অন্তঃপুর পর্ব-০৮

0
2

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
৮.

আফরিনের জীবনের প্রেক্ষাপটের সাথে রোড অ্যাক্সিডেন্টের বিশেষ একটা যোগ আছে। সাত বছর বয়সে বিষয়টা জানার এবং বোঝার পর থেকে রাস্তা নিয়ে তার মনে এক ধরনের ভয় তৈরি হয়েছে। সেই ভয়ের কথা সে কাউকে বলতে পারেনি। মনের গহীনে অবোধ ভয়টা শিকড় গজিয়ে, ডালপালা ছড়িয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। ফলে উত্তর কুঁড়িতেও সেটা বহাল তবিয়তে রয়েছে।

বিষয়টা কীভাবে কীভাবে যেন সাদমান ঠিক পেয়েছে। আফরিন নিজেই কখনও বলেছে কি না মনে নেই। তবে তার পর থেকে সাদমান কখনও তাকে রাস্তায় একা বের হতে দেয় না। ভার্সিটিতে তো তার সাথেই যাতায়াত করে। এছাড়া অন্য কাজেও সাদমান সঙ্গী হয়।

শেষবার কবে একা রাস্তায় বেরিয়েছিল বলতে পারবে না আফরিন। সাদমান যেবার বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার গেল তখন? নাকি এর পরেও? মনে পড়ছে না।
মস্তিষ্কে যেন চাপ না দিতে হয় এজন্যই বুঝি আজ সাদমান নতুন করে স্মৃতি তৈরি করল। আজকে থেকে তার হাসপাতালের কাজের শুরু। রিসিপশনিস্ট হিসেবে প্রথম দিন। সাদমান সকাল থেকে তার সাথে দেখা করেনি। ক্লাস ক্যান্সেল হয়েছিল বিধায় ভার্সিটিতে যেতে হয়নি। সাদমানের জন্য সুবিধাই হয়েছে। কয়েকদিন ধরেই তার সাথে কথা বলছিল না। ছেলেটা তার জরিমানার টাকা দিয়েছে। তার অনুরোধটা বোধহয় রাখার দরকার ছিল। আফরিন চোখ বন্ধ করল। কি হত সাদমান তাকে নিয়ে এলে? সে যে রাস্তা পার হতে ভয় পায় এটা কি ও জানে না?

একটা বাচ্চা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আফরিন বেরিয়ে এলো ভাবনার জগৎ থেকে। মুখের মাস্কটা ঠিক করে পরলো। হাসপাতালের ফিনাইলের গন্ধটা একদম সহ্য হয় না। সেই সেখানেই এসে পড়েছে সে। এখন সার্জিক্যাল মাস্কেই ভরসা।
আজ মায়ের একটা বোরখা পরেছে আফরিন। অভ্যাস না থাকায় বেজায় গরম লাগছে। স্কার্ফ মাঝে সাঝেই পরা হয়। তবে বোরখাটা আজই প্রথম। একেকবার মনে হচ্ছে খুলেই ফেলে। কিন্তু ঢোলা বোরখাটায় জামা কাপড় টানাটানি করে ঠিক করতে হচ্ছে না। গায়ের সাথে সেটেও নেই। রিল্যাক্সে থাকতে পারছে। এজন্যই গরমে কষ্টটা মুখ বুজে সয়ে যাচ্ছে আফরিন।

“আমার একটা অ্যাপয়েনমেন্ট ছিল।”
আফরিন সোজা হয়ে বসল। যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল, “কাইন্ডলি ডাক্তার এবং রোগীর নাম বলবেন।” তার চোখ কম্পিউটারের স্ক্রিনে নিবদ্ধ।
রাফি হতাশ হলো। এই মেয়ের মাথা ওঠানোর কোন লক্ষণ নেই।
“ডক্টর আবেদ হোসেন। রোগী রুমিলা বেগম।”
আফরিন খটখট করে কী বোর্ড চাপলো। পনের সেকেন্ডের মাথায় বলল, “একটু অপেক্ষা করুন। আপনার সিরিয়াল নাম্বার সতের। এখন কত চলছে জেনে জানাচ্ছি।”
ডেস্কে বসেই বেল বাজালো আফরিন। একজন ছুটে এলো। রাফি দেখল ছেলেটা ওয়ার্ড বয় ধরনের।
“আবেদ স্যারের এখন সিরিয়ালটা জেনে আসো তো।” আফরিন বলল।
ছেলেটা এক মিনিটের মাঝেই ফিরে এলো, “পনের নাম্বার চলে।”
আফরিন মাথা ওঠালো। সরাসরি রাফির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর একজনের পর আপনার টার্ন। স্যারের চেম্বারের সামনে চলে যান।”
রাফির বুকটা ধুক করে উঠেছিল। মেয়েটা সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে কেউ তাকায়! আশ্চর্য!
ঠিক তখনই ধা করে চোখ দুটোর কথা মনে পড়ল। নাবিলাকে সেদিন এই মেয়েটাই জড়িয়ে ধরে ছিল। শিওর! রাফি অপলক তাকিয়ে থাকতে পারল না। আরেকজন আফরিনের সাথে কথা বলছে।

আফরিন মনে মনে অবাকই হয়েছিল। আসলেই পৃথিবীটা গোল। ঐ লোকটার সাথেই আবার দেখা হলো। একবার নাবিলার খোঁজ জানতে পারলে হত। মেয়েটা কেমন আছে কে জানে। একবার লোকটার আশপাশে তাকালো আফরিন। এক বৃদ্ধা মহিলাকে নিয়ে বসে আছে। নাবিলা নেই।

রাফি ঘুরে ফিরে মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছিল। সেদিনের সেই নরম সরম ভাবটা আর নেই। কেমন কঠিন মূর্তি নিয়ে কাজ করছে। অবশ্য ঠিক কঠিনও বলা যায় না। যান্ত্রিক বললে বোধহয় ঠিক হবে। সেদিন কি বোরখা পরে ছিল? মনে হয় না। রাফি নিজের চিন্তায় বিরক্ত হলো। অচেনা অজানা একটা মেয়েকে নিয়ে এমন আগ্রহের মানে কি! নিজেই নিজেকে ধমক দিল। আরেক মন বলে উঠল নাবিলাকে সাহায্য করেছে বলেই এই আগ্রহ। ফলে বিবেকের কাছে একটা অজুহাত পেয়ে যাওয়ায় চক্ষু লজ্জাকে পাশে রেখে কৌতূহলটা জারি রাখার চেষ্টা করছিল রাফি। অন্তত নামটা জানতে পারলে হত।
পকেটে ভাইব্রেশন হওয়ায় দৃষ্টি সরাতে বাধ্য হলো রাফি। অফিস থেকে কল এসেছে। রুমিলা বেগম চুপচাপ বসে আছেন। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।
রাফি বলল, “দাদীমা আমি একটু আসছি।”

বাইরে বেরিয়ে গাড়ির সামনে গেল রাফি। জানালার কাচে টোকা দিয়ে বলল, “জাফর একটু দাদীমার কাছে যেয়ে বসো তো। আমি একটু কথা বলে আসছি।”
জাফর ভেতরে চলে গেলে রাফি কল ধরল।

জাফর যেতেই রুমিলার সিরিয়াল এল। রুমিলাকে ধরতে হল না। লাঠি ঠকঠক করতে করতে তিনি নিজেই দেখানো রাস্তায় চলে গেলেন।
বিপত্তি বাঁধল চেকআপ শেষে। ডাক্তার কিছু ওষুধের সাথে একটা ইনজেকশন এখুনি দিতে বললেন। রুমিলা বেগম কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারলেন না। এই পর্যায়ে তার গলার স্বর কিছুটা উঁচু হল। জীবনে এই একটা জিনিসকেই যমের মতো ভয় পান রুমিলা।

সামনে কেউ ছিল না। হালকা চিৎকার শুনে তাই আফরিনের মনোযোগ সেদিকে গেল। পাশের ছেলেটাকে বলল, “কি হয়েছে?”
“দেখে আসি।” ছেলেটা দৌড়ে গেল। আফরিন হাসলো। এই ছেলেটা একটু অদ্ভুত ধরনের। তার চেয়ে তিন চার বছরের ছোট হবে। একটা কথা বলতে দেরি এই ছেলের ছুটতে দেরি হয় না।
“আবেদ স্যারের চেম্বারের বুড়া একটা মহিলা ঢুকেছে। ইনজেকশন দিতে ভয় পায়।” নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল ছেলেটা।
আফরিন মাথা নাড়ল, “ওহ।”
কিন্তু মিনিট গড়ালেও মহিলার আওয়াজ থামল না। হাসপাতালের পরিবেশ নিরিবিলি হওয়ায় তার হালকা চিৎকার কানে বাজছিল। সামনে কেউ ছিল না। সবাই যার যার সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করছে। আফরিন ভাবল একবার উঠে দেখে আসে।
“তুমি থাক। কেউ এলে ডাক দিও। আমি একটু দেখে আসি।” ছেলেটাকে বলে উঠে দাঁড়াল আফরিন। ডান পাশের করিডোরে আবেদ স্যারের চেম্বার।
আফরিন দেখল একটা লোক চেম্বারের বাইরে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আশপাশে তেমন মানুষ নেই। কী মনে করে আফরিন বলল, “ভেতরে কোন নার্স আছেন?”
দরজার সাথে দাঁড়ান লোকটা মাথা নাড়ল, “না।”
আফরিনের কপালে ভাঁজ পড়ল। সব চেম্বারের জন্যই অন্তত একজন নার্স নিযুক্ত আছেন। রোগীকে সামাল দেয়ার জন্য। কী মনে করে আফরিন চেম্বারের দরজায় নক করল। এতক্ষণ আবেদ হোসেনের গলা পাওয়া যাচ্ছিল। শব্দ শুনে সেটা থেমে গেল।
“আসুন।”
স্লাইডিং ডোর সরিয়ে উঁকি দিল আফরিন। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, “কোন সমস্যা স্যার?”
পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া আবেদ হোসেন শব্দ করে নিশ্বাস ছাড়লেন। হতাশ কণ্ঠে বললেন, “চাচী আমাকে ভয় পাচ্ছেন।” ইশারায় রুমিলা বেগমকে দেখালেন ডাক্তার। আফরিন এগিয়ে এল। রুমিলার কাছে যেয়ে তার হাত ধরে বলল, “কোন সমস্যা দাদী?” মহিলা নাবিলার আত্মীয়। ধারণা করল আফরিন। যেহেতু নাবিলার ভাইয়ের সাথে এসেছে।
রুমিলা এতক্ষণে যেন অভিযোগ করার মতো মানুষ পেলেন। রাফি কই যেয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে আল্লাহই জানে। মনে মনে রাফিকে দু চারটা ধমক দিয়ে অসহায় কণ্ঠে বললেন, “আমাকে তো সুই দিতে চায়।”
এক পলক আবেদ হোসেনের হতাশ চেহারার দিকে তাকিয়ে আফরিন মুখের মাস্ক নামালো। নরম কণ্ঠে বলল, “সুই তো আপনার ভালোর জন্যই দেয়া হবে দাদী। ওষুধটা না দিকে কীভাবে হবে?”
মেয়েটার নরম কণ্ঠে রুমিলা খানিকটা ভরসা পেলেন বলে মনে হল। তার চোখের অস্থির ভাবটা দুর হয়ে দেখল আফরিন।
“ভয় লাগে যে..”
“ভয় কীসের! আল্লাহ আপনাকে এত বছরের জীবন দিয়েছেন। জীবনে তো কত কিছু সহ্য করতে হয়েছে। সেখানে এই সুই কি জিনিস দাদী!”
রুমিলা তবুও স্বস্তি পেলেন না।
“খাওয়ার ওষুধ নাই? সুইয়ের বদলে?”
আফরিন আবেদ হোসেনের দিকে তাকালো। মনে হলো তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। কিছু একটা মনে করে আফরিন রুমিলার হাত ধরল।
“দাদী আমি নাবিলা আপুকে চিনি। আপনি আপুর কি হন?”
রুমিলা অবাক হলেন। এই মেয়ে কি নাবিলার বন্ধু নাকি? তার মনোযোগ সরে গেল। আফরিন আবেদ হোসেনকে ইশারা করলে তিনি এগিয়ে এলেন।
“তুমি নাবিলাকে চেন?”
“জি।”
“তোমরা বান্ধবী?”
“না। আমি আপুকে চিনি। উনি আমাকে চিনেন না। আপনি আপুর কি হন?”
“দাদী হই। কি আজব কথা! তুমি চেন তাহলে ও চেনে না কেন?”
আফরিন বিজয়ী ভঙ্গিতে হাসল।
“এমনিই। দেখেন আপনার সুই দেয়া শেষ।”
হুশ ফেরার মতো করে তাকালেন রুমিলা। আবেদ হোসেন ইনজেকশন ফেলে দিয়ে প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দিলেন।
আফরিনের উদ্দেশ্যে বললেন, “আজকে আর রোগী দেখব না। খুব ক্লান্ত লাগছে। আর কেউ থাকলে আগামী কালকের আয়াপোয়েনমেন্ট দিয়ে দাও।”
“জি স্যার।”
রুমিলাকে ধরে ওঠাল আফরিন। রুমিলা মেয়েটার চালাকিতে অবাক হয়েছিলেন। ব্যবহারও ভাল লাগল।
“তোমার নাম কি?”
“আফরিন।” আফরিন হাসল। মাস্ক পরে নেয়ায় সেই হাসি দেখা গেল না।
“নাবিলাকে তোমার কথা বললে চিনবে?”
“না দাদী। আপু আমাকে চিনেন না। সাবধানে যাবেন দাদী। আসসালামু আলাইকুম।” জাফরের কাছে রুমিলাকে দিয়ে আফরিন রিসিপশনের দিকে গেল। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে ডেস্ক থেকে এসেছে।

মেয়েটা চলে গেলে রুমিলা আফসোস করলেন। বিয়ে হয়েছে নাকি এটা শুনলে হত। মেয়েটাকে তার মনে ধরেছে। চেহারাটা সুন্দর। রুমিলার শক্ত ধারণা যেসব মানুষের স্বভাব চরিত্রে খারাপের পাল্লা ভারী তাদের চেহারা সুন্দর হতে পারে না। নিখুঁত মুখেও একটা ছাপ থাকে। তার এই দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় এটা সত্যি পেয়েছেন। সেই নিক্তিতে মেয়েটা উত্তীর্ণ হয়েছে। মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে মনে করার চেষ্টা করলেন মেয়েটা নাকফুল পরে ছিল কি না। যতদূর মনে পড়ছে নাক খালিই ছিল। তিনি জাফরকে ডাক দিলেন।
“অ্যাই জাফর!”
“জি দাদী?”
“একটা কাজ করতে পারিস?”
“কি কাজ?”
“যেই মেয়েটা গেল না এই মাত্র?”
“রিসিপশনের ঐ মেয়েটা?”
“মনে হয়। খেয়াল করি নাই। যা হউক, এই মাত্র যে গেল। দেখছিস?”
“জি দাদী। উনি রিসিপশনিস্ট।”
“আচ্ছা। ঐ মেয়ের খোঁজ খবর দিতে পারবি আমারে?”
জাফর কিছুটা ভরকে গেল বলে মনে হল, “কেমন খোঁজ দাদী?”
রুমিলা ভাবুক কণ্ঠে বললেন, “পাত্রীর যেমন খোঁজ লাগে।”
“পাত্র কে?” অবাক কণ্ঠে বলল জাফর।
“তোর ঘোড়সওয়ার। নিজে ঘোড়া হইছো আর আমার নাতিরে সওয়ারী বানাইছ। এক্ষণ ওর একটা খুঁটি না হইলে আমি শান্তি পাই না।” গজগজ করতে করতে বললেন রুমিলা।
জাফর বিড়বিড় করে বলল, “আপনার নাতিই আমারে ঘোড়া বানাইসে।”
“এই খোঁজ দিতে পারবি!” রুমিলা ধমক দিলেন।
“দেখি দাদী। আমি না পারলে অনিক ভাইরে বলব।” আমতা আমতা করে বলল জাফর।
রাফিকে আশপাশে না দেখে রুমিলার মেজাজ গরম হয়ে উঠেছিল। অনিকের কথা শুনে কিছুটা ঠান্ডা হল। ছেলেটাকে তিনি পছন্দ করেন। কি সুন্দর বিয়ে করে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। আর তার নাতি দুনিয়া উদ্ধারের কাজে ব্যস্ত!
“আচ্ছা। রাফিরে কিছু বলিস না আগেই। আমি দেখি।”
“জি দাদী।”
রুমিলা বিড়বিড় করলেন, “এক মাসের মধ্যে রাফির বিয়ে দেয়া লাগবে। কবে না কবে মরে যাই। আমি মরলে আমার নাতির আর সংসার করা লাগবে না। যেই মা বাপ পাইসে!”
জাফর শুনলেও কিছু বলল না। দাদীকে সে যথেষ্ট ভয় পায়। কোন কারণ ছাড়াই। মনে হয় এখুনি একটা ধমক দেবে।

~চলমান~