অন্তঃপুর পর্ব-১০ এবং বোনাস পর্ব

0
1

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
১০.

ফুড ভ্যান কেনার কাজটা করল সাদমান। ডেকরেশনের কাজ করল আফরিন। সাঈদদের দলটা নিয়ে। ওরা সোৎসাহে সব কিছু করছিল। ভেবেছিল আফরিন হয়তো নতুন কাজ শুরু করছে। তার পক্ষে অসম্ভব না। যে মেয়ে বেদে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারে সে খাবার বিক্রির কাজও করতে পারে।

সবকিছু গোছগাছ করতে তিনদিন লাগল। তিন দিনের দিন আফরিন সাঈদকে ডেকে গম্ভীর গলায় বলল, “সাঈদ।”
“জি আপা।”
“একটা কাজ করতে হবে?”
“কী কাজ?”
“কঠিন একটা কাজ।”
“আচ্ছা বলেন। দেখি কেমন কঠিন।”
“একজন ড্রাইভারের খুঁজে দিতে হবে আমাকে।”
সাঈদ মাথা চুলকাতে লাগলো, “ড্রাইভার তো আপা চিনি না।”
“তোদের পাড়া থেকে।”
সাঈদ সোজা হয়ে দাঁড়াল। নুরি শুনছিল। এগিয়ে এসে বলল, “একটা কথা বলি?”
“বলো।” আফরিন তাকাল।
“আমার ভাই গাড়ি চালাইতে পারে।”
“লাইসেন্স আছে?”
“জি।” নুরি মাথা নাড়ল।
সাঈদ বিরক্ত হয়ে বলল, “থাকলেই কি? যেভাবে তাস উড়ায় গাড়ি চালানো বোধহয় ভুলেই গেছে।”
আফরিন নুরিকে টেনে নিয়ে এল, “তোমার ভাই কি কাজ করবে নুরি?”
নুরি একটু থমকাল। তাদের বাড়িতে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার মা। সকাল সকাল সিরামিকের থালা বাসন বোঝা মাথায় নিয়ে বের হয়। আসে সেই রাতে। এখন কি আর মানুষ হকারদের কাছ থেকে বাসন কোসন কেনে? তাও যদি আবার হয় বেদে! ভাইটা বড় হয়েও কোনো কাজ করে না। বাপের যোগ উত্তরসূরী হয়েছে।
“আমি বলব যেন করে। আপনার এই গাড়ি চালানো লাগবে?”
“হ্যাঁ।”

আফরিন উঠে দাঁড়াল। গলা উঁচু করে বলল, “সবাই এদিকে আসো!”
সে বলার সাথে সাথেই বার জন একসাথে দাঁড়িয়ে গেল। অ্যাসেম্বলির মতো করে। সাদমান গাড়ির ভেতরে ছিল। আফরিন জানালায় দাঁড়িয়ে বলল, “বাইরে আয়।”
সাদমান বেরিয়ে এলে আফরিন বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিল।
“কেমন আছো সবাই?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল। আপনারা কেমন আছেন?” সমস্বরে জবাব এল।
“আলহামদুলিল্লাহ্ আমরাও ভাল আছি। আচ্ছা এই গাড়িটা কীসের তোমরা জান?”
সাঈদ বলল, “খাবার বিক্রির।”
“হ্যাঁ। কী খবর বিক্রি হবে?”
“বার্গার!”
“পিজ্জা!” একেকজন একেকটা বলতে থাকল।
আফরিন বলল, “এই জাতীয় সব ফাস্টফুড বানানো হবে। কারা বানাবে?”
নুরি সন্দেহী কণ্ঠে বলল, “আপনি?”
“নাহ।” আফরিন হাসল। “তোমরা বানাবে।” বাচ্চাগুলো এক মুহূর্তের জন্য অবাক হয়ে গেল।
“আমরা তো পারি না।” সাঈদ বলল।
“শিখবে। একজন শেফ থাকবেন। তোমাদের শেখাবেন। আর আরেকজন ড্রাইভার থাকবেন। যতদিন না তোমরা নিজেরা রান্না আর গাড়ি চালান শিখে যাও ততদিন তারা থাকবে। চলে গেলে আমরা অন্য কাউকে খুঁজে দেব। তারপর তোমরা নিজেরাই এটা চালাবে।” সাদমান বলল।
নুরি বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “এটা আমাদের?”
“হ্যাঁ।” হাসি মুখে মাথা নাড়ল আফরিন।
সাঈদ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে গাড়িটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। এই প্রথম তো গাড়িটা দেখছে না। গত তিন দিন ধরে এক প্রকার গাড়ির ভেতরেই তাদের বসবাস। কিন্তু এই স্পর্শ একান্তই নিজের হওয়ার পর।
সাঈদ এগিয়ে গেল আফরিনের কাছে। বলল, “কঠিন একটা কাজ দিলেন আপা। এসব কিছু সামলাবে কে? ঝগড়া হবে না?”
“ভাই বোনের মাঝে ঝগড়া হতে পারে সাঈদ। কিন্তু বড় ভাই দায়িত্ববান হলে সেটা বিশ্রী পর্যায় যায় না। তাই না?” সাঈদের ঘাড়ে হাত রাখল আফরিন।
সাঈদ কেঁদে ফেলল, “আমি যদি না পারি?”
“আমরা তো আছিই। যতদিন না মরি ততদিন আমাদের পাশে পাবে।” সাদমান বলল।
“শুরু কর সাঈদ। এটা তোমাদের। নিজেদের মতো করে সবকিছু শিখে নাও। বুঝে নাও।”
সাঈদ আফরিনের দু হাত কপালে ঠেকিয়ে রাখল। তার কান্নার শব্দে বাকিরা তাকাল। নুরি ছলছল চোখে আফরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার কোন খবর পছন্দ আপা?”
ঝলমল করে হেসে আফরিন বলল, “নুরির হাতের ঝালমুড়ি।”
নুরির চোখ থেকে পানি পড়ল। অথচ তার ঠোঁটে হাসি। ঘন কুয়াশা ভেদ করে সকালের রোদ যখন গাছের ঝাঁকড়া পাতার ফাঁক দিয়ে মাটি ছুঁয়ে যায় তখন যেই ওম গায়ে অনুভব হয় নুরির হাসিমাখা কান্না দেখে সাদমানের ঠিক তেমন লাগল। এক অসহ্য সুখে তার বুক ছলকে উঠল। এভাবেও সুখ কুড়ানো যায়? এভাবেও ভাল থাকা যায়?

________________

পরদিন বিস্ময়কর একটা খবর জানল অনিক। আফরিনের বাড়ির আশপাশে খোঁজ করছিল মেয়েটার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে জানার জন্য। একজন ঘটককেও ধরেছে সে। কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যেন আফরিনদের পরিবার এখুনি কিছু জানতে না পারে। সময় হলে তারাই জানাবে। সেই ঘটকই খবরটা দিল।

খবরটা একটু রহস্যময়। এই ঘটক ভদ্রলোক বলছেন আফরিন মোশাররফ হোসেনের নিজের মেয়ে না। অনিক জিজ্ঞেস করেছিল, “মায়ের আগের ঘরের?”
“না। ভাই বোনের বয়স একই।”
“তাহলে?”
“আশপাশের মানুষ জন বলে ভাই। এই মেয়ে নাকি ওদের নিজের না। কিন্তু ছোট থেকে এখানেই থাকে। আবার নানা বাড়ি, দাদা বাড়ি কোনো জায়গায়ই এই মেয়ে যায় না।”
অনিক চিন্তায় পড়ে গেল।
“হতেই পারে মানুষ না জেনে বা শত্রুতা করে এমন বলছে।”
“মোশাররফ হোসেন সাদা সিধা মানুষ। তাদের সাথে কারো শত্রুতা নাই। কেউ আন্দাজেও বলে নাই। আমি নিজেই এইটা জানি। ভাই যা রটে তা কিছু তো বটে!”
অনিক মাথা নাড়ল। এইসব প্রবাদ বাক্য সে পছন্দ করে না। না ঘটলেও মানুষ গল্প বানাতে পছন্দ করে।
কিন্তু মেয়ের জন্ম নিয়েই একটা ধোঁয়াশা তৈরি হল। অনিকের মনটা খচখচ করছিল। এই ধোঁয়াশা কাটানোর কোন উপায়ও নেই। না পেরে রুমিলা বেগমকে জানাল সে।
“দাদীমা একটা সমস্যা হয়েছে।”
জাফর ফোনটা ঠিক করে ধরল। ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে সে। নিজেকে লুকিয়ে থাকা প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে পিয়ন বলে মনে হচ্ছে। ঠিক তেমন করেই ভয় পাচ্ছে জাফর। রাফি জানলে নিশ্চিত তার চাকরি নট করে দেবে।
“কী সমস্যা?”
অনিক বিষয়টা বলল। কপালে ভাঁজ ফেলে রুমিলা বললেন, “ভাই বোন যমজ আবার মেয়ে ওদের না? এইটা আবার কেমন কথা?”
“জি দাদীমা। পাড়ার সবাইই এই কথা বলছে। মেয়ের নামে কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। স্বভাব চরিত্রও ভাল। কিন্তু এই জায়গায়ই গিট্টু লেগে গেছে।”
“গিট্টু তো জায়গা মতো লাগছে দাদা। জন্ম নিয়ে কথা উঠলে তো সমস্যা। তুমি কি আরেকটু খোঁজ খবর করতে পার?”
“করেছি দাদীমা। মানুষের মনের খবর তো আর জানা যায় না। বাকি এসবই জেনেছি।”
রুমিলা নিশ্বাস ছাড়লেন, “তাহলে বাদ দেও। এমন ঝাপসা কথা নিয়ে আগান যায় না। অন্য কিছু হইলেও হইত। জন্ম নিয়ে রাখঢাক মানে সমস্যা আছে।”
অনিক নিজেও কিছু বলল না। বিষয়টা তার কাছে অস্পষ্ট লাগছে। সাফাই গাওয়া বা বদনাম করা কমতার জন্যই যথেষ্ট প্রমাণ নেই। ফলে তাকে হাল ছাড়তে হল।

________________

মাসুদ বেনাপোল হয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। সেসময় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাসুদের বাবা আগেই পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিল। মাসুদ নিজেও রেহাই পেল না।
রাফি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন লইয়ারের দ্বারস্থ হল। প্রমাণ সব ঠিকঠাক থাকলেও উকিল সাহেব আফরিন এবং সাদমানের সাথে দেখা করতে চাইলেন। রাফি ইতস্তত করছিল। নিজের প্রয়োজনে আরেকজনকে পুলিশী ঝামেলায় ফেলাটা বিব্রতকর।
“ওদের ছাড়াই কেস আগানো যায় না?”
“যায়। কিন্তু ওরা প্রত্যক্ষদর্শী। কেস শক্তিশালী করতে ওদের লাগবেই। আপনি ওদের ডাকুন। কোন সমস্যা হবে না। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।”
রাফি পড়ল ঝামেলায়। আফরিন বা সাদমান কাউকেই তো সে চেনে না। নাম্বারও নেই। কীভাবে খুঁজবে ওদের?

~চলমান~

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
🌸উপহার পর্ব🌸

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই হাসপাতালের কথা মনে পড়ল। সেদিন দাদীমাকে নিয়ে যাওয়ার পর না রিসিপশনে সেই মেয়েটার সাথে দেখা হলো? লাফিয়ে উঠল রাফি। মনে হলো একটা ম্যাচ হারতে হারতে জিতে গেছে সে। তখন লাঞ্চ আওয়ার চলছিল। বিকেলে কোনো মিটিং নেই। নিজের কাজগুল গুছিয়ে নিয়ে রাফি বেরিয়ে গেল। বাড়িতে যেয়ে এগুলো শেষ করা যাবে।

রাফি যখন হাসপাতালে পৌঁছাল তখন কেবল একটা পঁচিশ বাজে। রিসিপশনে সেই মেয়েটা নেই। একজন লোক বসে আছে। সেদিকেই এগিয়ে গেল রাফি।

“এক্সকিউজ মি?”
“জি বলুন।” লোকটা তাকালো।
“এখানে আরেকজন রিসিপশনিস্ট আছেন না? এক ভদ্রমহিলা?”
“জি।”
“উনি কখন আসবেন?”
“উনার ডিউটি তিনটা থেকে।”
“ওহ।” একটু হতাশ হলো রাফি। দেড় ঘণ্টা বসে থাকতে হবে? মেয়েটার ফোন নাম্বার পেলে হতো।
“আচ্ছা উনার ফোন নাম্বারটা কি দেয়া যাবে?”
এই পর্যায়ে ভদ্রলোক চোখ ছোট করে তাকালেন। কাষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, “দুঃখিত। এভাবে কারো পার্সোনাল ইনফর্মেশন আমরা দিই না।”
রাফি মাথা নাড়ল, “ইটস ওকে।” আসলেই জিনিসটা বাজে দেখায়। এভাবে একটা মেয়ের নাম্বার চাওয়াটাও অশোভনীয়। অগত্যা হাসপাতালেই বসে রইল রাফি। তিনটা বাজার অপেক্ষায়।

তিনটা বাজার ঠিক তিন মিনিট আগে হুড়মুড় করে মেয়েটা ঢুকল। রিসিপশনের লোকটার সাথে কথা বলে অন্যদিকে চলে গেল। দুই মিনিটের মাথায় আবার ফিরে এল। সম্ভবত স্কার্ফ ঠিক করতে গিয়েছিল। এক হাত তখনও মাথার কাছে স্কার্ফে।
লোকটা চলে গেলে রাফি নিশ্বাস ছাড়ল। তার দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিল। এজন্য কতক্ষন বাইরে থেকে ঘুরে এসেছে। এই ভরদুপুরে ভবঘুরে হয়ে কতক্ষণই বা ঘোরা যায়। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ফিরে এসে আবার সেই সন্দেহী দৃষ্টির সামনে পড়েছে রাফি। ভাগ্যিস তার বেশভূষা ভাল ছিল। নয়তো সমূহ সম্ভাবনা ছিল ঐ লোক তাকে বের করে দেবে।

“কেমন আছেন?” ডেস্কের সামনে যেয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল রাফি।
আফরিন তাকিয়ে অবাক হল। এই লোক এখানে! তাকে কী চিনতে পেরেছে?
“জি আলহামদুলিল্লাহ্।” আফরিনের কণ্ঠের প্রশ্ন টের পেল রাফি।
“আপনার সাথে একটু কথা বলা দরকার ছিল। জাস্ট টু মিনিটস।”
আফরিন বিপাকে পড়ল। এই লোক তার সাথে কী বলবে? তার চেয়েও বড় কথা সে মাত্রই এসেছে। এক্ষুনি ডেস্ক ছেড়ে যাওয়াটা অসুন্দর।
ইতস্তত করল আফরিন। দ্বিধার ভাবটা লুকিয়ে বলল, “এখানেই বলুন।”
“আচ্ছা।” দম ছাড়ল রাফি। ক্লান্ত লাগছে। “আপনার নামটা?”
“আফরিন।”
“আমি সাইয়েদ রাফি। সাইয়েদ নাবিলা, আমার ছোট বোন।” আফরিন অপেক্ষা করল রাফির পরবর্তী কথা শোনার জন্য।
“সেদিন আপনারা আমার বোনকে সাহায্য করেছিলেন। মাসুদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওর বিরুদ্ধে কেস ফাইল করা হয়েছে।”
জিভে ঠোঁট ভিজিয়ে রাফি বলল, “যেহেতু আপনারা দুইজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাই আপনাদের স্টেটমেন্টের গুরুত্ব অনেক। আমার লইয়ার বলছিলেন আপনারা যদি একটু উনার সাথে দেখা করতেন..”
আফরিনের কপালে ভাঁজ সমান হয়ে এল। মুহূর্তেই বিষয়টা বুঝতে পারল সে। এজন্যই সাদমান দ্রুত ওখান থেকে চলে আসতে চেয়েছিল। এসব কোর্ট কাচারি তার নিজেরও ভাল লাগে না। উশখুশ করল আফরিন। রাফি বুঝতে পারল না।
উত্তর না পেয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল রাফি। আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, “আপনাদের কোন প্রব্লেম হবে না। জাস্ট একবার লইয়ারের সাথে দেখা করবেন। ব্যস!”
সেই ক্ষণে একজন মহিলা ডেস্কের সামনে এলে রাফি সরে দাঁড়াল। আফরিন মুহূর্তেই পেশায় ফিরে গেল। মহিলাকে তার সিরিয়াল নাম্বার দিয়ে নির্দিষ্ট ডাক্তারের চেম্বার দেখিয়ে দিল আফরিন। রাফি আবার ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালে বলল, “আমি এখুনি আপনাকে কিছু বলতে পারছি না। আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানাবো।”
“শিওর! আমার কার্ডটা রাখুন। কাইন্ডলি আপনার নাম্বারটা যদি দিতেন।”
ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবল আফরিন। অতঃপর বলল, “আমার ভাইয়ের নাম্বারটাই নিন। সেদিন ওই ছিল ওখানে।”
“ওহ আচ্ছা।” আফরিন নাম্বার বলল।
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে একটা তথ্য পেল রাফি। এই মেয়ে দ্বিধায় আছে। ছেলেটার সাথে কি কথা বলবে? থাক আগে আফরিন জানাক। কাল পরশুর ভেতরে কল না করলে তখন না হয় যোগাযোগ করবে রাফি।

________________

আফরিন বাড়িতে ফিরে সাদমানকে সবটা জানাল। সাদমান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এজন্যই এসব ঝামেলায় যেতে চাই না।”
“আহ! এক কথা বারবার বলবি না তো! আমি হলে কি করতি তুই?”
“খোঁজ রাখতাম কাদের সাথে তুই মেলামেশা করিস। আগে তোকে সাইজ করতাম তারপর ওগুলোকে। ঘটনা এই পর্যন্ত যেতেই দিতাম না।”
আফরিন নিশ্বাস ছাড়লো। এই ছেলে একটা কথাও মাটিতে পড়তে দেয় না।
“ঘটনা ঘটে গেছে সাদ! এখন কী করবি বল।”
“সাইয়েদ গ্রুপ সম্পর্কে তুই জানিস না?” সাদ বিছানায় শুয়ে পড়ল।
“গার্মেন্টস আছে। ক্লোথিং সেক্টরে অনেক বড় কোম্পানি। আর কি?”
“শুধু বড় কোম্পানি না। লিডিং কোম্পানিগুলোর একটা। তোর কি মনে হয় তুই না বললেই ওরা মেনে নেবে? ঘাড় ধরে নিয়ে যাবে। লোকটা তোর কাছে এসে রিকোয়েস্ট করেছে শুনে অবাক লাগছে।” শেষটুকু ভাবুক কণ্ঠে বলল সাদমান।
“লোকটাকে দেখে অহংকারী টাইপ মনে হয়নি।”
আড়চোখে একবার আফরিনকে দেখল সাদমান।
“কার্ডটা দে।”
“তুই যাবি?”
“কাদায় যখন নেমেছি ছিটেফোঁটা তো গায়ে লাগবেই।”
আফরিন মুখ বাঁকালো। এই ছেলেটা ভাল কথা ভালভাবে বলতে পারে না।

নাম্বার টুকে কল দিল সাদমান। রিং বেজে বেজে কেটে গেল। মিনিট খানেকের মাথায় সাদমানের ফোন বেজে উঠল।
সাদমান ফোন রিসিভ করল, “আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। সাদমান বলছেন?”
সাদমান অবাক হল। এই লোক তার নাম্বার সেভ করে রেখেছ নাকি!
“জি।”
“ধন্যবাদ ভাই। আমি আপনার ফোনে অপেক্ষায় ছিলাম।”
সাদমান অবাক হল। এতটা বিনয় সে আশা করেনি।
“আমাদের কি করতে হবে?”
“আমার লইয়ারের সাথে একবার দেখা করলেই হবে। আপনারা কবে ফ্রি থাকবেন?”
সাদমান এক পলক আফরিনের উৎসাহী মুখের দিকে তাকাল। ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে বলল, “শনিবারে যাওয়া যাবে?”
“আমি কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি। থ্যাংকস ভাই। অনেক বড় হেল্প করলেন।”
সাদমান ফোন কেটে দিল। পকেটে অর্থকড়ি জমলে মানুষ সাধারণত ধন্যবাদ দিতে এবং কৃতজ্ঞ হতে ভুলে যায়। সবকিছুকে নিজের জন্য উপযোগী মনে করে। অপর দিকের মানুষটাও যে কিছুর প্রাপ্য হতে পারে এটা ভুলেও মনে করে না।
সেই নিক্তিতে রাফিকে মাপা গেল না। নিতান্ত সাধারণ মানুষের মতো সে নিজের বোনের জন্য খেটে যাচ্ছে। তাদের হু-মকি দিয়ে যেই কাজটা করাতে পারতো সেটাই অনুরোধ করে বলছে। সাদমানের মনে অজান্তেই রাফির জন্য শ্রদ্ধা তৈরি হয়ে গেল।

পরবর্তীতে কঠিন যেই কাজটা ছিল সেটা হল মোশাররফ হোসেন এবং আফসানাকে জানানো। কঠিন কাজটা সাদমানই করল। আফরিন ভাইয়ের পিঠের পেছন লুকিয়ে রইল।

আফসানা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। মোশাররফ হোসেনের চোখে বিস্ময়।
“একবার আমাদের বলার প্রয়োজন মনে করলে না!” কম্পনরত কণ্ঠে বললেন আফসানা। আফরিন মাথা নিচু করল।
“বাঘের বাচ্চার মতো কাজ করেছিস ব্যাটা! দেখি সামনে আয় রিনি।” দরাজ কণ্ঠে বললেন মোশাররফ। আফরিন ধীর পায়ে সামনে এল।
“একদম ঠিক করেছিস মা। কিন্তু আমাদের একটু বলবি না? আমরা কি কখনও তদের ভাল কাজে বাঁধা দিয়েছি?” নরম কণ্ঠে বললেন মোশাররফ।
“তোমরা টেনশন করবে এজন্য বলিনি।” আফরিন বলল।
“উদ্ধার করেছ। কত বড় পেট হয়েছে দুজনের? সব চেপে যাচ্ছ! মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা না আমিই ওদের পেট থেকে বের হয়েছি।” বলতে বলতে ঘরে চলে গেলেন আফসানা।
মোশাররফ নিচু কণ্ঠে বললেন, “চিন্তা নেই একটু পর একাই শান্ত হয়ে যাবে। মা তো তাই টেনশন করছে। আর কখনও এমন কিছু লুকাস না। আমাদের বললে আমরাও পাশে থাকব ইনশাআল্লাহ্।”

________________

শনিবারে সকাল দশটার দিকে বের হল আফরিন আর সাদমান। রাফি নিজেও উকিলের চেম্বারে পৌঁছে গিয়েছিল। সাথে ছিল অনিক।

চেম্বারে পৌঁছালে রাফি তাদের ভেতরে নিয়ে গেল। অনিক আনমনে একবার আফরিনকে দেখে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। আফরিন আজকে মাস্ক পরেনি। মুখ খোলা। সাই করে আবার তাকালো অনিক। আরে! এই মেয়ে এখানে কেন!

সাদমান আর আফরিনকে ভেতরে রেখে রাফি বেরিয়ে এলে অনিক তাকে চেপে ধরল।
“এই ঐ মেয়েটা কে?”
“তোকে তো এতক্ষণ ওদের কথাই বললাম।” বিরক্ত কণ্ঠে বলল রাফি।
“আফরিন!” বিস্মিত কণ্ঠে বলল অনিক।
“তুই চিনিস নাকি?”
অনিক যেন হুশ ফিরে পেল, “ঐ আর কি! ছেলেটা কে?”
“ওর ভাই। কি আশ্চর্য অনিক! আমি আধা ঘণ্টা ধরে কার সাথে বকবক করলাম?”
“আরে মিস করে গেছি ভাই।” রাফিকে পাশ কাটাল অনিক। তবে ভেতরে ভেতরে সে চমকে গেছে। উত্তেজিত বোধ করছে। এই মেয়ে নাবিলাকে বাঁচিয়েছে? সেলুকাস!

~চলমান~