অন্তঃপুর পর্ব-০৪

0
2

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
৪.

বাড়ির পেছন দিকে বিশাল বড় একটা বাগান আছে। মাঝখানে ছোট ছোট গাছ। চারপাশেরগুলো বড় বড়। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কনকচূড়া, সোনালু, জারুল ফুলের গাছগুলো চারপাশে প্রাচীরের সাথে লাগোয়া। মাঝের দিকে ফুটে আছে কসমস, ডেইজি এই জাতীয় ফুল। পুরো এলাকাটাই রঙিন। দেখতে দেখতে চোখে ঘোর লেগে যায়। এতো সৌন্দর্য ঠিক সহ্য হয় না। চোখ বন্ধ করে ফেলেন আসিফা। ফুল তার সৌন্দর্যের ভ্রমে তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে না।
সোনালু ফুলগুলো যখন ফোঁটে মনে হয় যেন কোন উৎসব। হলুদ ফুলগুলোকে হঠাৎ দেখলে গাছের কানের ঝুমকো বলে ভ্রম হয়। হালকা বাতাসেই ঝুরঝুর করে পড়ে যায়। আসিফার ঠোঁটে খেলে যায় তাচ্ছিল্যের হাসি। চকচকে ফুলগুলো ঠিক তার জীবনের মতো। দুর থেকে দেখতে সুন্দর। অথচ ভঙ্গুর।
দরজায় খট করে শব্দ হলো। আসিফা নড়লেন না। ঠায় বসে রইলেন বারান্দায়। তিনি জানেন এটা কার পায়ের আওয়াজ।

মাহমুদ বিরক্তির শ্বাস ছাড়লেন। কতবার আসিফাকে বলেছেন বাইরে থেকে এলে যেন সামনে এসে দাঁড়ায়। তবুও তার কোনো হেলদোল নেই।
“আসিফা!”
আসিফা যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের দিকে মুখ ঘোরাতেই লাল, কমলা রঙিন ফুলগুলো চোখের আড়ালে চলে গেল।
“তোমাকে না বলেছি বাইরে থেকে এলে সামনে দাঁড়াবে। কখন কি লাগে না লাগে।”
“কি লাগবে?”
“এক গ্লাস পানি এনে দাও।”
আসিফা টেবিলের জগ থেকে পানি ঢাললেন। মাহমুদ বললেন, “ঠান্ডা পানি আনো।”
আসিফা কিছু বললেন না। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামালেন। রান্নাঘরে ফ্রিজ। মাহমুদ জানে আসিফার কোমরে সমস্যা। সিঁড়িতে ওঠা নামা করতে কষ্ট হয়। চাইলেই সে উপরে ওঠার সময় খেয়ে আসতে পারে।
পানি নিয়ে উপরে উঠতে যেয়ে আসিফা ক্লান্ত হয়ে গেলেন। মাহমুদ এক চুমুকে সবটা খেয়ে বললেন, “জানোই আমি ঠান্ডা পানি খাই। তিতলিকে বলে এনে রাখলেই পারো।”
“তুমি কখন বাড়িতে আসবে তার তো ঠিক নেই। খামোখাই ঠান্ডা পানি এনে গরম করে রাখার কি দরকার?”
“তোমার সবটাতেই অজুহাত আসিফা। বিয়ের ত্রিশ বছরেও আমাকে চিনলে না।” শার্ট খুলে ফতুয়া পরলেন মাহমুদ।
আসিফা হাসলেন, “আমাকে চিনেছ? আমার এখন কি ওষুধ খেতে হয় জানো? জাফর না থাকলে আমাকেই রোজ ছুটতে হতো। ধন্যবাদ জাফরকে কাজে রাখার জন্য।”
মাহমুদ চোয়াল শক্ত করলেন, “এসব আঁকাবাঁকা কথা আমার সাথে বলতে আসবে না।” আসিফা হেসে চলে গেলেন। যতক্ষন সামনে থাকবেন ততক্ষন এমন খুটখাট লেগেই থাকবে। ছোট একটা বিষয় থেকে চিৎকার শুরু হবে। তার চেয়ে বারান্দায় বসে থাকাই ভালো। সোনালু ফুলগুলো বাতাসে দুলছে। আসিফা চোখ বন্ধ করলেন। রাফির সাথে কতদিন দেখা হয় না? নাবিলা কেমন আছে?

এক পলক বারান্দায় তাকিয়ে ফোন হাতে নিলেন মাহমুদ। এই সপ্তাহে কোনো গেট টুগেদার ছিল না। অথচ বাড়িতে থাকতেও ভালো লাগছে না। তার চেয়ে অনুষ্ঠান একটা অ্যারেঞ্জ করে ফেললেই হয়। কোনো উপলক্ষ্য যে থাকতেই হবে এর তো মানে নেই। ব্যবসা থেকে হাত পা গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক আগেই। নিতে হয়েছে। ফলে এখন ঝাড়া হাত পা নিয়ে বসে থাকা কষ্টকর। আড্ডার যেই অভ্যাস ব্যস্ততার সময়ই ছাড়তে পারেননি সেটা এখন ছাড়ার কথা তিনি ভাবেনও না। ওটাই তো এখন মন ভালো রাখার একমাত্র উপায়।

。。。。。。。。。

তিতলি ভয়ে ভয়ে আছে। তার শক্ত ধারণা যে কেউ সামনে এলে তার বুকের ধুকপুক শুনতে পারবে। তার ভয়ের একমাত্র কারণ নাবিলা। এই মেয়েটা বাড়িতে থাকলেই তার বুকে পানি থাকে না। আর কিছু একটা আদেশ দিলে তো কথাই নেই। কলিজাটা গলায় এসে আটকে থাকে। পান থেকে চুন খসলেই একেকটা ধমক দেয় যে আত্মা কেঁপে ওঠে। সেই তুলনায় রাফি নিরীহ ধরনের। তার কাজ নিয়ে তিতলিকে বিন্দুমাত্র ভয় পেতে হয় না। ভুল হলেও কিছু বলে না। যেটুকু বলে সেটা না বলারই সমান। রাফি ভাইয়ের বউ খুব শান্তিতে থাকবে। ভাবে তিতলি। পরক্ষণেই মনে হয় রাফি ভাই তো বিয়েই করতে চায় না। এদের কারবার!
আরেকজনকে ভয় পায় তিতলি। বাধ্য না হলে রুমিলা বেগমের সামনে যায় না। কিন্তু তার দেখভালের দায়িত্ব পুরোটা তিতলির উপরে। ঐ কাজের জন্যই তাকে আনা হয়েছে। রান্নাবান্নার জন্য আলাদা লোক আছে। সুবিধা হলো বুড়ির কথাবার্তা কেউ অতোটা শোনে না। রাফি ভাই শুনলেও তেমন কিছু বলে না। ফলে রুমিলার বকবক হাওয়ায় উড়ে যায়। ভয় যা সবটাই নাবিলাকে নিয়ে।

কফিটা বানিয়ে ট্রে তে নিলো তিতলি। শুধু একটা মগ ট্রে তে দেয়ার কি দরকার সে বোঝে না। না নিলেও বাড়িঘর কাঁপিয়ে ধমক দেবে নাবিলা। কি দরকার অতো কিছু বোঝার!
দরজায় নক করলো তিতলি। কপাল থেকে এক ফোঁটা ঘাম গড়িয়ে পড়ল।
“কে?” গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো দরজার ভেতর থেকে।
“আমি তিত.. তিতলি।”
“দরজা খোলা।”
দরজাটা খুলতেই অন্ধকার ঘর চোখের সামনে ধরা দিলো। এই ভরদুপুরে ঘর এমন অন্ধকার করে রাখার কি মানে? বড়লোকের কাজকাম তিতলির মাথায় ঢোকে না।
“ভূতের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে কফি রেখে যা।”
তিতলি তড়িঘড়ি করে কফি রাখলো। দরজার বাইরে থেকে একটুখানি আলো আসছে। সেটুকুতেই দেখা যাচ্ছে নাবিলা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। তিতলি প্রমোদ গুনলো। নাবিলা এবার সত্যিই পাগল হয়েছে। চলে যেতে যেয়েও ফিরে বলল, “আপা দুপুরে কিছু খাইবেন না?”
“না।”
“খালি কফি খাইয়া থাকবেন?”
“যা তিতলি।” জমে থাকা কণ্ঠ থেকে যেন উত্তরটা ভেসে এলো। তিতলি দ্রুত পা চালালো। তাকে ভূত বলে। অথচ এই মানুষটা পুরোটাই ভূত।

দরজা লাগানোর শব্দ পেয়ে উঠে বসলো নাবিলা। গায়ের কম্বল সরিয়ে রাখলো। শরীর গরম লাগছে। কপালে হাত দিয়েও লাভ হলো না কারণ হাত মুখের থেকে বেশি গরম হয়ে আছে। দুই ঘণ্টা টানা গোসল করার ফল। না করেও উপায় ছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল মাসুদের স্পর্শ গায়ে লেগে আছে। প্রতিনিয়ত খোঁচাচ্ছে। সাবান দিয়ে ডলতে ডলতে জায়গাটা লাল করে ফেলেছে। খানিকটা চামড়াও উঠেছে। সমানে জ্বলছে। নাবিলা গা করল না। হাত বাড়িয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে কফির মগটা টেনে নিলো। পুরো ঘর অন্ধকার। দরজার নিচ থেকে কেবল দুপুরের কড়া রোদের কিছুটা উকি দিচ্ছে। এভাবেই নিজেকে পুরো “হাসি কুঞ্জ” থেকে আলাদা করে রেখেছে নাবিলা। হাসি কুঞ্জের রোদ বৃষ্টি কিছুই তাকে ছুঁতে পারে না। এক অপরিণত অভিমান জমতে শুরু করেছিল বহু বছর আগেই। সেটা কেউ আদর করে গুড়িয়ে দেয়নি। হাতটা টেনে বলেনি এসব ছেলেমানুষী। ফলে মাইনাস তাপমাত্রায় সেই তরল অভিমান জমে কঠিন হয়েছে। নাবিলার জীবন প্রশান্ত না হলেও সেই মহাসাগরের বেশির ভাগটাই পাথরের দখলে।
তবে আজ মাসুদের কাজে বুঝতে পারল তার অনুভূতির কিছুটা আজও বাকি আছে। মাসুদ যে ইচ্ছে করে তাকে স্পর্শ করেনি এটা বুঝতে পেরেছিল সে। অতো সাহস মাসুদের নেই। তবে ওর উদ্দেশ্য ছিল ঐ সেলস গার্ল বুঝে মেজাজটা তক্ষুণি খিঁচড়ে গেছে। ওদের সাথে থেকে বেশ কিছু গালিও শিখেছে। শুনলেই কানে তালা দিতে হয়। মাসুদকে তখন ঠিক ঐ গালিগুলোই দিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ওর উপর্যুপরি সাফাই গাওয়ার ধরনে মাথাটা স্রেফ গরম হয়ে গেছিল। চিন্তা ভাবনার আগেই থাপ্পড়টা দিয়েছে। ভালো লাগলেও শান্তি লাগেনি। কারণ শাস্তি দেয়া গেলেও ঘটে যাওয়া ঘটনা তো কারসর দিয়ে রিমুভ করা যায় না। কেবলই মনে হচ্ছিল গায়ে বিচ্ছিরি কিছু একটা বসে আছে। দেরি না করে বাড়িতে এসে সোজা বাথরুমে ঢুকেছে।
মাসুদের বিরুদ্ধে কিছু করার ইচ্ছে নেই। ওদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে। তাতে অবশ্য তাদের খুব একটা আসবে যাবে না। নাবিলার ক্রেডিটে সবার খায়েশ মিটলেও ওদের সবার আলাদা আলাদা ক্রেডিট কার্ড আছে। সেটা ব্যবহার করার বেলায়ই কেবল ওকে স্মরণ করতে পারে। নাবিলা ধের চেনে ওদের। কেবল পুরোনো অভ্যাসের কারণেই ওদের সঙ্গে পরিত্যাগের কথা মনে করে নি। সেটাও আজ হয়ে গেলো।

দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল হলো তখন নাবিলার জ্বর ছুঁয়েছে একশ তিনের ঘর। বদ্ধ ঘরে তার মা মা আর্তনাদ কম্বলের নিচে চাপা পড়ে গেল। তার তুলে দেয়া দেয়ালের সম্মানেই আসিফা কখনও এদিকে উকি দেননি। জেদ করে সেই দেয়াল আরো খানিকটা উচু করেছিল নাবিলা। এই আশায় হয়তো আসিফা এসে অধিকার দেখিয়ে বলবেন তার মেয়ের কাছে আসতে কোনো দেয়ালের বাধা মানতে পারবেন না। সেটা তিনি করেননি। ফলে সম্পর্কের মাঝে চীনের মহা প্রাচীর তৈরি হয়ে গেছে। নাবিলার আর্তনাদ সেই প্রাচীরের গায়ে ধাক্কা লেগে ফিরে ফিরে আসছে তারই দিকে।

~~~~~~~~~~~~~~

দুটো দিন জ্বরে ভুগলো নাবিলা। ফোন বন্ধ ছিল এই দু দিন। সুস্থ হয়ে ভাবলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসবে। এই চার দেয়ালের মাঝে দম আটকে আসছে। ফোন অন করতেই মিস হয়ে যাওয়া কলের মেসেজে ফোন হ্যাং হয়ে যাওযার জোগাড় হলো। ভুরু কুচকে নাবিলা দেখলো মাসুদের কল এবং মেসেজ। লাস্ট মেসেজ ওপেন করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ইংলিশ অক্ষর দিয়ে বাংলা লেখা।
“Extremely sorry Nabila. Ami amar kajer kono excuse dibo na. Tui just amar sathe ektu dekha kor. Ontoto doshta minute amake de. Nahole sarajibon ami ei guilt theke ber hote parbo na. Plz Nabila!!!”

নাবিলা রিপ্লাই দিলো না। মাসুদ এবং এই গ্রুপের সাথে তার কলেজ থেকে বন্ধুত্ব। অভিভাবকদের বিজনেস সার্কেল এবং বর্তমানের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি দুটোই মিলে যাওয়ায় গ্রুপটা টিকে আছে। মাসুদকে সস্তা ইভ টিজিং করতে না দেখলেও নাবিলা জানে ও কখনোই গার্লফ্রেন্ড ছাড়া থাকে না। একই সাথে দু তিনটারও রেকর্ড আছে। তবে তাদের সাথে কখনও মিসবিহেভ করেনি। নাবিলারও ইচ্ছে হয় না কারো পার্সোনাল লাইফে নাক গলাতে। সেজন্যই বোধহয় এতদিন ওদের সাথে থাকতে পেরেছে।
যোগাযোগ না রাখার কারণ পুরোটাই মাসুদ নয়। মেয়ে দুটোই সঙের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। একটা কথা অবধি বলল মা নাবিলার হয়ে। এটাই তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে। তাই সে ওদের সাথে দূরত্ব বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে মাসুদের সাথে সেসবের বোধহয় দেখা করাই যায়। এতদিনের বন্ধুত্বের দাবি! কি ভেবে মাসুদকে রিপ্লাই দিলো নাবিলা। ফোন বাড়িতে ফেলে রেখেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাড়িতে আর ভালো লাগছে না।
সেদিন ঘুরে এসেও শান্তি পেলো না সে। কোত্থেকে মাসুদ সামনে উদয় হয়েছে। করজোড়ে বলেছে যেন একদিন ওকে দশটা মিনিট সময় দেয়। নাবিলা দেখা যাবে বলে কাটিয়ে এসেছে। বিরক্তির এক শেষ।

___________________

রোবটিক ভঙ্গির হাসি ধরে রেখে বিল করে দিলো আফরিন। মহিলা সামনে দাঁড়িয়ে। তার পেছনে মহিলার স্বামী মুখে হাসির স্ট্যাম্প ঝুলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তাকাতে রুচিতে বাঁধল আফরিনের। লোকটার চোখের ভঙ্গি বুঝতে তার এতটুকুও কষ্ট হলো না।
দুজন চলে গেলে আফরিন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। এখানে কাজ করছে এক বছরের কিছু বেশি সময় ধরে। এরই মাঝে তার চোখ দৃষ্টির কাজ অতিক্রম করে ডিটেক্টরে পরিণত হয়ে গেছে। মানুষের চোখের দিকে তাকালেই ঝট করে ভেতরটা দেখে ফেলতে পারে। নারী, পুরুষ দুজনারই। ফলে কিছুক্ষণ আগে লোকটা তার দিকে ঠিক কেন তাকিয়ে ছিল ভাবতেই গা গুলিয়ে ওঠে।
আফরিন চিন্তা করেছে এই চাকরিটা ছেড়ে দেবে। কিছু টাকার বিনিময়ে এসব ভদ্রতার মুখোশ পরা মানুষগুলোর চোখের ব্যায়ামের সরঞ্জাম হওয়ার কোনো ইচ্ছাই তার নেই। কিন্তু আরেকটা কাজ না পেয়ে এটা ছাড়তেও পারছিল না। সেদিন নাবিলার ঘটনাটা তার চিন্তায় বড়সড় একটা ধাক্কা দিয়েছে। এতদিন দৃষ্টি তির সহ্য করলেও স্পর্শের আ-ক্র-ম-ণের মুখোমুখি হতে হয়নি। আরেকটু হলেই ঐ অভিজ্ঞতাও ঝুলিতে ঢুকে পড়ত। আফরিন নিজেকে চেনে। সবাই তাকে উপর দিয়ে শক্ত ভাবে। ভাবে মেয়েটা অনেক কঠিন। তারা জানে না ফুপুর এক একটা কথা তাকে কতো গভীর থেকে আঘাত করে, রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে যায়। সেদিন যদি ছেলেটা তাকে স্পর্শ করত তাহলে এই আঘাত আফরিন কতদিনে ভুলতে পারতো নিজেও জানে না। এতো ঝুঁকি নিয়ে সে কাজ করতে চায় না। অন্তত নিজের আব্রুর বিনিময়ে তো নয়ই।
রিজাইন লেটার আগেই টাইপ করেছিল। সেটার ডেট চেঞ্জ করে কর্তৃপক্ষের কাছে মেইল করে দিল। মাসের শুরু হয়ে গেছে তাই এখুনি কাজটা ছাড়া যাবে না। এই মাসটা মুখ বুজে থাকতে হবে। বুদ্ধি করে দুদিন আগে সাবমিশনের কাজটা করলে আজ এই ভোগান্তি হতো না। কিন্তু সে তো জানত না নাবিলার ঐ ঘটনাটা তাকেও ভোগাবে।

ডিউটি করে বের হওয়ার সময় আফরিন চিন্তা করল এই মাসে যেই কয়েকটা দিন আসতে হয় আফসানার বোরখাটা পরে আসবে। স্যুট বুট পরা ভদ্র মানুষগুলো ঠিক কোথায় কোথায় তাকায় সে ভালই জানে। পরনের থ্রি পিসের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এটায় দেখাটা আরো সহজ হয় বরঞ্চ। ওড়নাটা বের হওয়ায় সময় মাথায় এক পাল্লা দিলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেটা আর মাথায় থাকে না। ঐ চোখগুলো নামাতে তো পারবে না তার চেয়ে বরং নিজের সামনে একটা অভেদ্য প্রাচীর তুলে দেবে।

সিএনজিতে ওঠার আগ মুহূর্তে ফার্মেসিতে যাওয়ার কথা মনে পড়লো। মোশাররফ হোসেন ওষুধ নিয়ে যেতে বলেছেন। ফার্মেসিতে যেতেই চোখ পড়ল লাগোয়া রেস্টুরেন্টে। স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালের ওপাশে চকচকে লাইটে সবটাই দৃশ্যমান। আফরিন অবাক হয়ে দেখলো নাবিলা বসে আছে। সপ্তাহ খানেক আগের ঘটনা আফরিন ভোলেনি। তার বিস্ময় ভয়ে রূপ নিলো যখন দেখলো নাবিলার সাথে সেদিনের সেই ছেলেটা ছাড়া আর কেউ নেই। ওষুধ কিনেও আফরিন চলে যেতে পারল না। কেবলই মনে হচ্ছে নাবিলাকে কিছু বলে যায়, একটু সতর্ক করে যায়। ভাবতে ভাবতেই দুজনে উঠে দাঁড়ালো। বের হলো রেস্টুরেন্ট থেকে। আফরিন একটু এগিয়ে যেয়ে ছেলেটার চোখের দিকে তাকালো। অমায়িক এক হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে নাবিলার দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ চোখের সেই হিংস্রতা একটুও কমেনি। আফরিনের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। বারংবার ঢোক গিললো সে। নাবিলা কি ছেলেটার সাথে একাই যাবে? মুহূর্তেই তার আশঙ্কা সত্যি হলো। ছেলেটার সাথে একই গাড়িতে উঠলো নাবিলা।

~চলমান~

মনের আকুতিগুলো মুখ ফুটে বলতে চাইলো জুঁই। পারলো না। হাসফাস করতে করতেই রাস্তার ওপাশে পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের একদম উপরে উত্তরের ফ্ল্যাটটার দিকে চোখ পড়ল। টং করে মাথায় একটা নাম বারি খেলো। হুমায়রা!
আস্তে ধীরে যেতে চাইলো জুঁই। কিন্তু মস্তিষ্কের বার্তা কেন্দ্র আশ্রয়স্থলের সন্ধান পেয়ে পা দুটোকে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিলো। ছুটতে শুরু করলো তারা। এক্কেবারে দরজার সামনে যেয়ে কলিং বেল চেপে শান্ত হলো জুঁই। প্রথমবারেই বাজিয়ে দিলো পরপর তিনবার।
রান্নাবান্না আজ দ্রুত শেষ করেছেন হুমায়রা। কাজ অল্পই ছিল। সেগুলো সেরে গোসল করে মাত্রই বের হলেন। ভেবেছেন যোহরের আযানের আগ পর্যন্ত বই পড়বেন। আর কোনো কাজ নেই। ভাবতেই শান্তি শান্তি লাগলো তার।
অসময়ে এমন দ্রুতগতির কলিং বেলের শব্দে কিছুটা হকচকিয়েই গেলেন তিনি। মাথায় বাঁধা ভেজা গামছার উপরেই হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হিজাবটা চড়িয়ে নিলেন। আই হোলে চোখ রাখার ন্যানো সেকেন্ডের মাথায় ঝট করে দরজাটা খুলে ফেললেন। বিস্ময়ে নিকাব বাঁধতেও ভুলে গেলেন হুমায়রা।
জুঁই ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছিল। সিঁড়িঘরের জানালা দিয়ে তাদের ফ্ল্যাট দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকাতেই দেখলো আরিফ তার ঘরের বারান্দায় এসে রাস্তায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। জুঁই দরজার দিকে আরো সরে এলো। এদিকে তাকালে যদি আরিফ তাকে দেখে ফেলে।
ঠিক সেই ক্ষণে দরজা খোলার আওয়াজে ঘাড় ঘোরালো জুঁই। মুখটা তার অচেনা হলেও চোখ দুটো চেনা। ফলে এটাই যে হুমায়রা সেটা বুঝতে তার সময়ই লাগলো না। ডান হাতে ঠোঁটের উপরে ঘাম মুছলো জুঁই। বড় করুন কণ্ঠে বলল, “আমাকে একটু আপনার কাছে রাখবেন?”

চলবে।