অন্তঃপুর পর্ব-২০

0
9

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
২০.

সবাই খাওয়ার পরও একটা রুটি বেঁচে গিয়েছিল। নাবিলা একেবারে এইটুকুনি খায়। একটা রুটি শেষ করতেই তার কি কসরত! সেই বেঁচে যাওয়া রুটি নিয়ে টেবিলে বসল আফরিন। রাফি এক একসাথে খাবে।
তিতলি এসে বলল, “ভাই কখন আসবে তার তো ঠিক নাই ভাবি। আপনি খান। ভাই আসলে আবার ভাইয়ের সাথে আবার খেয়েন।”
“ধুর! এক রাতেই দুবার খাবো কিভাবে? একটু বসি।” কিন্তু তার পেটে যেভাবে মেঘ ডাকছে তারা এই বুঝ কতক্ষন মানবে সেটা নিয়ে আফরিন নিজেই দ্বিধায় আছে।
“ভাইয়ের উল্টাপাল্টা নিয়মে কানুন। একদিন আসে দশটায়, একদিন বারোটায়, একদিন একটায়। পারে না অফিসেই সারাদিন থাকে।” নিজের মনেই গজগজ করতে করতে বলল তিতলি। আফরিন হাসি হাসি মুখ করে শুনল। স্নেহের শাসন শুনতেও ভাল লাগে।
“তিতলি তোমার সাথে একটু গল্প করি।” আফরিন বলল।
“আমার কোনো গল্প নাই।”
“পৃথিবীর সব মানুষই গল্প। কেউ বোঝে কেউ বোঝে না।”
“শিক্ষিত মানুষের শিক্ষিত কথাবার্তা।”
আফরিন হেসে ফেলল, “কেন তুমি পড়াশোনা কর না?”
“অনেক কষ্টের কাজ। ভাল্লাগে না।”
“কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছ?”
“কোনোদিন স্কুলে যাইই নাই।”
“তোমার কথা শুনলে তো বোঝা যায় না!”
“এসব আপনার মহান স্বামীর কীর্তি। তিনি জোর জুলুম করে আমাকে পড়িয়েছেন। শুদ্ধ ভাষায় যেন কথা বলি সেই ট্রেনিং দিয়েছেন। তাই বলে আমি কিন্তু আঞ্চলিক ভাষা ভুলি নি। আপনার দাদী শাশুড়ির ভাষা শুনবেন?” তিতলি গলা খাঁকারি দিল। কপালে দুটো ভাঁজ ফেলে গম্ভীর কন্ঠে বলল, “শোনো নাতবউ! বেশি কাজকাম করতে যাবা না। এই বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নাই। তোমার শাশুড়ি কাজ করে না আজকে কত বছর যাবত। তুমি দুই দিনের মানুষ কি করবা? তোমার একমাত্র কাজ হইলো আমার নাতির দিকে খেয়াল রাখা।”
আফরিন হেসে ফেলল। দাদীমাকে রুটি দিতে গেলে তিনি এই কথাগুলোই বলেছেন। একদম এভাবেই।
তিতলি মুখ বাঁকালো, “নিজেরা নিজেদের ছেলের যত্ন নিতে পারে নাই আরেক বাড়ি থেকে মেয়ে ধরে আনছে যত্ন করার জন্য। বলে কী না আমার নাতির মনের বাগানে ফুল ফোঁটাও। ক্যান আপনি কি মালি নাকি?”
আফরিন টেবিলে মাথা রেখে হাসছে। হাসির দমকে তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠছে। এই বাড়ির সবগুলো মানুষ নিষ্প্রাণ। সবার প্রাণ আল্লাহ এই মেয়েটার মাঝে সঞ্চার করে দিয়েছেন। নাহলে কবেই এই বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে যেত!
“হাসবেন না ভাবি। এসব আমার একদম দেখতে ইচ্ছা করে না। স্টার জলসার কাহিনী। নেহাত রাফি ভাই ভালো মানুষ দেখে আমিও তাল মিলিয়েছি। ভাবি আমার ভাইয়ের উপরে বেশি রাগ করেন না হ্যাঁ? সারাদিন এই ঝগড়াঝাঁটি দেখে ভাইয়ের মন একদম তিতা হয়ে গেছে।”
বলতে বলতেই তিতা ভাই হাজির হয়ে গেল। প্যারেডের মতো কোনো দিকে না তাকিয়ে লেফট রাইট করতে করতে একদম উপরে উঠে যাচ্ছিলেন উনি। আফরিন তাকে থামাল, “দাঁড়ান।”
তিতলি দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তার ঘুম আসছে। এদের বর বউয়ের কাহিনী দেখার ধৈর্য নেই।

বৌভাতের ঝামেলাটা ঝামেলা মনে হতো না যদি না রাফি সেসব মন থেকে মেনে নিত। অনাগ্রহের কারণে এসব তার কাছে স্রেফ সময় নষ্ট বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু লোকসম্মুখে একটা ফর্মালিটি দরকার বলে ঠোঁট দুদিকে প্রসারিত করে সারাটাদিন ম্যানিকুইনের মতো কাটিয়েছে সে। ডেকোরেটরের লোকজনদের টাকা পয়সাসহ জিনিসপত্র সব বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিল একবার অফিসে ঢু মারতে। অফিস ছুটি ছিল না। কর্মচারীরা যে মনে মনে তাকে গালি দিয়ে আধমরা বানিয়ে ফেলছে সেটাও বুঝতে রাফির অসুবিধা হয়নি কারণ অনিক সারাদিনই তাকে ধমকের উপর রেখেছে। বেচারা গালি টালি দেয় না বলে গলার জোরে স্বাদ মিটিয়েছে।
অফিসে ঢুকে মনে হলো এসেই যখন পড়েছে প্রজেক্টের কাজ কিছু এগিয়ে রাখে। এক ঘন্টা কাজ করবে ভাবলেও সেই সময় গড়িয়ে তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে। দারোয়ানের কাশিতে তার ধ্যান ভেঙেছে। বাড়িতে নববধূ ফেলে যেই লোক ফাইলের দিকে তৃষ্ণার্থ চোখে তাকিয়ে থাকে তাকে দেখে দারোয়ানের হুপিং কাশি হয়ে যাওয়ার কথা। ভদ্রলোক যে সাধারণ কাশিতেই কাজ সেরেছে তাতে তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে রাফি।
তিতলির সাথে আফরিনের হাসি চোখ না এড়ালেও রাফি এমন ভান করল যেন এই দুনিয়ার সাথে তার কোনো লেনাদেনা নেই। সে ঊর্ধজগতের বাসিন্দা। সেখান থেকে তাকে খপ করে ধরে আনল মেয়েটা। কাজেই তার দিকে ভুরু কুচকে থাকা জায়েজই বটে।

কীভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখ! মনে হচ্ছে আফরিন যেন চুরি করতে যেয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছে। আফরিন গুনল। একটা, দুটা, তিনটা ভাঁজ। এমন করে থাকলে দুদিনেই সাইয়েদ রাফি থেকে যে লোকটা ভাঁজ রাফি হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
“খেয়ে যান।” নম্র কণ্ঠে বলল আফরিন। বিবাহিত রাফির সাথে এই প্রথম আলাপ।
রাফি নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ পারদ দেখিয়ে কঠোর স্বরে বলল, “না।”
মুহূর্তেই আফরিনের মনের নববধূর লাজ পলকা কাঁচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
“খাবেন না মানে! দুই ঘণ্টা ধরে আপনার জন্য বসে আছি। আমার পেটে যেভাবে ঝড় শুরু হয়েছে তাতে আর কিছুক্ষণের মাঝেই এই বাড়িঘর উড়ে যাবে। শিগগিরই খেতে আসুন বলে দিলাম!”
ক্ষিধের চোটে মানুষের মাথায় যে আগুন ধরে যায় এতদিন বইয়ে পড়লেও এবার বাস্তবে দেখল রাফি। আফরিন তার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েকে কালকে বিয়ে করেছে রাফি। কোথায় তার লাজ?
আগুনকে ঘাটানো বুদ্ধিমানের কাজ না। নিজেকে বোকা প্রমাণ না করার জন্যই রাফি চুপচাপ টেবিলের কাছে চলে এল। জেদের জন্য ক্ষুধাটা মাটি চাপা থাকলেও টেবিলের সাথে দূরত্ব যতো কমছে তার পেটের ভেতরের গুরুম গুরুম তত বাড়ছে। আফরিনের কাছাকাছি আসতেই এমন জোরে শব্দ হলো যে সেই শব্দ আফরিন পর্যন্ত শুনে ফেলল। রাফির কান দুটো লজ্জায় লাল হয়ে এল। সাথে সাথেই খুক খুক করে কাশল সে। তাতে সেই শব্দ কতটা ধামাচাপা দেয়া গেল রাফি বুঝল না।
ফট করে এতগুলো কথা বলে ফেলে আফরিন নিজেই বোকা হয়ে গিয়েছিল। কোথায় একটু নরম করে কথা বলবে। ক্ষুধায় গেছে সব তালগোল পাকিয়ে। অবশ্য এই লোক প্রথম কথায় চলে এলে তো আর এতো কথা খরচ করতে হয় না।
রাফি কাছে এসে দাঁড়াতেই তার পেটের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল আফরিন। ফিক করে হেসে ফেলল সে। রাফি তাড়াতাড়ি চেয়ার টেনে বসে পড়ল। তার বিব্রত মুখটা দেখে আফরিনের হা হা করে হাসতে ইচ্ছে করল।

বৌভাতের ভারী ভারী খাবারের অনেক কিছু বেঁচে ছিল। আফরিন বলল, “পোলাও খাবেন নাকি সাদা ভাত?”
রাফি না ভেবেই বলল, “সাদা ভাত।” পেটের উপর দিয়ে ব্যাপক চাপ গেছে। আজ আর পোলাও খাওয়া যাবে না।
আফরিন আলু ভাজি, ডাল আর একটা ডিম ভেজে নিয়ে এলো। রাফি নিজের হাতেই সব নিয়ে নিল। একা খেয়ে তার অভ্যেস আছে।
সেই অভ্যেস এতটাই প্রখর যে সামনে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ যে দাঁড়িয়ে আছে সেটা ভুলেই গেল রাফি। আফরিন মনে মনে একটু আহত হলো। লোকটা তাকে একবার বসতে বলতে পারত না?
সেই মন খারাপকে পাত্তা না দিয়ে খেতে বসে পড়ল আফরিন। আগে পেটে পানি ক্ষুধার মিছিল থামাতে হবে।
আড়চোখে রাফির খাওয়া খেয়াল করল আফরিন। গরুর মাংস গরম করে একপাশে রেখেছিল। সেটা ওভাবেই পড়ে আছে। রাফি সাদামাটা খাবার দিয়ে খেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বুঝল আফরিন।
আফরিনের খাওয়া শেষ হলেও রাফির হয়নি। সে তুলনামূলক ধীর গতিতে খাচ্ছিল। আফরিন তার থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়াল। রাফিকে দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে খেয়াল করল তার ডান পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। কাছে যেতেই পরিষ্কার হল। আঙ্গুলের কোনা থেকে অনেকটা মাংস উঠে গেছে।
“এখানে কি হয়েছে?” নিঃসঙ্কোচে প্রশ্ন করল আফরিন। তার চোখে মুখে চিন্তা।
রাফি একবার আফরিনের দিকে তাকিয়ে পায়ের দিকে তাকাল। কাল রাতের কথাটা মনে পড়লেও বলার প্রয়োজন মনে করল না। মুখের খাবার গিলে বলল, “কিছু না।”
আফরিন আরেকবার পায়ের দিকে তাকাল। এভাবে থাকলে নখটা মরে যাবে নিশ্চিত। সে তিতলির কাছে গেল। রান্নাঘরের পাশেই ওর রুম।
মেয়েটাকে ঘুমন্ত দেখে জাগাতে ইচ্ছে করল না আফরিনের। কিন্তু এছাড়া আর উপায়ও নেই।
“তিতলি? তিতলি?” আস্তে করে ডাকল আফরিন।
“হুঁ?”
“ফার্স্ট এইড বক্স আছে বাসায়?”
“আছে।” ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল তিতলি।
“কোথায়?”
হাত দিয়ে নিজের টেবিলের দিকে ইশারা করল তিতলি। কসরত হলেও খুঁজে পেল আফরিন।
ডাইনিং রুমে সে যখন ফিরে গেল তখন রাফি হাত ধুয়ে যাওয়ার পায়তারা করছে। আফরিন বক্স খুলে মলম আর গজ খুঁজতে খুঁজতে বলল, “একটু দাঁড়ান।”
রাফি তাকাল না। না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছিল। আফরিনের মেজাজ খারাপ হলো। এই লোক সোজা কথার মানুষ না। সে এত আস্তেও বলে নি যে কাছে দাঁড়িয়ে থেকে রাফি শুনবে না। লোকটা মহা ত্যাদড়। আফরিন আবার আগের মতো করেই বলল, “দাঁড়াতে বলছি শুনতে পাচ্ছেন না!”
রাফি ভুরু কুচকে তাকাল, “কি সমস্যা?”
“দাঁড়ান।” থমথমে কণ্ঠে বলল আফরিন।
“আমার ঘুম আসছে।” রাফি ঘুরে দাঁড়াল।
আফরিন চটপট করে বলল, “না দাঁড়ালে দাদীমার কাছে যেয়ে বলব আপনি আমাকে খাটাচ্ছেন।”
“কিহ!” রাফি অবাক হয়ে আফরিনের দিকে তাকাল। কি ডাহা মিথ্যা কথা!
“মিথ্যা কেন বলবেন?”
“অবশ্যই মিথ্যা না। আমি আপনাকে দাঁড়াতে বলছি আপনি দাঁড়াচ্ছেন না। এতে আমাকে বারবার একটা কথা বলতে হচ্ছে। কায়িক শ্রম হচ্ছে না? এটা কি খাটনি না?”
রাফির মুখটা দেখে মনে হলো সে মাইনকার চিপায় পড়েছে। আফরিনের মনে পৈশাচিক আনন্দ হলো। কালকে দাদীমার বর্ণনা শুনে মনে হয়েছিল রাফি দাদীমার ন্যাওটা। জোর করে বিয়ে দেয়ার জন্য একটু অভিমান করলেও রুমিলা রাফির দুর্বলতম জায়গা। রাফির মুখ দেখে আন্দাজ সঠিক বলে মনে হচ্ছে। সাইয়েদ রাফি! এবার আপনি যাবেন কোথায়?
“কি দরকার?” রাফি এক পা এগিয়ে এল।
“বসুন।” চেয়ারের দিকে ইশারা করল আফরিন।
রাফি বিরক্ত হল, “বলবেন কি সমস্যা?”
“বলব বসুন।”
“বসব না।” শক্ত কণ্ঠে বলল রাফি।
“আমি তাহলে দাদীমার কাছে গেলাম।”
রাফি ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। আফরিন হাসল। সোজা কথায় কাজ করলে কি তাকে আর বাঁকা কথা বলতে হয়?
আফরিন রাফির পায়ের কাছে বসে পড়ল। এবার বাস্তবিকই অবাক হলো রাফি।
“কি করছেন আপনি!”
“চুপ করে বসুন।” রাফির চোখের দিকে তাকিয়ে কড়া কণ্ঠে বলল আফরিন।
কড়া কণ্ঠ শুনে রাফির রাগ হওয়ার কথা। তার বদলে সে অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে গেল। এমন শাসনের অভাবে সে কতকাল ভুগছে নিজেও তো জানে না। নিজের অজান্তেই আফরিনের বাধ্য হয়ে গেল রাফি।
আফরিন জায়গাটা পরিষ্কার করল। ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে দিল আঙুলটা। পায়ের দিকে তাকিয়েই বলল, “নিজের যত্ন নেন না কেন?”
রাফি সে কথার উত্তর দিল না। একবার আফরিনের দিকে তাকিয়ে উপরে চলে গেল। আফরিন নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল রাফির বন্ধ করে দরজার দিকে। যতবার রাফি তার সামনে দরজা বন্ধ করে ততবার অপমান যেন আফরিনের গালে অদৃশ্য চপেটাঘাত করে। যার সূত্রে এই বাড়ির সাথে বন্ধন তার সাথে আফরিনের কোনো বন্ধন নেই। তার ঘরেই আফরিনের ঠাই হয় না।

~চলমান~