে। বন্ধুও উদার হস্তে বান্ধবীর লতানো কোমর আঁকড়ে ধরছে। এটুকু ভার বহন না করতে পারলে সে আবার কিসের বন্ধু!
“এটা ট্রাই করব।” একজন বলল। আফরিন মুহূর্তেই নিজের মেজাজ ঠিক করে ফেলল, “আমার সাথে আসুন ম্যাম।” আফরিন খেয়াল করেছে এই মেয়েটা তুলনামূলক গম্ভীর স্বভাবের। এসে পর্যন্ত হাসতে দেখেনি। কথাও বলছে গুণে গুণে। কেন যেন তার মনে হলো এই গ্রুপটার সাথে মেয়েটাকে একদমই মানাচ্ছে না। অকারণ কৌতূহলের জন্য নিজের উপরই বিরক্ত হলো আফরিন। যে যার সাথে ইচ্ছে ঘুরুক তাতে ওর কি! বললেও মন মানলো না। মেয়েটার দু চোখে কিসের যেন একটা ছায়া। কালো অথচ ভয়ংকর না।
বিল করার সময় ঘটনাটা ঘটলো। আফরিন তক্কে তক্কে ছিল। এমন কিছু যে হবে এটা তার অভিজ্ঞতা থেকেই জানে।
শিষ বাজিয়েছিল যেই ছেলেটা সে খুব স্বাভাবিকভাবে হেঁটেই আফরিনের পেছনে এসে দাঁড়ালো। একদম কাছে। আফরিন সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলো। আড় চোখে দেখলো ছেলেটা পকেট থেকে ডান হাত বাড়িয়েছে। ন্যানো সেকেন্ডের মাঝে সামনে থেকে সরে গেলো সে। ফলে ছেলেটার পিপাসার্ত হাত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ল গম্ভীর মেয়েটার বুকের উপর। আফরিন দেখলো ছেলেটা দু সেকেন্ডের জন্য ফ্রিজ হয়ে গেছে। ততটুকুই। তারপরই হেসে বলল, “নাবিলা তোর জামার এই কাজটা কিন্তু জোশ! কই থেকে নিলি বল তো? আমার..”
দানবীয় চড়ে ছেলেটার কথা বন্ধ হয়ে গেলো। আফরিনের আশঙ্কা হলো ওর চাপার দাঁত একটা হলেও নড়েছে। নাবিলা নামের মেয়েটার দিকে তাকাতেই দেখলো তার চোখ থেকে আগুন ঝরছে। মুখ খিঁচিয়ে সে বলল, “ইতরের বাচ্চা! কার সাথে কি করিস তুই!”
ছেলেটার চোখের জ্বলে ওঠা ক্রোধ আফরিনের চোখের আড়াল হলো না। চিৎকারে আশপাশ থেকে স্টাফ এসে জড়ো হয়েছে। তবে আফরিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ছেলেটা সাফাই গাওয়ার কোনো চেষ্টাই করলো না।
“ব্রোথেলে যেয়ে তোর হয় না? আমার দিকে তাকাবি তো চোখ উপড়ে ফেলব জানোয়ার!”
হনহন করে চলে গেলো নাবিলা। আফরিন দেখলো ছেলেটা ঠান্ডা চোখে নাবিলার চলে যাওয়া দেখলো। অদ্ভুতভাবে নিজের গালে হাত বুলিয়ে দিলো। ওখানেই চড়টা মেরেছিল নাবিলা। তারপর আফরিনের দিকে তাকিয়ে চমৎকার হেসে বলল, “এটা বিল করে দিন।”
আফরিনের হাতে নাবিলার পছন্দ করা জামাটা ছিল। সে অবাক হলেও প্রশ্ন করলো না। বিল করে দিলো।
বাকি তিনজন বন্ধু যারা এতক্ষন তামাশা দেখছিল তারা যেন হুশ ফিরে পেলো।
ছেলেটা বলল, “ওর জামা তুই নিবি কেন?”
“ওকে গিফট করব। সরি বলব।” হাসলো ছেলেটা। আফরিনের অদ্ভুত লাগল সেই হাসি।
অপর ছেলেটা মুখ খিঁচিয়ে নিলো। কন্ঠ নিচু করে বলল, “ও দেখাইতে পারবে তাতে দোষ নাই আর..”
“আহ চুপ কর!” ছেলেটা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল। মেয়ে দুটোকে ইশারা করল। মেয়েরা দূরে থাকায় না শুনলেও আফরিন স্পষ্ট শুনলো।
হঠাৎ করেই একটা মেয়ে চিৎকার করল, “সম্পত্তি আছে বলে কি নিজেকে রানি ভিক্টোরিয়া মনে করে ও?”
“একটা ফানও বোঝে না।” অপর মেয়েটা বলল।
চড় খেয়েছিল যেই ছেলেটা সে কিছুই বলল না। ভদ্রলোকের মতো বিল মিটিয়ে চুপচাপ চলে গেলো। আফরিন কি মনে করে তাকিয়েই থাকলো ছেলেটার যাওয়ার দিকে।
বেতন পেয়ে বাজার করলো আফরিন। মাসে দুটো শুক্রবারে দুই সপ্তাহের বাজার করে সে। প্রথম প্রথম মোশাররফ হোসেন খুব রাগ করতেন। সাদমান এখনো এসব করে না তাহলে ও কেন করবে? আফরিন এটা ওটা বলে বুঝিয়ে দিয়েছে। যেই দায়বদ্ধতা তার আছে সেটা তো সাদমানের নেই। তাহলে দুজনের কাজ একই রকম কিভাবে হবে? বাবা, মা জানলে হয়তো কষ্ট পাবে। কিন্তু কিছু তো করার নেই। তার ঘাড়ের উপর যে ঋণ জমেছে তার একটু হলেও তো শোধ করতে হবে।
বড় ফুপু বাজার দেখে মুখ মুচড়ে চলে গেলেন। আফসানা বললেন, “তোর আর সাদমানের জন্য মিলিয়ে একটা জামা নিস তো। আমি টাকা দেব।”
আফরিন কিছু বলল না। প্রতি বছরই মা তাদের দুই ভাই বোনের জন্য ম্যাচিং ড্রেস কেনেন। কিন্তু জামার কথা উঠতেই নাবিলার কথা মনে পড়লো। আফরিন চোখ বন্ধ করলো। নাবিলা যেন বুঝতে পারে। কারণ ছেলেটার চোখে সে যেটা দেখেছে সেটা যদি সত্যি হয় তবে নাবিলার সামনে বিপদ।
~চলমান~
“তুমি কি ব্যস্ত আম্মু?” স্পষ্ট দেখছে জুঁই যে তিনি ব্যস্ত। তবুও এটা ছাড়া কথা শুরু করার জন্য কোনো কথা পেলো না সে।
“একটু তাড়ায় আছি। সংক্ষেপে বলো।” টেবিলে রাখা ফাইলে একবার চোখ বুলিয়ে সেটা হাত ব্যাগে নিয়ে নিলেন জেসমিন।
“আমাদের নিচ তলায় যেই ডাক্তার আঙ্কেল থাকেন না? উনার বোন মারা গেছে।”
“হ্যাঁ শুনেছি এটা। মেয়েটার সাথে দেখা করেছি। ভদ্র সভ্য মেয়ে।”
জুঁইয়ের মুখে হাসি ফুটলো। জেসমিন ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছেন মানে কাজ অর্ধেক হয়ে গেছে।
“ঐ আপু নাকি ফিজিক্স নিয়ে অনার্স করছে।”
“এসব দিয়ে কি করবো জুঁই? কাজের কথাটা তাড়াতাড়ি বলো।” জেসমিনের গোছানো শেষ। খাওয়ার সময় নেই। এখন বসলে দেরি হয়ে যাবে। তার চেয়ে ভার্সিটির ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নেয়া যাবে। ভেবে মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি। একদম জুঁইয়ের চোখের দিকে।
জুঁই ভেতরে ভেতরে একটু নার্ভাস হয়ে পড়ল। জেসমিন হাসানের দৃষ্টি অনড় এবং মজবুত। তাছাড়া কেউ সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালে একটু ঘাবড়ে যায় জুঁই।
“বেলী তো বেশ অনেকদিন ধরেই একা একা পড়ছে। লাস্ট মোমেন্টে কিছু গাইডলাইন পেলে ভালো হতো না? তাই বলছিলাম ঐ আপুর সাথে যদি কথা বলতে। উনি রাজি হলে বেলীকে..”
জুঁইকে শেষ করতে না দিয়েই জেসমিন বললেন, “ও কোথায় পড়ে জানো?” তার মুখে একটা তীর্যক হাসি। জুঁই বলল, “হ্যাঁ, ন্যাশনালে। আব্বুর কলেজেই তো।” মেয়েটা যে তার বাবার কলেজের স্টুডেন্ট এটা জুঁই পরে জেনেছে।
“শোনো জুঁই, ন্যাশনালের স্টুডেন্ট কোনো স্টুডেন্টের কাতারেই পরে না। কোথাও চান্স না পেয়ে এরা এখানে ভর্তি হয়। ওদের মেধার লেভেল বুঝতে পারছো? দরকার হলে বেলীর জন্য আমি টিউটর খুঁজে দেবো। কিন্তু এমন কলেজে অনার্স করা কারো কাছে পড়ার চিন্তা বাদ দাও জুঁই।”
কথা শেষ করে জেসমিন চলে গেলেন। জুঁইয়ের কাছে এতোদিন এই অধ্যায় অজানা ছিল। তার মানে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের একটা বড় অংশ মেধাহীনদের পেলে পুষে যাচ্ছে? জুঁই অবাক হলো। কি নিশ্চিত ভঙ্গিতে জেসমিন বলে গেলেন এদের কোনো মেধাই নেই!
চলবে।