#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
১৭.
হাসিকুঞ্জে মানুষ গিজগিজ করছে। সবাই ছুটছে বটে কিন্তু কাজ করছে ডেকোরেটরের লোকজন। রাফির দাদার দিকের আত্মীয়স্বজন কম। চাচা, ফুপু নেই। মাহমুদের চাচাত ভাইবোনেরা এসেছেন। আসিফার বাপের বাড়ির আত্মীয়ই বেশি। ডুপ্লেক্স বাড়ির পুরোটাই কানায় কানায় পূর্ণ।
বাঁধা বুয়ার সাথে ছুটোছুটি করছে তিতলি। মনে মনে মুখ বাঁকায় সে। বড়লোক মানুষের একগাদা আত্মীয়স্বজন থাকলে কি হবে? কাজের মানুষ একটাও নেই। মেয়েগুলো সব সাজগোজে ব্যস্ত। আর ছেলেরা ছুটছে বিনা কারণে। দেখলে মনে হবে আহা! কত কাজই না জানি করছে। বারবার উপরে যাচ্ছে, নিচে নামছে। বাইরে বাগানে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু গুণের গাছ গেন্ডুরি। ফিক করে হেসে ফেলল তিতলি। দাদীর কাছে এই কথা শিখেছে। গেন্ডুরি মানে কি এটুকু উদ্ধার না করতে পারলেও সে সারমর্ম বুঝে নিয়েছে। রাফি ভাইয়ের বউটাকে কিন্তু তার খুব পছন্দ হয়েছে। নরম সরম মানুষ বলেই মনে হল। মনে হয় না তার সাথে চোটপাট করবে বলে। এই বাড়ির মানুষজন কেউই তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। বাড়ির নতুন কর্ত্রী যদি করে তাহলে তিতলির খুব খারাপ লাগবে। আদর পেয়ে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
“এই তিতলি!”
রাফি ভাই ডাকছে। তিতলি ছুটে গেল। রাফি ভাইকে দেখে মনে হল সারারাত ধরে ঘুমায়নি। এই মানুষটা গতকালও অফিস করেছে। সেই রাত করেই ফিরেছে। নিশ্চয়ই ঘুমায়নি নাহলে চোখের নিচে কালি পড়বে কেন আর চোখই বা লাল হয়ে থাকবে কেন?
“গুছিয়েছিস?” নরম কণ্ঠ বলল রাফি।
“না ভাই।” তিতলি মাথা নাড়ল।
“কখন যেতে হবে?” কেমন নেশাগ্রস্থের মতো করে বলল রাফি।
তিতলি অবাক হল। এসব বলবে খালু। আর তিনি পালন করছে দুর সম্পর্কের আত্মীয়ের ভূমিকা। খাচ্ছে দাচ্ছে আর নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তিতলিরই অসহ্য লাগে। তাহলে আসিফার মেজাজ গরম হবে না তো কার মেজাজ গরম হবে?
“জানি না তো। আপনি যখন বিয়ে করবেন তখনই যেতে হবে।”
“বিয়ে!” নিজের মতো করেই বলল রাফি। “অনিকের কাছে শুনি।”
বলতে বলতেই অনিক হাজির হল। কাউকেই না গোছাতে দেখে এক দফা চিৎকার চেঁচামেচি সেরে নিল।
“কি আশ্চর্য! বাদ জোহর বিয়ে। এখন বাজে বেলা এগারোটা। একটা মানুষ এখনো গোছায়নি! কি আশ্চর্য!”
অনিকের কথায় আত্মীয়দের মাঝে এবার একটা ঢেউ খেলে গেল। সবাই মুহূর্তের মাঝে নিজেদের জামায় হাত দিয়ে বাথরুমের দিকে ছুটল। একদল বিজয়ী হল আরেকদল অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আরেকটু জোরে দৌড় দিলেই হত। ইশ!
তিতলি মনে মনে একটু দ্বিধায় ছিল। তাকে কি নিয়ে যাবে? কেউ তো একবারও বলেনি। রাফি ভাইয়ের কথা সে ধরতে পারছে না। তাকে অপ্রকৃতস্থের মতো লাগছে।
“অ্যাই তিতলি!” অনিক ধমকে উঠল।
তিতলি খানিকটা কাঁপল বৈ কি। “জি ভাই?”
“ভাই ভাই না করে গোছা তাড়াতাড়ি। সাজতে যদি এক সেকেন্ড বেশি টাইম নিয়েছিস তাহলে রেখেই চলে যাব বলে দিলাম।”
তিতলির চোখে পানি চলে এল। কে কবে শুনেছে কাজের মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এভাবে মানুষ হু-ম-কি দেয়? দ্রুত মাথা নাড়ল সে। অত সেজে তার কাজ কি? তার বিয়ের দিন সে সাজবে। আজকে রাফি ভাইয়ের বউয়ের সাজার দিন।
“তোর সমস্যা কি? খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
রাফি অনিকের চোটপাট খেয়াল করল না। সে তাকিয়ে আছে সদর দরজার সোজা বাগানের দিকে। একটা ফুলগাছ ম-রে যাচ্ছে। আশপাশের ফুলের জৌলুশে ওটাকে কারোর চোখে পড়ছে না। গাছ তো একদিনে ম-রে না। ঠিক মানুষের মনের মতো। আড়ালে ক্ষয়ে যায়। চুপচাপ চলে যায়।
“রাফি?” নরম কণ্ঠে ডাকল অনিক। বন্ধুর চেহারাটা দেখে তার কষ্ট হচ্ছে। মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে।
“হু?”
“গুছিয়ে নে। বের হব।”
রাফি মাথা নেড়ে চলে গেল। মামাতো, খালাতো ভাইবোনদের সাথে তার সখ্যতা কম। তরুণ বয়সে যখনই তাদের সাথে আড্ডায় বসত সবার আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়ে যেত সে। “আহা! বাপ মায়ের ভালবাসা পায় না। কি কপাল! সংসার না তো যুদ্ধ! ওখানে মানুষ বাঁচে?” এমন ধরনের বাক্যে রাফির নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। মানুষের দয়া সে কোনোদিনই চায়নি। অথচ ওটাই পাচ্ছে। তার বাবা তাকে ভালবাসে বলে মনে হয় না। দয়া করে বিয়েতে যাচ্ছে। এই যে আত্মীয় স্বজন এসেছে, হল্লা করছে তাকে ভালবেসে না। রাফি নিশ্বাস ছাড়ল। মাথাটা ব্যাথা করছে। রাতে একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে হলেও ঘুমানোর দরকার ছিল।
নিজের ঘরে ঢোকার আগে নাবিলার দরজায় টোকা দিল রাফি। ভেতর থেকে শব্দ এল, “খোলা।”
নাবিলা জানে তার ভাই এসেছে। টোকা দেয়ার ধরন সেটাই বলে দেয়।
“তুই যাবি না?” রাফি দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে। নাবিলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। একগাদা মানুষ তাদের বাগানে। হৈ চৈ করছে। আনন্দের আতিশয্যে ছোট ছোট গাছগুলো যে দলিত মথিত করে ফেলছে সেদিকে কারো নজর নেই।
নাবিলা হাসল, “আমার না যাওয়ায় কি ভাই? তুমি যাও। মেয়েটা ভাল।”
“তুই জানিস কে?”
“জানি। আফরিন। যেই মেয়েটা আমাকে মাসুদের গাড়িতে জড়িয়ে ধরে ছিল। চেহারাটা অবশ্য মনে নেই।”
রাফি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, “তোর সাথে আলোচনা করা হয়নি।”
নাবিলা শব্দ করে হেসে ফেলল। এতে রাফির অপরাধবোধ খানিকটা বাড়ল, “আমি জানি দাদীমা আর অনিক ভাই মিলে তোমার বিয়ে দিচ্ছে। তোমার নিজের কোন ইচ্ছে নেই।”
“তুই আমাকে কি করতে বলিস?” মাথা তুলে তাকাল রাফি।
“বিয়েটা করে নাও।”
“তাহলে তুই ঘর থেকে বের হচ্ছিস না কেন?”
“ভাল লাগছে না ভাই। সবাই শুধু শুনতে চাচ্ছে সেদিন আমার সাথে ঠিক কি কি হয়েছিল। আমার ভাল লাগছে না।” ফিসফিস করে বলল নাবিলা।
রাফি আরো খানিকটা ভেঙে গেল। দুদিন আগের রাফি হলেও বোধহয় একটা হুংকার ছেড়ে সবাইকে সাবধান করে দিত নাবিলাকে এই বিষয়ে কিছু না বলার জন্য। কিন্তু এখন সে নিজেই ভঙ্গুর অবস্থায় আছে।
কারুকার্যময় সাদা পাঞ্জাবিটা পরেও রাফি নিজের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন ঘটাতে পারল না। দম আটকে বিছানায় বসে রইল। অনিক কতক্ষণ দরজা ঝাকাঝাকি করে না পেয়ে চলে যাচ্ছিল। রাফি দরোজায় খুলে দিকে আরেক চোট ধমক দিল অনিক।
“আক্কেল জ্ঞান কোথায় রেখে এসেছিস? তুই কি শ্বশুরবাড়ি পার্মানেন্ট হচ্ছিস? তোর এত দুঃখ কীসের?”
বকতে বকতেই অনিক রাফির চুল আঁচড়ে দিল। পারফিউম দিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, “এখনও টেনশন করছিস?”
রাফি যেন হুশে এল, “নাহ।” বারবার সে চিন্তাগুলো সরিয়ে দিতে চাচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছে কই? কেবল মাথার এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে।
অনিক রাফির কাঁধে হাত রেখে বলল, “আল্লাহ ভরসা। চল।”
ড্রয়িংরুমে আসতেই রাফির কপাল কুচকে গেল। মিহাদ কই? একটা মানুষ কি ওকে মনে করেনি? চোয়াল শক্ত করে সে তৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে বের হল। গাড়ি নিয়ে ছুটল মিহাদের কাছে।
অনিকের মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। এই ছেলে কোথায় চলে গেল? যদি না আসে তাহলে তো তার নাক কাটা যাবে। রুমিলা পর্যন্ত এই খবর পৌঁছাতেই তিনি দোয়া দুরুদ পড়তে শুরু করলেন। আল্লাহ তুমি মান সম্মান রক্ষা কর। ঐ ছেলের মতিগতি ঠিক না।
রাফি সময় নিল না। আধা ঘন্টা পার হওয়ার আগেই মিহাদকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। ঢুকতেই লক্ষ্য করল সকলের চোখে একটা চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। মাহমুদ সোফায় বসে ছিলেন। চেকে ঢুকতে দেখে বললেন, “বিয়ে না করলে আগে থেকে বলে দাও। ওখানে যেয়ে তামাশা করার ইচ্ছে নেই।”
রাফির মুখে কঠিন একটা জবাব চলেই এসেছিল। শুধুমাত্র বাবা বলে সেটা গিলে ফেলল।
“ও তো তোমার ছেলে। তুমিও ওকে ভুলে যাও কীভাবে?”
মাহমুদ একবার রাফির পাশে দাঁড়ানো মিহাদকে দেখলেন। তার ডান হাত রাফি ধরে রেখেছে। বাম হাত দিয়েই টু বাই টু কিউব মিলিয়ে যাচ্ছে। মাহমুদের চোখের ভাষা রাফি বুঝল না। অপরাধবোধ এর একটু স্নেহ, এটুকুই খুঁজছিল রাফি। আর খুঁজল না। সব পরিত্যক্ত স্থানেই কি আর গুপ্তধনের দেখা মেলে?
মিহাদকে নিজেই গুছিয়ে দিল সে। মিহাদ কেবল একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “কোথায় যাব?”
রাফি উত্তর দেয়নি। সেও আর শোনেনি। বাড়িতে এসে তার খুব বেশি ভাল লাগছে না। একগাদা মানুষ তার দিকে বারবার তাকাচ্ছে।
বের হওয়ার আগে কি মনে করে রাফি মায়ের কাছে গেল। আসিফা সম্ভবত আশা করেননি রাফি তার কাছে বিদায় নিতে আসবে। ছেলেকে দেখে যারপরনাই খুশি হলেন তিনি। সেটা পাল্টে আতঙ্কে রূপ নীল মিহাদকে দেখে। মনে পড়ে গেল তার ফুলদানি ছুঁড়ে মারার ঘটনাটা। আসিফার হাতে চারটা সেলাই লেগেছিল। এখনও দাগ আছে।
রাফি তাচ্ছিল্য ভরে হাসল। মা সন্তানকে দেখে ভয় পায় সেখানে আর দুনিয়ার মানুষ কি করবে?
রাফি বেশি কিছু বলল না। কেবল বলল, “যাচ্ছি।” মিহাদের হাত ধরে বেরিয়ে গেল সে। আসিফা আবার চুপচাপ বারান্দায় যেয়ে বসলেন। সব গাছেই যেন আজকে ফুল ফুটেছে। এর মাঝে নয়নতারা গাছটার মৃ-ত্যু দৃশ্য তার চোখ এড়াল না। খুব সাধারণ গাছ। ম-রে গেলেই কি?
___________________
বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে তবে আফরিন ধন্দে পড়ে যাচ্ছে। সে ভেবেছিল আত্মীয় স্বজন তেমন কেউই আসবে না। তাকে তো বিশেষ কেউ পছন্দ করে না। তবে মোটামুটি সবাইকেই আসতে দেখে সে অবাক হয়েছে। আসেনি কেবল মাত্র ফুপু। তার শক্ত ধারণা তার মেজ ভাই তাকে ঠকিয়েছে। যদি ভালইবাসত তাহলে এই প্রস্তাবটা ঐ পরের মেয়ের জন্য না নিয়ে তার মেয়ের জন্য বলত। তার নিজের যে বিবাহযোগ্য একটা মেয়ে আছে সেটা কেউই মনে রাখেনি। মোশাররফের কাছে এই বোনের মেয়ের গুরুত্ব।
কারণটা শুনে আফরিন কতক্ষন তব্দা খেয়ে বসেছিল। ফুপুর মেয়ে এবার ক্লাস টেনের ছাত্রী। আগামীবার এসএসসি দেবে। ফুপুর অতি আহ্লাদে নিজের চুলটা অবধি বাঁধতে পারে না। আবার ফুপুও প্রতি লাইনের শেষে দুইবার করে বলেন তার ছোট্ট মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবেন না। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেলে তারপর ভেবে দেখবেন। সেই ছোট্ট মেয়েটা এক নিমেষে কীভাবে বিবাহযোগ্য হয়ে গেল আফরিন বুঝে উঠতে পারে না। সাদমান অবশ্য বলেছে, “বাদ দে, ভাল হয়েছে। ঝামেলাপূর্ণ মানুষ যত কম থাকবে তত ভাল।”
“কিন্তু বাবা তো কষ্ট পাবে।”
“আরে বাবা তার বোনের কর্মকান্ডে এতই হতবাক যে কষ্ট পাওয়ার সময় পাচ্ছে না। তোর কাজ না থাকলে ঘুমা। ফাউল চিন্তা করিস না।”
আফরিন ঘুমাতে পারেনি। চেপে রাখা ভয়টা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে আজই এই বাড়িতে তার শেষদিন। আর কক্ষনো বোধহয় আসতে পারবে না।
আত্মীয়দের সাথে তার একটু দুরত্ব আছে। বাবা মায়ের সামনে কেউ খারাপ ব্যবহার না করলেও আড়ালে কটু কথা বলতে দ্বিধা করে না। আজ অবশ্য তেমন কিছু কেউ বলল না। স্থায়ী নিবাস অস্থায়ী হতে চলেছে এজন্যই বোধহয়।
সময়টা খুব তাড়াতাড়ি গড়িয়ে গেল। কীভাবে যে সতেরোটা দিন পার হয়ে গেল আফরিন বলতে পারবে না। হাস্য লহরী ক্রমেই কান্নার বর্ষা বয়ে নিয়ে এল। আফসানা প্রতিবারই হাসি মুখে মেয়ের সাথে দেখা করেন। বুকের ভেতর জমে যাওয়া কষ্টটা মেয়েকে বুঝতে দেন না। মোশাররফ অত শক্ত হতে পারেন না। মেয়ের মুখটা দেখলেই তার দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সাদমান আদতে নির্বিকার। তার যেন কিছুতেই কিছু যায় আসে না।
সাজ সাজ রব নিয়ে বরযাত্রী এল। দুই গাড়ি ভরতি মানুষ। আফরিনের বুকের ভেতরের বাতাসটা কেমন থমকে রইল। যেন উল্টগুণতি শুরু হয়ে গেছে। পরণের শাড়ি খামচে বসে রইল সে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পাশে বসেই চিৎকার চেঁচামেচি করছে সেসব কিছুই তার কানে গেল না।
আফরিনের মনে হল ঘণ্টার কাটাও সেকেন্ডের গতিতে দৌড়াচ্ছে। তার সম্মতি নিতে এসেছেন মোশাররফ হোসেন। আফরিন চুপ করেই বসে রইল। দৃশ্যপটে দেখা গেল আফসানাকে, সাদমান নিজেও পিছু রইল না।
“রিনি?” সাদের এমন নরম কণ্ঠে ডাক শেষ করে শুনেছিল আফরিন বলতে পারবে না। ছোড়াটা সবসময় তার সাথে হম্বিতম্বি করে। আফরিন কিন্তু চোখ ওঠাল না।
আফসানা নিজেই এগিয়ে এলেন। বউ সাজে বসে থাকা আফরিনের কাঁধে হাত রাখলেন। আফরিন অনুভব করতে পারল মাতৃস্নেহের ওম।
আফসানা মেয়ের দিকে তৃষিত নজরে তাকালেন। ঢোক গিললেন খুব কষ্টে। কান্নারা উপচে পড়তে চাইছে। ফিসফিস করে বললেন, “আমাদের ভুলে যাবে না তো রিনি?”
সতের দিনের চেপে রাখা কান্নাটা ঝরঝরিয়ে পড়ে গেল। আফরিন মুখে হাত চাপল। খুব একটা লাভ হল না। তার কান্নারা স্বাধীনতা পেয়েছে। এটুকুতেই কি তা খর্ব করা যাবে?
মোশাররফ হোসেন কিছুই বলতে পারলেন না। শুধু মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন।
সাদমান বিরক্ত হল, “চ্! মঞ্জুলিকা সাজিস না।”
আফরিনের হেঁচকি উঠে গেল। এক হাতে বাবার হাত আরেক হাতে মায়ের হাত শক্ত করে ধরল সে। তার শীতল হাতের ভয় বুঝতে কারোরই কষ্ট হল না। সাদমান তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল, “অ্যাই তোর আরেকটা হাত কই?”
আফরিন ভেজা চোখে তাকাল। কী বলতে চাইছে সাদমান?
“আমার হাত ধরবি কীভাবে?”
আফরিন হেসে ফেলল। তার দুদিনের বড় ভাই ভালবাসার ভাগ দাবি করছে। অথচ সে জানেই না আফরিন বুকের গহীনে তাদের যত্ন করে রেখেছে। আসলেই জানে না?
কান্নাকাটি করে হালকা হল আফরিন। সম্মতি জানাতে দেরি করল না। সময় নিল রাফি। তার ঘুমহীন ক্লান্ত চোখজোড়ায় ভাসছে ছোট্ট নাবিলা আর মিহাদের কান্নারত কণ্ঠ। কানে বাজছে তীক্ষ্ম কণ্ঠের ঝগড়া। ঘোরের মাঝে থেকেই রাফি সম্মতি জানাল। সে বুঝতে পারল না শক্ত করে ধরে রাখা মিহাদের হাতটা কখন ছুটে গেছে।
আধা ঘন্টার মাঝে সারা বাড়িতে খবর ছড়িয়ে পড়ল। আফরিনের ছোট দেবরটা পাগল। আফরিন অবশ্য তাকে দেখতে পেল না। যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসায় আফরিনের বাবা মাও সেদিকে খেয়াল করতে পারলেন না। ছেলেটার মুখোমুখি হল আফরিন গাড়ি উঠে।
যাওয়ার আগে সাদমান ডাক দিল। আফরিন নিজেকে শাসন করলেও চোখ সেসব মানছে না। আষাঢ়ের বর্ষা নামিয়েছে। সাদমানের কাছে যেতেই ছোট্ট দলটার দেখা মিলল। আফরিন অবাক হয়ে সাদমানের দিকে তাকাল। সাদ ওদের মনে রেখেছে?
নুরি ছুটে এসে আফরিনকে জড়িয়ে ধরল, “আপনাকে কি সুন্দর লাগছে আপা!”
আফরিন কেঁদে ফেলল। নুরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল কয়েকবার।
সাঈদ আমতা আমতা করে বলল, “আপা এটা নিবেন?”
আফরিন ঝাপসা চোখে কেবল একটা সাদা প্যাকেট দেখতে পেল। সাদমান ওটা হাতে নিয়ে বলল, “নিবে না মানে! বিয়ে তো করেছেই মানুষের উপহার পাওয়ার জন্য।” অন্যান্য উপহারের সাথে রেখে দিল সাদমান।
“খেয়েছো?” আফরিন জিজ্ঞেস করল।
নুরি বলল, “হ্যাঁ আপা। দুইটা রোস্ট খেয়েছি।” শেষটুকু ফিসফিস করে বলল নুরি। আফরিন হেসে ফেলল।
ভেজা চোখে বাড়ির আঙিনা দেখে গাড়িতে উঠল আফরিন। ড্রাইভারের পাশে বসেছে অনিক। পেছনের সিটে রাফি মাঝে বসেছে। ডান হাতে শক্ত করে মিহাদের হাত ধরে রেখেছে। আফরিন বসেছে তার বামে। আফরিনের মনে বল লোকটা মাঝখানে অনেক বেশি ফাঁকা রেখে বসেছে। সে বেশিকিছু মনে করল না। তার নিজেরও অস্বস্তি লাগছে। মিহাদকেও খুব বেশি অস্বাভাবিক মনে হল না। জানালা দিয়ে এক মনে বাইরে তাকিয়ে আছে। ছেলেটাকে জানার জন্য আফরিন নিজের ভেতরেই এক ধরনের তাড়না অনুভব করল। গুমোট ভাবটা কাটল গাড়ি থেকে নেমে। বিশাল বাড়িটা দেখে আফরিনের প্রথমেই মনে হল সাদমানের কথা। ও ঠিকই বলেছিল। “হাসি কুঞ্জ”। নামটা আফরিনের চোখে লাগল।
আফরিন অবাক হয়ে দেখল ড্রয়িং রুমের সোফায় তাকে বসিয়ে দিয়েই সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তার খোঁজ কেউ নিতে এল না।
“ভাবি ভাবি! আপনার কিছু লাগবে?” একটা মেয়ে ছুটে এল। মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগলেও ঠিক চিনতে পারল না আফরিন। কোথায় যেন দেখেছে?
“কিছু লাগবে ভাবি?”
“না।” আফরিন মাথা নাড়ল। তার একটু শুতে ইচ্ছে করছে। এখানে ভাল লাগছে না। এটা কি এই মেয়েটাকে বলা যাবে? ও কে তাও তো আফরিন জানে না।
“আচ্ছা তাহলে আমি যাই। খালাম্মার খুব জ্বর। বমি টমি করে অবস্থা খারাপ।” বলেই তিতলি ছুটে চলে গেল।
আফরিন ওখানেই বসে রইল। একদম একা।
পরের দু ঘণ্টার মাঝে দফায় দফায় কয়েকজন এলেন। আফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। দুই একজন মিষ্টি করেও কথা বলেন। নিজেদের পরিচয় দিলেও আফরিন মনে রাখতে পারল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছিল হাসি কুঞ্জে পৌঁছাতে। আফরিন দেখল সাড়ে দশটা বাজে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল আফরিনের। ক্ষুধাও লেগেছে। মা কি রান্না করেছে? তখনই আফরিনের মনে হল মায়ের রান্নার সাথে তার ক্ষুধার আর কোনো সম্পর্ক নেই।
বর্ণনায় দাড়ি পড়ল রাফি আসার পর। লোকটা কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছিল। ফিরে এল এগারোটা নাগাদ। ড্রয়িং রুমে আফরিন যে বসে আছে সেদিকে একবার চেয়েও দেখল না সে। সিঁড়ি দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেল। আফরিনের পলক পড়ল দুম করে দরজা লাগানোর শব্দে। কাঠ হয়ে বসে রইল আফরিন।
“আমার সাথে আসো বউ।” একটা বয়স্ক কণ্ঠ ভারী মমতা নিয়ে বলল। আফরিনের হাত ধরল। মহিলাকে চিনতে পারল আফরিন। তার দাদী শাশুড়ি। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে আর এ তো জ্বলজ্যান্ত মানুষ। আফরিন নির্ভাবনায় তার হাত ধরল। রুমিলা আফরিনকে নিয়ে গেলেন রাফির একদম বিপরীতে গলির মাঝের ছোট্ট ঘরটায়। আফরিনের ভ্রম হল। তার ঘর কোনটা?
~চলমান~