অন্তঃপুর পর্ব-০৬

0
2

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
৬. (প্রথম অংশ)

আফরিন ছুটে চলেই যাচ্ছিল। সাদমান আটকালো।
“এই দাঁড়া!”
“সাদ নাবিলা!”
সাদমান তীক্ষ্ম চোখে গাড়ির দিকে তাকালো।
“ওখানে গেলে ওকে বাঁচানোর বদলে আমরাই ফেঁসে যাবো।”
আফরিন আবার গাড়ির দিকে তাকালো। দুটো লোক নাবিলার দুই পাশে। এর মাঝে সেদিনের সেই ছেলেটাও আছে। আরেকটা লোক ড্রাইভারের আসনে বসে আছে।
আফরিন চোখ বন্ধ করলো। জোরে জোরে দুইবার নিশ্বাস নিলো। জোর করে ছাদবাগানের দৃশ্যটা মনে আনার চেষ্টা করলো। লেবু গাছ লাগিয়েছিল একটা। হয়নি। মরে গেছে। মেহেদী গাছের পাতাগুলো লাল হয় না। কি যেন দিতে বলেছিল সাদমান? উহ! মনে পড়ছে না। চোখ ঘোরাতেই ডায়ানথ্যাসের রানী গোলাপী রঙের ফুলটা নজরে এলো। ঝট করে চোখ খুললো আফরিন।
“সাদ ছুরিটা কোথায়?”
সাদমান হাত তুলে দেখালো। বাম হাতেই ওটা ধরে রেখেছে।
গাড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে আফরিন বলল, “ঐ ঝোঁপের ভেতরে চল।”
সাদমান ভুরু কুচকে বলল, “কেন?”
“ওখানে যেয়ে কিছু একটা শব্দ করবি। উদ্ভট ধরনের। যেন ওদের মনোযোগ সরে যায়। গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য হয়।”
সাদমানের কপালের ভাঁজ মুছে গেলো, “ওরা নামলে তারপর ছুরি দিয়ে টায়ার কেটে দেবো। নাবিলাকে নামিয়ে নিয়ে আসবো।”
“হ্যাঁ।”
“রিস্কি।”
“অনেক।”
আফরিনের হাত শক্ত করে ধরলো সাদমান।
“আরেকটু হলেই আমার হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে সাদ। ভয় পেলে আয়াতুল কুরসী পড়।”
সাদমান শক্ত কণ্ঠে বলল, “হোক।”

সাদমান ঝটপট মোবাইলের থিমে চলে গেলো। সেখানে উদ্ভট কিছু রিংটোন আছে। খুঁজতে খুঁজতে কাঙ্খিত রিংটা পেয়ে গেলো। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। কিন্তু অপরাধী মাত্রই পুলিশের গাড়ি ভেবে ভুল করে।
মোবাইল লক করে আস্তে ধীরে গলি থেকে বের হয়ে গাড়ির পেছনে ঝোপের মাঝে গেলো।

আফরিন বলল, “হাত ছাড়। আমি গাড়ির ঐদিকে যাই। ওরা নামলেই নাবিলাকে বের করতে পারব।”
“না আমার সাথেই থাকবি। তোর কি মনে হয় তিনজন একসাথেই বের হবে?”
আফরিন কিছু বলল না। সাদমান এই পর্যন্ত যখন এসেছে কিছু একটা না করে যাবে না এই বিশ্বাসে চুপ থাকলো সে।
সাদমান গাড়ির দিকে তাকালো। একজন নাবিলার চুলের মুঠি ধরে গাড়ির সাথে ধাক্কা দিলো। ব্যাথাতুর ভঙ্গিতে চিৎকার করলো নাবিলা। কিন্তু তার চিৎকার সীসার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আবার তাকেই আঘাত করলো। আরেকজন নাবিলার পরণের টপস ধরে টানাটানি করছে। এখনো খুলতে সফল হয়নি।
আফরিন হাত ঝাঁকি দিতেই সাদমান স্ক্রিনে চাপ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠলো সাইরেন। নিশুতি রাতের আধারের জাল ছিন্ন করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। বটগাছে শান্তিতে ঝিমুতে থাকা দুটো পাখি চিৎকার করে ডানা ঝাপটাতে শুরু করলো।

⁠。。。。

মাসুদের উত্তেজনা বিরক্তিতে রূপ নিয়েছে। এই মেয়ে চুপ করার নামই নিচ্ছে না। বোকা হলেও গায়ে শক্তি আছে। ইতোমধ্যেই তার হাতে কামড় দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছে। চোয়াল শক্ত করে বন্ধুর দিকে তাকালো মাসুদ। মুখ খিঁচিয়ে বলল, “শালা ক্লোরোফর্ম আনতে পারলি না? ঘটে এইটুকু বুদ্ধি নাই!”
বন্ধুর চোখমুখ তখন চকচক করছে। বিরতিহীন চেষ্টায় নাবিলার টপসের পিঠের কাছে ছিঁড়তে সক্ষম হয়েছে।
“বুদ্ধি তো তোর ঘটেও নাই। ওরে যে চা খাওয়াইছিস তখনই তো ঘুমের ওষুধ মিশায়ে দিতে পারতি।” সর্বশক্তি দিয়ে আরেকবার টান দিলো সে। নাবিলার টপস দুভাগ হয়ে গেলো। চকচকে হাসি দিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে গেলে বাধা দিলো মাসুদ।
“এই থাম! আগে আমি। ওর সাথে আমার পুরানো মামলা আছে। তাই না বল?” নাবিলার গাল ছুঁয়ে বলল মাসুদ। বন্ধু বিরক্ত হলেও কিছু বলল না। সুযোগ যে পেয়েছে এই অনেক। আগে পরে বিষয় না।

নাবিলার গলা ভেঙে গেছে। চিৎকার করতে করতে মনে হচ্ছে গলার রগ ছিঁড়ে গেছে। চোখের পানি শুকিয়েছে। প্রথমে নিজেকে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছিল। কেন মাসুদের সাথে একা গাড়িতে উঠলো! কেন আজকে বাড়ি থেকে গাড়িটা নিয়ে এলো না! মাসুদকে অনুনয় করেছে, সেদিন থাপ্পড় দেয়ার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। কোনো কিছুতেই কাজ না হলে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। বিপরীতে দুটো চড় গালে জুটেছে। ঠোঁট কেটে রক্ত বেরুচ্ছে। নাবিলা ভাবলো এখুনি যদি আজরাইলের দেখা পেতো। বাবা মাকে ফোন দিয়ে লাভ নেই। তাদের সাথে নাবিলার তেমন সম্পর্কই নেই। ভাইয়াকে ফোন দেয়া যেত। কিন্তু ফোন তো মাসুদ সেই কখনই বাজেয়াপ্ত করেছে। নাবিলা লাল টকটকে চোখ দুটো বন্ধ করলো। এই ক্ষণে মৃত্যু না এলেও সে আর কখনও বাড়িতে ফিরবে না। আত্মহত্যা করবে। এই জীবন রাখার আর কোনো মানেই হয় না। আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রয়োজন সবটাই ফুরিয়েছে।

“ওই তুই বাইরে যা। তুইও যা।” প্রথমে ড্রাইভারকে বলে বন্ধুর দিকে তাকালো মাসুদ। ছেলেটা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “শুরু কর না শালা! তোর বউ নাকি যে প্রাইভেসি দেয়া লাগবে!”
“যা বলি তাই কর। বের হ।”
“ধুর!”
ড্রাইভার বের হয়ে গেলে ছেলেটাও বের হলো। নাবিলার শান্ত দেহের দিকে তাকিয়ে শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করল মাসুদ।
“হুদাই ধস্তাধস্তি করলি। আগুন তো নিভেই গেলো।”
নাবিলা তাকালো। রাগের আগুন আর ভয়ের অশ্রু মিলেমিশে তখন তার দুচোখের অবস্থা ভয়ংকর।
“ওরে ওরে! আমি তো ভয় পাইসি!” দু হাত তুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল মাসুদ। পরক্ষনেই হেসে বলল, “তেজ দেখাস আমার সাথে? মাসুদের গালে থাপ্পড় দিস! তোর কলিজা দেখার জন্যে আমার জান ছটফট করছে রে নাবিলা!” নাবিলার গাল শক্ত করে চেপে ধরলো মাসুদ। নাবিলা চোখ বন্ধ করলো আবার। খুব করে চাইলো এক্ষুনি যেন তার মৃত্যু হয়। এক্ষুনি।

ঠিক তখনই বাইরে কীসের যেন একটা আওয়াজ হলো। নিজের লক্ষ্য পূরণে মত্ত থাকায় মাসুদ গা করল না। তবে তার বন্ধু ছুটে এলো। জানালায় অনবরত ধাক্কাতে শুরু করল। নাবিলা তখন প্রতিরোধহীন।

“কি হইছে?” জানালা খুলে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল মাসুদ।
“শব্দ শুনছিস? ড্রাইভার তো পলাইছে।” ভীতু কণ্ঠে বলল ছেলেটা। মাসুদ কান খাড়া করতেই সাইরেনটা শুনতে পেলো। আশপাশেই আছে। আওয়াজটা শোনা যাচ্ছে।
চোখ বড় করে তাকালো মাসুদ, “পুলিশ!”
“তুই থাক মাসুদ। মেয়েরে আমি চিনি না। তুই ডাকছিলি তাই না করতে পারি নাই। বাড়িতে আমার জরুরী কাজ আছে।” মাসুদ দেখলো তার বন্ধু নিঃশ্বাস বন্ধ করে দৌড় দিলো। চোখের পলকে চলে গেলো রাস্তার দিকে।
অসহ্য হয়ে গালি দিলো মাসুদ, “শালা জানোয়ারের দল!” সাইরেনের আওয়াজ এক ধাপ বাড়ল। মাসুদের টনক নড়ল। ওরা কি এদিকেই আসছে? কেন? আশপাশে তো কিছুই নেই। কোনভাবে কি ওদের খোঁজ পেয়েছে? শুকনো ঢোক গিলে নাবিলার দিকে তাকালো। সে পড়ে আছে নড়চড়হীন হয়ে। ওকে ফোন ধরার সুযোগই দেয়নি মাসুদ। কপাল থেকে ঘামের একটা সূক্ষ্ম ধারা নেমে আসতেই সে গাড়ি থেকে বের হলো।

গাড়ির পেছনে ঝোপ। তার পেছনে হাইওয়ে। তবে ঝোপের ঘনত্বের কারণে রাস্তাটা সহজেই চোখে পড়ে না। কম্পনরত পা ফেলে ঝোপের দিকে এগিয়ে যেতেই মনে হলো আওয়াজটা আরো ভালোভাবে কানে আসছে। মাসুদ হা করে নিশ্বাস নিলো। বুক ধড়ফড় করছে। নাবিলার ফ্যমিলি ব্যাকগ্রাউন্ড তার অজানা নয়। যতই হেলাফেলা করুক ওর বাপ এই খবর পেলে যে সহজে ছাড়বে না এটা সহজেই অনুমেয়। তার উপরে তার বাবার ব্যবসা এখন আর আগের মতো নেই। পুলিশ নিশ্চয়ই নাবিলার বাপের পাল্লায় যাবে।
নানা ধরনের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাওয়ার মাঝেই শব্দটা আরেকটু বাড়ল। মাসুদ আর দাঁড়ালো না। পেছন দিকে না তাকিয়েই ভো দৌঁড়ে ঝোপের উল্টোদিকে চলে গেলো। আজকের রাতটা কোনো মতে পার হলেই সে দেশ ছাড়বে। দূরে যেতে না পারলেও অন্তত কলকাতায় তো যেতে পারবে।

শেষজন দৌড় দিতেই আফরিন টান দিয়ে হাতের বাঁধন খুলল। সাদমান নিজেই ছেড়ে দিলো। সাউন্ডের লেভেল সর্বোচ্চ করে কিছুক্ষণ ওভাবেই রেখে দিলো।
আফরিন খোলা দরজা দিয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। নাবিলা নিথর ভঙ্গিতে পড়ে আছে। নিশ্বাস নিচ্ছে কি না এটাও বোঝা যাচ্ছে না।

“নাবিলা!” নাবিলেকা ঝাপটে নিজের বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলল আফরিন।
“এই নাবিলা!” আফরিন নাবিলার শরীর ঝাঁকি দিলো। নাবিলা কেমন শূন্য চোখে তাকালো। যেন তার হুশ নেই।
“ওঠো!” নরম কণ্ঠে বলল আফরিন।
নাবিলার চোখ ঝাপসা হলেও বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা একটা মেয়ে। মুখটা ঢাকা। আশপাশে তাকালো। মাসুদ কোথাও নেই।
“ওরা চলে গেছে। কেউ নেই।”
আফরিনের এই আশ্বাসটুকু শুনে সাথে সাথেই বিশ্বাস করতে পারল না নাবিলা। মিনিট খানেকের মাথায় তার চোখ থেকে জল গড়াতে শুরু করলো। আফরিনের পিঠ শক্ত করে ধরে জ্ঞান হারালো সে।

সাদমান দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ির কাছে যাওয়া সমীচীন মনে করেনি। সাউন্ড বন্ধ করে একটু চিন্তায় ছিল। লোকটা যেদিক দিয়ে গেছে সেদিকেই বাইকটা রেখে এসেছে। বটগাছের পেছনে। এই অন্ধকারে দেখতে পাওয়ার কথা না। যেভাবে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেছে তাতে না দেখাই স্বাভাবিক। তবুও সন্দেহটা মনে খচখচ করছে। দেখলে আবার ফিরে আসবে নাকি? আফরিন এতো দেরি করছে কেন!

“সাদ!”
সাদমান এগিয়ে গেলো। আফরিন ভেজা চোখে বলল, “ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। কি করবো?”
সাদমানের চেহারায় চিন্তা খেলে গেলো।
“ওর ফোন আছে আশপাশে?”
চারদিকে দেখে আফরিন বলল, “এখানে তো নেই। ওর কাছেও থাকার কথা না। সামনে দেখ।”
আফরিনের ধারণাই সত্যি হলো। গাড়ির সামনের ড্যাশবোর্ডে একটা ফোন রাখা। কভার দেখেই অনুমান করা যায় ফোনটা কোনো মেয়ের।
“ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়া। লক খুলে কল লিস্টে ঢুকে আমাকে দে। তাড়াতাড়ি কর।”
ডান হাতে নাবিলাকে ধরে রাখলো আফরিন। নাবিলার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ছোঁয়াতেই লক খুলে গেলো। কল লিস্টে ঢুকে সবার প্রথমে মাসুদের নাম পেলো। আফরিন ভাবলো বাবা অথবা ভাইয়ের নাম্বারে ফোন দেয়াটা ভালো হবে। ঝুঁকি মুক্ত। নাহলে এই মাসুদ আবার কে সেটা কে জানে।
বাবার নাম্বার গত দুদিনে নেই। ভাইয়া লেখা পেয়ে সেটায় চাপ দিলো সাথে সাথেই। সাদমানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই কথা বল! ওর ভাইয়ের নাম্বারে ফোন দিয়েছি।”
সাদমান ফোন নিলো। কল বেজে বেজে কেটে গেলো। আবার ফোন দেয়ার আগেই ঐ নাম্বার থেকে কল ব্যাক এলো।
“হ্যাঁ নাবিলা বল।”
“আপনি কি নাবিলার আপন ভাই?” গম্ভীর কণ্ঠে বলল সাদমান।
রাফি একবার ফোন নামিয়ে স্ক্রিন চেক করল। স্পষ্ট নাবিলার নাম। তাহলে কথা বলছে কে? চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “জাস্ট এ মিনিট!”
মিটিং রুম ছেড়ে বেরোতেই তার গলাও গম্ভীর হয়ে এলো।
“জি। আপনি কে? নাবিলা কই?”
“নাবিলাকে নিয়ে যেতে হলে আপনাকে দশ মিনিটের মধ্যে আসতে হবে। আমি লোকেশন মেসেজ করছি। দেরি হলে আমরা চলে যাবো।”
“এক মিনিট! আপনি কে ভাই? নাবিলাকে দিন।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাদমান বলল, “নাবিলা কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।” খট করে ফোন কেটে মেসেজ পাঠালো সাদমান। রাফি স্তব্ধ হয়ে মেসেজ পড়ল। একগাদা শঙ্কা মাথায় নৃত্য করতে শুরু করেছে। কানে চি করে একটা তীক্ষ্ম শব্দ হচ্ছে। রাফি তৎক্ষণাৎ ছুটলো। লিফট পাশে রেখেই সিঁড়ি দিয়ে এক প্রকার উড়ে গেলো সে। মিটিং রুমে তখনও মানুষ তার অপেক্ষায় বসে আছে।

~চলমান~

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
৬ (দ্বিতীয় অংশ)

শহরের ভেতরেই ষাট কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালিয়ে গেলো রাফি। তার মাথায় যে ঝড় উঠেছে সেই ঝড়ের গতিবেগ এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। জিপিএসের অনুসরণে গাড়ি যখন ব্যস্ত সড়ক ছেড়ে গেলো তখন গাড়ির স্পিডোমিটার আশি ছুঁই ছুঁই করছে। দুপাশের উইন্ডো গ্লাসই খোলা। হু হু করে বাতাস ঢুকছে। রাফির কানে বাতাসের শো শো শব্দও কিছু করতে পারল না। ঠিক চৌদ্দ মিনিটের মাথায় সে জায়গাটায় পৌঁছালো। অথচ স্বাভাবিক গতিতে এলে কমপক্ষে চল্লিশ মিনিট লাগত।

রোড লাইটের গম্ভীর আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। আশপাশে দোকান পাট বা বাড়িঘর কোনোটাই নেই। পরিত্যক্ত আনসার ক্যাম্পটা চিনতে অসুবিধা হলো না। দৌড়ে গেলো রাফি।

একটা মেয়ে কাউকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছেলে। দুজনেরই মুখে মাস্ক। কাছে যেতেই নাবিলার মুখটা স্পষ্ট হলো। একটা হার্ট বিট মিস করলো রাফি। কমে যাওয়া দৌড়ের গতি আবার বাড়ল।

হুড়মুড় করে কেউ নাবিলাকে টেনে নিলো। ভড়কে গেলো আফরিন। ঘাড় ঘোরাতেই লোকটার মুখ নজরে এলো। চোখ জোড়া একদম নাবিলার মতো।

“কি হয়েছে ওর?” ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো রাফি। তার বুক দুরু দুরু করে কাঁপছে। আফরিন এক পলক সাদমানের দিকে তাকালো। ওর কিছু বলার ইচ্ছে আছে বলে মনে হলো না।
রাফির চোখে আটকালো নাবিলার গায়ের ওড়নাটায়। সবুজ রঙের টপসের সাথে নীল রঙের ওড়নাটা মিলছে না। বোঝাই যাচ্ছে এটা অন্য কোন জামার। উপরন্তু এমন ওড়না নাবিলা পরে না। দানা বাঁধা সন্দেহটা বৃহৎ আকারের ধারণ করলো।
“কি হয়েছে ওর!” প্রায় চিৎকার করলো রাফি। সাদমান বিরক্ত হলো। কপাল কুচকে বলল, “সেটা আপনার বোনকে জিজ্ঞেস করলে সবচেয়ে ভালো হয়।”
আফরিন তড়িঘড়ি করে বলল, “আপনি যা গেস করছেন তেমন কিছু না।”
এই কথাটুকুই রাফির বুকের প্রলয়ংকারী ঝড় থামিয়ে দিল। রাফির মনে হলো অনেকক্ষণ পর সে নিশ্বাস নিতে পারছে। সিটে আধশোয়া নাবিলাকে ঝাপটে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সে।
কিছুক্ষণের মাঝেই নাবিলার জ্ঞান ফিরল। আফরিন দেখলো সে চোখ খুলেই নিজের গায়ের ওড়নাটা দেখছে। সবসময় একটা ওড়না স্পেয়ার রাখে আফরিন। কখন কিভাবে লেগে যায় বলা যায় না। সেটাই আজকে কাজে এলো।
“নাবিলা?” রাফি নরম কণ্ঠে ডাকলো। আফরিন লোকটার কণ্ঠের ওঠা নামায় বেশ অবাক হল। মাত্রই তো খ্যাক করে ধমক দিল।
নাবিলা রাফির দিকে তাকালো। মুহূর্তেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেললো সে। অশ্রুগুলো জমা ছিল একটা কাঁধের আশায়, দুটো হাতের আশায়। পেয়ে যাওয়ার পরপরই ঝরতে দেরি করে নি।
“ভাইয়া!”
“কি হয়েছে?”
“মাসুদ..” নাবিলার হেঁচকি উঠে গেলো। চোয়াল শক্ত করল রাফি।
“এই গাড়ি ওর?”
নাবিলা মাথা নাড়ল।
“তুই গাড়ি আনিসনি?”
“না।”
রাফির মন চাইলো নাবিলার দুই গালে দুটো চড় দিতে। দম ফেলে নিজেকে শান্ত করলো সে। এই মুহূর্তে সেই কাজটা পরিস্থিতি আরো নষ্ট করবে বৈ কি। তৎক্ষণাৎ ফোন বের করে থানায় কল করলো।

সাদমান আফরিনের হাত ধরলো, “হয়েছে না এবার? চল।”
আফরিন চাপা কণ্ঠে ফিসফিস করল, “দাঁড়া! পুলিশ আসুক। এমন নির্জন জায়গায় দুটো মানুষকে রেখে যাওয়া যায়?”
“পুলিশ আসলেই ঝামেলা বাড়বে। সাক্ষী টাক্ষী নিয়ে জীবন ঝালাপালা করবে। চল তো!”

“আপনারা নাবিলাকে কোথায় পেয়েছেন?” রাফির কোথায় সাদমান থেমে গেলো। এই শুরু হলো জেরা। বিরক্ত চোখে একবার আফরিনকে দেখে মুখ ঘোরালো সাদমান।

“পোস্ট অফিসের পাশে। একটা রেস্টুরেন্টে।”
“এই পর্যন্ত পৌঁছালেন কীভাবে? আপনি কি নাবিলার পূর্ব পরিচিত?” ভুরু কুচকে বলল রাফি। নাবিলা তখন কান্না থামিয়ে রাফির পেটে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। তার খুব ক্লান্ত লাগছে। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে।

এক পলক নাবিলার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে আফরিন বলল, “না। পোস্ট অফিসের পাশের সুপার শপে আমি পার্ট টাইম জব করি। সপ্তাহ খানেক আগে নাবিলা আপু ওখানে গিয়েছিলেন কিছু বন্ধুদের নিয়ে। সেখানে..” থেমে গেলো আফরিন। মাসুদ ছেলেটা কিভাবে তাকে হ্যারেস করার চেষ্টা করেছিল সেটা মুখে আসতে চাইছে না। সাদমান তার দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে সেটুকু এড়িয়ে গেলো সে।
“মাসুদ উনার সাথে মিস বিহেভ করেছিল। তাই আপু মাসুদকে চড় মেরেছিলেন। তখনই ঐ ছেলের চোখ দেখে সন্দেহ হয়েছিল। আজকে সন্ধ্যায় দেখলাম দুইজন এক সাথে রেস্টুরেন্টে। সেদিনের ঘটনা মনে করে ভয় পেয়েছিলাম। যখন দেখলাম ঐ ছেলের সাথে নাবিলা আপু একাই গাড়িতে উঠছেন তখন গাট ফিলিংস হচ্ছিল একটা বিপদ হবে। এজন্যই পিছু পিছু এসেছি।” আফরিন থামলো। রাফি এক মনে কথাগুলো শুনে গেলো। মানতেই হবে মেয়েটার দৃষ্টি তীক্ষ্ম। নয়তো মাসুদের চোখের আক্রোশ নাবিলা পড়তে পারেনি আর থার্ড পারসন হয়ে এই মেয়ে পরে ফেলেছে।
রাফি নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “থ্যাঙ্কস।”

পুলিশ চলে এলো কিছুক্ষণের মাঝেই। আফরিন, সাদমনাকে জেরা করলো। নাবিলার স্টেটমেন্ট নিয়ে রাফিকে বলল, “আপনি কষ্ট করে একবার থানায় যাবেন। কিছু কাজ করতে হবে।”
রাফি মাথা নাড়ল। সাদমান ভুরু উঁচিয়ে বলল, “কষ্ট করে! নিশ্চয়ই কেউটে টাইপ লোক।”
সাদমানের মাস্কের আড়ালের কথা শুধু আফরিনের কানেই গেলো।
মাসুদের গাড়ি পুলিশ নিয়ে গেলে নিজের গাড়িতে নাবিলাকে বসালো রাফি। সাদমানের সামনে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, “থ্যাংকস এগেইন। কীভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন এটা বোঝাতে আমি অক্ষম।”
সাদমান হাত মেলালো, “ওয়েলকাম। আসছি।”
আফরিনের হাত ধরে বাইকের কাছে চলে গেলো সাদমান। আফরিন সাদমানের কাঁধে হাত রেখে বাইকে উঠলো। তারপর সাদমান নিজেও উঠলো। পুরোটাই দেখলো রাফি। আকাশের দিকে মুখ করে নিশ্বাস ছাড়লো সে। এক পলক গাড়ির দিকে তাকালো। নাবিলা ঘুমিয়ে গেছে।

⁠。。。。。。。

বাইক স্টার্ট দিয়ে সাদমান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “যেটুকু স্কিপ করেছিস সেটুকু বল।”
“কোথায় কি স্কিপ করেছি?” মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো আফরিন।
“ঐ লোককে বলার সময়। শপে আর কি হয়েছিল?”
আফরিন ঢোক গিললো। কাজ হয়েছে।
“কি স্কিপ করব আজব! বললামই তো। মন দিয়ে গাড়ি চালা। এদিক ওদিক হলেই অক্কা পেতে হবে।”
“যা জিজ্ঞেস করছি তাই বল।”
“আরে ধুর! বললামই তো।”
“ঠিকাছে। আমি শপে যেয়েই খোঁজ নিবো।”
“আরে আরে! আমাকে তুই বিশ্বাস করিস না?” কোমল কণ্ঠে বলল আফরিন।
সাদমান কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলল, “না।”
আফরিন দমে গেলো।
“তুই বলবি নাকি আমি বাবাকে বলবো?”
“বলছি বলছি!” আমতা আমতা করে আফরিন বলল, “ঐ মাসুদ আসলে আমার সাথে মিস বিহেভের চেষ্টা করছিল। আমি হঠাৎ করে সরে যাওয়ায় ঘটনা অন্য রকম হয়েছে।” আয়নায় একবার সাদমানের মুখ দেখার চেষ্টা করলো আফরিন। হেলমেটে সেটা ঢাকা পড়ে আছে।
“তুই কালকে থেকে আর ওখানে যাবি না।” শক্ত কণ্ঠে বলল সাদমান।
“বললেই হলো নাকি! একমাস আগে থেকে বলতে হয়। আমি বলেছি। সামনের মাস থেকে আর যাবো না।”
“কালকে থেকেই যাবি না।”
“তাহলে জরিমানা দিতে হবে। দিবি তুই?” বিরক্ত কণ্ঠে বলল আফরিন।
“কত?”
“জানিনা। তুই আসলেই দিবি!” আফরিন অবাক হল।
“সাদ আমাকে একটা কাজ খুঁজে দিস তো। আশপাশ ভালো এরকম দেখে।”
“ইন্টার থেকেই তো কাজ করছিস। দুটো মাস রেস্ট নিলে কি তোর শরীর ক্ষয়ে যাবে?” সাদমানের কন্ঠ উষ্ণতা।
আফরিন কিছু বলল না। কেন সে কাজ করছে এটা তো কাউকে বলতে পারে না। সাদমান দুই মাস কাজ করে তো এক মাস ঘুরে সেই টাকা খরচ করে ফেলে। মোশাররফ হোসেন তাদের টাকা নেন না। কড়া কণ্ঠে আদেশ দিয়েছেন ওসব গুছিয়ে রাখতে। নিজেদের কাজে লাগাতে। আফরিন সেটা মাথায় রেখেই আগাচ্ছে। তার মনের গভীরে একটা পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনায় সফল হতে হলে তাকে আরো কাজ করতে হবে।
“ক্ষয়ে যাবে। তুই খুঁজিস।”
“দেখা যাবে।”
সাদমান স্পিড বাড়ালো। আফরিন হুমড়ি খেয়ে পড়ল সাদমানের পিঠের উপর।

____________________

সাদমান সত্যি সত্যিই জরিমানা দিয়েছে। তাকে ওখানে আর যেতে দেয়নি। আফসানা আর মোশাররফকেও বিষয়টা খোলাসা করে বলেনি। আফরিন অবাক হলেও খুশিই হয়েছে। মনে মনে অবশ্য জরিমানার সংখ্যাটা টুকে রেখেছে। একদিন সাদমানকে ওটা ফেরত দিয়ে দেবে।

সেদিনের পর থেকেই আবার কাজ খুঁজতে শুরু করেছে আফরিন। চুপি চুপি করছে কাজটা। সাদমান শুনলে আবার ধমকাধমকি করবে। মন মতো একটা কাজ পেয়েও গেলো সে। একটা প্রাইভেট উইমেন্স হসপিটালে রিসিপশনিস্ট খুঁজছে। সেখানেই চট করে অ্যাপ্লাই করে ফেললো আফরিন। তারপর মা-কে বলতে গেলো।

আফসানা ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ। আফরিনের সাথে তার খুব একটা কথা হয় না। শুধু আফরিন বলেই না। আফসানা মানুষটাই কম কথা বলেন। সবার সাথেই। তাই তার সাথে কথা বলতে আফরিনের কেমন একটা ভয় ভয় লাগে। মেপে মেপে কথা বলে সে।

“মা আসবো?”
“এসো।” আফসানা শুয়ে ছিলেন।
“ঘুমাচ্ছিলে?”
“না। এমনি শুয়ে ছিলাম। বলো।”
“একটা হসপিটালে রিসিপশনিস্ট খুঁজছিল। উইমেন্স হসপিটালে। ওখানে অ্যাপ্লাই করলাম।”
আফসানা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
“কাজটা করা কি খুব দরকার? মন দিয়ে পড়ালেখা করলেই তো চলে।” আফরিন মাথা নিচু করে রইলো। কিছু বলল না।
আফসানা বললেন, “হাসপাতালটা কোথায়?”
“ভার্সিটি থেকে বিশ মিনিটের পথ।”
“তাহলে তুমি ক্লাস করবে কখন?”
“কথা বলে নেবো। পার্ট টাইম হলেই করবো।”
“দেখো যেটা ভালো লাগে।”
মোশাররফ হোসেন শুনেও যে খুব খুশি হলেন তেমন না। পড়াশোনার চাপের সাথে আবার অতিরিক্ত কাজের চাপ নেয়াটা তিনি পছন্দ করলেন না।
সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখালো সাদমান। ঘরে ডেকে এনে বকাবকি শুরু করল।
“কি শুরু করেছিস তুই! সেদিন ঐ রকম একটা অবস্থা দেখেও শিক্ষা হয়নি?”
“তো কি করবো? ঘরে বসে থাকলে হবে?”
“হবে না? আমাদের অবস্থা কি এতই খারাপ?”
আফরিন মুখ গোজ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সাদমান দম ছেড়ে বলল, “এসব আপাতত বাদ দে রিনি। তেমন কাজের খোঁজ পেলে আমি তোকে জানাবো। সেলস গার্ল আর রিসিপশনিস্টের মধ্যে পার্থক্য কি?”
“আমার কাজ করাটা দরকার।”
হাতের বইটা ছুঁড়ে ফেলল সাদমান। এক প্রকার চিৎকার করে বলল, “দরকার হবেই তো! বাবার টাকায় চলতে তোর আত্মসম্মানে লাগে। সপ্তাহে দুই দিন বাজার না করলে জাত চলে যায়। আসলে আমাদের তুই কোনোদিন আপন ভাবিসই নি। ভাবলে আমার রিকোয়েস্ট রাখতি।”
বিকট শব্দে দরজা লাগিয়ে চলে গেলো সাদমান। আফরিন কেঁপে উঠল। টুপ করে এক ফোঁটা পানি পড়ল তার স্থির চোখ থেকে। সাদমান এটা বলতে পারল!

_______________

সেদিনের পর থেকে নাবিলা চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে থেকেই সে শান্ত। তবে এবার যেন পাথর হয়ে গেছে। আসিফা মেয়ের ঘটনা শুনে শয্যা নিয়েছেন। মেয়েকে ঠিক মতো দেখা শোনা করতে পারেননি, তাকে তার প্রাপ্য সময় দিতে পারেননি এটা ভেবে ভেবেই ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছেন।
মাহমুদ এক ধাপ এগিয়ে সরাসরি থানায় গেছেন। তার প্রতিপত্তি ক্ষয়িষ্ণু হলেও সাইয়েদ গ্রুপ তখনও রাজ করছে। তাই নামের জোরেই থানায় হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিয়ে এলেন। মাসুদ এবং তার বাবার নামে দুটো মা-মলা করতে চাইলে রাফি আটকালো। বিরক্ত হয়ে বলল, “মিথ্যা মা-মলার কি দরকার? ও যেটা করেছে তাতেই তো সাজা ভোগ করে কুল পাবে না।”
মাহমুদ চুপ করলেও থামলেন না। মাসুদের বাবা একসময় তার বেটিং এর সহযোগী ছিল। রাফির চাপে সে এসব ছাড়লেও মাসুদ ওর বাবার সঙ্গী হয়েছে। দুজন মিলে এখনও অনলাইনে অফলাইনে ভদ্র নামে জুয়া খেলে বেড়ায়। সেটাই পুলিশকে বলে দিলো মাহমুদ। রাফি একবার শান্ত চোখে বাবাকে দেখলো। নিজেই সেই পথের পথিক ছিল। এক সময়ের প্রাণের বন্ধুকে একই কাজের জন্য ধরিয়ে দিতে দ্বিধা করলো না। ক্রা-ইম পার্টনাররা বোধহয় এমনই হয়।

_______________

বেগুনী কাপড়ের মলাট দিয়ে ডায়েরীটা বানানো। উপরে সাদা সুতার ফুল। আফসানা সেলাই করে দিয়েছিলেন। যখন আফরিনের বয়স সাত তখন এই উপহারটা পায় সে। সাথে আরেকটা চমক। ওটাকে উপহার বলা যায় কি না সেটা আজও জানে না আফরিন।

কাপড়ে মোড়ানো এই ডায়েরীটা তার সঙ্গী। দীর্ঘ ষোল বছরের। রোজনামচা লিখতে তার আলসেমি লাগে। তবে অনুভূতি নয়। নিজের বুকের ভেতরের অনুভূতির যেই পাহাড় কাউকে দেখানো যায় না, যেই পাহাড়ের চূড়ায় জমা বরফ বুকটা হিম করে দেয়, বুকজমিনে সৃষ্টি হওয়া ঝড়ের যেই বাতাস বাইরে বের করা যায় না সেই সবটার সাক্ষী এই ডায়েরীটা। কলমের কালি দিয়ে এখানে তো সে গল্প লেখে না। লেখে জীবন। যেটা গল্পের চেয়েও বেশি কিছু।

“প্রিয় সাদ,

আজকে তুই আমাকে কঠিন একটা কথা বলেছিস। তোদের আমি কখনোই আপন ভাবি নি। এটা তুই বলতে পারলি? মুখে একটুও আটকালো না? এই “তোদের”টা কারা? আমাকে ছাড়াই তুই “আমাদের” বানিয়ে দিলি? উল্টো অভিযোগ কি আমি করতে পারি না সাদ?

পারি। তবুও করব না। আকাঙ্খার ফিজিক্স ছেড়ে, স্বপ্নের ইউনিভার্সিটি ছেড়ে যেই ছেলেটা আমার জন্য, শুধু মাত্র আমার জন্যই অপছন্দের কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা করেনি তার উপরে কি রাগ করা যায় বল? তুই কেন চান্স পেয়েও ভর্তি হলি না সেটা কি আমার কাছে লুকাতে পারবি? মন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে এই লজিক বাবা মা বিশ্বাস করতে পারে। আমি না। আমি জানি গুচ্ছের পরীক্ষার জন্য তুই কীভাবে পড়াশোনা করেছিলি। আমাকে বারবার বলেছিলি ভালো করে পড়তে। যেন দুজনেই এক ভার্সিটিতে চান্স পাই। আমি পেলাম না। আমার জন্য তুই নিজেও গেলি না। আমাকে দেখে রাখার জন্য, দীর্ঘ পথে আমার হাতটা ধরে রাখার জন্য যেই ছেলেটা নিজের স্বপ্নকে বুকের ভেতরে চাপা দিয়ে রাখল সেই ছেলের উপরে রাগ করা যায় না। তাই না সাদ?

আমি তোদের সবাইকেই আপন ভাবি সাদ। তোরা ছাড়া আমার নিজের তো কোনো পরিচয় নেই! জ্বর হলে অবচেতন রিনির পাশে মা যে সারারাত বসে থাকে এটা কি আমি জানি না? তিক্ত মুখে যখন কিছু খেতে ইচ্ছে করে না তখন ঘোরের মাঝে তুই যে আমাকে থাই স্যুপ বানিয়ে খাওয়াস এটাও আমার অজানা নয়। উপরে যতই শক্ত পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখিস, তোর ভেতরের পুরোটাই আমার মুখস্থ। বাবার প্রকাশ্য স্নেহ, মায়ের লুকানো ভালোবাসা, তোর অকারণ ধমক, ভয়ের চোখ রাঙানি এগুলোই তো আমার পরিচয় সাদ। তাই তোর বিরুদ্ধে মন আকাশে কোনো কালো মেঘ জমা করলাম না। তোকে সাজিয়ে রাখলাম শরতের এক টুকরো সাদা মেঘের মতো।”

~চলমান~