অন্তঃপুর পর্ব-১৫

0
10

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
১৫.

পাত্র রাফি শুনে আফরিনের মনে যেমন খুব উচ্ছ্বাস তৈরি হয়নি তেমন খারাপও লাগেনি। বিয়ে একদিন করবে এটা সে জানত। তবে নিয়ে নিয়ে তার তেমন জল্পনা কল্পনা ছিল না। কারণ তার ভেতরে সূক্ষ্ম একটা ভয় কাজ করে। তার মনে হয় বিয়ে করে একবার এই বাড়ি থেকে চলে গেলে আর কখনোই সে এখানে আসতে পারবে না। আফসানা, মোশাররফ হোসেনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। যেই ভালবাসা সে এখন পাচ্ছে সেটা আর পাবে না। আফরিনকে ওরা সবাই ভুলে যাবে। যদিও এসব ভাবার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই তবুও আফরিন ভাবে। ভেবে ভেবে ভয় পায়। শুধু মনে হয় সে তো ঠিক সাদমানের মতো এই পরিবারের একজন না। নিশ্চয়ই সবাই তাকে ভুলে যাবে।
এটুকু মনে হলেই শ্বশুরালয় নিয়ে কোনো সুখ স্বপ্ন তার সাজাতে ইচ্ছে করে না। কেমন অনুভূতিহীন মনে হয় নিজেকে। ইচ্ছে করে চিৎকার করে কাঁদে। কেঁদেকেটে এই ভয়গুলো দুর করে।

বহুদিনের ইচ্ছে পূরণ করতে ব্যাংকে এসেছে আফরিন। সাদমানকেও সাথে এনেছে। কাজ শেষ করে বাড়িতে ফিরতে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগল। তখন দুপুর হয়েছে। ভার্সিটি বন্ধ থাকায় আজকের দিনটা বেছে নেয়া। একটু পরেই তো আবার হাসপাতালে ছুটতে হবে।

কথাগুলো কীভাবে বলবে বুঝতে পারছিল না আফরিন। ভাত খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল।
আফসানা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? খাচ্ছ না কেন?”
“কিছু না।” আফরিন মাথা নাড়ে। পরক্ষনেই আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
খাওয়া শেষে সাদমান তাকে ডাকতে আসে।
“এখন দিবি না?”
“হ্যাঁ।” আফরিন একেবারে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য গুছিয়ে নিল। ভেতরে ভেতরে সে কিছুটা ভয় পাচ্ছে। আফসানা, মোশাররফ কি খুশি হবেন?

“মা আসবো?” সাদমান দরজার বাইরে থেকে বলল।
“এসো।”
মোশাররফ হোসেন শুয়ে পড়েছেন। আফসানা হাঁটাহাঁটি করছিলেন। খেয়েই শুয়ে পড়লে তার মনে হয় খাবার গলায় উঠে আসছে। তাই একটু হাঁটাহাঁটি করেন।

আফরিন বিছানায় বসল। হাতের খাম আফরিনের পাশে রেখে সাদমান বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “রিনি তোমাদের জন্য এনেছে।”
মোশাররফ হোসেন উঠে বসলেন। উৎসুক হয়ে তাকালেন মেয়ের দিকে।
“কী এনেছিস?”
আফসানার দিকে এক পলক তাকিয়ে খামটা বাবার দিকে এগিয়ে দিল আফরিন। তার বুক ধুকপুক করছে। বাবা মা সম্পর্কিত কোনো কথা উঠলেই তার শক্ত মনটা দুর্বল হয়ে পড়ে।
মোশাররফ হোসেন কপাল কুচকে খামের মুখ খুললেন। পেট মোটা খাম থেকে বেরিয়ে এল চার বান্ডিল টাকা। সবগুলো এক হাজার টাকার নোট। চোখ বড় করে মোশাররফ হোসেন বললেন, “এত টাকা কার!”
“তোমাদের।” ফিসফিস করে বলল আফরিন।
আফসানা হাঁটা থামিয়ে বিছানার কাছে এলেন।
“কি বললে?”
আফরিনের গলা শুকিয়ে এল। তার মনে হলো আফসানা বিষয়টা পছন্দ করেননি। নিভু নিভু চোখে একবার মায়ের দিকে তাকাতেই ভাবনাটা গাঢ় হলো। আফসানা কপাল কুচকে তাকিয়ে আছেন। আফরিন আর কিছু বলতে পারল না।
“তোমাদের মেয়ে তোমাদের জন্য টাকা জমিয়েছে।” বলল সাদমান। আলমারিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সে।
“কেন!” মোশাররফ হোসেন বিস্মিত হলেন।
আফসানা জিজ্ঞেস করলেন, “কীভাবে?”
বোনের ভীতু চেহারার দিকে এক পলক তাকাল সাদমান।
“এসএসসির পর থেকে করা টিউশনির সব টাকাই উনি সঞ্চয় করেছেন। শপিং মলের জব, এখন হাসপাতালের সব জায়গার স্যালারি রেখে দিয়েছে। দীর্ঘ সাত বছরের সঞ্চয়।”
“কত টাকা আছে এখানে?” মোশাররফ হোসেনের বিস্ময় কমছে না।
“ছয় লাখ না?” আফরিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল সাদমান।
“সাড়ে ছয় লাখ।” মিনমিন করে বলল আফরিন।
“এত টাকা!”
বাবার চোখ কপালে উঠতে দেখে সাদমান হাসল, “টিউশনির টাকা, হাত খরচের টাকা, স্কলারশিপের টাকা সবকিছু থেকে বাঁচিয়েছে তোমাদের কৃপণ মেয়ে।”
“কেন জমিয়েছ?” আফসানা জিজ্ঞেস করলেন।
আফরিন ঢোক গিলল। মা আসলেই খুশি হয়নি।
“ওর ইচ্ছে ছিল তোমাদের হজে পাঠাবে। যা খরচ হয় ও দেবে। সেটা সম্ভব হয়নি। তাই টার্গেট এক ধাপ নিচে এসে উমরায় ঠেকেছে।”
আফসানা অবাক চোখে আফরিনের দিকে তাকালেন।
আফরিন মাথা নিচু করেই বলল, “আমি তো তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমার জন্য তোমাদের বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। আত্মীয় স্বজন তোমাদের বাড়িতে আসে না..”
“তাই কম্পেনসেশন করছ?”
আফরিন সবেগে মাথা নাড়ল, “না না!” মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার বদৌলতে তোমরা যেন একটু হলেও খুশি হও। তাই..”
বহুক্ষণ ঘরের কেউ কোনো কথা বলল না। সাদমান দেয়াল ঘড়ি দেখল।
“তোর হাসপাতালে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে।”
আফরিন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে উঠে পড়ল। বাবা মায়ের দিকে তাকানোর সাহস করল না। তার মনে হচ্ছে টাকাটা দিয়ে তাদের ছোট করে ফেলেছে। কিন্তু তার কতদিনের ইচ্ছে ছিল বাবা মা তার ইনকামে উমরা করবে!
ধীর পদক্ষেপে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল আফরিন। বাইকে ওঠার সময় সাদমানকে বলল, “বাবা মা খুশি হয়নি।”
সাদমান হাসল। তার ভুল ভাঙাল না।

________________________

ছেলেপক্ষ থেকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। মনে মনে ছেলেটাকে অপছন্দ না করায় তারা নেতিবাচক কিছু বলতে পারছিলেন না। তাদের নীরবতায় পাত্র পক্ষ বিশেষ করে রুমিলা অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন। আবার খবর পাঠাচ্ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পাত্রী পক্ষের চাহিদা বেড়ে গেল। আফসানা মোশাররফ আলোচনা করে একটা তারিখ ফেললেন। মেয়ে দেখে গেলে তো ক্ষতি নেই। তারা যখন এত আগ্রহ করছে। আবার তাদেরও বিশেষ কোনো বাঁধা নেই। ফলে এক শুক্রবারে রাফিদের দাওয়াত দেয়া হলো।

আফরিনের পরিবারকে অবাক করে দিয়ে রুমিলাও এলেন। আসলে নিজের পেটের ছেলে হলে কি হবে মাহমুদের উপরে তার একটুও ভরসা নেই। সমাজ সামাজিকতা বোঝে না। ছেলের বিয়ের জন্য কি বলতে হবে এটা জানে নাকি রুমিলার সন্দেহ আছে। তাই তিনি নিজেও এসেছেন। মেয়েটাকে আরেকটু ভাল করে দেখে যাবেন।

সাদমান এদিক ওদিক তাকিয়েও রাফিকে পেল না। কি আজব কারবার! যার বিয়ে সে ছাড়া সবাই এসেছে।
সাদমানকে এভাবে খুঁজতে দেখে অনিক বলল, “রাফি এখনও আসেনি। একটু কাজে গেছে তো। ওখান থেকে একেবারে চলে আসবে।” কাষ্ঠ হাসল অনিক। সাদমান তীক্ষ্ম চোখে তাকাল। এটা আবার কে?

আসিফা সৌজন্যতা করে অনেক কথাই বললেন। তবে রুমিলার সেসব খুব একটা পছন্দ না হওয়ায় তিনি নিজেই কথা বলতে শুরু করলেন। তার কথার বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে থাকল রাফির চারিত্রিক আর আর্থিক বৈশিষ্ট্যের খবর।
অনিক বিপন্ন বোধ করছিল। দাদীমার এসব আলাপকে ওরা টাকা পয়সার বড়াই না ভাবলেই হয়েছে। সে ইশারা করেও রুমিলার দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারল না। আবার সাদমান, মোশাররফ, আফসানার মুখ দেখেও ভেতরের অবস্থা খুব একটা বুঝতে পারল না।

মেয়ে দেখার কথা উঠলে আফসানা বললেন, “আপনারা আমার সাথে আসুন।” রুমিলা এবং আসিফাকে ইশারা করলেন। তারা উঠে এল। রুমিলার কপালে ভাঁজ পড়ল। মেয়েটাকে দেখে তো মনে হয়নি খুব পর্দা পুষিদা করে। যাক তারা দেখতে পেলেই হয়েছে। অনিক, মাহমুদ কেউ দেখেই কাজ নেই। হতচ্ছাড়া রাফি কেন এখনও আসছে না?
কথাটা মনে পড়তেই অনিকের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালেন। অনিক মুহূর্তেই বুঝে ফেলল। ফোন দিল বন্ধুকে। তার আশঙ্কাকে সত্যি করে দিয়ে রাফির ফোন বন্ধ দেখাল। অনিক চোরা চোখে সবার দিকে তাকাতে যেয়ে সাদমানের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।
সাদমান শুরু থেকেই এই লোকটাকে দেখে যাচ্ছে। উকিলের চেম্বারে যেদিন গিয়েছিল সেদিন দেখেছিল। রাফির বন্ধু। এতদিন বিদেশ চিল্ম সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছে। এসব কিছুই জেনেছে সাদমান। কিন্তু বিরক্ত হল রাফি না আসায়। ঐ লোকটার মতিগতিই তো আসল।

⁠。。。。。。。。。。

কলাপাতা রঙের একটা থ্রি পিস পড়েছে আফরিন। ছুটির ওড়না টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে। ওড়নার হালকা রংটা তার মুখেও একটা রং ছড়িয়ে দিচ্ছে। বেশ সতেজ একটা ভাব আফরিনের চোখে মুখে খেলে বেড়াচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে আসিফার মোটেও নার্ভাস বলে মনে হলো না।
আসিফা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, “কেমন আছো দাদু?”
আফরিন সালাম দিল, “ভাল আছি।” মিষ্টি করে হাসল সে। এ যাবৎকালে পাবলিক সার্ভিস দেয়ার সকল অভিজ্ঞতা এক করে এই দুজনের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করল।
আসিফা শুরুতেই আফরিনের মাথায় হাত রাখলেন। কথাবার্তা খুব একটা বলেন না তিনি। বলা ভাল বলার মানুষ পান না। ফলে। নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও দ্বিধাবোধ করলেন। কেবল বললেন, “অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
আফরিন চমৎকার করে হাসল। আসিফার আচরণের কারণে বুঝতে কষ্ট হল না।
সেই হাসি দেখেই আসিফা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন এই মেয়েকে বাড়ির বউ বানাতে শাশুড়িকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবেন তিনি।
রুমিলা অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন। মেয়েটার ঘর দেখলেন। বেশ গোছানো আছে। চুল আঁচড়ানোর ধরন দেখলেন, পায়ের গোড়ালি দেখলেন। আফরিনের চোখের আড়ালে ছেলের বউকে বললেন, “এই মেয়েই রাফির জন্য ঠিক আছে। আর দেরি করা যাবে না।”
আফরিন কিন্তু ঠিকই সেই ফিসফিসানি শুনে ফেলল। তবু বারান্দা থেকে ঘরে আসার সময় এমন ভাব করল যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি।

বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হলো সন্ধ্যা হয়ে গেলে। রাফির আরো আগে আসার কথা। সেভাবেই তাকে আদেশ দিয়েছিলেন রুমিলা। কিন্তু সেই আদেশের চূড়ান্ত অমান্য করে রাফি ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। মেজাজ উত্তপ্ত হলেও নিজেকে ঠান্ডা রাখলেন রুমিলা। মেয়ে পক্ষের সামনে কোনোভাবেই বেফাঁস মন্তব্য করা যাবে না।
অনিক নিজেই বুদ্ধি করে বলল, “রাফির জরুরী মিটিং থাকায় আজকে আসতে পারছে না। খুবই দুঃখিত। আপনারা অনুমতি দিলে একদিন যদি বাইরে আফরিন আর রাফির একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা যেত তাহলে খুব ভাল হতো।”
“বাড়িতে কেন নয়?” সাদমানের কণ্ঠের তীক্ষ্ণতা অনিককে এক মুহূর্তের জন্য এলোমেল করে দিচ্ছিল।
“বাড়ির ফর্মালিটি করার সময় ম্যানেজ করা রাফির জন্য বেশ টাফ।”
“কিন্তু আমরাও তো ছেলেকে দেখব। তাই না?”
অনিক খানিকক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, “তাহলে আঙ্কেল দুই ফ্যমিলিই একদিন একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করি। রাফির অফিসের পাশেই কোথাও।”
আফসানার খুব একটা পছন্দ হল না। কিন্ত পরিবারটা একেবারেই খারাপ না। যদিও দাদীর প্রভাব খুব বেশি সেই তুলনায় রাফির বাবা মা এক একেবারেই নট নড়ন চড়ন অবস্থায় আছে তবু খারাপের কাতারে ফেলতে পারলেন না তাদের। এই পর্যন্ত তাদের কোনো কথাই খারাপ লাগেনি। কিন্তু ছেলের না আসা এমনকি একবারের জন্য যোগাযোগ না করাটাই অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে।
আসিফা হয়তো মেয়ের বাবা মায়ের অবস্থা বুঝলেন। নম্র কণ্ঠে বললেন, “আপনাদের আর কি বলব? আমার ছেলে হলেও ওকে কাছে পাই খুব কম। ওর বাবা বিজনেস থেকে সরে আসার পর তো ওই সবটা সামলাচ্ছে। এজন্য খুব ব্যস্ত থাকে। মাঝে মাঝে এতক্ষণ ফোন বন্ধ রাখে যে আমরাই বিরক্ত হয়ে যাই। সেখানে আপনারা তো..”
“না না। তেমন কিছু না।” বিব্রত হেসে বললেন আফসানা।
ছেলের বউয়ের উপর তুষ্ট হলেন রুমিলা। এতক্ষণে একটা কাজের কথা বলেছে।
তাদের নিমরাজিকেই রাজি বানিয়ে অনিক প্রস্থান নিল। দু দিন পর রেস্টুরেন্ট এবং সময় ঠিক করে রুমিলা এবং আসিফাকে কড়া নির্দেশ দিল যেন রাফি ঘুণাক্ষরেও এসব না জানে।
পুরোটা সময় মাহমুদ অনাহুতের মতো বসে রইলেন। বুঝলেনও না মেয়ের বাবা এবং ভাই কতবার তার দিকে আড় চোখে তাকিয়েছে।

。。。。。。。。。。

ফোন বন্ধ করে পুরোটা সময়ে মিহাদের কাছে বসে রইলো রাফি। তার অসহ্য লাগছে। দাদীমার এই চাপাচাপি সে নিতে পারছে না। তাই সৈন্য রণে ভঙ্গ দিয়ে রণক্ষেত্র পলায়নের পথ বেছে নিয়েছে। তাতে সেনাপতির মান সম্মানের কি হতে পারে সেসব বোঝার সময় কই তার?
মিহাদ প্রতিদিনই কোনো না কোনো আবদার করে। তার বেশিরভাগ আবদারই কিউব কেন্দ্রিক। নতুন নতুন কিউব মেলানো শিখে সে আনন্দ পায়। তবে আজ কেন যেন রাফিকে একটুও বিরক্ত করল না সে। রাফি এসে থেকেই হাঁটুতে হাত ঠেকিয়ে আজলায় মুখ লুকিয়ে বসে আছে। মিহাদ কি মনে করে এগিয়ে গেল। তার অপরিপক্ক হাত এগিয়ে দিল রাফির দিকে।
মাথায় ভাইয়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠল রাফি। সে আরেক রাফির জন্ম দিতে চায় না। কস্মিনকালেও না।

________________________

অনিক শান্ত ভঙ্গিতে রাফিকে ফোন করল। রাফি ফোনের স্ক্রিন না দেখেই কল রিসিভ করে কানে ঠেকালো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “হ্যালো?”
“অনেক বিজি নাকি?”
রাফি হাতের ফাইল রেখে কান থেকে ফোন নামাল। স্ক্রিনে অনিকের নাম ভাসছে।
“আলতু ফালতু কথা বলার থাকলে ফোন রাখ।”
“কাজের কথা বলতেই ফোন দিয়েছি।” গম্ভীর কণ্ঠে বলল অনিক। “একটু দেখা করতে পারবি? ইমারজেন্সি।”
অনিকের কণ্ঠে গম্ভীর ভাব আর সূর্যগ্রহণ একই বিষয়। খুব কমই দেখা দেয়। ফলে রাফিকেও সিরিয়াস হতে হলো।
“সিরিয়াস কিছু?”
“হু।” অনিক কথা বাড়াল না।
“আচ্ছা আয়। কোথায় আসবি?”
“ব্লু বেরিতে আসি? আধ ঘন্টা পর?”
হাতঘড়ি দেখে রাফি বলল, “এখন আধ ঘন্টার বেশি সময়। দিতে পারব না। রাতে আসবি?”
“আধ ঘন্টাই এনাফ। আমি আসছি।”
ফোন রেখে রাফি চিন্তায় পড়ল। কি এমন সমস্যায় পড়ে অনিক এমন চিন্তিত কণ্ঠে কথা বলছে?
অপর প্রান্তে অনিক রহস্য হাসল। বয়কে ডেকে বলল, “আমার গেস্ট আসবে। সব ভালভাবে সাজাও কিন্তু।”
পুরো একটা কেবিন বুক করে নিয়েছে অনিক। কিছুক্ষণের মাঝেই আফরিন পরিবার চলে আসবে।

。。。。。。。。。。

আফরিনরা এসে পৌঁছানোর পাঁচ মিনিটের মাথায় রাফি ফোন দিল। তার ব্যস্ত কণ্ঠ পাওয়া যাচ্ছে।
“কোথায় তুই?”
“এসেছি। তুই দাঁড়া আমি আসছি।” নিচে চলে গেল অনিক। রাফি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
“অনেকক্ষণ আগে এসেছিস নাকি?” রাফি জিজ্ঞেস করল।
অনিক প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল, “খুব গরম মনে হচ্ছে?”
“খুব!”
“চল একটা ঠান্ডা নিই।”
“কিন্তু উপরে যাচ্ছি কেন? ওখানে তো কেবিন।”
অনিক কথার ছলে রাফিকে নিচের টেবিল চেয়ার থেকে সরিয়ে উপরে কেবিনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অনিক এই প্রশ্নের উত্তরটাও সযত্নে এড়িয়ে গেল।
“আচ্ছা কাদেরে ইনভেস্ট করা উচিত হবে কি না বল তো?” গুরুতর ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল অনিক।
“তুই আবার টেক্সটাইলে ঝুঁকছিস কেন? তোর আইটি ফার্মের কি অবস্থা?”
অনিক কেবিনের দরজা খুলে রাফির হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এল, “ভাল।”
“তাহলে আবার এদিকে তাকাচ্ছিস কেন? ওটাই ভাল করে কর।” কোমরে হাত রেখে বলল রাফি। এসির শীতলতা শরীরের অবসন্নতা বুঝিয়ে দিচ্ছে। শার্টের কলারের নিচের একটা বোতাম খুলে নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে পেছন ঘুরল সে। সরাসরি সামনের টেবিলটার দিকে তাকাতেই তার নিশ্বাস মাঝ পথেই থেমে গেল। ঐ চোখ জোড়া তার চেনা।

এক মুহূর্তেই লোকটাকে আগা গোড়া পরোখ করে ফেলল আফরিন। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। হালকা ঢেউ খেলানো তবে কোকড়া নয়। অযত্নে সেগুলো বেড়ে উঠেছে। চোখে ক্লান্তি। গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সাদা শার্টের কলারের পেছনে একদিনের না ধোয়া গানের চিহ্ন। ফুল হাতা শার্ট কনুইয়ের কাছে গুটিয়ে রাখা। কব্জির কাছে নেভি ব্লু ফিতার ঘড়িটা ফুটে উঠেছে। সম্ভবত কোর্ট পরে এসেছিল। প্যান্ট দেখে তাই মনে হচ্ছে। সব শেষে আবার চোখেই চোখ রাখল আফরিন। একটু আগের ক্লান্তি মুহূর্তেই বিস্ময়ে রূপ নিয়েছে। বিস্মিত হবার কি আছে এখানে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের দিকে তাকাল আফরিন। নতুন একটা বোরখা পরে এসেছে। মাথার স্কার্ফও ঠিকঠাক আছে। পেস্ট কালারের বোরখায় বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু তো নেই।

চট করে পেছনে তাকাল রাফি। অনিক দু পাটি দাঁত বের করে হাসছে।
“হোয়াট রাবিশ!” চাপা কণ্ঠে ধমক দিল রাফি।
“আস্তে! চিৎকার করিস না। তোর শ্বশুরবাড়ির লোক আছে এখানে। ইমেজ বিল্ডিংয়ের আগেই ধ্বসিয়ে দিলে সারাজীবন দেয়ালে মাথা খুটতে হবে।” হাসি ধরে রেখে বিড়বিড় করে বলল অনিক। আজকে রুমিলা আসেনি বটে। তবে মুখপাত্র হিসেবে তাকে পাঠিয়েছে। অনিকের দায়িত্ব বড় কঠিন।
“এটাই তোর ইমারজেন্সি?” রাফির কন্ঠ ক্ষোভ ঝরে পড়ছে।
“হ্যাঁ।” অনিক রাফির দিকে তাকালই না। “চল। সিনক্রিয়েট করিস না।” রাফির হাত শক্ত করে ধরল অনিক। হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে নিজেই আগেই হেঁটে গেল রাফি। খাঁচায় বন্দী হয়ে গেছে। কাঁচের দেয়াল ভেঙে রাস্তায় লাফ দেয়া ছাড়া এখান থেকে যাওয়ার উপায় নেই।

পুরোটা সময় চুপচাপ মুখে তালা লাগিয়ে বসে রইলো রাফি। কথা যা বলার অনিক বলল। আসিফাও প্রস্তাব এগিয়ে নিয়ে গেলেন। মাহমুদও আজ বাদ গেলেন না। অবস্থা দেখে মনে হল তারা আজই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে যেতে চায়।

মোশাররফ হোসেন খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। নিজে নিজেই বললেন, “এক্ষুণি ওরা আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে! আমরা একটু পরামর্শ করব না?”
“কার সাথে করবে?” আফসানা আস্তে করে বললেন।
মোশাররফ কথা পেলেন না। সত্যিই তো। কার সাথে আলাপ করবেন?
“ওরা তারিখ দিক। আমার ছেলেটাকে বিশেষ অপছন্দ হয়নি। ভালোই তো।”
মোশাররফ এক পলক রাফির দিকে তাকালেন। বারবার অনিকের দিকে তাকাচ্ছে। মনে হয় তাদের দিকে তাকাতে অস্বস্তিবোধ করছে।
আফসানা ভাবলেন ছেলেটা ক্লান্ত তাই কথা বলছে না। সাদমানের কাছে সেদিনের ব্যবহারের কথা শুনেছেন। ওরকম ব্যবহারের মানুষ নিশ্চয়ই খারাপ হবে না।
শেষমেষ আসিফা বললেন, “আমার শ্বাশুড়ির সাথে পরামর্শ করে দিন তারিখ আপনাদের জানাবো। আপনারাও সুবিধা মতো দিন দেখুন। আমরা বেশি দেরি করতে চাই না।” আফরিনের দিকে এক পলক তাকালেন তিনি।
রাফির অসহ্য লাগছিল সবকিছু। তখন অনিক বলল, “তোমরা নাহয় একটু কথা বলে এসো।”
রাফি কটমট করে অনিকের দিকে তাকালেও অনিক গা করল না। দুজনকে পথ দেখিয়ে দিল।
কেবিনের বাইরে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেও আফরিন কিছু বলতে পারল না। আসলে কথাগুলো গুছিয়ে উঠতে পারছে না সে। ভেবেছিল রাফিকে নিজের পরিচয়ের সবটা বলবে।
রাফির তো কথা বলার ইচ্ছেই নেই। সে থেকে থেকে হাতঘড়ি আর রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। প্রথম দিন এই মেয়েটাকে দেখে যেই ভাল লাগাটা কাজ করেছিল আজ সেটা একদমই নেই। স্বাভাবিক। সেদিন রাফি কৃতজ্ঞ ছিল। আজ সে বিরক্ত।
আফরিন গলা খাঁকারিদিয়ে বলল, “আমার কিছু কথা বলার ছিল।”
তক্ষুণি ঘড়ি দেখে রাফি বলল, “বারোটায় আমার মিটিং আছে।” বলে আর থামল না সে। প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নিচে নেমে গেল। মিনিট না পেরোতেই তাকে রাস্তায় দেখল আফরিন। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে রাফি যে চলে গেছে এটা বুঝতেই আফরিনকে দুই মিনিট সময় ব্যয় করতে হলো।
নিজের উপর বিরক্ত হলো সে। লোকটা কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিল! এর মাঝে বলে দিলেই হতো। এখন আবার ফোন দিয়ে কথা বলার ঝামেলায় যেতে হবে। অথচ আফরিন ফোন বের করলে জানতে পারত ঘড়িতে তখন কেবল এগারোটা তেইশ।
ভেতরে গেলে অনিক চকচকে মুখে বলল, “কথা হয়েছে?”
“উনি তো চলে গেলেন। মিটিং আছে নাকি।”
অনিক মনে মনে রাফিকে কঠিন একটা ধমক দিল। শালা চোরের মতো পালিয়ে গেছে।
আফরিনের পরিবারের কেউ অবশ্য জিনিসটাকে সন্দেহের চোখে দেখল না। গল্পের আড়ালের গল্প জানল কেবল রাফির বাবা মা আর অনিক।

যাওয়ার পথে আফরিন সাদমানকে বলল, “চৌমোহনীতে যাব একটু।”
হঠাৎ করেই মোশাররফ হোসেন, আফসানা চুপ করে গেলেন। সাদমান এক পলক আফরিনের দিকে তাকালেও কিছু বলল না। বাবা মাকে পাঠিয়ে দিয়ে তারা দুজন গেল আরেক দিকে।

চৌমোহনী থেকে একটু পশ্চিমে এগিয়েই কেন্দ্রীয় কবরস্থান। ঠিক মাঝের দিকের দুটো কবরকে বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যায় এমন জায়গায় দাঁড়াল আফরিন।
পাশাপশি দুটো কবরে দুজন নর নারী শুয়ে আছে। সম্পর্কে আফরিনের খুব কাছের। অথচ আফরিন তাদের চেনে না। মুখছবিটুকুও জানে না। কেবল জানে দুজন। শুধু দুজন। ঐ যে শুয়ে আছে। বহু দূরে!

~চলমান~